মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি ও সাইকোপ্যাথ সমাচার

শামীমা বিনতে রহমান
Published : 13 Feb 2015, 01:51 PM
Updated : 13 Feb 2015, 01:51 PM

২০১৩ সালের নির্বাচনপূর্ব সহিংসতায় দেশে ছিলাম না। তখন অনলাইনে খবর পড়তাম, আর আতঙ্কে স্কাইপ করতাম ঢাকায়। বাসায় সবাই ঠিকঠাক আছে তো, বন্ধুরা সবাই ঠিক-ঠাক আছে তো। যাদের খোঁজ-খবর নিতাম তারা সবাই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত উচ্চবিত্ত। তাদের গায়ে আগুনের আঁচ লাগেনি, কিন্তু আতঙ্কে গা ভার হয়ে গেছিল; আর মাথায় কোডের মতো ঢুকে পড়েছিল একটা শব্দ, 'পেট্রোল বোমা'।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপরই লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ইন্টারেকটিভ ক্লাসে এলেন নিতিন শ্রীবাস্তব, যিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ভারতীয় সাংবাদিক এবং মাত্র কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের নির্বাচন কাভার করে এসেছিলেন। ক্লাসে তিনি ২০১৩ সালের উত্তরাখণ্ড ভূমিধসের রিপোর্ট দেখানোর পর শুরু করলেন বাংলাদেশ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ প্রসঙ্গের আগেই, ইন্টারেকটিভ ক্লাস বলে রিপোর্টের ফুটেজ, স্ক্রিপ্ট, পিটিসি, মিড-পিটিসি, এন্ড-পিটিসি নিয়ে আমি অনেক প্রশ্ন করে মোটামুটি পুরা ক্লাস ইন্টারেকটিভ করে ফেলেছিলাম। উনি জানতেন না আমি বাংলাদেশের। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বলা শুরু করলেন: "এই রকম নির্মম, এত কম টাকায় মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনে দেখিনি।"

আমি তখন আড়ষ্ট। তিনি বলে যাচ্ছিলেন, "ওইখানে যা হয়েছিল নির্বাচনের আগে, আমি তো শুনেই থ। এরপর বিবিসি রেডিওর কাদির কল্লোলকে জিজ্ঞেস করলাম, এই পেট্রোল বোমাটা কী? তখন কাদির আমাকে জানাল যে, একটা ৫০০ গ্রাম কাঁচের বোতলে একটুখানি ফাঁকা রেখে বোতলটা পেট্রোল দিয়ে ভরে ফেলা হয় আর ব্যবহার করা হয় কাপড়। ইন্ডিয়ান রুপিতে সব মিলিয়ে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ রুপি। ওইখানে নাকি ৪০০ বা ৫০০ টাকা ভাড়ায় এসব বোমাবাজদের পাওয়া যায়। মানে মাত্র ৩০ কী ৩৫ রুপি খরচ করে ওদের রাজনীতিকরা মানুষ মেরে ফেলছে।"

প্রিয় নারী ও পুরুষ পাঠক, ক্লাসরুমে বসে এই নির্মমতা, নৃশংসতার ভার অপমানের মতো, গা-জ্বালা করা অনুভূতির ভেতর দিয়ে সয়ে গেলেও, এখন দেশে বসেই দেখছি স্বল্প ব্যয়ে সবচাইতে দামি জীবনহরণের ঘটনা– জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মানুষ মেরে ফেলার সহিংসতা। ঘর থেকে বের হলেই মৃত্যুভয়। যেন ওঁত পেতে থাকা হাত থেকে এখুনি ছুঁটে আসবে পেট্রোল বোমা। চায়ের দোকানে, গলির মোড়ে, খাবার টেবিলে, সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে, লিফটে পারস্পরিক কথোপকথনে একই আলাপ– ঠিকঠাক জান নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারব তো! ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, আশঙ্কায় আমরা সবাই জমে যাচ্ছি। আর পোড়া চামড়া; পোড়া মাংস; পোড়া মুখের গন্ধ পানে হাত-পা খুলে নাচছে কেবল হামলাকারীরা।

খানিকটা চলমান খবরের দিকে নজর দিই; ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বিএনপি-জামাত জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সমাবেশ করতে না পেরে জ্বলে উঠলেন, ডাকলেন অনির্দিষ্টকালের অবরোধ আর ফাঁকে ফাঁকে হরতাল। এই অবরোধ চলছেই, মাসখানেক হতে চলল। প্রকাশিত খবর জানাচ্ছে, পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে এবং বার্ন ইউনিটে মারা গেছে প্রায় ৬০ জনের মতো। আর পেট্রোলে পুড়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়াদের সংখ্যা হাতের আঙুলে গুনে শেষ করা যাবে না। এর আগে, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিরতিহীন টানা অবরোধে পেট্রোল বোমায় পুড়ে মরেছে ১২০ জন।

প্রিয় পাঠক, খেয়াল করুন, এরা কিন্ত কেউই ক্ষমতাধর নন। রাজনৈতিক কর্মী আছেন কয়েকজন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতা নন। তার মানে, এরা এলিট নন। এরা নিজেদের গাড়িতে চড়েন না, বাসে চড়ে চলাফেরা করেন। এরা সাধারণ মানুষ। খেটে খেয়ে, চাকরি-ব্যবসা করে, স্বামী-বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালোবাসা-মায়াময় নির্ভেজাল জীবনই যাপন করতে স্বস্তি পান।

১৩ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে চলন্ত বাসে ছুঁড়ে মারা পেট্রোল বোমায় যে ৬ জনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হল, এরা তো নিরীহ, নিতান্ত সাধারণ জনগণ; অথবা এই ৩ ফেব্রয়ারি কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চৌদ্দগ্রামে যে ৭ জন পুড়ে কয়লা হলেন, এরা কি ক্ষমতাধরদের, এলিট রাজনীতিবিদদের কারও গা-জ্বালা করার মতো কিছু করেছিলেন? এরাও তো নিতান্ত সাধারণ জনগণ। 'জনগণ' শব্দটা এ জন্যই বার বার উচ্চারণ করছি যে, এই আপনারাই কথায় কথায় শব্দটা ব্যবহার করেন, যেন জনগণ ছাড়া আপনাদের আর ভাবনা নেই। পার্টি অফিস, সমাবেশস্থল থেকে টয়লেট পর্যন্ত, সবসময় যেন এদের কথাই আপনারা ভাবেন। অন্তত সমাবেশে-বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাই-ই প্রজেক্ট করেন আপনারা।

২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবার কথা ছিল সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট বা এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হবার আগে, একটা আশাবাদী ভাবনাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল সবার ভেতর। নিশ্চয়ই এবার বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর কথা চিন্তা করে অবরোধ প্রত্যাহার করবেন এবং হরতাল দিবেন না। কিন্তু হল উল্টা। গোপন স্থান থেকে বিবৃতি দিয়ে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী ঘোষণা দিলেন, পরীক্ষার মধ্যে অবরোধ প্রত্যাহার হবে না এবং ৭২ ঘণ্টার টানা হরতাল চলবে।

প্রিয় নারী ও পুরুষ পাঠক, একটু নিরাপত্তার বাস্তবতায় চোখ ঘুরিয়ে আসি। বাংলাদেশ পুলিশের ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে পুলিশের সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার এবং দেশের মোট জনসংখ্যা অনুযায়ী অনুপাত হল, ১ হাজার ১৩৩ জনের জন্য মাত্র ১ জন পুলিশ। এর বাইরে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য আনসার বাহিনী আছে। আনসার-ভিডিপির ওয়েব সাইট জানাচ্ছে, তাতে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য আছে ৪০ হাজার। সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে, নিরাপত্তা দিতে চাইলেও প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে, এই নৃশংস নির্মমতায় সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয় সরকারের পক্ষে– ইচ্ছা থাকলেও।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দু'বার নির্বাচিত হয়ে এবং একবার অনির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা যদি ভাবি যে, উনি জানেন না, ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের বাবা-মাসহ প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ সরাসরি পেট্রোল বোমা আতঙ্কে আছেন, সেটা কি অর্বাচীনের মতো কথা নয়? এরাই তো জনগণ, নাকি? এরাই তো ভোটার, নাকি? মাননীয় সম্মানিত নেত্রী, কর্মসূচির ধরন দেখে এটা মনে করা কি খুব অস্বাভাবিক যে, সাধারণ নারী-পুরুষ-শিশুর পাশাপাশি এই পরীক্ষার্থীদের পোড়া চামড়ার গন্ধ নেওয়াটা এখন আপনার একমাত্র টার্গেট! বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যবহার করলেও আপনার কর্মসূচি এখন আর বিস্ময় তৈরি করছে না।

বরং মনোবিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দই আপনার জন্য বরাদ্দ রাখতে চাচ্ছি এই দাহকালে; সেটা হল, 'সাইকোপ্যাথ'। আপনি নিজে ক্ষমতায় থেকে থেকে সাধারণ মানুষ চুষে চুষে, দুর্নীতি করে করে এত আরাম পেয়ে গেছেন যে, ক্ষমতায় আবার বসতে না পেরে আপনার মানসিক অসুস্থতা আপনাকে 'সাইকোপ্যাথ' বা 'সোসিওপ্যাথ' বানিয়ে ফেলেছে। আপনার কাছে মানুষের পোড়া চামড়ার গন্ধ এখন রাফ লরেনের পারফিউম রোমান্সের মতোই রোমাঞ্চকর।

কিন্তু পোড়া মানুষ নিয়ে আপনার রোমান্স আমার নয়, আমাদের নয়।

শামীমা বিনতে রহমান: লেখক ও সাংবাদিক।