তাহের হত্যার পুনঃবিচার যে কারণে প্রয়োজন

তারেক আহমেদ
Published : 31 March 2011, 04:55 PM
Updated : 31 March 2011, 04:55 PM

একটা বড় মাপের ঘটনার অনেক চরিত্র থাকে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের পাশাপাশি থাকে অনেক পার্শ্বচরিত্র। ঘটনার পরিক্রমায় পার্শ্ব চরিত্রগুলো কখনও কখনও কেন্দ্রে চলে আসে। আবার অনেকে পার্শ্ব-ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ইতিহাসের নির্মমতা তাদের দূরে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কর্নেল তাহের তেমনি এক চরিত্র । আমাদের চার দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস কখনো তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আবার কখনো টেনে নিয়েছে কাছে।

সন্দেহ নাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে সাহসী সৈনিকদের একজন ছিলেন তাহের। আইএসআইয়ের গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে পালিয়ে এসে যিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধেই যোগ দেন নাই, একটি সেক্টরের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। কামালপুরের সম্মুখ সমরে হানাদার পাকবাহিনীর সাথে লড়ে নিজের একটি পা হারিয়েছেন। নিজে তো বটেই, গোটা পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারপর যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে শোষনহীন সমাজ গড়বার স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্ন পরবর্তীতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন রাস্ট্রের সবচাইতে শক্তিধর ও রক্ষনশীল দুর্গগুলোর একটি — সেনাবাহিনীর মধ্যে। উপনিবেশিক ধারার সেনা-কাঠামোকে ভেঙে সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য উৎপাদনশীল সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সেই প্রচেস্টার সাফল্য ব্যর্থতা ইতিহাস নির্ধারণ করবে– কিন্তু ব্যাক্তি তাহেরের ক্ষেত্রে তাঁর পরিণতি হয়েছিল নির্মম। রাস্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়ে গোপন সামরিক ট্রাইব্যূনালের দেয়া ফরমানে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু মৃত্যুর আগ মূহুর্তেও শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকে এক চুল নড়ানো যায়নি তাঁকে। নিজের প্রাণের জন্য বিন্দুমাত্রও মায়া হয়নি তাঁর। এমন আত্মত্যাগ প্রকৃত বীর ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব কিনা জানি না। গ্রীক ট্র্যাজেডীর মহানায়কদের সাথেই কেবল তাহেরের এই আত্মত্যাগের তুলনা চলে।

তবে তাহের হত্যার পুনঃবিচার সংক্রান্ত আলোচনায় যাবার আগে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই নাটকীয় সময়টায় আমাদের আরো একবার ফিরে যেতে হবে। পঁচাত্তরের মধ্য আগস্ট থেকে পরবর্তী প্রায় বৎসরাধিক কাল সময়ের ব্যাপ্তিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে কেবল একটি পলিটিক্যাল থ্রিলার ছবির সাথেই তুলনা করা চলে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ নামের রাস্ট্র তখন তার প্রতিষ্ঠাতাকে হারিয়েছে — যিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন। নিহত হন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় আরো একাধিক নেতা ও মন্ত্রী, জেলখানার অভ্যন্তরে নিহত হন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকালীন শীর্ষস্থানীয় একাধিক মন্ত্রী ও নেতা। দেশে একাধিক ক্যু পাল্টা ক্যু ঘটে। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ ভেঙে মাঝারি সারির কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এসব হত্যাকান্ড ঘটায়, অথচ পরবর্তীতে দীর্ঘকাল বিচারের আওতার বাইরে তাদেরকে রাখা হয়। আর ঘটনাক্রমের শেষ পর্যায়ে কর্নেল তাহেরের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কোন ধরনের আইনী লড়াইয়ের সুযোগ না দিয়ে রীতিমতো ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই গোটা সময় জুড়েই আমাদের রাজনীতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। আর রাজনীতিবিদরা যেন কলের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। যার প্রমান আমরা পাই, সংবিধান ও শাসন কাঠামোর কোন রকম তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী থেকে খন্দকার মোশতাক আহমদ দেশের রাষ্ট্রপতি বনে যান। এমনকি মওলানা ভাসানী আর আতাউর রহমান খানের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদরাও যেন দূর থেকে এসব তামাশা কেবল দেখেই যাচ্ছিলেন। কোন প্রতিবাদ দূরে থাক, প্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই নির্মম পরিণতি দেখে কোন প্রতিবাদ করতে দেখা যায় নি। অন্যদিকে, আমাদের বাম রাজনৈতিক দলগুলোও তখন প্রতিদ্বন্দী গ্রুপগুলোকে কেবল রুশ ভারতের দালাল কিম্বা পিকিংপন্থী বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চর ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত করে পরোক্ষে নিজেরাই নানা ধরনের দেশী বিদেশী শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল। যার ফল হিসেবে আমরা দেখি, পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃস্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রে চরম ডান ও ধর্মীয় শক্তিগুলো রাজনৈতিকভাবে দ্রুত বিকাশ লাভ করে। তারপর রাষ্ট্র ক্ষমতার আশেপাশে অবস্থান নিয়ে ছলে বলে কৌশলে রাষ্ট্রটিকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার চূড়ান্ত চেষ্টা চালায়।

তাহেরের পুনঃবিচার সংক্রান্ত রিট শুনানী চলাকালেই প্রধান বিরোধী দল বি.এন.পি. এই পুনঃবিচার প্রক্রিয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করেছে। তাদের ভাষায়, লরেন্স লিফসুলজের মতো 'ভাড়াটে' সাংবাদিক ডেকে এনে সরকার জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি হননের চেষ্টা করছে। কোন কোন নেতা এমনও বলছেন যে, সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাহেরের বিচার সঠিকই ছিল। তাহের হত্যার পুনঃবিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের প্রধান এই বিরোধী দলের তৎপরতা দেখে যে কেউ এটা মনে করতে পারেন, দলটি তাদের অতীত কলঙ্ক ঢাকবারই যেন চেষ্টা করছে।

একথা সত্যি যে, তাহেরের মামলার পুনঃবিচার চেয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে রীট আবেদনটি এমন সময় করা হয়েছে — যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। এই রীট আবেদনটি যদি বিএনপি সরকারের সময় আদালতে শুনানী হতো তবে গোটা দেশের মানুষই দেশে আইনের শাসন আছে বলে স্বস্তি পেত। কিন্তু বংলাদেশে এটা আশা করাও বৃথা। খুব একটা অবাক হবো না, যদি দেখি,পরবর্তীতে কোন এক বিএনপি সরকারের সময় সিরাজ শিকদার হত্যার বিচার চেয়ে একটি মামলা আদালতে রুজু করা হয়। আর,তাহের হত্যা মামলা নিয়ে আজ বিএনপি নেতারা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে সিরাজ শিকদার হত্যা মামলা হলে হয়তো আওয়ামী লীগ নেতারাও একই কথা বলবেন।

সত্যি কথা বলতে কি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যতই চেষ্টা করুন–অতীত তাদের পিছু ছাড়ছে না। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের দুই নেতার কাল্টের গুনগানেই জাতীয় সংসদ মুখরিত করে রাখছেন। অন্য কোন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তাদের বিবেচ্য নয়। কিন্তু ক্ষমতার পথ নিরঙ্কুশ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বা জিয়ার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতাও যে রক্তে রঞ্জিত করেছিলেন তাদের হাত সেটা যেন তাদের অনুসারী দল বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোন নেতা স্বীকার করতে চান না।

ইতোমধ্যেই কর্নেল তাহেরের বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে জিয়াকে তাহের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিহিত করায় তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের ভাষায় এটি করা হয়েছে, কেবলমাত্র জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের সুনাম নষ্ট করার জন্য। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন,তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সৎ মানুষ হিসেবে সুনাম থাকলেও তাহের বিষয়ে সাজানো মামলা তো বটেই, এমনকি তার জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং তার ফলশ্রুতিতে যে অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিককে প্রাণ দিতে হয়, সে সব হত্যাকাণ্ডের দায়ভার তার ওপরই বর্তায়। নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করবার জন্যই যে জিয়া এসব করেছিলেন, তা দেশের সচেতন যে কোন মানুষই এতদিনে বুঝে নিয়েছেন।

আদালতের রায়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও সামরিক শাসনামলে সেনাবাহিনীর ভেতর ঘটে যাওয়া এসব অজানা ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন। জিয়া ও পরবর্তীকালে এরশাদের সামরিক শাসনামলে সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া নানা অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জাতি জানতে চায়। শুধু তাই নয়, ৭২ থেকে ১৯৯০ সন পর্যন্ত সময়কালে নানা বাহিনীর হাতে নিহত জানা অজানা মানুষ সম্পর্কেও তথ্য দেশের সাধারণ মানুষ জানতে চাইতে পারে।

আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি দেশে সত্যিকার অর্থেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চান তাহলে নিজেদের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। এজাতীয় সংলাপই কেবল আমাদের সাধারণ নাগরিকদের মাঝে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

আর রাজনীতিকে ভবিষ্যতমুখী করতে হলে শুধু তাহের হত্যার পুনঃবিচার নয়– সিরাজ শিকদার, খালেদ মোশাররফ, জেনারেল মঞ্জুর ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ প্রতিটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন। সামরিক ও অসাংবিধানিক শাসনামলে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডসহ আলোচিত অন্যান্য সব ঘটনারও তদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন।