পরিকল্পিত ভাইরাল আবেগ, ছদ্ম-ক্ষমতায়ন ও ছদ্ম-অ্যানার্কিজম

কৌশিক আহমেদ
Published : 12 Feb 2015, 08:14 AM
Updated : 12 Feb 2015, 08:14 AM

ইন্টারনেট যুগকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। প্রি-সোশ্যাল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া অধ্যায়। সোশ্যাল মিডিয়া অধ্যায় শুরু হয়েছে মূলত ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে।

ইন্টারনেট যুগকে আমরা কালের নিরিখে পরিষ্কারভাবে আলাদা করতে পারি। বলা যায়, সভ্যতারই নতুন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যদি আমরা পৃথিবীর সমস্ত সময়কালকে দু'যুগে ভাগ করার চেষ্টা করি, সেটা করতে হবে ইন্টারনেট যুগ এবং প্রি-ইন্টারনেট যুগ হিসেবে।

ইন্টারনেট ও প্রি-ইন্টারনেট যুগ আলাদা করা যায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়ে। মিডিয়া-বিপ্লব ইন্টারনেট যুগকে আলাদা করেছে প্রি-ইন্টারনেট যুগ থেকে। আগে মিডিয়ার যে ধরন ও প্রভাব ছিল তা একেবারে পাল্টে গেছে ইন্টারনেট যুগে এসে। দ্রুত মিডিয়া সম্প্রচার জনমতে প্রভাব ফেলছে বহুমাত্রিকভাবে– জন্ম দিয়েছে একদম আনকোরা দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতির। একদম নতুন একটা অধিকার মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে এবং শেষে তা স্বীকৃত হয়েছে তথ্য অধিকার হিসেবে। মিডিয়া ও তথ্য পরস্পরকে যে পদ্ধতিতে সম্পর্কযুক্ত করেছে সেই অংশটি অনেক বেশি জটিল।

ইন্টারনেট যুগে বিকশিত মিডিয়া নতুন জনমানস তৈরিতে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছে। এই মিডিয়া নতুন মিডিয়াকে সামনে এনে জনগণের যোগাযোগ সক্ষমতা বহুমাত্রিক করেছে। জনসাধারণের এই যোগাযোগ সক্ষমতা পূর্বের সকল অবস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি জন-ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে। ফলে জন-ক্ষমতায়নকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি ইন্টারনেট যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান যা সভ্যতার প্রাক-ইন্টারনেট যুগকে সম্পূর্ণ 'প্রাগৈতিহাসিক' বানিয়ে দিয়েছে।

নতুন আধুনিক যুগ, যেটি ইন্টারনেট যুগ থেকে সূচিত হল, এর জন-ক্ষমতায়নের সূচনা জনগণের যোগাযোগ সক্ষমতার বহুমাত্রিকতা থেকে হলেও, এর বিকাশ ও পরিপক্কতা ঘটেছে মিডিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে ও বিকল্প মিডিয়া জন্ম দিয়ে। মিডিয়ার একমুখী ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ-উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বিকল্প মতামত প্রকাশের জন্য বিকল্প মিডিয়া জন-ক্ষমতায়নকে সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছে।

এই বিকল্প মিডিয়া তথ্যকে অধিকার হিসেবে দেখার সংগ্রাম থেকে অগ্রবর্তী হয়ে প্রাপ্ত তথ্য ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে জনদাবি সংগঠনে ভূমিকা রেখেছে এবং রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। ফলে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে প্রাক-ইন্টারনেট রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতির সঙ্গে এবং ক্রমশ প্রভাবশালী জনদাবিতে পরিণত হয়ে সরকার পতন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরিবর্তনে বাধ্য করতে শুরু করেছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে প্রচলিত রাজনীতি ও ক্ষমতা-বলয় যেভাবে মোকাবিলা করে উত্তীর্ণ হয়েছে তা এক আশ্চর্যজনক বাস্তবতা। প্রাক-সোশ্যাল মিডিয়া যুগের মিডিয়া যেভাবে জনমত প্রভাবিত করত, তার তুলনায় মূলত সহজ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া যুগের জনমত প্রভাবিত করা।

সোশ্যাল মিডিয়া যুগে জনগণের ক্ষমতায়ন যে বিপুল শক্তিধর হয়েছে তা একই সঙ্গে দুটো অবশ্যম্ভাবী দুর্বলতারও জন্ম দিয়েছে। এর একটি ওয়েব গণ-হিস্টিরিয়া; অন্যটি জনগণের উপর আগ্রাসী ও নির্যাতনমূলক নজরদারি। এই দুই দুর্বলতা এতই প্রভাবশালী ও কুহেলিকাপূর্ণ যে, জন-ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সকল ধরনের জনগোষ্ঠীকেই একটা বৃহত্তর ও সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে এনে ফেলেছে যেখানে জনগণ স্রেফ দাবার গুটি। এ সম্পর্কে প্রবন্ধে জনসাধারণের মধ্যে বিন্দুমাত্র সচেতনতা তৈরিও সম্ভব নয়। কারণ একই সঙ্গে এই ছদ্ম জন-ক্ষমতায়নের ধারণা বিস্তারিত হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইডবিরোধী জনপ্রিয় আন্দোলনের ধরনে যা প্রকৃতপক্ষে সুবিধা দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর তাঁবেদার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র-পরিচালকদের।

এই অস্তিত্বহীন জন-ক্ষমতায়নের ছদ্মবরণে ওয়েব গণ-হিস্টিরিয়াকে প্রকৌশল ও পৃষ্ঠপোষকতা করা এখন অনেক সহজতর। ফলে বৃহত্তর জনগণ, সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবিত জনগণ, যারা জনমত তৈরিতে ফ্রন্টলাইনে থাকে, তারা ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত ও ছড়ানো ছিটানো হলেও মূলত তাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠী সহজেই সংকুচিত হয়ে একটা ছোট্ট কামরাতেও বসবাসের জন্য জায়গা করে নিতে পারে। তখন এই জন-বিবিধ মতামত ও বিশ্বাসের বিশাল জনসমষ্টিকে খুব সহজেই একই আফিমে বুঁদ করে রাখা যায় এবং এ জন্য সবার পরস্পরের বিশ্বাস ভেঙে একই বিশ্বাসে যুক্ত হবার প্রয়োজন ছাড়াই খুব আরামে নিবিষ্ট করে রাখা যায়, নানাবিধ নির্ধারিত ও উদ্দেশ্যমূলক বিষয়ে।

এমন উদ্দেশ্যমূলক নানান বিষয়ের ইস্যু সামনে নিয়ে এসে ছোট্ট কামরায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসকারী শতেক কোটি সবল জনমত ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা যায়। ইস্যুগুলি যেভাবে সামনে নিয়ে আসা হয় তার পদ্ধতি এবং প্রকৃতি খুব চমৎকারভাবে নির্বাচন করলেই বিশাল এই জনগোষ্ঠীর জন-ক্ষমতায়ন আবেগতাড়িত হয়ে গণ-হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত আচরণ বিভিন্ন জনগোত্রকে পরস্পরের বিরুদ্ধে শক্তিশালীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া-সংঘর্ষে জড়িয়ে, নির্ধারিত ইস্যুতে কেন্দ্রীভূত রেখে মূলত কামরাটি আরও ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে ফেলে।

সোশ্যাল মিডিয়া-আশ্রিত যে সমস্ত ইস্যুময় আবেগে জনমানস তাড়িত ও ভাইরাল হবার প্রবণতা রয়েছে, তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সবচেয়ে বেশি আবেগতাড়িত হবার বিষয়গুলো পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করা যায়-– প্রয়োজনমাফিক বিরতি দিয়ে এবং একই ফলাফলও পাওয়া যায়– যা পরীক্ষিত হয়েছে কালক্রমে। এর ক্রমবিন্যস্ত প্রয়োগ রাষ্ট্রের নির্ধারিত কর্মসূচির ছিদ্র থেকে যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত জনমতে প্রবল হয়ে ওঠে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবদমনের জন্য প্রাকৃতিক উপায় হিসেবেও কাজ করে।

দেশপ্রেম, জঙ্গি-আক্রমণ, ধর্ষণ, চলচ্চিত্র, ধর্ম, যৌনতা, পরিবার, প্রেম, সামাজিক অনুশাসন ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষের আন্তর্জাতিক ও অঞ্চল-নির্বিশেষে বেশ শক্তিশালী আবেগতাড়িত হয়ে পড়ার নানান ঘটনা সংগঠিত হয়েছে; ফলে সে সমস্ত ঘটনার ধরন পরীক্ষিত অস্ত্র হিসেবে পরিগণ্য। এসব নিশ্চিত করে দেয় কী পরিমাণ পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তিশালী অবস্থান এবং কতদিন এই ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়া-আশ্রিত জনগণের চেতনায় থাকবে।

এমন ঘটনার ভাইরাল-ক্রমে পরবর্তী আবেগের আগমনী ধরনও চিহ্নিত করা যায় বা পূর্বাভাস করাও সম্ভব। ফলে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনামতো বিভিন্নমুখী আবেগের প্রভাবশালী ঘটনা তুলে এনে অথবা গল্প বানিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে যে কোনো সময়ে যে কোনো দিকে পরিচালিত করা সম্ভব, যার মধ্যে তথাকথিত অ্যানার্কিজমের সম্বন্ধ নেই। দ্বিতীয় দুর্বলতাটি, যাকে আমি জনগণের উপরে আগ্রাসী এবং নির্যাতনমূলক নজরদারি বলছি, তার শক্তিশালী এবং প্রায়শই সামরিক প্রয়োগের কারণে এমন পরিকল্পিত আবেগ-সঞ্চারিত ছদ্ম-অ্যানার্কিজম বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে পথ করে দেয় সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকদের।

কোনো শক্তিশালী মেকানিজম এর আগে এত বেশি প্রভাবশালী হয়নি যারা জনমানসে কী আবেগ থাকবে এবং কখন থাকবে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে এই সময়ে জন-ক্ষমতায়নের ধারণা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া যে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে মূলত তা জনসমাজকে আগ্রাসী ও নির্যাতনমূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত, বিকারগ্রস্ত বানানোর এবং মানবিক অধিকার খর্ব করার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।


কৌশিক আহমেদ:
ব্লগার ও গল্পলেখক।