শোনেন বলি নতুন করে পুরান ঘটনা

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
Published : 24 March 2015, 07:18 AM
Updated : 24 March 2015, 07:18 AM

কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় গুরুত্বসহকারে ছাপা খবর পড়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিলাম। 'যুক্তরাষ্ট্রে বসে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র' শিরোনামের খবরটিতে বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্রের টার্গেট জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশের নাম কেটে দেওয়া। ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে যার নাম খবরে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের ভাত-ডাল, মাছ ও নুন-খাওয়া একজন 'গুণধর' ব্যক্তি। নাম তার মুশফিকুল ফজল আনসারী। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব ছিলেন। বর্তমানে তাঁর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য। অর্থাৎ তিনি বিএনপির একজন হার্ডকোর মেম্বার। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড হোল্ডার সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত থেকে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া একটি রাজনৈতিক দলের হার্ডকোর মেম্বার কীভাবে জাতিসংঘের মিডিয়া অ্যাক্রেডিটেশন পেয়ে সাংবাদিক সেজেছেন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনও যে কেন এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করে না– সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। তবে কোনো রাজনীতিবিদকে যদি মিডিয়া অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেওয়ার বিধি থাকে, তাহলে বলার কিছু নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, জাতিসংঘের পাবলিক ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের শর্ত অনুযায়ী, কোনো বিদেশি সাংবাদিক যদি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ফরেন প্রেস সেন্টারে মিডিয়া অ্যাক্রেডিটেশনের জন্য আবেদন করেন তবে তাকে সংশ্লিষ্ট দেশের মিশনের প্রত্যয়নপত্র দেখাতে হয়। তার মানে, মুশফিকুল ফজল সাংবাদিক পরিচয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশন অথবা বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে প্রত্যয়ন নিয়েই অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড পেয়েছেন। ''ডাল মে কুচ কালা হ্যায়?''

ডাল মে কুছ কালা আছে না ধলা আছে সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমার ভাবনার বিষয়, দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করছে, তারা। ষড়যন্ত্রকারীরা দুর্বৃত্ত। আর দুর্বৃত্তের ছল যে নানামুখী ও নানা কিসিমের– সে কথা সবারই জানা। দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কতভাবে যে ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং হচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকেই সব ষড়যন্ত্রের শুরু। একাত্তরে বাঙালি নিধনের প্রধান দুর্বৃত্ত গোলাম আযম পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তান ও সৌদি আরব হয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেয় লন্ডনে। সেখানে বসে ১৯৭২ সালে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের ষড়যন্ত্র। সেটি সফল হয়নি। তবে শেষও হয়নি। এখনও চলছে ভিন্ন ফর্মে, ভিন্ন দুর্বৃত্তের নেতৃত্বে।

এ সম্পর্কে বিশদ কিছু বলার দরকার নেই। শুধু এটুকু বলি, নিঃসন্দেহে মুশফিকুল ফজলদের ষড়যন্ত্রের 'আঁতুর ঘর' লন্ডন। বাহাত্তরে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হোতা গোলাম আযম লন্ডনে রিফিউজি ছিলেন। আর বর্তমানের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী তারেক রহমানও লন্ডনেে আছেন এবং একই স্ট্যাটাস নিয়েই। তার না আছে পাসপোর্ট, না ভিসা। আছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চাবি। দেশে-বিদেশে মুশফিকুল ফজলরা এই চাবির মোচড়ে যে যার অ্যাসাইনমেন্ট পালন করে।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের দরজা চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা এই অ্যাসাইনমেন্টেরই অংশ। মুশফিকুল ফজল এ ব্যাপারে সেখানকার ওপিনিয়ন লিডারদের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে অসত্য তথ্য তুলে ধরে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি, আমাদের গণমাধ্যমগুলোও বারবার তথ্য দিচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে হেয় করবার জন্য বাংলাদেশিদেরই একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক নানা রকম ষড়যন্ত্রের জাল ফেলছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট এবং প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে অপপ্রচার চালানোর জন্য ঢালা হচ্ছে টাকা-পয়সা। জাতীয় দৈনিকের ওই খবরে বলা হয়েছে 'সরকারবিরোধী'; আসলে এটি বাংলাদেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্র। যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা ঘরের শত্রু বিভীষণ নয়, বিভীষণের বাবা।

ষড়যন্ত্রের অস্ত্র কী? বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তাতে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সংস্থাগুলোর সদস্যদের নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা থাকে। তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোই নাখোশ হয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। কৌশল মন্দ নয়। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন অতীতে এ ধরনের কাজ একাধিকবার করেছে।

কথায় বলে, টাকায় কথা কয়। খানিক আগে ষড়যন্ত্রের জন্য অঢেল টাকাপয়সা ঢালার কথা বলেছি। টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন সংগঠন এবং মানুষ বিশ্বের সবখানেই আছে।

বাংলাদেশের সাড়ে দশ হাজার সদস্য বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বিভিন্ন দেশে কর্মরত। দায়িত্ব পালন, নৈতিকতা, সততা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, যথাযথ কর্তব্য সম্পাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুনাম সর্বজনবিদিত। জাতিসংঘের উচ্চতর কর্তৃপক্ষও বারবার বাংলাদেশের সদস্যদের প্রশংসা করেছেন। কেবল জাতিসংঘই নয়, যে সব দেশে তারা শান্তিরক্ষার কাজ করেন, সে সব দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বাংলাদেশিদের খুব পছন্দ করেন। সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের ব্যাপারে বাংলাদেশের শান্তিকর্মীরা যে 'নাম্বার ওয়ান', সে কথা বিদেশি গণমাধ্যমে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে রাস্তার নাম পর্যন্ত হয়েছে বাংলা শব্দে। কোথাও কোথাও স্থানীয়রা বাংলা কিছুটা বুঝতে ও বলতে শিখে গেছেন। আফ্রিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পশ্চাৎপদ মানুষের কাছে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা নাকি 'দেবতুল্য', এ রকম কথাও শোনা যায়।

শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কর্তব্যরত প্রায় সাড়ে দশ হাজার বাংলাদেশি সেবকের ব্যাপারে সামান্য যে ক'টি কথা বললাম তাতেই বোধ করি বাস্তবতা তুলে ধরা গেছে। এটাও সম্ভবত বোঝানো গেছে যে, শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কতখানি পরীক্ষিত, গ্রহণীয় ও অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞরাও সে কথাই বলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভ্রম-জাগানো ভাবমূর্তি যদি কেউ যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করে থাকে তবে সর্বাগ্রেই নাম আসবে শান্তিরক্ষা বাহিনীর। এটা বলাও ভুল হবে না যে, পোশাক শিল্পে ব্র্যান্ড হওয়ার আগেই এ কাজে ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের পরই শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শীর্ষ অবস্থানে আছে পাকিস্তান। সে দেশে দীর্ঘমেয়াদে নানামুখী সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা থাকলেও, তাদের কেউ কিন্তু বিদেশে শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের বিরুদ্ধে কথা বলেনি, বলে না। বদ্ধ পাগলও নিজেরটা বোঝে। জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয় থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, যে কোনো দেশের দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দুটি ভিন্ন বিষয়। তবু থেমে নেই ষড়যন্ত্রকারীরা।

ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য অবশ্য গভীরে। ষড়যন্ত্রটি আসলে চলছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাঙালি জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করার জন্য। এটা গোলাম আযমের ষড়যন্ত্রেরই নতুন সংস্করণ। এর আঁতুর ঘর লন্ডনে, যে কথা আগে বলেছি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ার কথা বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথা। যেটি কেবল ষড়যন্ত্রই প্রতিহত করবে না, সে সঙ্গে আমাদের দেশ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস এবং উন্নয়ন ও সম্ভাবনার সত্যিকারের চিত্র বিশ্বের মাঝে প্রতিষ্ঠা করবে। কাজটি যথাযথভাবে হয়নি। কিছু কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি অবশ্য সাধ্যমতো কাজ করে চলেছেন। কিন্তু পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক ফান্ডিংয়ের বিরুদ্ধে এসব প্রচেষ্টা কতটুকুই-বা শুভ ফল দেবে?

সময় শেষ হয়ে যায়নি। গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন দেশপ্রেমিক ও ভালো মানুষেরা। তাদের কাজে লাগাতে হবে। আছে অনেক প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সংগঠন। সবাইকে এক সুতোয় গাঁথতে হবে। কাজটি রাজনীতির। তাই দূতাবাস-নির্ভরতা দিয়ে হবে না। কাজগেুলো খুব কঠিন নয়, তবে জরুরি ও অপরিহার্য; অত্যাবশ্যকীয়ও বটে। নইলে দুর্বৃত্ত শিকারীর পরিকল্পিত জালে পা জড়িয়ে বারবার হোঁচট খেতে হবে। সেটা কারও কাম্য নয়।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়: নাট্যব্যক্তিত্ব।