গণতান্ত্রিক সংবিধান ও চা-চক্রের অরাজনৈতিক শক্তি

রিফাত হাসান
Published : 29 March 2011, 02:32 PM
Updated : 29 March 2011, 02:32 PM

সংবিধান বানানো ও সংশোধনের ব্যাপারটাকে চায়ের টেবিলে নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা পুরোপুরি একটি অরাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা খুবই জরুরী। বাংলাদেশে বর্তমানে চায়ের টেবিলে বসে সংবিধান বানানো ও সংশোধনের নামে রাষ্ট্রের উপর দলীয় খায়েশ ও দলের স্বার্থ সংশ্লষ্ট ইচ্ছে-অনিচ্ছে চাপিয়ে দেয়ার যে উন্মাদনা চলছে, তার বিষয়ে আমাদের নাগরিকতার জায়গা থেকে একটি পর্যালোচনা খাড়া করানো এই লেখার অভিমুখ। আমরা একই সাথে মনে রাখছি, এটি বাংলাদেশে পূর্বাপর দলীয় দুর্বৃত্তপনার ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সাথে মিলিয়ে পাঠ করার বিষয়। রক্তাক্ত প্রতিরোধ সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজি ১৯৭১ সালে 'স্বাধীনতা' লাভের পর থেকে এই পর্যন্ত ঐতিহাসিকভাবে শাসকগোষ্ঠি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংবিধান নিয়ে ধারাবাহিক অপকর্ম করেছে, ফলশ্রুতিতে এই সংবিধান আর এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির জন-ইচ্ছের দলিল হিশেবে হাজির নেই। কাজেই গণতান্ত্রিক এবং প্রায়োগিক বিচারে সংবিধান নামের এই বস্তুটি বর্তমান বাংলাদেশে নষ্ট অর্থহীন কাগজের দলাতে পরিণত হয়েছে। বিশেষত সংবিধান পুনর্মুদ্রণের সাম্প্রতিক জগাখিচুড়ি ঘটনাবলিতে- কতকটা 'মহামান্য' বিচার বিভাগের আদেশে, কিছুটা 'সার্বভৌম' সংসদীয় কমিটির ইচ্ছেয়, এটি এর আইনগত ও বাস্তবিক অস্তিত্বের (de jure and de facto) ব্যাপারেও নাগরিকদের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রম ছড়িয়েছে।

মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় দুর্বৃত্তপনার কারণে রাষ্ট্রের আরম্ভ-বিন্দুকে বৈধভাবে চিহ্ণিত করার দলিল এবং বিদ্যমান যাবতীয় আইনের প্রাণবিন্দু হিশেবে বিবেচিত এই বস্তুটি বাংলাদেশে কতো ঠুনকো, খেলো এবং অনর্থ-উপসর্গ হিশেবে পরিণত হয়েছে তা এই ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট।

দেখা যাচ্ছে, চায়ের আড্ডায় সংবিধান বানানো বা সংশোধনের বর্তমান যজ্ঞে ক্ষমতাসীন দল বিচার বিভাগের হাতিয়ার নিয়ে প্রায় এককভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আবার, একই সাথে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলও তাদের অংশগ্রহণের ইচ্ছে বেশ কয়েকবার বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছে। সর্ব সম্প্রতি সংসদে বিএনপি নেতা মওদূদ আহমদের দলীয় অবস্থান ব্যখ্যা করে দেয়া বক্তব্য দ্রষ্টব্য হিশেবে আসতে পারে: 'বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সংবিধানে সংশোধনী আনা হলে তা আমরা প্রত্যাখ্যান করবো'।

মানে, এই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, একই পদ্ধতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। শুধু তাদের চাওয়াটি হল এই সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিনিধিকে সাথে নেওয়া। সংবিধান কাটাছেড়া করার এই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর কোন আপত্তি নেই বা আইনি ও রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরি করার ইচ্ছে নেই। এই কথাটি তাদের উপরোল্লেখিত বক্তব্য এবং আগের প্রতিক্রিয়াগুলোতেও স্পষ্ট। মূলত বিরোধী দলের এই প্রতিক্রিয়ায় শুধু দলীয় ভাগ-বাটোয়ারার ইচ্ছেটাই প্রবল। তাদের কাছে আওয়ামীলীগ আর বিএনপির দলীয় সমঝোতাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের সমার্থক।

তাহলে, নাগরিকতার জায়গা থেকে, এই দলীয় ভাগ-বাটোয়ারার সংবিধান, যেটি আওয়ামীলীগ প্রণয়ন করবে বা বিএনপি মেনে নেবে বা মানবে না বা আবার কাটাছেড়া করবে- এর একটা রাজনৈতিক বিচার জরুরী। উভয় দলের পুরো প্রক্রিয়াতেই নাগরিক হিশেবে এই আমরা কোথায়, কোন জায়গায় অবস্থান করছি বা আদৌ আছি কিনা- সেটি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ বা অনিচ্ছুক হলেও এই দলীয় ভাগ-বাটোয়ারার সংবিধান ও তৎপ্রসূত রাষ্ট্র যা আমাদের সামনে জগদ্দলরূপে দাঁড়িয়ে আছে, তার ব্যাপারে আমাদের একই সাথে আইনি এবং রাজনৈতিক-বৈপ্লবিক বোঝাপড়া তৈরির জন্য যুগপৎ আলোচনা পর্যালোচনা ও তৎপরতা চালানোর কর্তব্য আছে। এটি কোন রাষ্ট্রের খোলনলচে পাল্টানোর মত বৈপ্লবিক কাজ না হলেও, বিদ্যমান রাষ্ট্রে যে অধিকারে নাগরিক হিশেবে আমরা বসবাস করছি, সেই একই অধিকারে ন্যূনতম নাগরিকতার অনিবার্য দাবী। একটি নতুন সংবিধান না হোক, নিদেন পক্ষে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য নাগরিকের কাংখা তো থাকতেই হবে। নইলে নাগরিক যে বিষয়গুলোর ভিত্তিতে 'নাগরিক'- তার মৌল উপাদানগুলো প্রতিনিয়ত শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক অপমানিত-অবদমিত হবে, কোন সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ছাড়াই।

মূলত নাগরিক অধিকারের জায়গা থেকে গণতন্ত্র একটি আপাত ভাল রক্ষাকবচ, যদিও এই রক্ষাকবচের বেশিরভাগ অংশই তত্ত্বীয় শোরগোলে সীমাবদ্ধ। এই শোরগোলশুদ্ধ গণতন্ত্রের মোটা দাগের লোভনীয় দিকটি হলো, এটি ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছা ও স্বাধীনতার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলে বেড়ায়। তাহলে যখন শাসকশ্রেণী বা অন্য কেউ জনগণের এই সার্বভৌম ইচ্ছেকে অস্ত্রের জোড়ে বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে বা সাংবিধানিকভাবেও দাবায়ে রাখতে উদ্যোগী হয়, সেই নিপীড়ককে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অপসারণ করার অধিকারকেও স্বীকার করে নিতে বাধ্য গণতন্ত্র। মানে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। যদিও এমন অধিকার স্রেফ একটি কাগুজে সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ হতে পারে না কখনোই, জনসম্মত এবং আস্থাই এমন অধিকারের বৈধতা তৈরি করে। সেজন্য যে কোন সফল গণঅভ্যূত্থানকে সাংবিধানিক বৈধতা-অবৈধতা দিয়ে মাপার প্রয়োজন পড়ে না, বরং এই অভ্যুত্থান থেকে যে গণসম্মতি তৈরি হয় তার ভিত্তিতে কখনো কখনো নতুন সংবিধান বানানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে 'অবৈধ'- এমন বিচার ধোপে টেকে না। এটি নিজেই নিজের বৈধতা ঘোষণা করে।

আমাদের আলোচনায় এ পর্যায়ে কিছু ইতিহাসের বরাত নেয়া প্রয়োজন। আমরা পূর্বেই মনে রেখেছি, এটি বাংলাদেশে পূর্বাপর ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সাথে মিলিয়ে পাঠ করার বিষয়। উপমহাদেশের ইতিহাসে চায়ের আড্ডায় আলোচনা সেরে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে 'স্বাধীনতা'র মোয়া ভিক্ষা ও ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী কাম ভারতীয় নেতৃবৃন্দের যৌথ ইচ্ছে-অনিচ্ছেতে দেশ বিভাগ ও ভূখণ্ড ভাগ-বাটোয়ারার ঘটনা আছে। এই ধরণের ঘটনায় ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত মর্মার্থ- এদেশের মানুষের হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভিতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়ন ও শক্তির জায়গাগুলো উপেক্ষিত হয়েছে বলে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলি। সেই চা-চক্রের খেসারত হিশেবে বিশ বছরের অধিক কাল বাংলার ভূখণ্ড 'পূর্ব পাকিস্তান' হিশেবে থাকলেও তার পরে এদেশের জনগণের গণইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে ইংরেজি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে। ইতিহাস থেকে শিক্ষার কারণে, এদেশের জনগণ কাউকে দেশবিভাগের মত হঠকারী উপায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মীমাংসা চায়ের টেবিলে সারার সুযোগ দেয় নাই। যদিও সেসময়কার দলীয় নেতৃত্ব সবসময় চায়ের টেবিলে ও ক্ষমতার ভাগাভাগিতেই গণ-ইচ্ছের টুঁটি চেপে ধরার প্রয়াস খুঁজছিলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জনগণ স্বেচ্ছায় গণপ্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নেতৃত্বের এমন ইচ্ছেকে সফল হতে দেয় নাই। প্রতিরোধ সংগ্রামে এদেশের জনগণ জয়ী হবার পর, আবারো তাদের উপর সেই চা-চক্রের অগণতান্ত্রিক শক্তি এবং তাদের প্রণীত সংবিধান চেপে বসে, যাকে আমরা ভক্তিভরে ৭২ এর সংবিধান নামে ডাকি। হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং বক্তব্য অনুযায়ী ইংরেজী ২০১১ সালের বর্তমান বাংলাদেশ এখন ৭২ এর সংবিধানেই বিরাজ করছে। পাকিস্তানের সংবিধান সভার জন্য নির্বাচিত আওয়ামীলীগের সদস্যগণ কর্তৃক গৃহীত এই সংবিধানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্নগুলি, অথবা একটি স্বাধীন দেশের হৃদয়ের ভিতর থেকে কেন নতুন সংবিধান সভা আহ্বান করা হলো না, সেই বিতর্ক এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরী প্রশ্ন হলেও, সেই সময়ে প্রণীত সংবিধানের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের কথাটির আলোচনা আরো বেশি জরুরী। এটি এমনই এক অগণতান্ত্রিক ও অথর্ব সংবিধান ছিলো, এর প্রণেতা বালাদেশের তৎকালীন নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রে নিজের চিরস্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কলমের এক খোঁচায় চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এর ফাঁসি কার্যকর করেন। যার কোন প্রতিরোধ বা প্রতিকার এই সংবিধান নিজের ক্ষমতা-পরিধিতে করতে পারে নাই। ফলত মুজিব-জিয়া-এরশাদ সবাই এই সংবিধানকে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও বৈধতা নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করেছেন। রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিতর দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের সম্ভাবনা এভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল চা-চক্রের কুশিলবদের হাতে।

অতঃপর নব্বুই এলো। স্বাধীনতার পর নব্বুইয়ের গণ আন্দোলন এদেশের ইতিহাসের আর একটি প্রত্যুষমুহূর্ত সন্দেহ নেই। সেই প্রত্যুষমুহূর্তে আবার এদেশের সচেতন বুদ্ধিজীবীমহল ও জনগণ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের আশায় আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের ঘণ্টাধ্বণি আবার নাড়িয়ে দিতে সবাই প্রস্তুত। কিন্তু দেখা গেল, সেই সম্ভাবনার মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের এক অগণতান্ত্রিক এলিট ভূত এসে চেপে বসল বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ের উপর। সাংবিধানিক বিতর্কের আসরে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণার গণতান্ত্রিকতাকে প্রশ্ন করে- এমন আলোচনাগুলোকে প্রাসঙ্গিক করতে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল এবং সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বরং তার সুযোগ নিয়েছে। নিজ নিজ দলীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ধান্ধায় তারা এই সরকারব্যবস্থাকে বাতিল অথবা জারি করার মতলবে থাকছে সবসময়- গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত, মৌলিক মানবাধিকার হরণ ও এ সংক্রান্ত বিতর্কগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে । লক্ষ করার বিষয়, বর্তমানে আদালতের মর্যাদা রক্ষার নামে 'আদালত অবমাননা' আখ্যা দিয়ে এক ধরণের জুরিস্টোক্রেসি বা বিচার বিভাগীয় অভিজাততন্ত্র সক্রিয়ভাবে বহাল আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায়। এটি বহুলাংশে আমাদের সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের বিপরীতে হুমকি হিশেবে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাতেই বাংলাদেশে এই বিচারবিভাগীয় অভিজাততন্ত্রের বীজ। এই ব্যবস্থাতে সব রাজনীতিবিদ বা নাগরিকের বিপরীতে বিচারপতিদেরকে ঐশ্বরিক পবিত্রতা দেয়া হয়েছিল। জেনে রাখা ভাল, এই পবিত্র ঈশ্বরগণকে আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রের বিপরীতে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছে, যার কারণে হাইকোর্টে রীট অধিকার নিয়ে নাগরিকগণ ফরিয়াদি বনে যায়। দেখা যাচ্ছে, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-বলে তাঁরাই এখন সেই রীটের অধিকারসম্পন্ন নাগরিকগণকে 'আদালত অবমাননা'র অযুহাতে বিনা বিচারে কাটগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে, অথবা যেমন ইচ্ছে সাজা দিয়ে, এমনকি অ-আদালতীয় ভাষায় অপমানও করছেন কোন কোন ক্ষেত্রে। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নাগরিক অধিকার হননের বিরুদ্ধে আইনি বা সাংবিধানিক প্রতিকার কোন কর্তৃপক্ষ দেবেন, আমাদের অগণতান্ত্রিক সংবিধানে সেই কথাটিও স্পষ্ট নেই। আবার এই একটি ব্যবস্থাবলেই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এখন দলীয় রাজনীতির আখড়া ও ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মূলত, সেই নব্বুইয়ে যখন মাঠেই সব সমাধা হবার কথা, জনতা অধীর আগ্রহে নতুন বৈপ্লবিক সংবিধানমুহূর্তের জন্য তৈরি, তখন আবার সেই চা-চক্রের অগণতান্ত্রিক শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ফলে গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী সরকারের পরিবর্তে বাংলাদেশ পেল ক্ষমতার হরিলুট ও দলীয় ভাগবাটোয়ারার চা-চক্রে সালিশদারের ভূমিকা নেয়া 'নির্দলীয়', 'নিরপেক্ষ' তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অথচ সচেতন বুদ্ধিজীবীদের কারো কারো লেখায় ইশারায় সেদিন নব্যগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন সংবিধান কীভাবে হবে, তা নিয়ে বিস্তর স্বতঃস্ফূর্ত আলাপ চলছিল। তাঁরা খুব সচেতন ছিলেন, অন্দোলনের মাধ্যমে ছাড়া অন্য কোন উপায়ে, চায়ের টেবিলে সরকার পরিবর্তনের আত্মঘাতি বিপদ সম্পর্কে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে এই কিম্ভূত সরকার পদ্ধতির কথাবার্তা-ইশারাগুলো বাতাসে চাউড় হবার আগেই তারা হুশিয়ার করে দিচ্ছিলেন, 'যে কোন অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবার ব্যাপার নয়, হয়ে উঠবার ব্যাপার। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংস্থাই বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার অভিপ্রকাশ হয়ে ওঠে এবং এটিই অন্তর্বর্তী সরকার হিশেবে আবির্ভূত হয়।' বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখিতে এমন প্রস্তাবও এসেছিল: 'এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কোন সার্বভৌম সংসদ বা গণপরিষদ গঠন নয়, একটি সংবিধানসভা ডাকা। যেখানে নবোদ্ভূত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হবে। এবং এই সংবিধানের নির্দেশিত নিয়মেই সংসদ বা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে সরকার পরিচালনার জন্য'। কিন্তু এই সব কণ্ঠস্বর ইশারায় দলবাজিতার ভবিষ্যত অন্ধকার দেখে ঘটনার নায়ক খলনায়করা কেউ সাড়া দিলো না। অবশেষে অরাজনৈতিক শক্তির তৎপরতায় সেইসব তর্ক-আলাপ-গণ-আন্দোলন ভেস্তে গেলো। বিপরীতে একটি গণঅভ্যুত্থানের ঘাড়ের উপর সওয়ার হয়ে জন্ম নিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে এক বিচার বিভাগীয় অভিজাততন্ত্র- যার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি উভয় অবস্থাই একই সাথে বর্তমান বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিপদ হিশেবে প্রতিপন্ন করতে চাচ্ছে বিশেষ মহল।

অতএব, বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের এতদিন পরেও কেন আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান বা সমাজের উন্মেষমুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হতে পারলাম না, তার জন্য আরো বিস্তর তর্ক-বিতর্ক- আলাপ শুরু করা দরকার আমাদের। সাথে সাথে বর্তমান বাংলাদেশে আবার দলীয় ভাগ-বাটোয়ারার সংবিধান সংশোধনের যে উন্মত্ততা ও প্রতিযোগিতা চলছে, নাগরিকতার জায়গা থেকে তার মৌলিক বাঁক ফেরানোর জন্য বিতর্ক করা ও তৎপরতা চালানো এই মুহূর্তের সবচেয়ে ফরজ কাজ। সংবিধান সম্পর্কিত যে কোন নতুন বিতর্ককে দলবাজির দৌরাত্ম্যে বুদ হয়ে থাকা অবস্থা থেকে রাষ্ট্র ও তার সংবিধানকে মুক্ত করে এনে একটি গণতান্ত্রিক ও কার্যকর সংবিধানের জন্য মৌলিক বিতর্কসমূহের জায়গায় দাঁড় করানো জরুরী। এ সম্পর্কে নিজেরা হুশিয়ার থাকা এবং একই সাথে জনগণকে হুশিয়ার করাও আমাদের নাগরিক কাজ। এইসব দলীয় বাখোয়াজের সংবিধান সংশোধন এবং প্রণয়ন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে কোন কাজে আসবে না। বরং আরো কিছু অভিজাততন্ত্র বাড়াবে, জনগণের আরো কিছু অধিকারকে সীমিত করবে। আরো কিছু অগণতন্ত্র হবে। একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য আমাদের অপেক্ষা আরো প্রলম্বিত হতে থাকবে।

ফুটনোট:

১. বিস্তারিত দেখুন: সমঝোতা ছাড়া সংবিধান সংশোধন প্রত্যাখ্যান করবে বিএনপি। বিডিনিউজে খবরের লিঙ্ক। http://www.facebook.com/l.php?u=http%3A%2F%2Fwww.bdnews24.com%2Fbangla%2Fdetails.php%3Fid%3D153540%26cid%3D3&h=ad047
২. ভারতের নর্মদা নদীতে বিতর্কিত বাঁধ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখার দায়ে 'আদালত অবমাননা'য় কনভিকটেড হবার পর ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতি রায় বিচার ব্যবস্থার এই কিম্ভূত লর্ডশিপের বিষয়টিকে 'জুরিস্টোক্রেসি' অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে কোন একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মতই এটি বিপজ্জনক। অবশ্যই, আদালতের এই নতুন অভিজাততন্ত্রের বিষয়টি এর মধ্যেই একাডেমিশিয়ানদেরও বিস্তর নজরে এসেছে যার কারণে এমন প্রশ্নও হাজির হয়েছে যে, বিচারকগণ কি আমাদের স্বাধীনতা হাইজ্যাক করে নিচ্ছেন? যেমন ধরুন এ সংক্রান্ত একটি স্টাডির শিরোনাম হলো, ফ্রম ডেমোক্রেসি টু জুরিস্টোক্রেসি- মানে, গণতন্ত্র থেকে বিচারবিভাগীয় অভিজাততন্ত্র। বিষয়টি গুরুত্বতো বটেই- কারণ এই জায়গায় এসে আইন, প্রতিষ্ঠান, ন্যায়বিচারের ধারণা গুবলেট পাকাতে পারে- যদি কোনরকম অস্পষ্টতা ও অতিভক্তিতে নিমজ্জিত হওয়ার ইচ্ছে থাকে এর কোনটির প্রতি।
৩. ৩ মার্চ বৃহস্পতিবার ২০১১ তারিখে বয়োজেষ্ঠ্য লেখক কলামিস্ট জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদকে বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেন সমন্বয় গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ 'অশিক্ষিত', 'বর্বর', 'নির্বোধ', 'হরিদাস পাল', 'আহম্মক', 'সে', 'দুই দিনের বৈরাগী' ইত্যাদি সম্বোধনে ডাকেন এবং আড়াই ঘণ্টা ধরে এজলাসে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এ সময় আদালত 'একে আমরা ছাড়ব না তাকে জানতে হবে, আমরা কী করতে পারি'- এমন উক্তিও করেন। সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো, আমার দেশ ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা: মার্চ ৪, ২০১১। তার আগে, ১৯ আগষ্ট ২০১০ বৃহস্পতিবার সাবেক সচিব আসাফউদ্দৌলাকে চার ঘন্টা এজলাসে দাঁড় করিয়ে রাখেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ। একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যদানকালে 'বিচারপতিদের দেবতূল্য কেন মনে করতে হবে, কোনো বিচারক ঘুষ নিলে কেন তা বলা যাবে না, এটি বললে কেন আদালত অবমাননা হবে'- এমন প্রশ্ন করায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি ও তীব্র ভর্ৎসনা করা হয়। সূত্র: নয়া দিগন্ত, ২০ আগষ্ট, ২০১০। তার আগের দিন ১৮ আগষ্ট ২০১০ বৃহস্পতিবার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বর্তমান প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে 'চান্স এডিটর' বলে বিদ্রুপ করেন। সূত্র: দৈনিক আমার দেশ ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা, ১৯ আগস্ট, ২০১০।
৪. ফরহাদ মজহার। সংবিধান ও গণতন্ত্র: 'ঘোড়ার জীন মাটিতে লাগে না, রাজাবাবুকে চড়ে বসলেই হোল' অথবা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয় কীভাবে? পৃষ্ঠা ২৭-৩১। আগামী প্রকাশনী।
রিফাত হাসান : আইন, ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে লেখালেখি করেন।