মাইনাস ওয়ান, মাইনাস টু

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 5 July 2011, 06:05 AM
Updated : 5 Feb 2015, 11:43 AM

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। অস্বাভাবিক মৃত্যুই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে নিরীহ নিরাপরাধ মানুষ– শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। সরকার দোষ দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতকে, বিএনপি-জামায়াত দিচ্ছে সরকারকে। দোষারোপের রাজনীতি চলছে– অপঘাতে মৃত্যু, যানবাহনে আগুন, পেট্রোল বোমা, ভাঙচুর, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি, কোনো কিছুরই দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ।

পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে প্রতিদিনই, আর প্রতিদিনই উভয় পক্ষ জানান দিচ্ছে তাদের অনড় অবস্থানের কথা। তাতে ভাঙলে ভাঙুক, কেউ মচকাবে না। সরকার ভাবছে, ছাড় দিলে তাদের হার হবে; বিএনপি-জামায়াত ভাবছে, সরকার এবার পার পেয়ে গেলে আগামী চার বছর আর মুখ ফিরে তাকাবে না। অর্থাৎ লড়াইটা হার-জিতের। উভয় পক্ষই জিততে চায়, কেউ হারতে নারাজ।

তাদের হার-জিতের লড়াইয়ে জিম্মি হয়েছে দেশ ও জনগণ, জিম্মি হয়েছে রাজনীতি তথা গণতন্ত্র ও অর্থনীতি। এর শেষ কোথায়, তার সদুত্তর জানা নেই পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, শ্রমিক-মালিক কারও কাছে।

প্রতিপক্ষ, বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রেখে সরকার অবরোধমুক্ত করতে পারেনি দেশকে। অবরোধের কবলে কাঁচা শাক-সবজির বাজার হারিয়ে হা-হুতাশ করছে কৃষক, উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করতে না পেরে মাথায় হাত কলকারখানার মালিকের, ঝুঁকিতে প্রায়-অচল দূরপাল্লার পরিবহন ব্যবস্থা। উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে, ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের উপরের স্তর থেকে নিম্ন স্তর পর্যন্ত। এ যেন এক ব্রেকবিহীন চলন্ত ট্রেনে ষোল কোটি যাত্রী– ভেতরে বসে থাকলেও মৃত্যুর ঝুঁকি, নামতে গেলেও মৃত্যুর ঝুঁকি। এ ট্রেন থামানো না গেলে হয় সাগরে ডুববে, না হয় পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।

'অস্বস্তিকর স্বস্তি'তে এক বছর পার করেছে বর্তমান সরকার। চলতি বছরের তিন তারিখের আগ পর্যন্ত মাঠে বস্তুত কোনো রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল না। বেগম খালেদা জিয়াকে রাজধানীর বুকে ও বাইরে কয়েকটি জনসভা করতে দেওয়া হলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল হুমকি-ধামকির মধ্যেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী ও বিএনপির নেতা-নেত্রীদের বাকযুদ্ধে বাতাস উত্তপ্ত হলেও মাঠ উত্তপ্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর দল আর সহসা আন্দোলনমুখী হতে পারবে না। নির্বাচনের পর আন্দোলনে পিছুটান দিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের এই ধারণা পোক্ত করে।

নির্বাচনের বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক কৌশলে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, আর ব্যর্থ হয়ে বিএনপি পড়ে গেছে রাস্তায়। সরকার গঠনে সফল হয়ে আওয়ামী লীগ তার শক্তি সংহত করেছে ও নতুন করে আস্থা সঞ্চয় করেছে; আর বিএনপির ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা– নেতৃত্ব-সংকটে ঘুরপাক খেয়েছে হতাশায় ও আস্থাহীনতায়।

নির্বাচন-উত্তর আলোচনার প্রতিশ্রুতি ঝেড়ে ফেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা বলতে শুরু করলেন, ''আলোচনা কীসের, কার সঙ্গে? পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে এসেছি, মেয়াদ শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।'' সুতরাং নির্বাচনের আগে 'সংবিধান রক্ষার নির্বাচন' বলে যা বলা হয়েছিল, তা আর নির্বাচনের পরে বহাল থাকল না।

বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারিকে ঘোষণা করল 'সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা দিবস' হিসেবে, আর ওই দিনকে 'গণতন্ত্রহত্যা দিবস' হিসেবে ঘোষণা দিল বিএনপি। সংঘাতের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিবসটির নামকরণেই। আর তারপরই রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়ে গেল সাজ-সাজ রব। দুই বিপরীত অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে মিছিল-সমাবেশের কর্মসূচির ঘোষণা দিল। পুলিশের টালবাহানা দেখে বিএনপি বলল, অনুমতি না দিলেও ওই দিন তারা রাজধানীতে সমাবেশ করবেই। বাতাসে বাকযুদ্ধ থেকে উত্তেজনা নেমে এল মাঠে।

মানুষের উদ্বেগ-আশংকার মধ্যেই দ্রুত ঘটে গেল একের পর এক কয়েকটি ঘটনা। ৩ জানুয়ারি রাতে বিএনপির পুরানা পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। রাত এগারোটায়, খালেদা জিয়া যখন তাঁর গুলশান অফিসে, খবরটি শুনে তিনি রিজভীকে দেখতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন বলে গাড়ি প্রস্তত করতে বললেন। বের হতে গিয়ে দেখলেন, তাঁর অফিস ঘেরাও করে ফেলেছে পুলিশ। তাঁর পথ আটকে পুলিশ বলল, উপরওয়ালার নির্দেশ, বের হওয়া যাবে না।

ওদিকে, কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে 'দরদী' পুলিশ অসুস্থ রিজভীকে তুলে নিয়ে ভর্তি করেছে অ্যাপোলো হাসপাতালে। সরকারি মহলের ভাষ্য, রাতে রিজভীর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা ছিল বিএনপির পূর্ব-পরিকল্পনার অংশ। অসুস্থ রিজভীকে দেখার অজুহাতে খালেদা জিয়া পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আস্তানা গেড়ে বসতে চেয়েছিলেন; তারপর ওখান থেকে পুরানা পল্টন সড়কে, যেখানে পুলিশের অনমুতি ছাড়াই ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

সরকারি মহলের এই ভাষ্য যদি সত্যও হয়, তাহলেও প্রশ্ন উঠে: অনুমতি নেই, পুলিশ সমাবেশ করতে দেবে না। কিন্তু খালেদা জিয়ার কি নিজ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার অধিকার নেই?

এদিকে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি বড় বড় নগরীতে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হল। আবার প্রশ্ন: 'সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা দিবসে' বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দিয়ে কি সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা হল? 'গণতন্ত্রহত্যা দিবস' বলে বিএনপি যে দাবি করেছে, সরকারের পদক্ষেপ তাহলে জনগণের দৃষ্টিতে কীভাবে বিবেচিত হবে?

ফাঁদ পেতে সে ফাঁদে সরকার নিজেই পড়েছে। যে বিনাশী অবরোধ এখন চলছে, তা শুরু করেছিল সরকারই। বিএনপির জনসমাবেশে যাতে রাজধানীর বাইরে থেকে কেউ না আসতে পারে, সে জন্য দুদিন আগ থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ঢাকাগামী বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল। এরপর অবরোধের উপর অনির্দিষ্টকাল অবরোধ ঘোষণা করলেন অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া।

কৌশলে জয়ী হয়ে ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর সরকার গঠন করলেও এখন মনে হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কৌশল নির্ধারণে বিভ্রান্তি থেকে ভুগছে। রাষ্ট্রীয় শক্তির সঙ্গে দলীয় শক্তি এক করে কৌশল নির্ধারিত হওয়ায় তার প্রয়োগে দমন-নিপীড়নের বিষয় মূখ্য হয়ে উঠেছে এ কারণে যে, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে এখন সরকার সংকট সামাল দেওয়ার জন্য নির্ভর করছে প্রশাসনযন্ত্রের উপর। ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে রাজধানীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একদিন আগে-পরে সমাবেশ করলে কারও উত্থান-পতন হত না। আওয়ামী লীগ তা করেছেও একদিন পরে।

নাশকতার অজুহাত হাজির করে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রেখে ও ওই দিন সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কৌশল হিসেবে যা করল, তাতে গত এক বছরে সরকার তার ঝুলিতে যা সঞ্চয় করেছিল, নিজেই তা ফুটো করে দিয়ে একদিনেই ঝুড়ি হালকা করে ফেলল। খালেদা জিয়ার হালকা ঝুড়ি তাতে ভারিই হল। গণতান্ত্রিক অধিকারের বদলে সরকার তাঁর অফিসের সামনে যে ট্রাকভর্তি বালুর বস্তা রেখে দিয়েছিল, তা যে শাপে বর হয়েছে, সরকার মনে হয় তা আজও বুঝতে পারেনি। 'জনবিচ্ছিন্ন' খালেদা জিয়াকে জনপ্রিয় করার দায়িত্বটা যেন সরকার নিজের কাঁধেই নিয়ে নিয়েছে।

তৎকালীন পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ, উভয় আমলেই আমরা দেখেছি, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের নির্যাতন-নিপীড়ন করে বিভিন্ন স্বৈরাচারী সরকার বিভিন্ন সময় জনসমর্থন ও সহানুভূতি তাদের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের পঁচিশ বছরে সরকারের জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা ও প্রতিবেশি মিয়ানমারের অং সু চিকে জীবনের দীর্ঘ সময়ই কাটাতে হয়েছে কারার অন্তরালে।

আমাদের দুই নেত্রীকে মাইনাস করার জন্য তাদের বন্দি করে রেখে এক/এগারোর অবৈধ মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে 'মাইনাস টু' ফর্মূলা সফল হয়নি, উল্টো গণতন্ত্রকামী মানুষের রোষের মুখে তারাই বাংলাদেশের মাটি থেকে মাইনাস হয়ে গেছে। সেদিন জনগণ মতাদর্শের দৃষ্টিতে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেত্রী এবং বেগম খালেদা জিয়াকে বিএনপির নেত্রী হিসেবে দেখেনি, দেখেছিল গণতন্ত্রের প্রতীক রূপে। ২০০১-এর নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া যে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন, তারা ছিল 'মাইনাস টু' ফর্মূলার নিরব সমর্থক।

'মাইনাস টু' ফর্মূলা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন প্রতিশোধ নেয় মাতৃভূমির বিরুদ্ধেই। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১-এর নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, তারা তার উপর অস্ত্রোপচার করে ২০০৮-এর নির্বাচনে নিজেদের নিরাপদ নিষ্কৃতির জন্য। অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপির ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ও আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন সে ভারসাম্যহীনতা গভীরতর করে ছড়িয়ে দিয়েছে সমাজের সকল স্তরে। রাজনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে তার প্রভাব পড়ে যেমনি সরকারের সিদ্ধান্তে, তেমনি প্রভাব পড়ে প্রশাসনে, বিচার বিভাগে, এমনকি অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে। যে কারণে সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পায়।

গণতন্ত্রের এই গভীর সংকট চিন্তা-চেতনায় না থাকায় কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাই প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির। আমাদের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্র করেই– কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখার জন্য, কেউ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে। ফলে রাজনীতির নামে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে তার শিকার হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের মালিক নিরীহ জনসাধারণ। এই ক্ষমতার লড়াইয়ের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে একে অপরকে 'মাইনাস' করার ফর্মূলা।

মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অব্যাহত বিরোধের সুযোগেই মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন 'মাইনাস টু' ফর্মূলা গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছিল। এর আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই কৌশল হিসেবে অঘোষিত 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা কেন্দ্র করে তাদের রাজনীতি পরিচালনা করেছে, এখনও যা অব্যাহত রয়েছে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল রাষ্ট্রক্ষমতা স্থায়ীভাবে করায়ত্তে রাখার জন্য একে অপরকে নির্মূল করতেই 'মাইনাস ওয়ান' কৌশল গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগকে নির্মূল করা গেলে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে বিএনপির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না; তেমনি আওয়ামী লীগও চায় বিএনপিকে নির্মূল করতে পারলে সেই হবে ক্ষমতার একক প্রতিদ্বন্দ্বী।

আর এই দুই বৃহৎ দলের সঙ্গে ছোট ও মাঝারি ডান-বাম দলগুলো ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণের জন্য জোট বাঁধায়, তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির অভাবে জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। বাম দলগুলোর কয়েকটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে পরগাছার মতো ঝুলে আছে; বাকি বাম দলগুলো নামে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। পক্ষান্তরে, জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় নিজেই মহীরুহ হয়ে উঠছে। রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে জামায়াতের এই উত্থান কাউন্টার করতে পারত কেবল বাম মোর্চা, যা এখন চিন্তা করাও বাতুলতা।

কিছুদিন আগে একটা টেলিভিশন চ্যানেলে টক শো শেষে আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত জাসদের এক প্রভাবশালী নেতার (তিনি এমপিও) সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মৃদু বাক-বিতণ্ডা হচ্ছিল। আমার কথা শুনে তিনি এক পর্যায়ে খেপে গিয়ে বললেন, ''এই দুই দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) একটা শেষ না হলে দেশে শান্তি আসবে না, এবং সেটা অবশ্যই বিএনপি। কারণ মাইনাসের রাজনীতি বিএনপিই প্রথম শুরু করেছে। শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্যই একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল।''

ওই গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত আমলেই গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া। সরাসরি বিএনপিকে নির্মূলের কথা না বললেও প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন জোটের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীরা ইদানিং এই আভাস বেশ স্পষ্ট ও জোরালভাবেই দিচ্ছেন। শেখ হাসিনাকে 'মাইনাস' করার উদ্দেশ্যেই একুশের গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, এটা তারা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলার পরিকল্পনা ওই সময়ই হয়েছিল। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের 'মাইনাস টু' ফর্মুলা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আবার 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা বাস্তবায়নের তৎপরতা চলছে।

আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো মনে করে, ২০ দলের ডাকা অবরোধের মধ্যে যেসব সহিংস ও প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটছে তাতে কৌশলগত ও নৈতিকভাবে বিএনপি defensive অবস্থানে পড়ে গেছে। বিএনপির এই অবস্থান সামনে রেখেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী offensive কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে স্বীকার না করে বলছে এটা আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা। সুতরাং এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা, রাজনৈতিকভাবে নয়। অপরদিকে, বিএনপি একে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে আখ্যায়িত করে রাজনৈতিক সমাধানের দাবি করছে।

দুই দলের এই বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে বর্তমান সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। টেবিলের পরিবর্তে রাস্তায় সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত থাকলে দীর্ঘসূত্রতার কারণে জান-মালের আরও ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা বলাই বাহুল্য। আওয়ামী লীগের যুক্তি, সন্ত্রাসের কাছে নতি স্বীকার করলে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তেনের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিবর্তে বারংবার সন্ত্রাসেরই আশ্রয় গ্রহণ করা হবে এবং সেটা হবে দেশের জন্য একটা ভয়াবহ নজির। বিএনপি সংলাপ দাবি করলেও সংলাপের নিশ্চয়তা না পেলে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করবে না।

সর্বশেষ আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটে গেল, তা রাজনৈতিক পর্যাবেক্ষক ও সচেতন মহলের দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানানোর জন্য গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে। কিন্তু ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁকে অফিসের সামনে থেকেই ফিরে যেতে হয়েছে। এই অবমাননাকর ও শিষ্টাচারবর্জিত দৃশ্যে বিস্মিত ও আহত হয়েছে দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষ। শেখ হাসিনা যাচ্ছেন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তাঁর অফিসে– টেলিভিশনে এই খবর শুনে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির শিকার মানুষ ক্ষীণ হলেও আশার আলো খুঁজছিল। লক্ষ্যণীয় যে, এই একই গেট আগের বার বন্ধ করেছিল সরকার, এবার বন্ধ করল বিএনপি নিজেই।

পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ছোট হলেও এ ঘটনাই একটা বিশেষ বার্তা বহন করে। যে বার্তাটি বিএনপির উর্বর-মস্তিকের নেতারা পায়ে ঠেলে দিয়েছে।

অপর একটি ঘটনা বায়তুল মুকাররমে কোকোর নামাজে জানাজায় অবিশ্বাস্য জনসমাগম। কোকো বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন না এবং একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারী আসামি। এই বিশাল জানাজার বার্তা বুঝতে নিশ্চয়ই সরকারি মহলের ভুল হয়নি। সুতরাং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা খালেদা জিয়া ও তাঁর দলকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে জনবিচ্ছিন্ন বলে যে প্রচার চালিয়েছে, তা প্রতিষ্ঠা পায়নি।

২০-দলীয় জোটে বিএনপির পরেই বড় শরীক দল জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি ও জামায়াত একই সঙ্গে আন্দোলন করলেও তাদের মূল লক্ষ্য ভিন্ন। অস্তিত্ব-সংকটে জামায়াত বিএনপির ছত্রদায়ায় লড়াই করছে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, যে কারণে তারা বারংবার সহিংস হয়ে উঠছে। কাজেই জামায়াতের সহিংসতার দায় বিএনপি এড়াতে পারে না। জামায়াতকে বাদ দিয়ে এখন যেমন বিএনপির পক্ষে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি জামায়াত না থাকলে আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক রণনীতিও দুর্বল হয়ে পড়বে। কেননা আওয়ামী লীগ নবপ্রজন্মের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও স্বাধীনতাযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। তার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উদ্বুদ্ধ করে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা দলে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। তাদের এই প্রধান প্রতিশ্রুতি আংশিক বাস্তবায়িত হলেও আইনগত ও রাজনৈতিক কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ততদিন তারা জামায়াতের আশ্রয়দাতা ও রক্ষাকারী হিসেবে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে ঘায়েল করার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিশেষত জামায়াত নেতাদের বিচার শেষ ও শাস্তি কার্যকর হওয়ার আগে সরকার পরিবর্তন হলে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করে, তা হবে তাদের জন্য বিরাট রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং বিএনপির উপর ভর করে জামায়াত আবার রাষ্ট্রক্ষমতার শরীক হয়ে প্রতিশোধ পরোয়ন হয়ে উঠবে, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পরিবর্তে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াবে।

মিডিয়ার খবর অনুসারে দেখা যায়, বর্তমানে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটছে, তার সিংহভাগের জন্য দায়ী জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ও একই চিত্র দেখা গিয়েছে। একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি জামায়াত-শিবিরকে শক্তির মহড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

এখন আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি) দ্বারা বর্তমান সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলার সরকারি সিদ্ধান্ত কি জামায়াত-শিবিরের জন্য একই সুযোগ তৈরি করে দেয়নি? এই সংঘর্ষে রাষ্ট্রীয় শক্তির মুখোমুখি হবে জামায়াত-শিবিরের দলীয় শক্তি। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের সংহিস শক্তি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তিকেও সহিংস পথ বেছে নিতে হবে। যার অবধারিত পরিণতি সশস্ত্র সংঘাত ও রক্তপাত।

ইতোমধ্যে সহিংস ঘটনাবলী বিভিন্ন মাত্রায় ও বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়ি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে হামলা হচ্ছে, এমনকি বিচারকদের বাড়িও হামালা থেকে রেহাই পায়নি। পাল্টাপাল্টি আক্রমণে রাজনীতিকরাও আহত-নিহত হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতসমূহ যে হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তু হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

এমন অস্থির ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে সুযোগ বুঝে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী শক্তিসহ অসাংবিধানিক শক্তিও সক্রিয় হয়ে উঠে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ, এরই মধ্যে পুলিশ নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর ও জেএমবির বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, তারা নিষিদ্ধ জেএমবির সদস্য এবং জেএমবি নতুন করে সংগঠিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা করছে। ভারতীয় সংবাদপত্রগুলো গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃত করে খবর দিয়েছে, জেএমবির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ রয়েছে এবং জেএমবির পরিকল্পনা ছিল দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে হত্যা করা। বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ হলেও দুই নেত্রীর কেউই নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত নন, তা অতীতেও দেখা গেছে।

অস্তিত্ব সংকটে পড়ে জামায়াত বাঁচার জন্য ক্রমেই জঙ্গিরূপে আবির্ভুত হচ্ছে। এটা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই অবগত। কিন্তু জামায়াত যেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা– গিলতেও পারছে না, ফেলতেও পারছে না। আইন করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই কি সমস্যার সমধান হবে? জামায়াত নিষিদ্ধ হলে তার নেতা-কর্মীদের বিরাট অংশই চলে যাবে আন্ডারগ্রাউন্ডে, আরেক অংশ নানা ছদ্মবেশে অন্যান্য দল বিশেষত বিএনপির মধ্যে আশ্রয় নেবে। ওই অবস্থাতেই আবার সংগঠিত হয়ে তারা সুযোগ বুঝে নতুন রাজনৈতিক দলের নামে আত্মপ্রকাশ করবে।

জামায়াত ইসলামী ওয়াহাবী মতাদর্শের অনুসারী এবং তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সম্পর্কে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। সুতরাং আইনগতভাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না, বরং পরবর্তী সময়ে যে নামেই আবির্ভূত হোক, তখন হয়তো পুরোপরি জঙ্গিরূপেই আবির্ভূত হবে। কেননা পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে তার চেয়েও জঙ্গি আল-কায়েদা, তালেবান ইত্যাদি জঙ্গি ইসলামি শক্তির উত্থান। পাকিস্তানে জামায়াতের পরিণতির কথা ভেবেই বাংলাদেশে জামায়াত (বা পরবর্তীতে অন্য নামে) তার পূর্বের কৌশল পরিবর্তন করতে পারে।

মুসলমান-প্রধান প্রায় সব দেশে যেখানেই ইসলামি শক্তিগুলো রাজনীতিতে প্রধান্য বিস্তারের জন্য সক্রিয় সেখানেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও অস্থির হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টির আলামতগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ যখন খালেদা জিয়া ও তার দলকে নির্মূল করতে চায় এবং বিএনপি যখন শেখ হাসিনা ও তার দলকে অস্তিত্বহীন করার চেষ্টা করে, তখন তা জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামি শক্তির উত্থানের পথই প্রশস্ত করে দেয়। এক-এগারোর সেনাবাহিনী সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্ববধায়ক সরকার যখন দুই নেত্রী ও তাদের দলীয় নেতাদের কারাবন্দি ও নিপীড়ন করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের উপর আঘাত হানে, তখন জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো প্রতিবাদ না করে বরং নিরবে তাকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছিল। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের যোগসাজসের খবর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের কাছে অজানা থাকার কথা নয়।

যে পরিস্থিতিতে এক-এগারোর দুঃস্বপ্নের জন্ম হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে তার চেয়েও বহুগুণে ভয়াবহ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে যে সংহিস পরিস্থিতির সৃষ্টি, তার সঙ্গেও বর্তমান পরিস্থিতির গুণগত পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য কৌশলগত দিক থেকেও। আওয়ামী লীগ তখন offensive-এ যাওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক কৌশলেই প্রাধান্য দিয়েছিল। কৌশলের খেলায় বিএনপি হেরে গিয়ে নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল। বিএনপি ও জামায়াতের চেষ্টা আংশিক সফল হলেও আওয়ামী লীগ তার মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য সরকার গঠন করে।

আওয়ামী লীগের দলীয় শক্তির সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় শক্তি। ওই সঙ্গে প্রতিবেশি ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো বিদেশি শক্তিগুলোর সমর্থনও তাদের সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল। সুতরাং জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি যে শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় অবতীর্ণ হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারও তা মোকাবিলা করছে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় শক্তি দ্বারা।

এমন সর্বনাশা রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি কারও কাম্য না হলেও জামায়াত ও অন্যান্য জঙ্গি শক্তি এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। এমন অস্থির পরিবেশ-পরিস্থিতিই তাদের বিকাশ ও উত্থানের জন্য সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অন্তহীন বিরোধ ও সংঘর্ষ তাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান না হয়ে অব্যাহত থাকুক, এটাই তাদের কাম্য। ভারত ও বাংলাদেশের ইসলামি শক্তির প্রতি আল-কায়েদা প্রধান আল-জাওয়াহারির আহ্বান তাদের সেই ইচ্ছা ও কর্মকাণ্ডই উৎসাহিত করছে।

কারও পছন্দ-অপছন্দ যাই হোক, দ্বিদলীয় গণতন্ত্রই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী এ দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ক্ষমতার লড়াইয়ে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য পরস্পরের পরিপূরক শক্তি। একে অপরকে মাইনাস করে এককভাবে দুই দলের কারও পক্ষে এককভাবে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি– কে কত বড় গণতন্ত্রী, বর্তমান অবস্থায় তা নিয়ে বিতর্ক করাও অবান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুণগত কারণে নয়, বাস্তবতাগত কারণে আমাদের চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নিয়ামক শক্তি। এ প্রক্রিয়া থেকে বিএনপিকে 'মাইনাস' করা হলে আওয়ামী লীগ সরাসরি ইসলামী জঙ্গি শক্তির চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, আর আওয়ামী লগীকে মাইনাস করার চেষ্টা করা হলে বিএনপিকে গ্রাস করে ফেলবে জামায়াত ও তার সমমনা ইসলামি শক্তিগুলো। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে মাইনাস করার লড়াইয়ে অনড় থাকলে উভয়েই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে এবং বাংলাদেশেও ইসলামি জঙ্গি শক্তির উত্থান ঘটবে। এসব শক্তির উদ্ভব ঘটলে পরিস্থিতি কী হয়, আমাদের চোখের সামনে তার জলজ্যান্ত নজির পাকিস্তান ও আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো।

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই এর প্রতিফলন ঘটেছে দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে, প্রশাসনে ও বিচার বিভাগে। সরকার সংবিধান-প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার সীমিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে নীতি গ্রহণ করেছে, তা আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যারা মালয়েশিয়ার উদাহরণ টানেন, তারা দেশটির ভৌগলিক চিত্র, জাতিসত্তাগত বৈষম্য ও বিভক্তি, ধর্মীয় বৈচিত্র, সমাজবিন্যাস ও ব্যবস্থা বিবেচনায় না নিয়েই ঢালাওভাবে মতামত প্রকাশ করেন।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বৈদেশিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তাও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে দিল্লির সমর্থনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব নতুন করে দানা বেঁধে উঠেছে। দিল্লিতে সরকার বদল হয়েছে, কংগ্রেসের পরিবর্তে বিজেপি ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রাধিকারের নীতি ঘোষণা করেন। অর্থাৎ প্রতিবেশি দেশগুলোতে বিদ্যমান ভারতবিরোধী মনোভাব প্রশমন তাঁর সরকারের নীতির প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে তা অনুসৃত হবে, তা-ই স্বাভাবিক। কাজেই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দিল্লি কর্তৃপক্ষ পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের নীতি পর্যালোচনা করে নতুন নীতি নির্ধারণ করবে না, এমন ভাবা যুক্তিসঙ্গত নয়।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের নতুন পর্যায়ে ঘনিষ্ঠতাও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে। দীর্ঘদিন যখন ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্ক চলছে, তখনই আমরা দেখলাম, মোদী সরকারের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের এই মাখামাখি। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ বা counterweight হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে; সে ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটুকু অক্ষত থাকবে, তা বহুলাংশেই নির্ভর করছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন মাত্রায় কার্যকর হবে।

দেশের অভ্যন্তরীন ও বাইরের পরিস্থিতিসহ সকল বিবেচনাতেই মৌলিক জাতীয় ইস্যুগুলো ব্যাপারে ঐকমত্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর উপর আজ বিতর্ক থেকেই বহ্নিশিখার সৃষ্টি হয়েছে। এ বহ্নিশিখা নেভাতে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। কোনো খণ্ডিত বা তাৎক্ষণিক ইস্যুর সাময়িক সমাধান স্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নিশ্চয়তা দিতে পারে না। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন কী হবে, তা এই মুহূর্তে প্রধান ইস্যু হলেও জাতির জন্য এটাই একমাত্র ইস্যু নয়। গণতন্ত্র আর নির্বাচনতন্ত্র এক নয়।

সুতরাং নির্বাচন সংক্রান্ত একটা ইস্যুর সমাধান হলেই গণতন্ত্রের সব সমস্যার সুরাহা হবে, তা বলা যুক্তিসঙ্গত হবে না। এটা সম্ভবত শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার সৌভাগ্য যে, বর্তমান পরিস্থিতি তাদের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণে কিছু মহৎ 'কাজ' করার, যা আমাদের উত্তরসূরীদের সামনে দেশ পরিচালনায় পথনির্দেশনা হয়ে থাকবে। হাজারো সমালোচনার পরেও বলতে হবে তাদের অবর্তমানে যে নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা নিঃসন্দেহে দেশকে নতুন সংকটে নিমজ্জিত করবে।

যাহোক, বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতির ফাঁক দিয়ে জঙ্গি শক্তি মাথা তোলার চেষ্টা করছে। তা কেবল তখনই বন্ধ হতে পারে যদি গণতন্ত্রের পথ অবাধ, নিরপেক্ষ, ও কল্যাণমুখী হয়। তাহলে সমাজের ভেতর থেকেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের জনগণ চিন্তা-চেতনার নেতা-নেত্রীদের চেয়ে অগ্রগামী। পরস্পরকে 'মাইনাস' করার কৌশল পরিহার করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরস্পরের পরিপূরক শক্তি হিসেবে কাজ করলে জনগণ তাদের যাত্রাপথে অগ্রবর্তী কাফেলা হিসেবে সামিল হবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে প্রধান দুই দলের বিরোধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জিম্মি তারা। এই জিম্মিদশা থেকে তারা মুক্তি চায়। তারা মুক্তি পাবে যদি বাইরের সংঘাতকে ঘরে বন্দি করা যায়।

আর এ কাজটি করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে তিনি আলোচনার ডাক দিলে তাতে তাঁর প্রাপ্তিযোগই হবে, পরাজয় হবে না। তাঁর আহবান যেমন শর্তমুক্ত হতে হবে, তেমনি প্রতিপক্ষকেও সাড়া দিতে হবে শর্তহীনভাবে। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে বিএনপি-জামায়াত শর্তহীনভাবে সাড়া না দিলে এর দায়ভার তাদের ঘাড়েই পড়বে। তখন সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও নিরাপত্তাহীন মানুষ তাঁর পাশেই দাঁড়াবে।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।