ফরহাদ মজহারের ‘বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’ প্রসঙ্গে

Published : 11 March 2015, 10:36 AM
Updated : 11 March 2015, 10:36 AM

ফরহাদ মজহার জ্ঞানীজন। তাঁর লেখা 'বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না' শিরোনামের একটি প্রবন্ধ ঠিক এমন সময়ে প্রকাশিত হল যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে যে কোনো বিজ্ঞান বা মুক্তজ্ঞানের দাবিদারদের গয়রহ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এ জন্যেই এই প্রবন্ধ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। হ্যাঁ, একে আমি প্রবন্ধই বলব। যদিও খুব স্পষ্ট কোনো থিসিস বা হাইপোথিসিস নেই, তবু প্রবন্ধের গুণাবলী ঠিক রেখেই তিনি অন্তঃস্রোতের মূল বক্তব্য খোলাসা করেছেন; তা হল, "বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না"। বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞান ভালো; কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে যারা বেশি কথাবার্তা বলে তা চাই না।

বিজ্ঞানবাদিতা কী? আমি ধরে নিচ্ছি, বিজ্ঞান যখন কোনো একটি 'ইজম'এর মতো কাজ করে তাকে এখানে তিনি বিজ্ঞানবাদিতা বলতে চেয়েছেন। তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে:

"… বরং সেটা ঘটে বিজ্ঞানবাদিতার কারণে। বিজ্ঞানবাদিতা একটি মতাদর্শ। এই মতাদর্শ দাবি করে, আমাদের অন্য কোনো বৃত্তির দরকার নাই। সত্য নির্ণয়ের একটাই মানদণ্ড, সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান। শুধু বিজ্ঞান, অতএব আমাদের চিন্তা ও চেতনা অধিকার করে রাখুক। আমাদের সমাজ, নীতি-নৈতিকতা, রাষ্ট্রনীতি সব বিজ্ঞান দ্বারা ঠিক হোক। বিজ্ঞানবাদিতার নানান রূপ আছে। রূপভেদে তার ক্ষতির মাত্রাও ভিন্ন। তার কারণেই এই বিপদ ঘটে।''

আমি বিজ্ঞানবাদিতার এই সংজ্ঞার সঙ্গে সহমত পোষণ করি; কারণ তিনি এখানে 'সত্য নির্ণয়ের একটাই মানদণ্ড সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান' বলেছেন। যদি কোনো ইজম বা বাদ বা মতাদর্শ সত্য নির্ণয়ের একটাই মানদণ্ড বলে দাবি করে তাকে আমিও সমর্থন করব না। কিন্ত আসলে বিজ্ঞান কি তা বলে? বলে না।

তার আগে বলে নিই, ফরহার মজহার এখানে বিজ্ঞানের যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি উল্লেখ করলেন না তা হল, বিজ্ঞানমনস্কতা। আমি খুব সাধারণভাবে বলি, বিজ্ঞানমনস্কতা একটি দর্শন, একটি প্রসেস। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ে, এমনকি একটি পিএইচডি করেও তা তৈরি হয় না। বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া এক ধরনের সাধনা, পুরনোকে ঝেড়ে ফেলে কঠিন, কঠোর সত্য গ্রহণ করার সাধনা।

এই সত্য কি স্থির বা স্থবির কিছু? না, বিজ্ঞান তা বলেও না। বরং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এ জন্যেই 'ফলসিফিকেশনিজম' বিজ্ঞানের একটি বৈশিষ্ট্য। সুতরাং তিনি বিজ্ঞানের ওপরে একটি মিথ্যা দোষ চাপালেন তাঁর বিজ্ঞানবাদিতার স্বআরোপিত সংজ্ঞা 'ভিলেইন' প্রমাণ করার জন্য। বিজ্ঞানে মানদণ্ডের ভিন্নতাতেই বরং গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়।

ফরহাদ মজহার তাঁর প্রবন্ধে উপকথা বা মিথগুলোর চমৎকার শৈল্পিক প্রয়োগ তুলে ধরেছেন। আমাদের লোকজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই উপকথা বিরাজমান এবং এক অনির্বচনীয় জগত তা উন্মোচন করে দেয়। যেমন সূর্যের উপকথা। আগুনের উপকথা। আমি উপকথার অনুরাগী। আমার 'অগ্নিবালক' উপন্যাসে উপকথা আর সাইকোএনালিটিক্যাল তত্ত্বের মিলনও ঘটিয়েছি।

এই প্রসঙ্গ কেন টেনে আনলাম? আত্নপ্রচার করতে? না। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আমিও যে উপকথার এই শৈল্পিক রূপ আস্বাদন করি তা বুঝাতে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান এবং উপকথার ফরহাদ মজহার কর্তৃক সৃষ্ট কৃত্রিম সাংঘর্ষিক রূপ ভুল প্রমাণ করে দিতে এবং এর তাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে কথা বলতে।

উপকথা কী? সাধারণভাবে বললে, আদিকাল থেকে মানুষ যখন কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারত না, তখন গল্পের মধ্য দিয়ে যা বিবরণ দিত তা-ই উপকথা। সমাজ বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন উপকথা হল মানুষের ভাষার রোগ। ভাষা যখন ততটা সক্ষম ছিল না তখন গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষ তাকে প্রকাশ করেছে। মানুষ মানুক আর নাই মানুক, ধর্মীয় কাহিনিগুলোর সবই এই উপকথার মধ্য দিয়ে তৈরি। এই উপকথার সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ কোথায়? ফরহাদ মজহার সংঘর্ষ খুঁজে পেয়েছেন এবং মনে করেন যে এই সংঘর্ষ অসংখ্য শিশুর জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে। তিনি বলেন,:

"বিজ্ঞানের প্রধান চরিত্র হচ্ছে প্রত্যক্ষ অন্বেষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যকে জানা। তার ডমেইন বা সীমানা চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা হচ্ছে এমন এক ব্যাধি যা মানুষের সব বৃত্তিকে নির্বিচারে বিজ্ঞানের অধিকারে ও দখলে নিয়ে আসতে চায়। যেমন ঈশ্বর আছেন কী নাই সেটাও বিজ্ঞানবাদীরা তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে চায়। যখন পায় না, তখন নাই বলে ফতোয়া দেয়। যা বিজ্ঞানের অধীনস্থ করা সম্ভব না, তাকে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা ইত্যাদি বলে বাতিল করে দেয়।''

কথাটা কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাসের একটি সরলিকরণ ব্যাখ্যা। যেমন ফরহাদ মজহার বা কোনো ধর্মীয় পণ্ডিত কখনও স্পষ্ট করে বলেন না 'ঈশ্বর' এবং প্রচলিত ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বর এক কি না। প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলোর ঈশ্বর নিজেদের বর্ণিত কথা বা বাক্যবিন্যাসেই নিজেদের অস্তিত্বের সংকট দেখিয়ে গেছেন। তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দর্শন কি শুধু ঈশ্বরকে ল্যাবরেটরিতে দেখতে চায়? মোটেই নয়। বরং বিজ্ঞানের দর্শন দিয়েই মহাবিশ্বের এই অসীম শূন্যতায় বা অসীম সম্ভাবনায় এক মহাপরাক্রমশালীর সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর নন। সে অর্থে একজন ধার্মিক না হয়েও এই মহাপরাক্রমশালী শক্তিকে বিশ্বাস করে' স্পিরিচুয়াল' বা আধ্যাত্নিক হতে পারেন।

আমি কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে সেই আধ্যাত্নিকতার সংঘর্ষ দেখি না। আসলে বিজ্ঞানের দর্শনও তা দেখে না। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং দার্শনিক জাঁক লাকাঁ মানব মনের গঠনের সঙ্গে ভাষার যে স্বরূপ দেখিয়েছেন সেখানে উপকথার সঙ্গে মানুষের মনোজগতের গঠনের বিশেষ করে 'আনকনসাস মাইন্ড' বা অজ্ঞান মনের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে দেখলে তাই উপকথা বা পুরাণেও নতুন আবিস্কার আমরা দেখতে পাই।

বিজ্ঞানের জগতের শিশুরাও কি নতুন উপকথা শিখছে না পড়ছে না? বিজ্ঞান কি শুধুই ইন্দ্রিয় উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ খুঁজে বেড়ায়? ফরহাদ মজহারের তো অজানা থাকার কথা নয় যে, দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল তাঁর 'প্রবলেম অব ফিলোসফি' গ্রন্থে অনেক আগেই ইন্দ্রীয় উপাত্তের সঙ্গে কোনো কিছুর অস্ত্বিত্বের সম্পর্ক নেই তা দেখিয়েছেন; আবার তারপরও কিন্তু বাইবেলের ঈশ্বরকে মেনে না নিয়ে লিখেছেন, "হোয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চিয়ান'।

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগের শিশু কিশোরেরা কি 'হ্যারি পটার' পড়ছে না? আধুনিক পুরাণ কি তৈরি হচ্ছে না? আসলে কিন্তু বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ (এখন পর্যন্ত) পর্যায়ে অনেক তত্ত্বই আছে যা কোনে রকমের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ দিয়ে গ্রহণ করা হয়নি। বিজ্ঞান তো সাহিত্য-শিল্প থেকে আলাদা হয়েও একই সত্য অন্বেষণের আরেকটি পথ। এ কারণেই এই যুগের ডরিস মেসিংএর গল্প হয়ে ওঠে উপকথার মতো, বিজ্ঞান উপকথার মতো।

ফরহাদ মজহার এক কথায় রায় দিয়ে দিলেন:

"আধুনিক মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে সে তার মিথ বা পুরাণকে হত্যা করেছে এবং নিত্যদিন নিজেকেই নিজে সে শহীদ করে, নিজেই সে জানে না।''

এখানেও দেখতে পাই ফরহাদ মজহারের মধ্যেও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। তা না হলে তিনি এক কথায় "সবচেয়ে বড় ট্রাজিডি" বলতে পারতেন না। কারণ, পৃথিবীতে ট্রাজেডির মতো বিষয়কে সবচেয়ে বড় বলা অবৈজ্ঞানিক, বরং অনেকগুলো বড় ট্রাজেডির মধ্যে এটা অন্যতম হতে পারে। অর্থাৎ তিনিও কিন্তু তাঁর বর্ণিত বিজ্ঞানবাদিদের মতোই কথা বললেন। সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি যদি মিথ বা পুরাণ হত্যা হয় তবে নতুন নতুন মিথ তৈরি হচ্ছে কীভাবে? এক যুগে সূর্য বা অগ্নি যেমন মিথের উপকরণ ছিল; এখন ইন্টার গ্যালাকটিক ট্রান্সপোর্ট মিথ হিসেবে তৈরি হচ্ছে। ফরহাদ মজহার কি সেই সম্ভাবনা দেখেন না?

অন্যদিকে কিছু মুর্খের দল বলা শুরু করে, বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল, তাই তা না মানাই ভালো। যার পরিবর্তন হয় না তা তো স্থবির। মানব জীবন, জগত, সত্য কোনোটাই স্থির নয়। যা স্থির, পরিবর্তনহীন তা কী করে মানুষকে উন্নত করবে, সামনে নিয়ে যাবে? এটাই হল বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। কারণ, বিজ্ঞান অর্থই হল প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল জগত এবং সম্ভবত মানব মনও; অপেক্ষাকৃত ভালো, গ্রহণযোগ্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করে গ্রহণ করা।

কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, কোনটা অপেক্ষাকৃত ভালো এবং গ্রহণযোগ্য? হ্যাঁ, সেটাই হল বিজ্ঞানের দর্শনের আলোচনার বিষয়।

ফরহাদ মজহার আরও বলেন:

"বিজ্ঞান যদি তার নিজের জগতে বিরাজ করে, তাহলে এখানে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরির কারণ ঘটে না। কিন্তু বিজ্ঞান যদি বলে, পুরাণ বা মানুষের মিথ বা কল্পনার জগৎ স্রেফ কুসংস্কার, সূর্যের আবার ঘোড়া কী?… বিজ্ঞানের এই সন্ত্রাস ভয়ানক। বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জন এখানে তর্কের বিষয় নয়।''

এখানে আমার আপত্তিটা হল, সূর্যের ঘোড়াকে কুসংস্কার বলায় বিজ্ঞানকে সন্ত্রাস মনে করা। কেন, বিজ্ঞান বিজ্ঞানের মতো বলবে, যা সত্য তা জেনেও তো আমরা উপকথার স্বাদ নিয়ে পারি। আমি যখন বিজ্ঞানের কার্যকরণ দিয়ে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের সামাজিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজছি, ঠিক তখনই আবার "প্রোজেক্ট ভূতং আধুনিকং" কিম্বা "অগ্নিবালক" লিখছি না? আমার বিজ্ঞানমনস্কতা তো সাংঘর্ষিক হয় না। কারণ, আমার কাছে বিজ্ঞানমনস্কতা একটি দর্শন।

তিনি বলেন:

"না, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে নয়; কিন্তু বিজ্ঞানসর্বস্ব আর অতিশয় বুদ্ধিমান হওয়ার ভুল শুধরে। এ কারণে সেই বুদ্ধিকেই একালে 'মুক্তবুদ্ধি' বলা হয়, যে বুদ্ধি বুদ্ধিসর্বস্বতার সীমা সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। বিজ্ঞানবাদিতা পরিহার করা এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে হুঁশে থাকাটাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা…… বিজ্ঞান এখন আরও নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার অধীন, কারণ একালের বিজ্ঞান নির্দোষ চর্চা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কর্পোরেট স্বার্থ, বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা, যুদ্ধকৌশল ও প্রযুক্তি।''

এখানে ফরহাদ মজহার কিছু সত্য আর কিছু ধোঁয়াটে বিষয় মিশিয়ে একাকার করে দিলেন।

"বিজ্ঞানসর্বস্ব আর অতিশয় বুদ্ধিমান", এই বাক্যাংশের অর্থ কী? যিনি বিজ্ঞানমনস্ক তিনি তো কখনও অতিশয় বুদ্ধিমান হতে বা ভাবতে পারবেন না। কারণ বুদ্ধিও আপেক্ষিক এবং স্থান-কাল ভেদে পরিবর্তনশীল। একজন মহাপণ্ডিত যখন সাঁতার জানেন না তখন মাঝির সামান্য বুদ্ধি বা জ্ঞানের কাছে পরজিত হন ঝড়ের নদীতে। বাবুর ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তা জানবেন এবং মানবেন। তাহলে?

ফরহাদ মজহার কুর্ট গোডেলের "ইনকমপ্লিটনেস থিওরম" থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং বলেন:

"কুর্ট গোডেলের (১৯০৬-১৯৭৮) ইনকমপ্লিটনেস থিওরম গত শতকের ত্রিশ দশকে আবিষ্কৃত হওয়ার পর যুক্তি, গণিত ও বুদ্ধির সীমা বিজ্ঞানের নিজেরও জানা হয়ে গেছে। এতে বিজ্ঞান ছোট হয়ে যায়নি। কিন্তু বিজ্ঞান যা না, নিজেকে সেভাবে হাজির করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অস্বস্তি বেড়েছে। বিজ্ঞানের যে অহংকার উনবিংশ ও বিংশ শতকে মহামারীর মতো দেখা গিয়েছিল, বিশ শতকের শেষের দিকে তার তেজ কমতে শুরু করে। বিজ্ঞান নিজেই উপলব্ধি ও বুঝতে শুরু করে যে, বিজ্ঞান সার্বভৌম সত্য প্রকাশক নয়। আর 'সত্য' নিজেও এমন একটি ধারণা, যা এখনও দর্শনে তর্কাধীন। নিজেই বিজ্ঞান উপলব্ধি করতে শিখেছে যে, দেশকালের অধীন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানের কারবার, হোক তা দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক, চার কিংবা তারও অধিক। কিন্তু তার বাইরেও জগত আছে, তার বাইরেও বিষয় আছে, মানুষ যেসব বিষয়ে ভাবতে সক্ষম। বিজ্ঞান যেখানে যায় না বা যেতে পারে না; কিন্তু মানুষের কল্পনা ও চিন্তার শক্তি সেখানে যেতে পারে, মানুষ দেশকালে সীমিত হয়েও অসীমকে তার চিন্তা, ভাব, কল্পনা ও সংকল্পের বিষয়ে পরিণত করতে পারে। নইলে শিল্প-সাহিত্য থাকে না, দর্শনের সমুদ্র শুকিয়ে যায় এবং নতুন জগতের কল্পনায় বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটানোর জন্য বিপ্লবও অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি বিজ্ঞানের অজানা, সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার দাবি সত্যিকারের বিজ্ঞানীরা এখন আর করেন না।''

এখানে তিনি কুর্ট গোডেলের তত্ত্ব দিলেন, কিন্তু সেই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা আবার দিলেন না। সকল এক্সিওম এই ত্তত্বের হাইপোথিসিস খুশি করতে পারে না সে কথা বললেন না। কিন্তু আমি ওপরের অনুচ্ছেদের বেশিরভাগ কথার সঙ্গেই সহমত পোষণ করি।একেই আমি বিজ্ঞানমনস্কতা বলব। এ কারণেই বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, এমনকি দর্শনগতভাবে তা হয়ে উঠতে পারে পরিপূরক। কিন্তু এই সত্য কথার আবরণে তিনি আসল চেহারাটা প্রকাশ করলেন। লিখলেন:

"কিন্তু পৃথিবীতে সব সময়ই আহাম্মকেরা ছিল এবং তাদের সংখ্যাও কম নয় যারা নিজেদের বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দেওয়াকে অভিজাত ব্যাপার বলে গণ্য করে।''

ফরহার মজহার যদি সত্যিই বিজ্ঞানমনস্কতা বুঝে থাকেন তাহলে তো বোঝা উচিত ছিল বিজ্ঞানমনস্কতায় 'অভিজাত' বলে কিছু নেই। সুতরাং কারা তাহলে প্রতিপক্ষ এখানে কারা আহম্মক এখানে? তিনি যদি তাঁর লেখায় একবারও বিজ্ঞানমনস্কতা এবং বিজ্ঞানবাদিতা আলাদা করতেন তাহলে আমার এই লেখার প্রয়োজন বা গুরুত্ব থাকত না। না করাতে তিনি বিজ্ঞানীদের এক ধোঁয়াটে অবস্থানে রেখে সমানে নিজের আক্রমণটি চালালেন এবং বললেন:

"বিজ্ঞান চাই, কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। বুদ্ধি চাই, কিন্তু বুদ্ধিসর্বস্বতা নয়; কারণ অতি বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিমান নয়, আহাম্মকে পরিণত করে। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি কথাটা বোধ হয় এ কারণেই আমরা বলি।"

অবশ্যই বিজ্ঞানের সুফল তো আপনি ভোগ করবেন, আপনার ভক্তেরাও করবে। কিন্তু যদি মিথ বা পুরাণের নামে নয়, বরং কোনো ঐশ্বরিক বাণির বিরুদ্ধে কেউ কুসংস্কারের অভিযোগ তোলে, তাহলে অনায়াসেই তাদেরকে আপনার এই বক্তব্যের ফ্রেমে 'অতিবুদ্ধিমান আহম্মক' বলা যাবে। অনায়াসেই ঐশ্বরিক কোনো বাণীর অনুসারীরা হয়ে উঠবে এই যুগের নির্যাতিত মানব। যেমন মানুষের জিনেটিক বা বংশগতিবিদ্যার উৎকর্ষের মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি কী রোগ কখন হয় বা কোন রোগের প্রতিকার কীভাবে সম্ভব।

অন্যদিকে এই জিনেটিক আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে স্বতঃসিদ্ধ সত্যের মতো যে মানুষের বা অন্য প্রাণিদের বিবর্তন হয়েছে। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বলে দিচ্ছে যে, সব মানুষ আফ্রিকা থেকে এসেছে এবং আদি মাতা বা পিতা কোনোভাবেই শুধু দুজন মানুষ থেকে আসছে না। এখানে বিজ্ঞানের সুফলটুকু নিচ্ছি কিন্তু এই সত্য কথাগুলো বললেই সে হয়ে ওঠে 'অতিবুদ্ধিমান আহম্মক' বা বিজ্ঞানবাদী! আর ঐ আহম্মক অতিবুদ্ধিমানদের আজকাল আর গলায় দড়ি পড়ে না, মাথায় চাপাতি পড়ে।

আমিও আপনার লেখার শিরোনামের সঙ্গে সহমত হয়ে এভাবে বলতে চাই, বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানমনস্কতা চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। চাই না অন্য কোনো বাদিতাও।