ক্রিকেট হোক শক্তি ও আনন্দের উৎস

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 22 March 2015, 11:38 AM
Updated : 22 March 2015, 11:38 AM

আবেগপ্রবণ না হলে কেউ বড় কাজ করতে পারে না। তবে কিছু অর্জিত হয়ে গেলে সে অর্জন সংহত ও ফলপ্রসূ করতে পরিমিত আবেগ ও কৌশলের বিকল্প নেই। আমাদের ক্রিকেট যখন আমাদের প্রেরণা ও শক্তির উৎস মনে করছি, তখন এর পেছনে সাহসের পাশাপাশি যুক্তি আর কৌশলের এস্তেমালও জরুরি। খুব সহজভাবে আমরা বন্ধু দেশ বা শত্রু দেশ, এভাবে ছকে ফেলে দিলেই খুশি হয়ে যাই। সে ছক কতটা কার্যকর বা কে কখন কোন ভূমিকায়, সেটা আর মাথায় রাখি না।

আবেগের একটা খারাপ দিক হচ্ছে, চোখের দৃষ্টি মনের আড়ালে নিয়ে যাওয়া। মন, আত্মা আর চিন্তা বাদে সে অবলোকনে যা-ই থাক, সুদূরপ্রসারী ভাবনা বা সামনে যাবার আগ্রহ থাকে না। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটি যে সম্ভাবনা ও আশাবাদের উৎস হয়ে এসেছিল, বাজে আম্পায়ারিং আর ভুল সিদ্ধান্ত তাকে এমন এক খাতে প্রবাহিত করেছে যা নিয়ে শঙ্কিত হবার বিকল্প দেখছি না। সোস্যাল মিডিয়া যেহেতু 'আন-এডিটেড' এবং বাস্তবে জবাবদিহিতাহীন, এর ভেতর দিয়ে উস্কে দেবার কাজও সারা হয়ে যায়।

আগে খেলার কথায় আসি। ভারত এখন তাবত দুনিয়ার ক্রিকেটের 'পাওয়ার হাউজ'। ফলে আলীম দার বা গুল্ড, তারা যে দেশের যে জাতিরই হন না কেন, ভারতকে চটাতে পারবেন না। ভারতের হাতে ক্রিকেটের যাবতীয় অর্থ ও সমর্থনের যোগান আছে বলেই জুয়া, বেটিং বা ম্যাচ ফিক্সিং থাকার পরও ভারতকে কেউ কিছু বলতে পারে না। ভারতের ক্রিকেটে জুয়ার আগমন নিয়ে সবার আগে কথা বলেছিলেন ঋষি অরবিন্দ। তিনি এ নিয়ে সাবধান বাণীও করে গিয়েছিলেন। এটা আজ এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে, ক্রিকেট হিরোরাই ভারতের সবকিছু।

যদি কোনো শিশুকেও প্রশ্ন করি অলিম্পিক বড় না ক্রিকেট, উত্তর দিতে এক মিনিট বিলম্ব করবে না। অথচ দুনিয়ার সেরা ক্রীড়ানুষ্ঠান অলিম্পিক গেমসে সোনার মেডেল জেতা ভারতীয় খেলোয়াড়রা দেশে ফিরে এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাদের কেউ বরণ করতে যায় না। আর কোহলি, জাদেজা, ধোনি বা কাল সকালে উদিত বোলার যাদবের জন্যও মানুষ পাগল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মিডিয়া ও প্রচারের পাশাপাশি টাকা-পয়সা আর জুয়ার কারণে ক্রিকেট ভারতে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, তাতে সততা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।

কোয়ার্টার ফাইনালে ইন্ডিয়ান এক ভদ্রমহিলাকে ফলো করেছিল টিভি ক্যামেরাগুলো। আমার মতো অনেকেরই কৌতূহল চরমে পৌঁছুল তার সঙ্গে রাখা প্ল্যাকার্ডের ভাষায়। ভদ্রমহিলা ইংরেজিতে লিখে এনেছিলেন, 'কোহলি, আমি আমার স্বামীকে বাড়িতে ফেলে মাঠে এসেছি তোমাকে খেলতে দেখব বলে…'। কী সাংঘাতিক আবেদন! তার সে আশা অবশ্য পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের দুর্দান্ত বোলিংয়ে কোহলি তিন রানেই সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন।

যে কথা বলছিলাম, কোয়ার্টার ফাইনালে আমাদের দলের প্রতি, আমাদের জাতির প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে তার সমুচিত জবাব কি কথার তোড়ে দেওয়া যাবে? এই সেদিনও ক্রিকেটে ভারত তেমন কোনো শক্তি ছিল না। বরং সে সময় পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের জয়জয়কার ছিল দেখার মতো। হানিফ মোহাম্মদ, আসিফ ইকবাল, জহির আব্বাসদের কালে পাক ক্রিকেটের যে জৌলুস ও রমরমা, আজ তা অস্তমিত। নেই গ্যারি সোবার্স, কালিচরণ, ক্লাইভ, ভিভ রিচার্ডস বা লারাদের দেশগুলোর গৌরব। আজ সে জায়গা ভারতের দখলে।

এই কাজ করতে তারা সমবেতভাবে নানা দিক থেকে এগিয়েছে। আর্থিক, রাজনৈতিক আর সামাজিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে দুনিয়ায় সমীহ আদায় অসম্ভব। ভারতীয় ক্রিকেটের যে শক্তি তা যদি কোথাও কাজ না করে তবে তারা এ জাতীয় কৌশলের আশ্রয় নিতেই পারে। তাও দরকার হয় না এখন আর। আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো কাজ করে দেয়।

যেমন ধরুন, অষ্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট 'নাম্বার ওয়ান গেইম' নয়। এর উপরে আছে রাগবি ফুটবল (যেটা অবশ্য সকার নয়) বা টেনিস। সে জায়গায় ক্রিকেটে দর্শক টানার ব্যাপারে তারা কী দেখছে? ভারতের খেলা মানেই হাজার হাজার দর্শক। মাঠভর্তি। মাঠ ভরা মানেই খাবারের দোকান, বিয়ার, চা, কফির রমরমা ব্যবসা। সঙ্গে বাসে-প্লেনে-ট্রেনে বাড়তি উপার্জনের সরকারি সুযোগ। শোনা যায়, পাকিস্তান বনাম সাউথ আফ্রিকার খেলায়ও নাকি সে বাণিজ্যের ছায়া পড়েছিল। কারণ পাকিস্তানেরও একটা ভালো দর্শক বেইজ আছে। বলা হচ্ছে, তা না হলে সাউথ আফ্রিকা শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানকেও উড়িয়ে দিতে পারত।

বাংলাদেশের সৌভাগ্য, আমাদেরও একটা ভালো দর্শক বেইজ আছে। আস্তে আস্তে সেটা এখন সবার চোখেও পড়ছে। সিডনি, মেলবোর্ন বা যে কোনো শহরে বাংলাদেশের খেলা মানে কয়েক হাজার সরব দর্শকের সপ্রাণ উপস্থিতি। বলা বাহুল্য, এটা আগামী বারে আরও বেশি কাজে আসবে। কারণ ইংল্যান্ডে আমাদের লোকবল আর অবস্থান বেশ পুরনো। বাঙালি সেখানে আর্থিকভাবেও সচ্ছল। আমাদের উচিত হবে সেটা কাজে লাগানো। কেউ আমাদের জিতিয়ে দেবে বা অন্যায্য ফলাফল এনে দেবে তা কিন্তু নয়। বড় কথা হল, এতে আমাদের প্রতি অবিচার, অনাচার বা ভুল সিদ্বান্ত আসবে না, আসতে পারবে না।

কেন আমরা ভবিষ্যত ভাবি না? কেন একটি খেলা শেষ হলেই এই জাতীয় ভাগাভাগি আর আত্মপীড়ন? আমি তো দেখেছি খেলার নামে কী বিপুল ঐক্য আর ভালোবাসা গড়ে ওঠে। সবাই বাংলাদেশি; সবার হাতে জাতীয় পতাকা; মাঠে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের কারণে এক দল মানুষ বাংলাদেশকে সমর্থনের নামে এখনও আমাদের জাতীয় চেতনার বারোটা বাজাতে সক্রিয়।

খেলায় ভুলচুক বা আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত অতীতে হয়েছে বা ভবিষ্যতেও হবে। আমরা আজ তার শিকার, আমাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বলে আমরা উত্তেজিত। কিন্তু এর সঙ্গে অকারণ ভারত-বিরোধিতার সম্পর্ক কোথায়? ভারত বা যে কেউ ম্যাচ ফিক্সিং করছে কিনা তার চেয়ে জরুরি হচ্ছে স্বচ্ছ আম্পায়ারিং ও তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কেন আমরা সেভাবে ভাবতে পারছি না? এ খেলায় আমাদের বিরুদ্ধে ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কা খেললে কি ডিসিশনগুলো এমন হতে পারত না? ভারতের শক্তি, আয়তন আর ধর্মীয় পরিচয় যেন এখানে ফ্যাক্টর না হয়।

জরুরি বিষয় হল, সস্তা দেশপ্রেমের বদলে যৌক্তিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। যে জায়গায় আপত্তি, যেখানে দুর্ভাবনা, সেটায় হাত দেওয়া। এখানেও আমাদের শক্তি কিছু কম নয়। আইসিসি সভাপতি লোটাস কামাল ঠিক কথাই বলেছেন। কথা ও কাজে সমন্বয় ঘটাতে পারলে দুনিয়ার সব ক্রিকেট জাতিতে তার কথার প্রতিফলন দেখা যাবে।

'খোলা মিডিয়া' নামে পরিচিত সামাজিক নেটওয়ার্কে সাবধানতার বিকল্প নেই। একে ঘিরে যে উন্মাদনা ও উত্তেজনা কাজ করছে তার ফলাফল শুভ হতে পারে না। প্রতিবাদ আমরা করবই। আমাদের ন্যায্য বেদনা আর রাগ যেন অন্য খাতে প্রবাহিত হতে না পারে। নানা ধান্দাবাজি ও জামায়াত-বিএনপির অপরাজনীতি এটি নিয়ে খেলবে। তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করবে। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনও অনেক দূর যাবার পথে। তাকে কলহ বা বিবাদে ফেলে, কারও দুশমন না করে জয়ের পথে নিতে হলে শান্ত ও সুস্থির হবার বিকল্প দেখি না। আমরা যৌক্তিকভাবে দাঁড়াতে না শিখলে ভারত, পাকিস্তান বা ইংল্যান্ড, কেউ ছেড়ে কথা বলবে না।

একটা বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই। উনিশশ ছিয়াশির ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ম্যারাডোনার কথিত 'ঈশ্বরপ্রদত্ত' গোলে ('হ্যান্ড অব গড' নামে দুনিয়াজোড়া খ্যাত) ইংল্যান্ডের পরাজয়ের পর থেকে ফুটবল ইতিহাসের এই মহাতারকার পতনের শুরু। সে থেকে আজ অবধি একদিনের জন্যও তাঁকে শান্তি দেয়নি বিলেতি মিডিয়া। তর্ক-বিতর্ক, মাদক আর ব্যক্তিগত কেলেংকারি সামনে এনে তাঁকে সর্বনাশের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে তারা।

আমাদেরও ছাড়বে না। দু'শ' বছর তাদের কাছে পরাধীন থাকা, ছোট একটি দেশের কালো কালো মানুষেরা মাথা উঁচু করে তাদের হারাবে, এটা ইংল্যান্ড সহজে মেনে নেবে না। পাকিস্তানিরা কখনও চায় না আমরা জিততে থাকি। চাইবে না ভারতও। এর জবাব ফেসবুকে মান-অভিমান করে আর গালাগালি দিয়ে হবে না। লোটাস কামাল ও পাপন সাহেবরা বিহিত করতে না পারলে জাতিকে এর দায়িত্ব নেবার জন্য তৈরি হতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা রাগ-অভিমান ও দুঃখ জানানোর বাইরে আসলে কিছুই করতে পারবেন না। করবেনও না। সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবনের আর সব কাজে 'ন্যূনতম' দেশপ্রেমের রাজনীতি হঠাৎ করেই ক্রিকেটের বেলায় 'অবারিত' দেশপ্রেম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এ আশাই-বা করব কেন?

বাংলাদেশের সহায় তার জনগণের দেশপ্রেম; সেটা যেন অসুস্থ আর রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত না হয়, তা এখন দেখার বিষয়। না হলে এ দেশের ক্রিকেটের সামনে আরও অনেক বিপদ এসে দাঁড়াবে। সম্ভাবনার এই ক্রিকেটকে দেশপ্রেমের নামে জামায়াত বা উগ্র জাতীয়তাবাদীরা পুঁজি করতে চাইছে। দেশের এক পরিচিত মুখ, পেশায় ডাক্তার, বিতার্কিক, গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থক হবার পরও, ইসলামী ব্যাংকের সৌজন্যে একটি টিভি চ্যানেলের এক অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় তার একটি সাম্প্রতিক লেখায় বাংলাদেশের সব খেলোয়াড়ের নাম বললেও সৌম্যর নামটি এড়িয়ে গেছেন। ভারতে সংখ্যালঘুদের বেলায় এমন কিছু নেই। তারা জাতীয় স্বার্থে এক, অভিন্ন। আমরা বিভক্ত। কোনোভাবেই এদেশে তাই আর কোনো অপপ্রক্রিয়া বেগবান করতে দেওয়া যাবে না।

আরেকটা ব্যাপার, ক্রিকেটের সঙ্গে সঙ্গে এর ইতিহাস ও লেখাপড়ার বিষয়টাও সামনে আনতে হবে। যে মাঠে বাংলাদেশ হেরেছে, সেই এমসিজির ভেতরে আছে ক্রিকেটের মায়াজাল– ইতিহাস আর তার নায়কদের সম্মান জানানোর জন্য জাদুঘর। আছে ইতিহাসভিত্তিক পাঠাগার; শচীন-ইমরানদের মূর্তি। সম্মান, ভালোবাসা আর ঠাণ্ডা মাথা ছাড়া কোনো কিছুতে বড় হওয়া যায় না। এটা শ্রীলঙ্কাকে দেখেও শেখা সম্ভব।

বাংলাদেশ ও তার ক্রিকেট মর্যাদার আসনে নিতে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। উত্তেজনা নয়, চাই দেশপ্রেম ও সুস্থিরতা। আমরা কি তা করে দেখাতে পারব?

সিডনি; ২১ মার্চ, ২০১৫