মানব নগরে যন্ত্রমনিব

সৈয়দ মাহবুবুল আলম
Published : 8 April 2011, 12:59 PM
Updated : 8 April 2011, 12:59 PM

একটি বিষয়ে সবাই আমরা একমত, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলার জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে বা এলাকায় শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার জায়গা আছে কি? উত্তর নেই। আমাদের এত প্রিয় সন্তান তথা আগামী প্রজন্মের জন্য প্রতিটি বাড়িতে বা এলাকায় খেলার জায়গা নিশ্চিত করে কেন শহর গড়তে পারিনি? অথচ দেখুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে প্রতিটি বাড়িতে গাড়ি থাকুক বা না থাকুক পার্কিং করার জন্য জায়গা রাখতে হয়। যদি কোন এলাকায় গাড়ি পার্কিং করার জায়গা না থাকে তবে রাস্তায় পার্কিং করা যায়। আর মতিঝিলের মতো দামী এলাকায় গাড়ির জন্য সরকারী উদ্যোগে পার্ক দখল করে বা জায়গা একোয়ার করে পার্কিং সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।

যাই হোক, যদি প্রস্তাব করা হয় শিশুদের জন্য সপ্তাহে অন্তত ২ দিন বিকেলে ৩ ঘন্টা করে শহরের বদ্ধ গলির রাস্তাগুলো বন্ধ করে খেলার ব্যবস্থা করা হবে। এ সময়ে রাস্তাগুলোতে গাড়ি চলবে না। এই মুহূর্তে আমার এ প্রস্তাবের অনেকেই ভিন্ন ব্যাখা করবে বা অবাস্তব মনে হবে, যদিও আমি বিশ্বাস করি এ ব্যবস্থা একদিন করতে হবেই। প্রাইভেট গাড়ি গুটিকয়েক মানুষের… আর শিশুরা এ দেশের আগামী দিনের সম্পদ। গুটিকয়েক মানুষের গাড়ীর জন্য এত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে, শিশুর জন্য কেন পারবো না?

আর একটি উদাহরণ দেই, ঢাকা শহরের পরিবেশবান্ধব রিকশা যানজটের অপবাদে অভিযুক্ত একটি বাহন। শহরের অতিরিক্ত রিকশাসহ নানা অপবাধ দিয়ে ডিটিসিবিসহ সরকারী বিভিন্ন সংস্থাগুলো এই পরিবহনকে বিভিন্ন রাস্তায় নিষিদ্ধ করে। তাদের বক্তব্য ছিল রিকশা নিষিদ্ধ হলে যানজট হ্রাস পাবে। কিন্তু ফলাফল ঘটেছে বিপরীত, ঐ রাস্তাগুলোতে কিন্তু যানজট কমেনি বরং বেড়েছে।

রিকশাকে কমানোর জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও, আশ্চর্যজনকভাবে প্রাইভেট গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিআরটিএ-এর তথ্যমতে, ২০০৩ সালে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কারের সংখ্যা ছিল ৮৭৮৬৬ এবং জিপ/মাইক্রোবাস ৩২৩৯১টি। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি এর সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৪৭২৮৩ এবং ৫৮৬০৮। এখন ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১৫০-১৮০ টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। অথচ ১৯৮৮ সাল থেকে রিকশার রেজিষ্ট্রেশন দেয়া বন্ধ আছে। সহজে রিকশা বন্ধ করা হলেও, গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। এখন যখন মাত্র ২% মানুষের প্রাইভেট গাড়ির চাপে, ঢাকার ১ কোটি মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা অচল প্রায়। আমি জানি এই লেখা যারা পড়ছেন তাদের কেউ কেউ এই কথার বিরোধিতা করবেন। অথচ দরিদ্র মানুষের আয়ের অবলম্বন, স্বল্প যাতায়াতের সুবিধার বাহন পরিবেশবান্ধব রিকশা নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে এত যুক্তি বা তর্ক আসেনি। যতটা না গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য আসছে। কারণ গাড়ি আমাদের কিছু মানুষের অভিজাত্য ও বিলাসিতার প্রতীক, মনিবের মতোই সম্মানিত।

ঢাকা শহরের যে সকল রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে সকল রাস্তার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে প্রাইভেট গাড়ির পার্কিং। ঢাকার নিউমার্কেটের পাশের রাস্তা দিয়ে রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। রাস্তার পাশে নোটিশ রয়েছে রিকশা পার্কিং নিষিদ্ধ, কিন্তু গাড়ির পার্কিং করার ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ নেই। সরু এই রাস্তায় গাড়ী পার্কিং করার জন্য সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এই রাস্তার এক পাশে বিগত কয়েক বছরে ধরে গড়ে উঠছে একটি মার্কেট। এই মার্কেটে প্রায় ১০০০ টি দোকান রয়েছে। যেখানে গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থাও রয়েছে। ভাবছি যখন এই মার্কেট চালু হবে তখন কী অবস্থা হবে। গাড়ির জটে মানুষ এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। তখন কি নতুন কোন সমস্যা দেখিয়ে এ রাস্তায় শুধু রিকশা নিষিদ্ধ করে নিশ্চিত করা হবে প্রাইভেট গাড়ির চলাচল?

গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্প্রতি এক পরিবারে একাধিক গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা এবং একদিন জোড় আর একদিন বেজোড় গাড়ি চালানোর বিধান করার পরিকল্পনা করা হয়। গাড়ি ব্যবহারকারীদের অসুবিধা হবে বিধায়, এই ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়নি। অথচ সম্প্রতি বিভিন্ন রাস্তায় আবারও রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। যারা রিকশায় চলাচল করে, তারা এ শহরের নাগরিক এবং এ রাষ্ট্রের জন্য কর দেয়া সত্তেও তাদের চলাচলের ক্ষেত্রে কেন বৈষম্যমূলকভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়? ঢাকার রাস্তায় যানজটের কারণ দেখিয়ে রিকশার পাশাপাশি নানা পরিবহনের চলাচলে বিধিনিষেধ অরোপ করা হয়েছে। যেমন দিনে ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ, সিএনজির লাইসেন্স সীমিত, পুরাতন বাস নিষিদ্ধ, রিকশার লাইসেন্স প্রদান বন্ধ, বাসের রুট পরিবর্তন, পথচারীদের জন্য পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ নির্মানসহ নানা পদক্ষেপ। অথচ সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে প্রাইভেট গাড়ির নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

সিটি কর্পোরেশন আইনের তৃতীয় তফসিলে ১৯.১ এ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধানে, পথচারীরা যাতায়াতের সময় যাতে বিপদগ্রস্ত না হন এবং নিরাপদে যাতায়াত করতে পারেন, সেজন্য যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। অথচ বাস্তবে সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম ভিন্ন। পথচারীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং, পথচারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ। এই ফুটওভার ব্রিজকে নিরাপদ যাতায়াতের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অথচ একজন হৃদরোগী, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী মহিলা, অসুস্থ্য রোগী বা আথ্রারাইট্রিসে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এই ব্রিজ অতিক্রম নিরাপদ নয়। সিটি কর্পোরেশন নিজেই নিজের আইন ভাঙ্গছে। হাটা যাতায়াতের একটি মাধ্যম যা পরিবেশ বান্ধব, সাশ্রয়ী এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী। পথচারীদের জন্য নিরাপদ যাতায়াত তৈরির মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন তার স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত দায়িত্বগুলোর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। যন্ত্রমনিব গাড়ির তুলনায়, পথচারী মানুষের জন্য চিন্তা ও পরিকল্পনা নেই বললেই চলে।

গত ২৪ আগষ্ট ২০০৯ তারিখে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখছি, সিলেট রেজিষ্ট্রি অফিস সংগ্লন মাঠ হকারমুক্ত করা হয়েছে। কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় এই মাঠটি হকাররা ব্যবহার করে আসছিল। ফলে মাঠের পার্শ্বে থাকা পূর্তভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাড়ি পার্কিং করতে হতো রাস্তার উপর। উচ্ছেদের পর মাঠটি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে গাড়ি পার্কিং করার জন্য। কারো মতে হয়তো বিষয়টি যৌক্তিক। আর এ প্রেক্ষিতে আমার মনে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এই মাঠটিতে ৫০টির বেশি হকারের দোকান ছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় প্রতিটি দোকানের কর্মচারী ও পরিবারের লোকজন মিলে দোকান প্রতি ৪ জন করে লোক এই দোকানের উপর নির্ভরশীল ছিল, তাহলে প্রায় ২০০ লোক এই দোকান হতে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু হকার উচ্ছেদের পর, গাড়ি পার্কিং করায় কত লোকের জীবিকার সংস্থান হয়েছে, কত লোক সুবিধা পাচ্ছে? রাষ্ট্র, সরকার এবং সমাজের কাছে প্রশ্ন, গাড়ির পার্কিং ও মানুষের জীবিকার মাঝে কোনটির সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন?

ফুটপাত দখলের অভিযোগে ঢাকার রাস্তা হতে প্রায়শই হকার উচ্ছেদের জন্য তোড়জোড় করা হয়। ঢাকার কয়েকটি রাস্তার পাশে ফুটপাতে হকারদের অবস্থান সত্যিই চলাচলের জন্য প্রতিবন্ধক। এ স্থানগুলো হচ্ছে মতিঝিল, গুলিস্থান, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, পুরানা পল্টন সড়ক। কিন্তু অন্যান্য রাস্তায় হকার সমস্যা নয়। অথচ সারা ঢাকা শহরের ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে রাখে প্রাইভেট গাড়ি ও মোটর সাইকেল। বিভিন্ন তথ্য অনুসারে দেখা যায় ঢাকায় হকার রয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজারের মতো। আর বর্তমানে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা ২ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি। যততত্র গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধের বিধান কার্যকর না করা হলেও, হকার উচ্ছেদের বিষয়ে কেউ কেউ সোচ্চার। হকার সেই মানুষ, রাষ্ট্র যাদের জীবনধারনের জন্য মৌলিক সুবিধা দিতে পারছে না, যারা রাষ্ট্রের রাস্তায় নূন্যতম জায়গা নিয়ে জীবন ধারনের পথ খুঁজে নিয়েছে। গাড়িকে সমস্যা হিসেবে না দেখলেও, হকারকে সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। যদি ভারত ও সাউথ আফ্রিকার মতো হকারদের সুশৃঙ্খলভাবে বসার ব্যবস্থা করা হয়, তবে হকার পেশা কর্মসংস্থানের একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। হকারদের উচ্ছেদ এবং গাড়ির জন্য পার্কিং– মানব ও যন্ত্রের জন্য এ রাষ্ট্রে কেন এই বৈষম্যমূলক নীতি?

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। জনগনের টাকায় তৈরি রাস্তায় (মাত্র ১০-২০ টাকায়) ঘন্টা খানেক এখানে গাড়ি রাখতে পারেন। এই জায়গায় একই মূল্যে হকারদের বসার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে কি? গাড়ির জন্য সুযোগ দিলে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সুযোগ আমরা কেন দিতে পারবো না। কারণ আমাদের মানসিকতায় গাড়ি অপেক্ষা হকার গৌন বিষয়। ঢাকা শহরে গাড়ি পার্কিংকে যেমন একটি সমস্যা মনে করা হয়, তেমনি হকারদের বসার ব্যবস্থা তার চেয়েও দীর্ঘ ও পুরাতন একটি সমস্যা। গাড়ির জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পার্কিং সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, কিন্তু হকারদের সুবিধার জন্য স্থায়ী কোন গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ঢাকা শহরের রাস্তার একটি বড় অংশ দখল করে রাখে প্রাইভেট গাড়ি। যা ব্যক্তিগত পরিবহন এবং একক মানুষের সুবিধাকে নিশ্চিত করে। ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য গাড়ির উচ্ছেদ কার্যক্রম হয় না।

দেশের নীতিনির্ধারকদের মাঝে প্রাইভেট গাড়ির অবস্থানটি কী রূপ তা তুলে ধরছি। প্রায়শই বলতে শুনি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কোন বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারে না। বিষয়টি আসলেই একেবারে ঠিক নয়, কেননা সকল সংসদ সদস্যদের জন্য যখন শুল্কমুক্ত গাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো তখন কেউ কিন্তু এর বিরোধিতা করেনি। অপরদিকে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতায়নের জন্য তোড়জোর আন্দোলন শুরু হলো। ক্ষমতায়নের জন্য নির্বাহী ক্ষমতা কতটুকু দেয়া হয়েছে তা পরিষ্কার না হলেও, নিয়মিত খবর দেখেছি, তাদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ী দেয়া হচ্ছে। গাড়ি কি ক্ষমতায়নের অংশ? আমি এ সকল উপজেলা চেয়ারম্যানদের বেশ কয়েকজনকে জানি তারা গাড়ি ছাড়া চলাফেরা করতেন এবং জনগণের মাঝে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। এই মানুষগুলো গাড়ি ছাড়াই পথে প্রান্তরে ঘুরে মানুষের ভোটে জয়ী হয়েছেন। ক্ষমতায়নের নামে এই কাঁচে ঘেরা বিলাসবহুল এসি গাড়িতে বসিয়ে ঘোরানো মানে তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করার সামিল। জনগনের জন্য রেল/নৌ, স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার মতো সেবা বৃদ্ধির কথা এলে বলা হয় দরিদ্র দেশ, আমাদের পক্ষে এগুলো করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেখলাম প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য ১৬ লক্ষ টাকার আর্থিক ঋণ প্রদান করা হচ্ছে এবং প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা করে খরচ বরাদ্দের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গাড়ির উপর কর বৃদ্ধির প্রস্তাব এলে কত যুক্তিই আসে। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে নীতিনির্ধারকরা নির্বিকার। জনগনের জন্য নূন্যতম সুবিধা দিতে দাতা নামের ঋণ প্রদানগোষ্ঠীর বারণ, আন্তর্জাতিক চুক্তি, দারিদ্র–কত যুক্তিই না আসে। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও সেবকদের সুবিধার জন্য এদেশে রয়েছে অফুরন্ত ঐশ্বর্যের ভান্ডার।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে শ্রমিক ও অগ্রসর জনগোষ্ঠীকে শোষণ হতে মুক্তি প্রদান এবং মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। অনুচ্ছেদ ২০ (১) অনুসারে কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য এবং সম্মানের বিষয়। আর যদি সংবিধানে আমাদের রাষ্ট্রনীতি প্রাধান্য পায়, তবে অধিকাংশ জনগনের চলাচলের ব্যবস্থা, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং হকারদের কর্ম করার ব্যবস্থা অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার সনদ, মানবাধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদে স্বাক্ষর করেছে। এ সকল সনদে মানুষের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান ও এ সকল আন্তর্জাতিক সনদের কোথাও প্রাইভেট গাড়িকে সুবিধা প্রদানের কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু অবাক হলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ নিয়ে, ঋণ গ্রহণ করে, বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ির জন্য পার্কিং, ফ্লাইওভার, বিশাল রাস্তা করার পরিকল্পনায় মত্ত সরকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের চলাচল, শিশুদের বিনোদন, দরিদ্র হকারদের কর্মসংস্থান, রিকশা চালকদের ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর চিন্তা ও কর্মের সীমাবদ্ধতা বিস্ময়কর।

প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার আজ সমাজের আভিজাত্যের প্রতীক। আমাদের চিন্তায় কে কোন ব্রান্ডের গাড়ি ব্যবহার করে তার উপর নির্ভর করে কোন মানুষ কত উঁচু মানের। যার যত দামী ও আধুনিক গাড়ি তার দাম তত বেশি। গাড়ি হচ্ছে মানুষের অবস্থান নির্ণয়ের সূচক। প্রায়ই মনে হয়, এই নগরে মানুষের কতটুকু মূল্য ? সেবাদাস হচ্ছে এমন একটি শ্রেণী যার মূল কাজ হচ্ছে যে কোন মূল্যে মনিবের সার্বিক সুবিধা নিশ্চিত করা। সেবাদাসগন তার মনিবের সুবিধাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও মনমানসিকতাও কি সেদিকেই যাচ্ছে?

যানবাহন ও নগর পরিকল্পনার যে কোন সিদ্ধান্তে প্রথমেই চিন্তা করা হয় যন্ত্রমনিব প্রাইভেট গাড়ি কীভাবে যাবে। প্রাইভেট গাড়ি কিভাবে নির্বিঘ্নে চলাচল করবে? প্রাইভেট গাড়ি কোথায় থাকবে। গুটিকয়েক প্রাইভেট গাড়ির মালিকের জন্য অধিকাংশ মানুষের অর্থ খরচ করে এত পরিকল্পনা কেন? রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে অধিকাংশ মানুষ কেন অগ্রাধিকার পাবে না ? তাই মনে হয় আভিজাত্য আর অহংকারের প্রতীক দেখাতে গিয়ে আমরা হয়ে পড়েছি গাড়ির সেবাদাস। ভাবতে অবাক লাগে একটি জড়বস্তু কীভাবে সভ্য ও জ্ঞানী সমাজের প্রতিনিধি মানুষকে সেবাদাসে পরিণত করতে পারে। হয়তো এ লেখা পড়ে কেউ কেউ প্রতিবাদ করবেন এবং প্রাইভেট গাড়ির পক্ষে যুক্তি দিতে চেষ্টা করবেন। এ ধরনের কাজের পূর্বে বিনীত একটি অনুরোধ, একবার ভাবুন আপনি কি অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত সুবিধা, শিশুদের বিনোদন, হকারদের ব্যবসার সুবিধা, রিকশা চলাচল নিশ্চিত করার জন্য এভাবে যুক্তি উপস্থাপন করবেন ?

সৈয়দ মাহবুবুল আলম : সংগঠক, নীতি বিশ্লেষক এবং তরুণ আইনজীবি।