ভয়াল সেই দিনগুলো!

রাজ্জাক
Published : 25 March 2011, 03:04 PM
Updated : 25 March 2011, 03:04 PM

একাত্তর সালে যুদ্ধ শুরুর সময় অর্থাৎ ২৬ মার্চের আগে থেকেই আমি ঢাকায় ছিলাম। ঢাকা থেকে বেরুতে পারিনি। আমার ওস্তাদ জহির রায়হানের বাসায় ছিলাম ২০ দিনের মতো সেই ভয়াল দিনগুলোতে। উনি চাচ্ছিলেন না যে আমি কোথাও যাই। কারণ আমার নড়াচড়া মানেই কারোর না কারোর নজরে পড়ে যাওয়া। ফলে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। ততদিনে লোকজন আমাকে সিনেমার কল্যাণে চেনেন। সুতরাং কারও মাধ্যমে আমার অবস্থান জেনে ফেলবে পাকিস্তানিরা।

তো, বিশ দিন তাঁর বাসায় থেকে আবার আমি ফিরে এলাম নিজের বাসায়। ঐদিকে জহির রায়হান সাহেব চলে গেলেন ভারতে। কিছুদিন পরে উনি দেশে ফিরে এলেন। সম্ভবত স্বাধীনতার পরপরই। পরের বার আবার যখন কোলকাতায় গেলেন তখন আমিও তাঁর সঙ্গে ছিলাম।

স্বাধীনতার পরে সম্ভবত ২০ তারিখে উনি দেশে ফিরলেন। আমি ওখানেই থেকে গেলাম আরও তিন দিন। ঢাকায় ফিরলাম ২৩ জানুয়ারি। ফিরেই শুনলাম তিনি নিখোঁজ। তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, কোন কিছুই জানতে পারলাম না।

তাঁকে হারানোটা আমার জীবনে ও জাতির জীবনেও একটা বড় ক্ষতি। আমি যদিও আগে সিনেমা ও মঞ্চে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করেছি। কিন্তু তিনিই আমাকে প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। তিনি আমার গুরু, উপদেষ্টা এবং বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন।

মার্চের সময়টা রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আমাদের চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরাও আন্দোলনে নেমেছিল। টেলিভিশন ঘেরাও, ঢাকা বেতার ঘেরাও এই সব আন্দোলনের শরিক হয়েছিলাম। আর্মিরা আমাকে তিনবার ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়েছিলো। তাদের ধারণা ছিল, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছি।

দিতাম বটে। আমার বাড়ির চারিদিক তখন ফাঁকা জায়গা। বাড়ির অন্যপাশে একটা বোম্বাইয়া বাড়ি ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বাড্ডা থেকে এদিকে আসত। আমার বাড়িতে যে মুক্তিযোদ্ধারা আসত তা পাকিস্তানিরা হাতেনাতে প্রমাণসহ ধরতে পারেনি কখনও। তবে নিয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্টে। নানা প্রশ্ন করেছে। আমি কোলকাতা গিয়েছিলাম কিনা– এই সব প্রশ্নও করেছে। তখন আগরতলা বেতার বাণী থেকে সংবাদ বেরিয়েছিল যে, আমি এখন আগরতলায় আছি।

নিতান্ত ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি। কারণ তখন যাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেত তারা আর ফিরে আসত না। আর্মিদের মধ্যে আমার কিছু পরিচিত লোকজন ছিল। মোটামুটি তারাই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

নয় মাসের জন্য এক রকম হাউজ অ্যারেস্টেই ছিলাম। ওরা বলে দিয়েছিল যাতে ঢাকার বাইরে কোথাও না যাই। রুদ্ধশ্বাস সেই দিনগুলো কী যে কষ্টের ছিল! তবে এই কষ্টের পরে আমাদের যে প্রাপ্তি ঘটেছে তা মহান। আমার ঐ কষ্ট সে তুলনায় খুবই তুচ্ছ মনে হয়।

শুধু মাঝে মধ্যে ভাবি তখন যদি মরে যেতাম তাহলে বাঙালির এই মহত্তম অর্জনটি সম্পর্কে না জেনেই মরে যেতে হত। ঐ সময় যাঁরা মারা গেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম। সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের।