মুক্ত কর বই

আকতার হোসেন
Published : 8 Feb 2015, 07:58 AM
Updated : 8 Feb 2015, 07:58 AM

ছোটবেলায় আম-কাঁঠালের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যেতাম। সেই মৌসুমি আনন্দ এখনও মন নাচায়। বিদেশে এসে দেখেছি পারিবারিক বিয়ে-শাদিতে কিছু কিছু মানুষ ছুটে যায় দেশে। তারপর একসময় শুনতে পেলাম, 'এবার দেশে গিয়ে ঈদ করব'। কিছুদিন আগেও তেমন শোনা যেত না, তবে ইদানিং বেশ শোনা যাচ্ছে কথাটা, 'বই মেলাতে দেশে যাব'। ফেব্রুয়ারিতে এখন যারা দেশে যায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন বই প্রকাশ করতে যায়; কেউ-বা যায় 'বই' এবং 'মেলা' দুটোই কাছে পেতে। বলা যেতে পারে বইমেলা এখন মৌসুমি বেড়ানো।

আটাশ বছর আগে এদেশের বাসে-ট্রামে যেভাবে মানুষকে বই পড়তে দেখতাম এখন আর তেমন দেখি বলে মনে হয় না। যুগের হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে বইপড়াতেও এসেছে পরিবর্তন। প্রথম প্রথম এদেশে বইপড়ার দৃশ্য দেখে মনে হত, সামনে বুঝি এদের সকলের পরীক্ষা অথবা ইন্টারভিউয়ের প্রশ্ন মুখস্ত করছে ওরা। আজকাল দেখি সেলফোন, এমপি-থ্রি সে জায়গা দখল করে নিয়েছে।

একবার গিয়েছিলাম ব্রডভিউ থিয়েটারে 'লায়ন কিং' দেখতে। ফেরার পথে দেখলাম বাসের আটজন যাত্রীর সবাই হয় টেক্স করছে, না হয় কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। পথে-ঘাটে বই পড়লেও এরা এখন KOBO, KINDLE, NOOK-এর মতো ইলেকট্রনিকস মাধ্যমে ই-বুক পড়ে। এদেশের লাইব্রেরিগুলোতে এখন খুব কম লোকই বই আনতে যায়। বই নিজেই চলে আসে পাঠকের কাছে।

বাংলাদেশে এর উল্টো দৃশ্য। এখনও বইয়ের টানে ভক্ত পাঠক যাচ্ছে বইমেলাতে। আগের দিনে মেলা মানে ছিল কাঠপুতুল, নাগরদোলা, মুড়কি-মুড়ি। সেখানে এখন ঝকঝকে অক্ষরে ছাপানো বই। পুরো পরিবার যায় বই কিনতে, নাতি যায় দাদুর হাত ধরে। প্রিয় আর প্রিয়া যায় টি-শার্ট গায়ে। স্বামীর জন্য স্ত্রী বই কিনে এনে সারপ্রাইজ দেয়।

অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন বই ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সময় কাটানোর মাধ্যম। দুপুরে খাবার পর পুরুষরা আয়েসি একটা ঘুম দিত। সে সুযোগে বিছানায় উপুড় হয়ে মেয়েরা ব্যস্ত হত প্রিয় উপন্যাস শেষ করার কাজে। কেউ কেউ পড়ত লুকিয়ে, মুরুব্বিদের না জানিয়ে। আমার এক বন্ধু তার মেয়েকে একদিন আবিষ্কার করেছিল জানালার পর্দার পেছনে। বোকা মেয়ে বুঝতে পারেনি যে, তার পা দুটি বেরিয়ে আছে পর্দার নিচ দিয়ে। বাবা পর্দা সরিয়ে দেখে, চোখ-মুখ ফুলিয়ে তার মেয়ে একটা বই পড়ছে।

অনেক আগে বিয়ের কনে দেখা উপলক্ষে যারা আসতেন তাঁরা প্রশ্ন করতেন, তুমি কি ওই বইটা পড়েছ, কিংবা কার লেখা বই সবচাইতে বেশি পছন্দ কর? এতেই নাকি যাচাই-বাছাই হয়ে যেত বিবাহযোগ্য মেয়েটির রুচি এবং বিদ্যার বহর। তবে, কিছু কিছু পরিবার ছিল বই-বিরোধী। বই বলতে তারা কেবল বুঝত 'ধর্মগ্রন্থ'। তাদের জন্য সাহিত্য পড়া ছিল 'পাপ'!

কয়েক যুগ ধরে চাকরির ইন্টারভিউতেও বই নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু হয়েছে। যেমন, বিখ্যাত বই 'মা' কার লেখা? কীভাবে যেন এক সময় উপহারের তালিকাতেও বই শীর্ষে উঠে এসেছিল। এত সবের পরও বই ছিল একটি বিশেষ শ্রেণির দখলে।

এখন আকাশ সংস্কৃতির যুগ। ক্যাবল আর ডিশের যুগে চব্বিশ ঘণ্টা কম্পিউটার কিংবা টিভির সামনে বসে থাকা যায়, বইপড়ার দরকার পড়ে না। শুনেছি এই পরিবেশেও নাকি বই মেলাতে কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। এ কথা সত্য হলে বলব, সত্যি বদলে গেছে দেশ।

আমেরিকা কানাডার বাজারে বই আসে একটা টিম-ওয়ার্ক বা গোষ্ঠীবদ্ধ কাজের ধারাবাহিকতায়। একাধিক ব্যক্তি ও সংস্থা জড়িত থাকে বই প্রকাশ প্রক্রিয়ায়। যেমন; লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, গোষ্ঠীবদ্ধ পাঠক, সমালোচক, চুক্তি লেখক, প্রচার প্রতিনিধি, বিতরণ কেন্দ্র ইত্যাদি। একজন লেখক সাধারণত দু'ভাবে তাঁর বই প্রকাশ করে থাকেন। একটি হল, নিজ উদ্যোগে; অপরটি সনাতনী প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে। আজকাল নিজ উদ্যোগেই অধিকাংশ বই প্রকাশিত হচ্ছে। বই লেখার চিন্তাভাবনা চূড়ান্ত হলে এডিটরের এডিটিং, পাণ্ডুলিপির প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ চয়ন, পাবলিশার্স খুঁজে বের করাসহ যাবতীয় কাজ লেখক কিংবা তাঁর পক্ষ থেকে কাউকে করতে হয়।

নিজ উদ্যোগে যাঁরা বই বের করেন তাদের বই অনলাইন কিংবা পাবলিশার্সরা ছাপানোর আগে কিছু কিছু বিষয় যাচাই-বাছাই করে নেয়। যেমন, লেখকের সামাজিক মিডিয়ার বলয় (ফেসবুক, ব্লগ, ইমেইল-গ্রুপ), মিডিয়া পার্টনার, বিনিময় বা প্রমোশন পার্টনার, ফ্রেন্ডস-গ্রুপ, সমালোচক, প্রচারক, লেখকের পূর্ব সাফল্য ইত্যাদি। তারপর লেখক এবং বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে যথাসম্ভব অল্প মূল্যে বাজারে বই ছাড়া হয়। মজার ব্যাপার হল,বই বিক্রির সফলতার উপর বইয়ের মূল্য ওঠানামা করে। আবার সনাতনি পাবলিশার্স ও বড় লেখকদের বই প্রচারণা নিয়েও চলে নানান কর্মকাণ্ড। যেমন, টিভি-রেডিও-পত্রিকার ইন্টারভিউ, বুক রিভিউ, বুক সাইনিং সেশন, বড় বড় শপিং সেন্টার কিংবা বিমান বন্দরের আকর্ষণীয় স্থানে বই ডিসপ্লে ইত্যাদি।

সম্ভবত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং উন্নত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম পার্থক্যগুলো হল; এডিটর দিয়ে বই এডিট করানো, তা সেটা হোক গবেষণাভিত্তিক বই কিংবা গল্প-উপন্যাস। এরই খুব কাছাকাছি হয়তো বাংলাদেশের প্রুফ-রিডারের ভূমিকার তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রুফ-রিডার আর আমেরিকা-কানাডার এডিটরের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। যত জনপ্রিয় লেখকই হোন না কেন, তিনি যদি এডিটর নিয়োগ দিয়ে থাকেন তবে তাঁকে সেই এডিটরের শলাপরামর্শ মেনে চলতে হয়। এডিটর-লেখক মিলে বইয়ের কনটেন্ট কাটছাঁট করেন, যোগ করেন, দরকার হলে পুনরায় চ্যাপ্টার যোগ-বিয়োগ করেন। বড় বড় লেখকরা চড়া পারিশ্রমিকে ব্যক্তিগত এডিটর পোষেন।

সাহিত্যে কানাডার সাম্প্রতিক নোবেলবিজয়ী এলিস মুনরো তাঁর এক সাক্ষাতকারে বিনয় করে বলেছেন, আমার গল্প-উপন্যাসের সাফল্যের বড় একজন দাবিদার হচ্ছেন আমার এডিটর। এরপর রয়েছে প্রাথমিক পাঠকগোষ্ঠী। অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পাঠকদের বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়। বই পড়ে এরা যে মতামত দেয় সেটাও লেখকের উপকারে আসে। বই প্রকাশের প্রক্রিয়ায় আর একটি বড় কাজ করেন সমালোচক। সমালোচকদের রিভিউ হল চূড়ান্ত বাছাই পর্ব। বাকিরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিপুণভাবে দায়িত্ব পালন করার পর একটি বই প্রকৃত পাঠকের কাছে পৌঁছায়। এতসব হয় বলেই হয়তো বই লিখে জীবিকা নির্ভর করা সম্ভব এ সমস্ত দেশে। বই লিখে কেউ-বা হয়ে যান মিলিওনিয়ার।

আমাদের দেশে বই প্রকাশকের ব্যাপারে লেখকই একক কর্তৃপক্ষ। বিষয়ভিত্তিক লেখা কিংবা প্রফেশনাল বিষয়ে নিয়ে যারা লেখালেখি করেন তাদের বাদ দিলে, দেশের বেশিরভাগ লেখক সাধারণত শিক্ষক কিংবা সাংবাদিকতার কাজে নিয়োজিত। আগেকার দিনে যারা বই লিখতেন সামাজিক পদমর্যাদায় তাঁরা এতই উপরে থাকতেন যে অন্য কোনো কাজ করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকত না। বই লেখাই ছিল তাঁদের পেশা। তাঁরা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিক। বড় বড় পাবলিশার্সরা তাদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকত। অগ্রিম টাকা দিয়ে অথবা কথার জালে পাবলিশার্সরা লেখকদের এমনভাবে আটকে রাখতেন যেন অন্য কাউকে লেখা দেবার আগে সে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পাণ্ডুলিপি বগলদাবা করে ছাপাখানায় দৌড়াতে পারে। এতেই তাঁর জিত হত।

বর্তমান সময়ে যারা প্রতিষ্ঠিতই লেখক নন, কিন্তু লিখতে ভালোবাসেন তাঁরা একটি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চেষ্টা করছেন। একটা বই বাজারে আসার পর যদি সহসা তাঁর অন্য বই খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে পাঠকের আগ্রহ হারিয়ে যায়, এ কথা নবীন লেখকরা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন। প্রতিষ্ঠিত কোনো লেখকের মতো না লিখে এরা নিজস্ব ভাবনা ও পদ্ধতি নিয়ে লিখছেন বলেই নতুন নতুন ধারা তৈরি হচ্ছে।

'লেখক ভাব' বলতে একটি কথা আছে সেটা থেকেও সরে আসতে পেরেছে অনেক নবীন লেখক। পাঠকই চূড়ান্ত বিচারক সে কথা শতভাগ সত্য বলে মেনে নিয়েছে দেশের বেশিরভাগ লেখক। কাজেই পাঠকের হাতে বই পৌঁছানোর আগেই যতসব সাবধানতা নিতে হবে। বাংলাদেশে এই চর্চা চালু হলে বই শুধু পড়ার জন্য নয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক মানবিক উপকারেও আসবে। হয়তো আমেরিকা-কানাডার মতো গোষ্ঠীবদ্ধ প্রচেষ্টা কিংবা বিভিন্ন স্তরের ব্যবহার এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি, তবু সচেতন পদ্ধতি আছে বলেই দিন দিন বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে।

খুব কম লেখক আছেন যিনি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হবার পর খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছে গেছেন। লেখক খ্যাতির ব্যাপারে এই সমস্ত দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, দান দানে দশ দান। অবহেলার কারণে যদি অপেক্ষাকৃত মন্দ লেখা পাঠকদের হাতে যেতে শুরু করে, তাহলে বইয়ের ভুবনে যে ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেবে সেটা কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্টদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

নতুন উদ্যোগ আর নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলাদেশে যারা পাঠকদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন যেমন 'বাংলা ই-বই' তাঁরা যেন এখনই অতিরিক্ত মুনাফার জন্য মানসিক চাপে না ভোগেন। সময়ই তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে। যত্ন ছাড়া যে শিল্প পথ চলতে চেষ্টা করেছে তাকেই বড় ধরনের হোঁচট খেতে হয়েছে। বই নিয়ে যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে, তার গণমুখী ধারা অব্যাহত রাখতে মান নিয়ন্ত্রণে যত্নবান হতে হবে।

জনসংখ্যার বিশালতা, দিন বদলের পালা, দ্রুতগতিতে প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, বিশ্ব-যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারে অংশগ্রহণ এবং উন্নত প্রচারমাধ্যমে জড়িত হওয়াতে আশা করছি, বাংলা বই অচিরে পৌঁছে যাবে বিশাল পরিমণ্ডলে। দশ গ্রামে একজন পড়ুয়া, সেইদিন বদলে গেছে অনেক আগে। সময়টা ছিল পাতার উপর দোয়াত-কালি দিয়ে লেখার যুগ। বাস্তবতা হল, এখন দশ বছরের একজন শিশুও নামকরা লেখক হতে পারে।
আগামীতে হয়তো 'তুমি অমুকের বই পড়েছ' এর পরিবর্তে বাংলাদেশে প্রশ্নের ধারা হতে পারে 'এই বিষয়ে তোমার লেখা কোনো বই আছে?'

এ রকম একটি দিনের প্রত্যাশা পূরণে পাঠকদেরও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন, একটি বই পড়া শেষ হতেই সেটাকে অন্যের হতে তুলে দিতে হবে। আকাশের পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা কিংবা পানির মাছকে কাচের অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখা যদি অন্যায় হয়, তবে বই কেন পড়ে থাকবে বুকশেলফে? যে যত বই হাত বদল করবে সে তত ঋণী করবে আগামীকে। যদি কোনো বই ভাল লেগে যায় বা উপকারে আসে তবে সেই বই আমাদের পৌঁছে দিতে হবে অন্য পাঠকের হাতে। কেননা একজন লেখক যেমন পাঠক তৈরি করেন, তেমনি পাঠকও লেখক তৈরিতে অবদান রাখেন।

আসুন, আমরা সকলে বুকশেলফ খালি করে ফেলি। কোনো বই যেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না পায়।