Every book has a counter book– আর্জেন্টিনার বিখ্যাত লেখক হোর্হে লুইস বর্হোসের চিন্তাপ্রসূত এই বাক্যের বাংলা করলে দাঁড়ায়, প্রত্যেক বইয়ের একটি প্রতি-বই আছে। সরলীকরণ করে বলা যায়, যেহেতু চিন্তা প্রকাশিত হয় বইয়ের মাধ্যমে, সেহেতু প্রত্যেক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে বইয়ের মাধ্যমে বা আরেকটি প্রতি-বইয়ের মাধ্যমে। আদতে বই আর প্রতি-বই, যা-ই বলি না কেন, সভ্যতার পরম্পরা সচল আছে এই বই কেন্দ্র করেই।
আমাদের দেশে বই কেন্দ্র করে প্রকাশক-লেখক-পাঠকের সর্ববৃহৎ সম্মিলনী হচ্ছে ফ্রেব্রুয়ারির বই মেলা। এ মেলার জন্য সারা বছর লেখক-প্রকাশক-পাঠক অপেক্ষায় থাকেন। মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন নতুন বই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রার চালচিত্রই শুধু পরিস্ফুট করে না, এর মধ্য দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতেও সৃষ্টি হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির বহুমাত্রিক বিকাশের ফলে মুদ্রিত বইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত; তবে প্রযুক্তির সঙ্গে মুদ্রিত বইয়ের চিরায়ত ঐতিহ্য যুক্ত করে নতুন দিনের সূচনা সম্ভব।
গত শতকের আশির দশকের শুরুতে প্রচলন হওয়া এই বই মেলা আজ একটি সংহত রূপ পেয়েছে। যদিও মেলার আদি ইতিহাস আজকের দিনের মেলার মতো প্রকাশক ও পাঠকের বাড়-বাড়ন্তের ইতিহাস ছিল না। তখন চিত্তরঞ্জন সাহা বই বিছিয়ে বসতেন। যতটা না বিক্রির উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে বেশি লেখক-পাঠক সমাগমের প্রয়াসে। তখন সেখানে আসতেন পটুয়া কামরুল হাসান। ছবি আঁকতেন এবং বিক্রি করতেন। মাত্র পাঁচশ টাকায় তাঁর আঁকা ছবি চাইলেই কিনতে পারতেন আগ্রহী কোনো সংগ্রহকারী। অনাড়ম্বর ও অবাণিজ্যিক রূপের একটি মেলা ছিল তখন। মাসব্যাপী তো ছিলই না।
নব্বই দশকের শুরুতে মুক্ত গণতন্ত্রের সূচনার কারণে কিনা, মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রকাশনী সংস্থার অংশগ্রহণও। স্বাভাবিকভাবে বিক্রি-বাট্টাও। আর গত দেড় দশক যাবত ফেব্রুয়ারির বই মেলা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার অন্যতম বাণিজ্যিক আয়োজন।
এ কথা বললে বোধ করি ভুল হবে না যে, আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যাবতীয় আয়োজন ও বিনিয়োগের সিংহভাগ এই ফেব্রুয়ারির বই মেলা উপলক্ষ্য করে। তবে এ কথা মানতেই হবে, যদি শুধু একটি মাস বা মৌসুম বিবেচনায় রেখে তৎপরতা চালানো হয় তবে তা কোনো শিল্পের জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়। কিন্তু চাই বা না চাই, এদেশের প্রকাশনা শিল্পের ভবিতব্য যেন তাই হয়ে গেছে। সারা বছর ধুঁকতে থাকা এই শিল্প যেন ফেব্রুয়ারির দুই-তিন মাস আগে থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। বছরে যত বই প্রকাশিত হয়, তার ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ প্রকাশিত হয় এ সময়। ফলে দেখা যায়, বেশিরভাগ বই স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে দায়সারা সম্পাদনায়, যেনতেন বাঁধাই আর অশোভন পরিপাট্য নিয়ে ক্রেতা তথা পাঠকের বরাবরে উপস্থিত করা হয়। দেশের বয়স চল্লিশ ছাড়ালেও আমাদের প্রকাশনা শিল্প তার চাইতেও দেড় কী দু'দশকের বেশি বয়েসী। কিন্তু এখনও সাবালকত্ব অর্জনের চৌকাঠই পেরুতে পারেনি। শিক্ষার হার বাড়া সত্ত্বেও খুব জনপ্রিয় জনা দশেক লেখকের লেখা আর খুব প্রয়োজনীয় একাডেমিক কিছু বই বাদ দিলে বেশিরভাগই বড়জোর তিনশ' কী পাঁচশ' কপি ছাপা হয়।
বইয়ের কাটতি না থাকলে প্রকাশকেরা কেন গাঁটের পয়সা খরচ করে বই ছাপাবেন? কারণ শেষ বিচারে এটাই তাদের জীবিকার অবলম্বন। তবে এটাও সত্যি, এ শিল্পে সংশ্লিষ্ট দুয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই অপেশাদার। এদের প্রুফ রিডিং, কপি এডিটিংসহ প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ শাখাই অনুপস্থিত। অথচ পশ্চিমা দেশগুলোতে লেখক তার এজেন্টের মাধ্যমে বই প্রকাশ, বিতরণ, বিপনন ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করে থাকেন। ওখানে সুসংহত ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজগুলো করা হয়। কপিরাইট, কমিশন, রয়্যালিটি ইতাদি ব্যাপারেও ব্যাপক অস্বচ্ছতা আমাদের প্রকাশনা শিল্পের আজন্ম বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখনও বিদ্যমান। তার মানে, আমাদের প্রকাশনা শিল্পে অরাজকতা না হলেও অস্থিরতা আছে।
এসব দূর করতে প্রায় দুই দশক আগে জাতীয় গ্রন্থনীতি ও জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রস্তাবিত নীতিটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে আলাপ-আলোচনা। আলোচনা পর্যন্তই, আর কোনো ফলাফল নেই। প্রকাশনা শিল্পের সমস্যাও দিন দিন বাড়ছে এ ধরনের অনির্দিষ্ট অবস্থার কারণে। আলোচিত প্রস্তাবিত গ্রন্থনীতিতে গণগ্রন্থাগার নেটওয়ার্ক একেবারে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে বলে জানা যায়। যদিও প্রতিটি উপজেলায় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা আজও সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে আছে বইয়ের মূল্য নির্ধারণে এক ধরনের নৈরাজ্য, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বই ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম; লেখকদের রয়্যালটি নিয়ে সংকট। সামগ্রিকভাবে বই ও প্রকাশনার পেশাগত মানের অবনতি হচ্ছে দিন দিন। তাই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, প্রস্তবিত জাতীয় গ্রন্থনীতি দ্রুত সংশোধনপূর্বক চূড়ান্ত করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। এর ফলে জ্ঞান ও সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা একটি মর্যাদাকর ও গ্রহণযোগ্য শিল্প হিসেবে দাঁড়াবে বলে আশা করা যায়।
একটি রিডিং সোসাইটি গড়ে তুলতে যে ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ থাকা প্রয়োজন তার অভাব হয়তো এদেশে নেই, কিন্তু ভৌত অবকাঠামোর অভাব খুব প্রকট। আশির দশকে ইউনেসকো এটা শুরু করেছিল। আমাদের ন্যাশনাল বুক ক্যাপাসিটি বাড়ানো প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকরা জানেনই না যে, জাতীয়ভাবে একটি বইয়ের ভাণ্ডার উন্নত সব দেশেই আছে। সেখান থেকেই এই রিডিং সোসাইটি গড়ে উঠতে পারে। রিডিং সোসাইটি হলে 'অ্যাকসেস অব বুক' নিশ্চিত হবে। আমাদের এ রকম কোনো পলিসি নেই যেটা অনুসরণ করলে সবারই উন্নতি হত।
পাশাপাশি, আমাদের প্রকাশকদের একটা বড় অংশের জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রামের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখানে যে হারে পাইরেসি হচ্ছে, তাতে পাইরেসি কালচার 'এস্টাবলিশড' হয়ে গেছে। এ ব্যাধি থেকে মুক্তির পথ হিসেবে 'অ্যান্টি-পাইরেসি স্টেপ' গ্রহণ করা দরকার। কপিরাইট ভায়োলেশনের ওপরও জোর দিতে হবে।
১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদদের পরামর্শে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সৃজনশীল বই কিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের অবিমৃষ্যকারিতায় এই প্রকল্প এখন বন্ধ হয়ে আছে। এটি চালুর উদ্যোগ এই শিল্পের জন্য নতুন প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে নিঃসন্দেহে।
সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্প্রতি নতুন আঙ্গিক লাভ করেছে। একাডেমির সীমিত পরিসর ছাপিয়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্রন্থমেলা বিস্তারের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন প্রকাশকদের যেমন সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে, তেমনি এ গোটা অঞ্চলে সৃষ্টি হবে সাংস্কৃতিক প্রণোদনা। গত ক'বছর যাবত মেলায় পাঠক সমাগম বৃদ্ধির বিবেচনায় মেলার পরিসর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একটি সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত। যদিও প্রকাশনার সংশ্রবহীন প্রতিষ্ঠানের মেলায় অংশগ্রহণের সমস্যা রয়েই গেছে।
পার্বণপ্রিয় বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে আর একটি নতুন পার্বণ, বই মেলা তথা বই-পার্বণ। তাই জাতীয় গ্রন্থনীতি ও জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি প্রণয়নের জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হলে সমস্যাগুলো দুর করা সহজ হত।
এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।