এবারের বই মেলা

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 26 Feb 2015, 04:58 PM
Updated : 26 Feb 2015, 04:58 PM

এবারের বই মেলাটা অন্যরকম। আগে কখনও টানা অবরোধ-হরতালে বই মেলা হয়নি। প্রথম প্রথম আমার একটু সন্দেহ ছিল, মানুষজন বই মেলায় আসবে কিনা। অবরোধ কিংবা হরতাল পালন করার জন্য মানুষজন বই মেলা বয়কট করবে সেটা কখনও ভাবিনি; কিন্তু পেট্রোল বোমা, ককটেলের ভয়ে লোকজন মেলায় এসে স্বস্তি পাবে কিনা সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। দেখা গেল, এ দেশের মানুষের পেট্রোল বোমা আর ককটেলের জন্যে যেটুকু ভয়, বইয়ের জন্যে ভালোবাসা তার থেকে অনেক বেশি।

আমি সিলেটে থাকি; শুক্র শনিবার বই মেলায় আসতে পারি। এবারে ছুটি নিয়ে পুরো সপ্তাহের জন্যে ঢাকা চলে এসেছিলাম বই মেলায় যাবার জন্যে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে এই বই মেলার কোন জিনিসটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, আমার উত্তরটি হবে খুবই সহজ; আমি বলব, সেটি হচ্ছে বই মেলায় উপস্থিত এই দেশের অতি বিচিত্র মানুষ।

মেলায় উপস্থিত থাকা অবস্থায় ঘড়ির কাঁটা যখন রাত আটটার কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে জিজ্ঞেস করি, "কী হল, আটটা বেজে যাচ্ছে, এখনও কিছু ঘটল না?''

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলে, "ঘটবে! নিশ্চয়ই ঘটবে।"

সত্যি সত্যি ব্যাপারটি ঘটে, আশেপশে কোনো জায়গায় বিকট শব্দ করে একটা ককটেল ফুটে। আমি মেলার শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়স্ক মানুষের দিকে তাকাই এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি একজন মানুষেরও একটু ভুরু পর্যন্ত কুঞ্চিত হয় না। দেখে মনে হয় তারা সেই বিকট শব্দটি শুনতেই পায়নি! যে যার মতা মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, বই দেখছে। ভয় দেখানোর জন্যে বোমা ফাটানোর পরও যদি কেউ বিন্দুমাত্র ভয় না পায়, তাহলে বোমাবাজদের জন্য তার থেকে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে?

তারপরও মেলাটি নিয়ে আমার ভেতরে একটা দুঃখবোধ আছে। আমার পরিচিত অনেকেই ঢাকার বাইরে থাকে। তাদের মাঝে অনেকেই লেখক। কেউ নূতন লেখক, কেউ অনেকদিন থেকে লিখে। বই মেলা এলে তারা দল বেঁধে বই মেলা দেখতে ঢাকায় আসে। এবারে তাদের অনেকেই বই মেলায় আসতে পারেনি। নিজের বই বের হয়েছে বইয়ের স্টলে, সেই বই দেখতে পারেনি। অবশ্যি এটা নিয়ে দুঃখ করলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। যখন এসএসসি পরীক্ষার জন্যে হরতালে ছাড় দেওয়া হয় না, তখন বই মেলা দেখতে আসার জন্যে ছাড় দেওয়া হবে সেটি আশা করার মতো উৎকট রসিকতা আর কী হতে পারে?

২.

পুরানো লেখালেখি ঘাঁটাঘাটি করে দেখলাম, বছরের এই সময়টাতে গত বছর ঠিক একইভাবে আমি বই মেলার উপর একটা লেখা লিখেছিলাম, লেখার দুটো বিষয় আলাদাভাবে চোখে পড়ল। গতবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে আমার খুব আশাভঙ্গ হয়েছিল; কারণ আমি লিখেছিলাম, বই মেলাকে মোটেও বই মেলা মনে হয়নি, মনে হয়েছে শুধুমাত্র বই বিক্রি করার জন্যে গাদাগাদি করে দাঁড় করানো কিছু বইয়ের স্টল! ঘিঞ্জি স্টলের ভেতর মানুষজন ঘেঁষাঘেষি করে হাঁটাহাঁটি করছে।

এবারে মেলায় এসে আমার সেই দুঃখ দূর হয়েছে। বিশাল এলাকা নিয়ে বইয়ের মেলা, সুন্দর স্টল, তার চাইতেও সুন্দর প্যাভেলিয়ন এবং তার বাইরেও সুন্দর হচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ফাঁকা জায়গা। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার জন্যে বাঁশের তৈরি বেঞ্চ। তার সাথে যদি চা-কফি খাওয়ার জন্যে একটি দুটি স্টল থাকত, তাহলে আমার কোনো দুঃখ থাকত না।

গত বছর আমার আরও একটি খুবই গুরুতর বিষয় নিয়ে দুঃখ ছিল; সেটি হচ্ছে, বাথরুমের অভাব। পরিস্কার বাথরুমের প্রয়োজনীয়তার উপর বিশাল একটা বক্তৃতা দিয়ে আমি লিখেছিলাম, "বাংলা একাডেমির বই মেলার বাথরুমের মতো কুৎসিত, জঘন্য, অপরিস্কার, অস্বাস্থ্যকর জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই!"

শুধু তাই নয়, কোনো একজন বিখ্যাত মানুষের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি বলেছিলাম, "যে জাতি যত সভ্য তাদের বাথরুমের সংখ্যা তত বেশি এবং তাদের বাথরুম তত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন!"

এবারের বই মেলা নিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, এক বছরে আমার অনেক বেশি সভ্য জাতি হয়ে গেছি, এই বই মেলায় ঝকঝক তকতকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বাথরুমের সারি। প্রকৃতির ডাকে যাদের বাথরুমে যেতে হয়েছে তাদের কাছে বইয়ের স্টলে সাজানো বইয়ের সারি থেকে সেই বাথরুমের সারি কম দৃষ্টিনন্দন মনে হয়নি!

৩.

বই মেলায় অনেক স্টল ছিল, আমি সেগুলোর ভেতর থেকে শুধু একটা স্টলের কথা আলাদা করে বলি। স্টলটির নাম 'স্পর্শ' এবং সেই স্টলের বইগুলো অন্যরকম। অন্যান্য স্টলের বইয়ের মতো সেগুলো চোখে দেখে পড়া যায় না, স্পর্শ করে পড়তে হয়। কারণ, বইগুলো ব্রেইলে লেখা। যারা চোখে দেখতে পায় না তাদের জন্যে আলাদাভাবে এই বইগুলো ছাপতে হয়। ছয়টি একটু উঁচু হয়ে থাকা ফুটকি দিয়ে ব্রেইল লেখা হয়, যারা দেখতে পায় না তারা ব্রেইলে লিখতে পড়তে শিখে। একটা বই তাদেরকে পড়ে শোনালে তার বিষয়বস্তুটা শুনতে পারে, বুঝতে পারে; কিন্তু তাতে তাদের লেখাপড়া শেখা হয় না, বানান শেখা হয় না, বাক্য গঠন শেখা হয় না।

তাই যেসব ছেলেমেয়ে চোখে দেখতে পায় না তাদের লেখাপড়ার জন্যে ব্রেইল বই দরকার। আমাদের দেশের দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েরা এক দিক থেকে খুব দুর্ভাগ্যের শিকার, তাদের জন্যে যথেষ্ট দূরে থাকুক, প্রয়োজনীয় ব্রেইল বইও নেই। দুই বছর আগে বই মেলায় আমার একটা কিশোর উপন্যাস একই সঙ্গে ছাপা বই এবং ব্রেইল বই হিসেবে বের হয়েছিল, আমার কাছে সেই ব্রেইল বইয়ের দুটি কপি রয়ে গিয়েছিল। আমি সেই বই দুটি উপহার হিসেবে সেই স্টলে নিয়ে গিয়েছিলাম।

স্টলে গিয়ে দেখি সেখানে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে স্কুলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে, তারা সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কিন্তু সবাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। আমি বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্যে লিখি, এই বয়সী ছেলেমেয়েরা অনেকেই আমার লেখা পড়েছে। ব্রেইলে আমার বই একটির বেশি দুটি আছে কিনা আমার জানা নেই। তাই এই ছেলেমেয়েরা আমার কোনো বই পড়েছে কিনা সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু আমি খুবই অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, এই ছেলেমেয়েদের কাছে আমার পরিচয় দেওয়া মাত্রই তারা আমাকে চিনতে পারল এবং আমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠল। বেশ অনেক ক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে তাদের সাথে কথা হল, তারা আমাদেরকে খুব সুরেলা গলায় গান গেয়ে শোনাল।

দেখতে দেখতে ছোট স্টলের সামনে বেশ ভিড় জমে গেল, সাংবাদিকেরা নোট বই এবং ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং কোথা থেকে যেন একটা টেলিভিশন চ্যানেলও তাদের ক্যামেরা নিয়ে হাজির হল। আমি তখন অনেকদিন থেকে যে স্বপ্নটা লালন করে এসেছিলাম, সেই ঘোষণা করে এলাম। সবাইকে সাক্ষী রেখে বলে এলাম, এখন থেকে যখনই আমি কিশোর-কিশোরী বা ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু লিখব, প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি দেবার আগে তাদের জন্যে একটা শর্ত জুড়ে দেব, একই সাথে সেই বইটি ব্রেইলও বের করতে হবে। অন্য যারা কিশোর-কিশোরী বা ছেলেমেয়েদের জন্যে লিখেন তাদের সবাইকেও একই কাজ করতে বলব।

তাহলে দেখতে দেখতে আমাদের দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্যে ব্রেইল বইয়ের বিশাল একটা ভাণ্ডার গড়ে উঠবে। সবাই যদি এগিয়ে আসে তাহলে, পরের বছর বই মেলায় হয়তো 'স্পর্শ' প্রতিষ্ঠানটি ছোট একটি স্টল নিয়ে কুলাতে পারবে না। ব্রেইল বইয়ের বিশাল ভাণ্ডারের জন্যে মস্ত একটি প্যাভেলিয়ন নিতে হবে!

আমি যখন ছেলেমেয়েরে কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি তখন তারা বলল, "স্যার, একটা অটোগ্রাফ!"

আমি ব্রেইলে অটোগ্রাফ দিতে পারি না; তাই সাধারণ কাগজে সাধারণ কলমের অটোগ্রাফ দিয়ে এসেছি, তারা সেই পেয়েই যথেষ্ট খুশি। এই বয়সটাই মনে হয় আসলে খুশি হওয়ার বয়স।

৪.

বই মেলায় গেলে সবারই নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। আমার ধারণা, আমার অভিজ্ঞতাটা অন্য অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে বেশি চমকপ্রদ। তেমন, আমি একটি বই না কিনেই বইয়ের বিশাল বোঝা নিয়ে বাসায় ফিরি। নূতন লেখকেরা আমাকে তাদের বই উপহার দিয়ে যান, সব বই আমার পড়া হয় না, কিন্তু বইগুলি আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি এবং প্রায় সময়েই আমার নিজের প্রথম বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমি আমার প্রথম বইটি হাতে নিয়ে যে উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম, এই নূতন লেখকেরাও নিশ্চয়ই সেই একই উত্তেজনা অনুভব করেন।

কিছু কিছু বইয়ের পেছনের কাহিনি অবিশ্বাস্য। যেমন একটি মেয়ে ভিড়ের ভেতর আমাকে তার নিজের হাতে লেখা একটি বই দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাসায় এসে বইটি খুলে দেখি, তার গ্রামে সবাই তাকে 'খারাপ মেয়ে' হিসেবে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে সে তার জীবনের ইতিহাসটুকু লিখে বই হিসেবে ছাপিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছে! বই লেখার এই কাহিনি দিয়েই নিশ্চয়ই একটি বই লিখে ফেলা যায়।

বই মেলায় গিয়ে আমি যেসব বই উপহার পাই তার একটা অংশ থাকে আমাকে উৎসর্গ করা বই। এই বৎসরটি সেই হিসেবে আমার জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই বছরে আমার ঢাকা কলেজের শিক্ষক প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্রীর লেখা বই আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে! কতজনের এত বড় পরিসরের মানুষজনের কাছ থেকে বই উৎসর্গ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়!

৫.

বই মেলাতে সবকিছুই যে ভালো তা নয়। কিছু কিছু খুব খারাপ ঘটনা ঘটে। মানিব্যাগ, মোবাইল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তার মাঝে একটি, আমি অবশ্যি সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। পকেট মারা সম্ভবত পৃথিবীর আদিমতম পেশাগুলোর একটি। আমার মা যখন হজ্জে গিয়েছিলেন, সেই খানে তার পকেট মেরে দিয়েছিল। আমার সাদাসিধে মা লজ্জায় বহুদিন সেই ঘটনার কথা আমাদেরকে বলেননি। শুনেছি, হজ্জের সময় প্লেন ভরে এই দেশের অনেক বিখ্যাত পকেটমার মক্কায় পকেট মারতে যায়!

কাজেই বই মেলায় ভিড়ের মাঝে কিছু পকেটমার উপার্জন করার জন্যে আসবে না সেটা তো হতে পারে না। লেখক, প্রকাশক, চিংড়ি মাছের মাথা বিক্রেতা, চুড়িওয়ালা, পাইরেটেড বই বিক্রেতা, নতুন লেখকদের ফাঁকি দেওয়া প্রকাশকরূপী প্রতারক, ককটেল ফোটানোর সাব-কন্ট্রাক্ট নেওয়া ছিন্নমূল তরুণ– সবাই যখন কিছু অর্থ উপার্জন করে নিচ্ছে, তখন পকেটমাররা বাকি থাকবে কেন?

তবে বই মেলার (কিংবা অন্য যে কোনো মেলার) যে বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দেয় সেটি হচ্ছে, ভিড়ের সুযোগ নিয়ে কিছু পুরুষ যখন মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা দাঁতে দাঁত চেপে এগুলো সহ্য করেছে, আজকাল করে না। ভিড়ের কারণে সব সময় তারা মানুষটিকে ধরতে পারে না, কিন্তু যদি ধরতে পারে তাহলে তার কপালে বড় ধরনের দুঃখ থাকে। এই বই মেলাতেই 'ঢিসুম' শব্দ শুনে দেখি, একটি কমবয়সী মেয়ে একজন তরুণের নাকে ঘুষি মেরে দিয়েছে, তারপর ঘুরে অন্য আরেকজনের নাকে! আরেকটি 'ঢিসুম'!

(এই বই মেলাতেই আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় ছাত্রীকে একটা বই উৎসর্গ করেছি। আমি ছাত্রীদের কথা দিয়েছিলাম যারা প্রথম ব্ল্যাক বেল্ট পাবে, আমি তাদেরকে একটা বই উৎসর্গ করব! আমি আমার কথা রেখেছি। কাজেই মেয়ে দেখলেই যাদের হাত নিশপিশ করে, তারা সাবধান, কখন একজন ব্ল্যাক বেল্টের হাতে পড়ে তুলোধুনা হয়ে যাবে কে বলবে?)

যাই হোক, মন খারাপ করা একটা বিষয় দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই না। একটা মজার ঘটনা বলে লেখা শেষ করি। আজকাল পাঠকরা লেখকদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে খুবই আগ্রহী। যারা সত্যিকারের লেখক তাদের সত্যিকারের পাঠক থাকে এবং সেই পাঠকরা তাদের লেখকদের কাছ থেকে মোটামুটি একটা সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় অটোগ্রাফ নিয়ে থাকেন।

আমি যেহেতু কমবয়সী ছেলেমেয়েদের জন্যে লেখালেখি করি আমার অবস্থাটা একটু ভিন্ন। আমার পাঠকেরা কমবয়সী এবং তাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার প্রক্রিয়া যথেষ্ট আদিম। তারা অটোগ্রাফ নেবার জন্যে ঘিরে ধরে, চেপে ধরে, ধাক্কাধাক্কি করে, চিৎকার করে এবং প্রয়োজন হলে হুমকি দেয়। মাঝে মাঝে তাদের দেখে মনে হয়, অটোগ্রাফ নামের এই অতি বিচিত্র বিষয়টি নিতে না পারলে তাদের জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে।

তবে অটোগ্রাফ নিয়ে আমার অতি বিচিত্র অভিজ্ঞতাটি হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুর বেলা। অনেকেই আমাকে ঘিরে ধরেছে এবং তাদের সবাইকে ঠেলে একজন তরুণ এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "সাইন করে দেন।"

আমি অন্য কারও বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলাম, বললাম, "এটা শেষ করেই দিচ্ছি।"

তরুণটির ধৈর্য্য নেই, ছেলেটি বলল, "সাইন করে দেন।"

আমি বললাম, "একটু দাঁড়াও।"

কিন্তু তার দাঁড়ানোর সময় নেই। রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলল, "সাইন করেন।"

অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি তার কাগজে অটোগ্রাফ দিলাম। তরুণটি কাগজটি হাতে নিয়ে মোবাইল বের করল। আজকাল সব মোবাইলেই ক্যামেরা থাকে, সে সেই ক্যামেরায় ছবি নিয়ে ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আপনি কে? আপনার নাম কী?"

বই মেলায় প্রতিদিনই এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটে, আর আমার মনে হয়, আহা, বেঁচে থাকাটা কী মজার!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।