ক্যাপ্টেন নূরুল আবসার: যে মৃত্যু জন্ম দেয় স্বাধীন জীবনের

সাকিনা হোসেন
Published : 3 Jan 2011, 11:35 PM
Updated : 26 March 2011, 06:55 AM

আজ আমি এমন একজন নির্ভীক, সাহসী, দেশপ্রেমিকের কথা বলবো যিনি আমাদের গর্ব। তিনি  আমার অতি প্রিয় ছোট চাচা শহীদ ক্যাপ্টেন এ. কে. এম নুরুল আবসার । উনি শুধু আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছেই তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র। উনি  ছিলেন অফুরান ভালবাসার ভাণ্ডার। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে উদারভাবে দান করতেন সেই ভালবাসা।

এদেশটাকে উনি ভীষণ ভালবাসতেন, সেটা ওনার কথাতেই বুঝতাম। যদিও তখন আমার বয়স ছিল ১০/১১ বৎসর । উনি তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। যখনই (পূর্ব পাকিস্তান) দেশে আসতেন আমাদের বাসায় কিছূদিন থাকতেন, তারপর দেশে দাদা-দাদীর কাছে চলে যেতেন। ওনার প্রতিটি স্মৃতি আমার কাছে অম্লান। ওনার একটা কাজ সবসময় আমাকে দিয়েই করাতেন। তাহলো ওনার মাথায় একটা তিন ইঞ্চি পরিমান আঁচিল ছিল। আমাদের বাসায় আসলে প্রত্যেকবারই উনি আমার কোলে মাথা রেখে ঐ আঁচিলটি থেকে মরাচামড়া  পরিষ্কার করে দেওয়ার কথা বলতেন। আব্বার কাছে বলতে শুনতাম যে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মিরা বাঙালি আর্মিদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতো যা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। ফলে সবসময়ই পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মিদের সাথে ওনার লেগে থাকতো। সেই কথাগুলো শুনতে আমি খুবই রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। আর তাই ঐ ঘটনাগুলো শুনতে চাইতাম । পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার সময়ে যে সব ঘটনাগুলো ঘটতো আমাকে তিনি তা বলতেন আর আমি উনার সেই আঁচিলটি পরম ভালবাসার সাথে পরিষ্কার করতে থাকতাম। দেশের প্রতি ওনার ভালবাসা দেখে আনন্দে আমার বুকটা ভরে উঠত। দেশের প্রতি ভালবাসা খুব সম্ভবত ওনার  কাছে থেকেই শিখেছি। দেশকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতেন বলেই হয়তো এতো নির্ভীকভাবে জীবনের এতো বড় ঝুঁকি নিয়ে ২০টা ট্যাংক একেবারে বিকল করতে পেরেছিলেন।

আমার সাথে ওনার শেষ দেখা ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।  তখন একদিন উনি সকাল ১০/১১ টার দিকে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। সেদিন খুব সম্ভবত রবিবার ছিল।  উনি আব্বাকে বললেন দেশে (পূর্ব পাকিস্তান ) খুব সম্ভবত একটা গণ্ডগোল হবে। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক ট্যাংক আসছে পূর্ব পাকিস্তানে। ট্যাংক আনছে দেখেই ওনার সন্দেহ হয়েছিল যে একটা যুদ্ধ হতে পারে যদি ভূট্টো হেরে যায়। আর আমার ভাইকে বলেছিলেন যে যুদ্ধ যদি বেধে যায় তাহলে আমার ভাই যেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এবং কাঁচের বোতলের ভিতরে কী কী দিয়ে বোমা বানাতে হয় তা শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। ওনাকে সেদিন খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছিল। কারণ সে দিন ওনার আচরণটা ছিল খুবই গম্ভীর । যেটা আমার কাছে ছিল একদম অপরিচিত। কারণ সবসময় ওনাকে দেখেছি অনেক হাসিমুখ,  অনেক গল্প করতেন, দুষ্টামি করতেন আমাদের সাথে।

আমরা চাচার কথাগুলো বার বার মনে হচ্ছিল। এপ্রিল মাসের ১ তারিখে নানী আমাদেরকে নানীর বাসায় পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে নিয়ে গেল । আব্বা একা ওয়াপদা রোডের বাসায় রয়ে গেলেন। এপ্রিল মাসেই আমরা নানীর পুরো ফ্যামিলি, সব মিলে ৭৫ জন আমরা নানার দেশের বাড়ী নরসিন্দির রায়পুরা থানার পাড়াতলীতে চলে গিয়েছিলাম। আব্বা ঢাকাতেই রয়ে গেলেন। কারণ আমার আব্বা চাকুরীজীবী ছিলেন। তখন জেমস্ ফিনলে কোম্পানীতে কাজ করতেন। কাজ না করলে কীভাবে আমাদের সংসার চলবে ? কি যে কঠিন বাস্তবতা সেই ছোটবেলা থেকে দেখতে পেলাম। যাই হোক আমি অন্য দিকে চলে যাচ্ছিলাম। আমার চাচার কথাতেই ফিরে আসি। আমার ছোট চাচা, মজনু ওনার ডাকনাম ছিল। উনি এপ্রিল মাসে, খুব সম্ভবত প্রথম সাপ্তাহের দিকে আমার মেঝ চাচা রব্বানীর বাসায় এসে ২/ ৩ দিন ছিলেন। আর্মিরা ওনাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। সকালে বিকেলে আবার পাহারা দিয়ে রব্বানী চাচার বাসায় দিয়ে যেতো। যতক্ষণ উনি রাব্বানী চাচার বাসায় থাকতেন ততক্ষণই ঘরের বাইরে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মি ও সি. আই .ডি সিভিল ড্রেসে পাহারা দিয়ে রাখত। চাচার বাসা থেকে যাওয়ার পরপর উনি মানে মজনু চাচা একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পালিয়ে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন কারণ উনি পালিয়ে গেলে আমার রাব্বানী চাচার ফ্যামিলিকে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মিরা মেরে ফেলবে। উনি পালাবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিশ্চিত মৃত্যুটাকেই বেছে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেলেন। রাব্বানী চাচাকেই বলে গিয়েছিলেন যে ২০টা ট্যাংক বিকল করার কথা ।

চাচার বাসা থেকে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মনে হয় মজনু চাচাকে রংপুরে নিয়ে যায়।  আমাদের কাছ থেকে সারা জীবনের জন্য চলে গেলেন। যুদ্ধ চলাকালে  আব্বা অনেক খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন খোঁজই পেলেন না। একসময় দেশ স্বাধীন হল । কিন্তু আমার চাচার কোন খোঁজই কোথাও থেকে পাচ্ছিলাম না। সরকার থেকেও নিখোঁজ বলেছিল। আমরা চারদিকে  খোঁজ করেছিলাম। বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায়, রংপুরেও খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। ওখান থেকে জানালো যে ১৯৭১ সালে এপ্রিল/মে মাসের দিকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য জীপে করে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে গেছে। তারপর আর কিছুই জানা যায় না। আমরা অধীর চিত্তে ওনার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার দাদীতো আমার মজনু চাচুকে মানিক বলে ডাকত। মানিক মানিক করে কাঁদতে  কাঁদতে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। দাদীও জানতেন আসলে মজনু চাচু নিখোঁজ। ঠিক এক বৎসর পর ৭ ই এপ্রিল ১৯৭২ সালে আমার দাদী পরলোক গমন করেন।

আমার ছোট চাচু  যে মারা গেছেন তা আমরা প্রথম জানতে পারলাম ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে অর্থাৎ নয় বৎসর পর। আমার আব্বা মজনু চাচুর এক বন্ধুর মুখে জানতে পারলেন যে আমার চাচাকে ১৪ই এপ্রিলে পাক আর্মিরা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার নাম করে বগুড়াতে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছিল। কিন্তু ওনার মরদেহ কোথায় আছে তা বলতে পারেনি। এই নয় বৎসর আমার আব্বা তন্নতন্ন করে মজনু চাচুকে খুঁজেছেন বাংলাদেশে এবং পাকিস্তানেও আমাদের যে সব আত্বীয় স্বজন ছিলেন তাদের মাধ্যমে ।

১৪ই সেপ্টম্বর ১৯৮০, ওনার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর আমরা (পরিবারের সদস্যরা) স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কারণ এতদিন পরেও আমাদের মনে ক্ষীণ আশ ছিল যে, উনি বেঁচে আছেন। এক পাকিস্তানি বড় পোষ্টের সেনাকর্মকর্তা চাচাকে অনেক আদর করতেন এবং উনি চাইতেন ওনার মেয়ের সাথে চাচাকে বিয়ে দিতে, কিন্তু আমার চাচা একদমই রাজী ছিলেন না । আমরা ভাবতাম উনি হয়তো কোনভাবে চাচাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।  চাচার হয়তো স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। উনি হয়তো পাগলের বেশে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোনদিন হয়তো দেখা পাব ওনার। এই জন্য আমাদের পরিবারের প্রায় সব সদস্যই কিন্তু রাস্তায় বের হলে চাচাকে খুঁজতেন মনে মনে। অনেক কষ্ট লাগল  যখন শুনতে পেলাম যে পাক সেনারা ওনার উপর শারীরিক অনেক নির্যাতন করেছে। ওনার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর আব্বার তখন একটি কাজ শুরু হয়ে গেল তা হল ওনার মৃতদেহের কোন হদিস পাওয়া যায় কিনা? আমার পরম প্রিয় আব্বা গত ১/১/১৯৯৭ সালে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার আব্বা আমার ছোট চাচার মৃতদেহ খোঁজ করছিলেন । কিন্তু কোন খোঁজই পেলেন না।

আমার এই প্রাণপ্রিয় চাচার মৃতদেহ কোথাও পাওয়া যাবে না আর, কারণ তিনি আমাদের সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার  মাঝে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। যিনি অমর তাঁর মৃতদেহ আর খুঁজবো কেন!