এক তরুণীর সংগ্রাম ও আমাদের ৫৭ (১) ধারা

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 29 March 2015, 09:57 AM
Updated : 29 March 2015, 09:57 AM

ইন্টারনেটে জনগণের মতপ্রকাশে বাধাদান 'অসাংবিধানিক' বলে রায় দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। তারা দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (এ) ধারা বাতিল করে দিয়েছে। ওই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য, ছবি বা ভিডিও পোস্ট করলে তাকে গ্রেফতার করা হত। শুধু তাই নয়, ওই পোস্টে কেউ লাইক দিলেও গ্রেপ্তারের শিকার হতেন। বিতর্কিত আইনটি বাতিলের আবেদন করেছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী শ্রেয়া সিঙ্ঘাল। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েক জন ছাত্রছাত্রী এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে এমন কিছু সংস্থা। আড়াই বছর লড়াই করে জয়ী হন শ্রেয়া।

২০১২ সালে মুম্বাইয়ে শিবসেনা প্রধান বাল ঠ্যাকারের মৃত্যুর পর পুরো শহরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাতে লাইক দেওয়ায় কারান্তরীণ করা হয় আরেক নারীকেও। এরপরই শ্রেয়া উপলব্ধি করেন, কেউ যখন-তখন এ আইনের আওতায় গ্রেফতার হতে পারেন। এ চিন্তা থেকেই তিনি জনস্বার্থে মামলা ঠুকে দেন।

শ্রেয়ার এই লড়াই এবং আদালতের রায় বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ওই রকম একটি ধারা মতপ্রকাশের অন্তরায় হয়ে কাজ করছে। মামুলি কিছু ঘটনায় নাগরিকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে; কারও কারও বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারা মতে, "কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।"

এই অপরাধে ব্যক্তি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ভারতীয় আইনটির চেয়ে বাংলাদেশের আইনটিতে শাস্তি আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে। ২০০৬ সালে যখন এটি করা হয় তখন শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড। ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়। সেখানে সর্বনিম্ন কারাদণ্ড রাখা হয় ৭ বছর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ জামিনঅযোগ্য করা হয়। আগে মামলা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। এখন সেটারও দরকার নেই। অপরাধ আমলে নিয়ে পুলিশ শুধু মামলাই নয়, অভিযুক্তকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারও করতে পারছে।

প্রসঙ্গত, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা অনুযায়ী, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আপত্তিকর কিছু পোস্ট করলে অভিযুক্তকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হত এবং দোষ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান ছিল।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় বিচারকদের বক্তব্য ছিল, একজনের কাছে যেটা আপত্তিকর, অন্যের কাছে সেটা আপত্তিকর নাও হতে পারে। কোনটি আপত্তিকর এবং কোনটি অতিমাত্রায় আপত্তিকর, তা কী করে নির্ধারণ করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা? রাষ্ট্রপক্ষ বলার চেষ্টা করে যে, এই ধারার অপব্যবহার হবে না। বিচারপতিরা পাল্টা মন্তব্য করেন, সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু ৬৬ (এ) ধারা থেকে যাবে। এরপরই ধারাটি বাতিলের ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্ট। ভারতীয় বিচারপতিদের ওইসব মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য অক্ষরে অক্ষরে প্রযোজ্য। বেশি কিছু ব্যাখা করার দরকার পড়ে না।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এটাও বলেছে যে, এই ধারা বাতিলের অর্থ এই নয় যে, সোশ্যাল নেটয়ার্কিং সাইটে যে কোনো আপত্তিকর মন্তব্য বা ছবি পোস্ট করা যাবে এবং সে জন্য শাস্তি হবে না। দেশ ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর কিংবা অশালীন মন্তব্য বা ছবি পোস্ট করার ক্ষেত্রে এখনও নিষেধাজ্ঞা জারি থাকছে।

আমরাও মনে করি, কেউ যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার নামে সীমা লঙ্ঘন করে তবে তার শাস্তি হতেই পারে। তবে এর জন্য কমপক্ষে ৭ বছর শাস্তি অবশ্যই হওয়া উচিত নয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, কোনো ব্যক্তি শুধু হাসি-ঠাট্টা বা মজা করার জন্য কিছু লিখে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ওই ধারাটি দেশের নাগরিকদের হাসি-ঠাট্টা-মশকরা করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। একে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার কারণে ইন্টারনেটের যে কোনো কর্মকাণ্ড অপরাধ মনে করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

কোনটি অপরাধ আর কোন অপরাধের মাত্রা কেমন এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে কোনো নির্দেশনা কি দেওয়া হয়নি? রাষ্ট্র ওই আইন করে ‌রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছে, উদার মনোভাব দেখাতে পারেনি। প্যারোডি রচনা বহু পুরনো ঐতিহ্য। ওই আইনে ব্যাঙ্গাত্মক হাস্যরস সৃষ্টির পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, সৃষ্টিশীলতার গতিতে ধাক্কা লেগেছে। কারণ নাগরিকরা কোনো কিছু লেখার সময় যদি চিন্তা করে, এটা লিখলে বা বললে কত বছর জেলে থাকতে হবে, তাহলে লেখার গতি যে এগুবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক গান লিখে এক ব্যক্তি ৭ বছরের জন্য দণ্ডিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর শাড়ি নিয়ে মন্তব্য করে এক ব্যক্তিকে কারাগারে যেতে হয়েছে। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেওয়ায় একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। জুম্মার নামাজের পর মোনাজাতে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করায় ইমামের নামে মামলা হয়েছে। এ জাতীয় উদাহরণ আরও অনেক রয়েছে।

আইনটিতে মানহানির বিষয় এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করার সুযোগ থেকে যায়। সে সুযোগের ব্যবহারও ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নিয়ে নানা জন নানা রকম মন্তব্য করতেই পারেন। সেগুলো এত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার দরকার পড়ল কেন? রাজনীতিবিদরা কি যুগ যুগ ধরে এসব কথাবার্তা হজম করে আসছেন না? তারা তো কোনোকালে এসব আমলে নেননি। কিছু ব্যক্তি আর অতিউৎসাহী পুলিশ মামুলি কিছু মন্তব্য আমলে নিয়ে নাগরিকদের কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন যা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য নয়।

এটা চলতে থাকলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেরাই এর ফাঁদে পড়তে পারেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা যেখানে একজন আরেক জনকে 'চোর', 'খুনি' এসব হরহামেশাই বলে বেড়ান– যা গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়ে আসছে– তখন কোনো নেতা বা নেত্রীকে কটূক্তি করে একজন নাগরিককে কারাবন্দি হতে হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এছাড়া বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে যেসব অপরাধের শাস্তি সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, সে সব অপরাধের শাস্তি তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৭ থেকে ১৪ বছর করা হয়েছে। প্রচলিত বেশ কিছু আইনের সঙ্গেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের শাস্তির মাত্রা বিরোধপূর্ণ। অনেকটা এ রকম: প্রচলিত আইনে খুন করে কেউ ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন; আর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কাউকে 'খুনি' বলেই ১০ বছরের জন্য কারাগারে থাকতে হতে পারে। 'খুনি বলা' আর 'খুন করা' এখানে একই রকম অপরাধ।

২০০৬ সালে যখন এ আইন করা হয় তখন সর্বনিম্ন কারাদণ্ডের সময়সীমা ছিল না, বিচারকরা সেটি নির্ধারণ করতে পারতেন। ২০১৩ সালে সংশোধিত এই আইনে যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ বছর। এ আইনে লঘুপাপে গুরুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অনলাইনে অসত্য ও অশ্লীল কিছু প্রকাশের কারণে যদি ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়, তাহলে খুনের শাস্তি কত বছর হবে, এমন প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন।

মূলত বাকস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের জন্য আইনটি খুবই বিপদজনক। যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তির ওপর এই আইন কার্যকর হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যারা লেখালেখি করেন তারা অত কিছু মাথায় নিয়ে লিখতে পারেন না। সব সময় যদি মাথার ওপর তলোয়ার ধরে বলা হয়, লিখলে গলা কর্তন করা হবে, তাহলে মুক্তভাবে নাগরিকরা লিখবেন কী করে?

উন্নত বিশ্বে এখন জোরালো দাবি উঠেছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হাত দেওয়া যাবে না বলে। গুগল ও ফেসবুক যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে এ বিষয়ে আরও নমনীয় হতে বলেছে। অথচ বাংলাদেশ আরও কঠোর আইন করে মানুষের মুক্তচিন্তা বন্দি করে রাখছে।

ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এ সংক্রান্ত ধারা সংবিধানে প্রস্তাবিত মানুষের মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত করেছে। তাই এ ধারা আইনের বই থেকে বাতিল করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধের গণ্ডি পেরিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের ব্যক্তিগত মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ করা যেত। আদালত এটাও বলেছে, যে কোনো রাজ্যের সরকার এখনও কোনো ওয়েবসাইট ব্লক করে দিতে পারে, যদি সেই সাইটের তথ্য কোনোভাবে সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোল, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে বা সেই সাইটের তথ্য ভারতের সঙ্গে তার কোনো প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রভাবিত করে, তাহলে।

আমরাও মনে করি, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ আরোপ করেও মুক্তচিন্তার পথ খোলা রাখা দরকার। বাংলাদেশের সংবিধানও সেই নিশ্চয়তা দিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কিছু ধারা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে আইনটির ৫৭ ধারা নাগরিকদের সেই মৌলিক অধিকার হরণ করেছে।

আমার বিশ্বাস, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শ্রেয়া সিঙ্ঘালের মতো বাংলদেশেও কেউ না কেউ এ আইন চ্যালেঞ্জ করবেন, ওটি বাতিল হবে। নয়তো আমরা অন্ধকারে হেঁটে ঢুকে যাব আরও নিকষ আঁধারের গহীনে– আলোর পথে যাত্রা আর সম্ভব হবে না!

২৬ মার্চ, ২০১৫


জায়েদুল আহসান পিণ্টু:
প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।