গ্রামীণ বনাম বাংলাদেশ

জগদিশ ভগবতী
Published : 2 April 2011, 06:26 PM
Updated : 2 April 2011, 06:26 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুহাম্মদ ইউনূসের লড়াইটাকে প্রচার করা এমনভাবে যেন তা মহাভারতের দুষ্ট কৌরব গোষ্ঠী ও সত্যবান পাণ্ডবদের লড়াইয়ের আধুনিক রূপ।

ধারণাটা এমন যে সন্ত ইউনূসকে- যিনি ক্ষুদ্রঋণের রূপকার- শাস্তি দিতে রাজনীতির খেলা খেলছেন প্রতিশোধপরায়ণ প্রধানমন্ত্রী; কেননা তিনি রাজনীতিতে আসার হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি রাশিয়ার ব্যবসায়ী মিখাইল খোদোরকভস্কির বিরুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিন যে প্রচার চালিয়েছিলেন তার সঙ্গেও তুলনা করা হচ্ছে শেখ হাসিনাকে।

কিন্তু গ্রামীণের ঘটনাটা আরো জটিল। সুচারু জনসংযোগের মাধ্যমে ইউনূসের প্রচারণায় বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা ঠিক নয়।

প্রথমত শেখ হাসিনা কোনো সাধারণ রাজনীতিক নন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। তাঁকে [মুজিবুরকে] প্রায়ই জাতির জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয় যাকে ১৯৭৫ সালের অগাস্টে সেনাবাহিনী হত্যা করে।

২০০৯ সালের স্বচ্ছ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন হাসিনা। তিনি নারীদের সেই ছোট তালিকাটির একজন যারা উত্তরাধিকারসূত্রে নয়, নিজের যোগ্যতায় প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জন করেন তাঁর বাবা ও ভাইবোনদের হত্যার দীর্ঘদিন পর। তাঁর পরিবারকে হত্যার সময় শেখ হাসিনা ছিলেন জার্মানিতে- এ কারণে তিনি বেঁচে যান। বছরের পর বছর ধরে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করেন তিনি।

হাসিনা একটি ইসলামি দেশের নির্বাচনে ভোটে জিতেছেন- এ ঘটনা একজন নারীর জন্য কম অর্জন নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইউনূসের পাশে আমেরিকাকে পেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন একটি বন্ধু সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো দোষ করছেন, যা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিচালন নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

দ্বিতীয়ত, এখন যারা শেখ হাসিনার অর্জনকে উড়িয়ে দিচ্ছেন তারা একই সময়ে ইউনূসের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। প্রায়ই বলা হয়, ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। বস্তুত, আসল প্রতিষ্ঠাতা হলেন ভারতের আহমেদাবাদের ইলা ভাট। মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী ভাট ১৯৭৪ সালে এসইডব্লিউএ'কে (সেল্ফ-ইমপ্লয়েড উওমেন্স অ্যাসোসিয়েশন) নামে একটি ব্যাংক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের জোবরা গ্রামে ইউনূস তার গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প শুরু করার দুবছর আগে এটি করেন ভাট।

এসইডব্লিউএ সবসময় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটি সবসময় কঠোর আইনে পরিচালিত এবং বিশেষ কোনো সুবিধা এটা কখনো চায় না। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো এটি কখনো বিদেশি তহবিল পায়নি (যেমন ধরুন নরওয়ের কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার অনুদান পাওয়া এবং তহবিল পরিচালনা, যা থেকে ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগগুলো ওঠে)। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৯-১২ শতাংশ বাৎসরিক লভ্যাংশ দিয়েছে এসইডব্লিউএ। ইউনূস বিপুল অংকের বিদেশি অর্থের মাধ্যমে গ্রামীণের লোকসান আড়াল করেছেন বলে সন্দেহ করা হয়। অন্যদিকে, এসইডব্লিউএ দেখিয়েছে গরীব আত্ম-কর্মসংস্থান করা নারীরা একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে এবং বাইরের অর্থ ছাড়া এটি চালাতেও পারে।

তৃতীয়ত, ৪০ বছর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা পার হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। তাই অনেক বাংলাদেশি বিপুল বিদেশি অর্থের প্রবাহ পছন্দ করেন না। কেননা ওই ধরনের অর্থ গ্রামীণ এবং ইউনূসকে প্রায় দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে; এই বিষয়টি কোনো সরকারই পছন্দ করবে না। আসলে ইউনূস ও শেখ হাসিনার লড়াইয়ে ক্লিনটনের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি প্রভাবের বিপদটিই প্রকাশ করে।

এছাড়া আছে ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি। এটি যে দারিদ্র-বিরোধী কৌশলের একটি হাতিয়ার তা প্রমাণিত। কিন্তু ১৯৯১ সালে ভারতে শুরু হওয়া ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি বিশাল প্রভাব পড়ে দারিদ্র মোচনে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে ভারতের মতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেনি। উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এমন নীতিতে বাংলাদেশ আটকে ছিলো দশকের পর দশক- দুবছর আগে নির্বাচিত হয়ে হাসিনা এটি বলেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিক এবং দেশটির কৌশলগুলি প্রবৃদ্ধি-রোধী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আটকা পড়ে যা তারা অর্ধশতাব্দি আগে শিখেছিলেন ক্যামব্রিজ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে।

ভারতের সংস্কারমূলক সামষ্টিক অর্থনৈতিক কৌশলের ফলে ইলা ভাটের এসইডব্লিউএ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের লাভবান করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সংস্কারহীন সামষ্টিক অর্থনৈতিক কৌশলের খাদে ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক বড় জোর ক্ষুদ্রঋণের এক ফোঁটা শিশির দিতে পারে। আমার কি আশা করতে পারি যে, গ্রামীণের ঘটনাটা উদারপন্থী সেইসব সংস্কারের আগের অধ্যায় যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রূপান্তর আনবে?

[ইংরেজি থেকে অনূদিত]

জগদিশ ভগবতী : ভারতীয় অর্থনীতিবিদ। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও আইন বিষয়ের অধ্যাপক।