বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিরসনের কতিপয় প্রস্তাবনা

মেহেদী আহম্মদ আনসারী
Published : 9 Oct 2009, 05:13 AM
Updated : 23 March 2011, 04:08 PM

সম্প্রতি জাপানে সংঘটিত ভূমিকম্পটি ছিল স্মরণকালের ভয়ঙ্করতম ভূমিকম্পগুলোর একটি যার মাত্রা ছিল ৮.৯। জাপানকে ভূমিকম্প প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচাইতে অগ্রগামী দেশ বলা যেতে পারে। কেননা প্রতি বছরই জাপানে অসংখ্য ভূমিকম্প হয় যার মধে ৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প থাকে গড়ে ৪-৭টি। প্রকৃতপক্ষে জাপানের ভৌগলিক অবস্থান হলো 'রিং অফ ফায়ার' নামের ভূমিকম্পপ্রবণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় বেল্টে। এই বেল্টটি এতটাই সক্রিয় যে পৃথিবীর ৯০% ভূমিকম্পই হয় এই অংশে। এই কারণে জাপানের স্থাপনাগুলো যথেষ্ট ভূমিকম্পরোধী করেই তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি জাপানের মত না হলেও বাংলাদেশ হিমালয়ান ফল্ট ও আন্দামান ফল্ট থেকে বেশি দূরে নয়। এই ফল্টগুলো যথেষ্ট সক্রিয় ও ৫৪ বছরের প্রত্যাবর্তণকালে আসাম ও আন্দামান-নিকোবর অঞ্চলে ৩-৪টি ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল। বাংলাদেশ ও এর আশপাশে ১৮৫৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ছয়টি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, যার প্রতিটির মাত্রা ৭-এর অধিক। এ ছাড়া ১৯৩৪ ও ১৯৫০ সালে ভারতে ৮ দশমিক শূন্য মাত্রার দুটি ভূমিকম্প হয়েছে; যার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে রেডিও-কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভূমিকম্পগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর পর হয়েছে বলে জাপানি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন।

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১০-এ মতলবে সংঘটিত ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি ঢাকাবাসীকে যথেষ্ট আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু ওই ভূমিকম্পটি ৭ দশমিক শূন্য মাত্রার ভূমিকম্পের তুলনায় এক হাজার গুণ কম শক্তি ধারণকারী। একটি ৭ দশমিক শূন্য মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকার তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ধ্বংস করবে আর এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ লোককে হতাহত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দূর্যোগ মোকাবিলার জন্য একাধিক সরকার ও বেসরকারি সংস্থা থাকলেও একটি সমন্বিত ও আর্থিক-কারিগরীভাবে সমৃদ্ধ প্রয়াসের অভাব সবসময়ই লক্ষ্য করা যায়। প্রস্তুতি এবং উদ্ধারকাজ হলো দুর্যোগ মোকাবিলা করার প্রধান দুটি অংশ। যেকোন দূর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজে  সময়ক্ষেপন ও পূর্ন দায়বদ্ধতার অভাব দেখা যায়। সরকারি বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর মধ্যে যদি আন্তরিকতার অভাব নাও থাকে, তাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরঞ্জামের তীব্র অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতা আশংকাজনকভাবে লক্ষ্যণীয়। র‌ংগস ভবনের ঘটনা এত দ্রুত আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এটা ছিল মাত্র একটি স্থাপনার ক্ষেত্রে কিন্তু বড় ভুমিকম্পের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা হয়তো লাখের কোটায় পৌঁছাবে। একইভাবে ২০০৫ সালের স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টস ও ২০০৪ সালের শাখাঁরী বাজারের ঘটনাও স্মরণীয়।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভুমিকম্পে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ছে নিম্নোক্ত কারণগুলোর জন্যেঃ

ক. ভূমিকম্পের পূর্বেঃ ১. ভালোভাবে ডিজাইন না করা তথা ভূমিকম্পরোধী ডিজাইন না করা; ২. নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানে অবহেলা; ৩. নিম্নমানের উপকরণের ব্যবহার; ৪. অননুমোদিত ফ্লোর বাড়ানো; ৫. দূর্বল মাটিতে মাটিকে শক্তিশালী না করেই ভবন নির্মাণ ইত্যাদি।

খ. ভূমিকম্পের পরেঃ ১. ভবনের সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল সরঞ্জাম; ২.ভবনের চারদিকে অপর্যাপ্ত জায়গা এবং সরু রাস্তা; ৩. উদ্ধার কাজে পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞানের অভাব; ৪.গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগের অবিন্যস্ত অবস্থা যা ভূমিকম্পের পর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জন্ম দিতে পারে, আবার আগুন প্রতিরোধেও আমরা যে কোনভাবেই প্রস্তুত নই তা বর্তমানে বারবারই দেখা যাচ্ছে। অবহেলা ও অপ্রস্তুতির কারণে এই বিশাল দুর্যোগের সামনে আমরা অনেকটাই অসহায়। জুন ২০১০ সনের নিমতলী, ২০০৮ সনের বসুন্ধরা, ২০০৫ সনের চট্টগ্রামের KTS-এর ঘটনার কথা ভুললে চলবে না।

বর্তমান অবস্থায় ঢাকায় ভবনগুলোর গাঠনিক দুর্বলতা, চুড়ান্ত বিশৃংখল বিন্যাস এবং উদ্ধার উপকরণের অভাবের ফলে বলা যায় যে বড় মাপের ভূমিকম্প হলে ঢাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশেরই উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাব্যতা খুবই কম। তাই প্রস্তুতিই হলো  পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এদেশে ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড বা অন্য যেকোন দূর্ঘটনায় প্রাণহানির অব্যবহিত পরে গণমাধ্যম ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোতে যে অনুপাতে কর্মতৎপরতা দেখা যায় তার সিকিভাগও দীর্ঘমেয়াদে দেখা যায় না। অথচ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও সুসংগঠিত কার্যক্রম ছাড়া শুধু 'শক্তিশালী' তদন্ত কমিটি তৈরি অবশ্যম্ভাবী  ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে না ।

বর্তমানে নির্মীয়মান  ও ভবিষ্যৎ স্থাপনাগুলোতে যেন যথাযথভাবে ডিজাইন ও মানসম্পন্নভাবে নির্মাণ করা হয় সেদিকে কঠোর নজরদারী  এবং তার জন্য গনসচেতনতা এবং সরকারী সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রক তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন। এই নিবন্ধের মূল দৃষ্টি থাকবে ঢাকায় বর্তমানের তৈরি ভবনগুলোর দিকে। কেননা দেখা গেছে, তৈরি ভবনগুলোতে এ ধরনের ভূমিকম্পরোধী ব্যবস্থা নেয়া আইনগত ও প্রকৌশলগতভাবে অনেক কঠিন। সরকারী সংস্থাগুলো চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বেশ কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় যা পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ সব সংস্থায় দুর্নীতির পাশাপাশি আইনগতভাবে অভিযান চালানো অনেক সময়সাপেক্ষ। তদুপরি সরকারি সংস্থাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ও  সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার উপরেও মানুষের আস্থা  ও অংশগ্রহনের তীব্র অভাব পরিলক্ষিত হয়। সে কারনে একটি বিকল্প ব্যবস্থায় মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

এই বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে একটি বিশেষায়িত ও স্বায়ত্ত্বশাসিত কমিশন তথা বাংলাদেশ সিসমিক কমিশন। এই কমিশনের কাজ হবে মূলত: প্রকৌশলগত পরামর্শ ও সমন্বয়কের দায়িত্বপালন করা। এই সংস্থাটি দেশী,বিদেশী ও অনাবাসী বাংলাদেশি (NRB) বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে তৈরি হতে পারে। কাজের ব্যাপকতার কথা মাথায় রেখে পর্যাপ্ত সংখ্যক জনবল ও কারিগরী সুবিধা বরাদ্দ করা প্রয়োজন। সংস্থাটির কাজ হবে মূলত: তিনটি দিকে:১. স্থাপনাকে পরীক্ষা করা, ২.দুর্বল স্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য কারিগরী পরামর্শ দেয়া ও ৩. প্রতিটি স্থাপনার ঝুঁকিমাত্রা বিবেচনা করে একটি রেটিং দেয়া বা গ্রেডভুক্ত করা। এ ধরনের সংস্থা তথা Evaluation, Consulting and Monitoring Agency বিরল নয়। উদাহারণস্বরূপ, যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া সিসমিক সেফটি কমিশন (www.seismic.ca.gov)-এর কথা বলা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালে সিসমিক সেফটি অ্যাক্টের মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়। সূচনাতেই এর তৈরির উদ্দেশ্য বলে দেয়া আছে। প্রথমতঃ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থা নানারকম ভূমিকম্পরোধী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে, দ্বিতীয়তঃ (তা স্বত্ত্বেও) ভুমিকম্প ঝুঁকি রোধে একটি সুনিয়ন্ত্রিত ব্যাবস্থা এবং সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরী যা বর্তমানে কোন সংগঠন দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে না, তৃতীয়তঃ দীর্ঘমেয়াদে ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস এবং চতুর্থতঃ আইনানুগভাবে নির্দেশিত অন্য সংস্থার কাজ ও দায়িত্ব এই কমিশনের উপর বর্তাবে না। ( First, many different agencies at various levels of government have substantial responsibilities in the fields of earthquake preparedness and seismic safety. Second, there is a pressing need to provide a consistent policy framework and a means for coordinating on a continuing basis the earthquake-related programs of agencies at all governmental levels and their relationships with elements of the private sector involved in practices important to seismic safety. This need is not being addressed by any continuing state government organization. Third, through concerted efforts of broad scope, coordinated by a Seismic Safety Commission, long-term progress should be made toward higher levels of seismic safety. Fourth, it is not the purpose of this chapter to transfer to the commission the authorities and responsibilities now vested by law in state and local agencies.) এই কারনগুলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেও পুরোপুরিভাবে প্রযোজ্য।

প্রস্তাবিত এই কমিশনের সম্ভাব্য কাজগুলো সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে। কোন ভবন পরীক্ষা করার জন্য দুটি দিক দেখতে হয়। প্রথমত: ভবনটি যে উপকরনগুলি দিয়ে তৈরি তার মান ও বর্তমান সামর্থ্য। দ্বিতীয়ত: পুরো ভবনের অবস্থা তথা তা ভূমিকম্পের সময় কেমন আচরণ করবে। প্রথমটির আমরা মূলত NDT (Non-destructive Testing) ব্যবহার করি যা কিনা উপকরণটি (কংক্রিট,স্টীল) যেখানে যে অবস্থায় আছে তাকে স্থানচ্যুত না করে এবং না ভেঙ্গে তার ভারবহন, অবস্থান ও অন্যান্য গুনাবলী পরীক্ষা করা যায়। সৌভাগ্যের বিষয় হলো এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আমাদের দেশে মোটামুটিভাবে পাওয়া যায়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোও এ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহারের সাথে পরিচিত। তাই বলা চলে,পর্যাপ্ত সংখ্যক না থাকলেও প্রথম উদ্দেশ্যটি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রের সাথে পরিচিতি দেশেই রয়েছে। দ্বিতীয়টির জন্যই মূলতঃ বিশেষজ্ঞের বেশি প্রয়োজন। কেননা ভূমিকম্পের সময় স্থাপনার আচরনের পূর্বাভাস দেয়ার জন্য বেশ জটিল কম্পিউটার মডেলিং করার প্রয়োজন যা ভালো বিশেষজ্ঞ ছাড়া সম্ভব নয়। শক্তিশালী উপকরণ  সব সময় শক্তিশালী স্থাপনা নির্দেশ করে তা কিন্তু  একদমই নয়। স্থাপনার আকার, উচ্চতা, ব্যবহার, কলাম ও বীমের আকার ও দূরত্ব এমন অসংখ্য বিষয় এখানে বিবেচ্য। এর  কারণে একটি  প্যানেল প্রয়োজন যারা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। পুরো প্রক্রিয়ার সবচেয়ে জটিল শ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ অংশ এটিই। আবার দূর্বল স্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য (Retrofitting) একইভাবে মডেলিং করে তারপর কোন কোন স্থানে নতুন ভাবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন তার পরামর্শ দিতে হবে। এই অংশটিও যথেষ্ট জটিল ও বিশেষজ্ঞের সাহায্যের প্রয়োজন।

তৃতীয় পয়েন্টে প্রতিটি ভবনের একটি রেটিং দেয়ার কথা বলা  হয়েছে। এটি বলা অত্যন্ত সহজ হলেও কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন। কেননা স্থাপনায় ঝুঁকি মাত্রা হিসাবের জন্য অসংখ্য তথ্যকে সন্নিহিত করে তারপর এই রেটিং দেয়া যাবে। তবে কঠিন হলেও এটা করা গেলে তা হবে গণসচেতনতা  এবং উপলদ্ধির দিকে একটি বিশাল অর্জন। সংস্থাটি যখন কোন স্থাপনার অবস্থা যাচাই করবে এখন ঐ স্থাপনা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করবে যা ইন্টারনেট ও পুস্তিকা আকারে পাওয়া যাবে। একইভাবে কোন স্থাপনাকে দেয়া রেটিং ঐ স্থাপনার সামনে প্রদর্শিত হতে হবে। তাহলে বাড়ির মালিক বা অধিবাসীরা ঐ বাড়ীতে বাস করা বা অন্য কাজে ব্যবহার করার ব্যাপারেও সজ্ঞান সিদ্ধান্ত (Informed Decision) নিতে পারে। এটা করা গেলে সচেতনতার মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আদেশ বা জবরদস্তি নয়, সহযোগিতা ও উপকার করার মনোভাবই এই বিশাল কাজে সবার অংশগ্রহনকে নিশ্চিত করতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক সংস্থাই ভূমিকম্প গবেষনা ও গনসচেতনতার জন্য অনেকদিন থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। সরকারিভাবে রাজউক, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, ফায়ার সার্ভিস, দুর্যোগ বিষয়ক মন্ত্রনালয়, গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের পাশাপাশি বুয়েটসহ অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিষয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের বেশ বড় আকারের বেসরকারি প্রকৌশল সেক্টরে বহু বিশেষজ্ঞ কর্মরত আছেন। তার সাথে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা দেশের প্রয়োজনে সাড়া দিবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। সে কারনে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জনবলের একটি বড় অংশ আমাদের দেশেই প্রস্তুত আছে বলে ধরা যেতে পারে।

এই বিশাল কাজে সরকারের অংশগ্রহণ হবে মূলত: আর্থিক এবং আইনী। যেহেতু পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ স্থাপনা আছে, কাজের মাত্রা হবে অত্যধিক। এর পাশাপাশি ঢাকা বাদে ঘন জনবসতিপূর্ণ ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি এমন অঞ্চলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করলে যে বিশাল সংখ্যক জনবল ও বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হবে তার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সরকারি আন্তরিকতা খুবই জরুরী। তবে এই কমিশনের কাজ কোনভাবেই কোন ভবনকে বৈধ বা অবৈধ ঘোষনা করা নয় বা কোন ভবনকে ধ্বংস করার আদেশও এই কমিশন দিবে না। মোটকথা, কমিশন প্রণীত রেটিং এর কোন আইনী ভিত্তি থাকবে না। এই কমিশনের কাজ হবে শুধুমাত্র  জনগনকে পরামর্শ দেয়া এবং সচেতন করা, সাধারণ মানুষ যদি ভয় পেয়ে দূরে থাকে তাহলে কোনভাবেই ভুমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব নয়। তবে যেকোন ভবনে প্রবেশাধিকার ও প্রদত্ত রেটিং দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে প্রদর্শনের জন্য আইন করা প্রয়োজন।

এই বিশাল কাজের সাফল্যের সম্ভাবনা একদমই শূন্য যদি মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা না যায়। অধিবাসীরা যতক্ষন না চাইবে, সরকারের সর্বোচ্চ শক্তি ও আগ্রহ দিয়েও কিছুই করা সম্ভব হবে না । এই জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো গনমাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরির অব্যাহত প্রয়াস। পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, একটি বড় ভূমিকম্পের পরপরই এই নিবন্ধের মতো আরো অনেক নিবন্ধ ছাপা হয়। এতে মানুষ সাময়িকভাবে চিন্তা করে, আতংকিত হয় কিন্তু অব্যাহতভাবে মনে না করিয়ে দেয়ার ফলে সবাই কিছুদিনের মধ্যেই  তা ভুলে যায়। চলমান কোন প্রয়াসের অনুপস্থিতিই মানুষের অসচেতনতার জন্য দায়ী।

বাংলাদেশের শক্তিশালী ও গণপ্রসারী মিডিয়াগুলো সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের কোন কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আশার কথা এই যে, সামাজিক আন্দোলনগুলোতে  মিডিয়ার  আগ্রহ  ও লেগে থাকবার মনোভাব দেখা যায়। সবার জন্য শিক্ষা আন্দোলন, যৌতুকবিরোধী আন্দোলন, মাদকবিরোধী আন্দোলনসহ অসংখ্য ভালো কাজে গণসমর্থন আদায় এবং সংগঠিত করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের তরুন মিডিয়ার রয়েছে। প্রস্তাবিত কমিশনের কাজে মানুষের সমর্থনই হল মূল চালিকাশক্তি । মিডিয়াই পারে এই বিশাল কর্মযজ্ঞে মানুষের আস্থা ও সমর্থন যোগাড় করে দিতে। এই সহযোগিতাটুকু  অব্যাহতভাবে পেলে আপাত:দৃষ্টিতে জটিল ও বিশাল এ কাজটি সম্পন্ন  করা কঠিন হবেনা বলে আশা করা যায়।

এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল  ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গনমাধ্যম ও সংগঠনগুলো মিলে একটি সুসংগঠিত  ও অব্যাহত সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে হবে। একটি বিশাল সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এই সংকটময় অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ অসম্ভব।

মেহেদী আহমেদ আনসারী: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

নাজমুস সাকিব: প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, গাজীপুর।