একটুখানি চাওয়া

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 29 Jan 2015, 06:44 PM
Updated : 29 Jan 2015, 06:44 PM

১.

আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখি। বেশিরভাগ সময়েই বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্যে লিখি বলে আমার লেখালেখিতে দুঃখ-কষ্ট বেশি থাকে না। যদি কখনও কাহিনির খাতিরে অল্পবিস্তর দুঃখ চলে আসে, সেটা লিখতেও আমার খুব সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে কাল্পনিক চরিত্রের জন্যেই লিখতে লিখতে চোখ ভিজে আসে। যদি কখনও কেউ আমাকে বরিশালের বাসের হেলপার সোহাগ বিশ্বাসের কাহিনিটি দুঃখের একটা গল্প হিসেবে লিখতে বলত, আমি সম্ভবত লিখতে রাজি হতাম না; বলতাম, এটা মোটেও বাস্তব গল্প নয়– কোনো মানুষের জীবনে এত ট্র্যাজেডি হয় না। কিন্তু আমরা সবাই পত্রপত্রিকায় সোহাগ বিশ্বাসের কাহিনিটুকু পড়েছি; তাই সবাই জানি আমাদের দেশে মানুষের জীবনে এ রকম ট্র্যাজেডি হয়।

সোহাগ বিশ্বাসের বয়স মাত্র আঠার। বাবা নেই, মায়ের একমাত্র সন্তান। মা চোখে দেখেন না, সংসারে অর্থকষ্ট। সোহাগ শেষ পর্যন্ত বাসের হেলপারের একটা চাকরি পেয়েছে, বেতন তিন হাজার টাকা। প্রথম যেদিন কাজে যাবে, তার উৎসাহের সীমা নেই। মায়ের কাছে দোয়া নিয়ে কাজে যাবার আগে মাকে জিজ্ঞেস করেছে আজ রাতে কী খেতে চায়, সবকিছু সে কিনে আনবে।

সেদিন বরিশালে বিএনপি-জামাতের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, সোহাগ বিশ্বাসদের ট্রাকে তাই ভোরবেলা পেট্রল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দিল। ড্রাইভার কোনোমতে বেঁচে গেল, আঠার বছরের সোহাগ বাঁচল না, পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। মা চোখে দেখতে পায় না বলে সন্তানের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহটি দেখতে পেল না। তার কবর স্পর্শ করে চুপচাপ বসে রইল।

আমরা এখন জানি, আগুন ধরিয়ে কাউকে পুড়িয়ে মারতে পারলে তার রেট বিশ হাজার টাকা। সোহাগ বিশ্বাসকে পুড়িয়ে মেরেও সম্ভবত কেউ একজন বিশ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি গেছে। কিংবা কে জানে, হয়তো বিএনপি-জামাতের কর্মীরা নিজেরাই কাজটা করেছে, বিশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়নি। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, বিএনপি-জামাতের নেতাদের মুখে একটুকু হলেও উল্লাসের ছাপ পড়েছে যে, অন্তত আরও একজনকে পুড়িয়ে মেরে আন্দোলনটা আরও একটু এগিয়ে নেওয়া গেছে। আমি যখন এটা লিখছি, তখন পর্যন্ত ৩৬ জনকে পুড়িয়ে কিংবা বোমা মেরে মারা হয়েছে, আন্দোলনের সাফল্যের জন্যে সংখ্যাটি কতদূর নেওয়া হবে আমরা কেউই এখনও জানি না।

এই ৩৬ জনের মৃত্যু তালিকায় মাহবুবুর রহমকান বাপ্পীর নামও আছে। সে ছাত্রদলের কর্মী, ঘরে বসে বোমা বানানোর সময় হঠাৎ করে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে খুবই খারাপভাবে আহত হয়েছিল, ছিন্ন ভিন্ন একটা হাত কেটে বাদ দিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি। বিএনপির কোনো নেতা সম্ভবত তার এই কর্মীর জন্যে কোনো সমবেদনা জানাতে আসেনি। তার জন্যে নিশ্চয়ই কোনো শোকবই খোলা হয়নি, সেই শোকবইয়ে কেউ সাক্ষর দিতে আসেনি। আমার বাপ্পীর মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। রাজনৈতিক দলের যে নেতারা তাঁর সন্তানকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে, তিনি কি কখনও তাদের ক্ষমা করতে পারবেন?

খবরের কাগজে একটি অত্যন্ত বিচিত্র খবর চোখে পড়েছে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান "এজেন্ট ও গোয়েন্দা দিয়ে পেট্রল বোমা মেরে নিরাপরাধ মানুষ পুড়িয়ে তাদের পোড়া দেহ নিয়ে কুৎসিত রাজনৈতিক বেসাতি বন্ধ" করার জন্যে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আমি ঠিক জানি না কোন অপরাধটি বেশি জঘন্য– মানুষ পুড়িয়ে মারা, নাকি মানুষ পুড়িয়ে মারার পর এ রকম একটি বিবৃতি দেওয়া!

আমি অবশ্য এ ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের খুব একটা দোষ দিতে পারি না। আমাদের দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ খবরের কাগজ কিন্তু পেট্রল বোমা কে মারছে সেটা লিখতে খুবই সতর্ক। তারা সব সময় তাদেরকে 'দুর্বৃত্ত' বলে সম্বোধন করে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র যেহেতু এখনও জানে না কারা এই অমানুষিক নৃশংসতা করছে, তাহলে সেই সুযোগটি কেন জামাত-বিএনপি নেবে না? এই দেশে এত বড় সুযোগ আর কেউ কি তাদের জন্যে তৈরি করে দেবে? পত্রপত্রিকা পড়ে মাঝে মাঝে আমার গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলতে ইচ্ছে করে।

২.

আমাদের দেশে রাজনীতির হিসাব খুব সোজা। যদি সোজাসুজি পাওয়া না যায় সেটা জোর করে আদায় করে দিতে হবে। গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা জোর করে বন্ধ করার জন্যে জামাত-বিএনপি অনেক চেষ্টা করেছিল, অনেক বেশি মানুষ পুড়িয়ে মেরেছিল। শুধু স্কুলই পুড়িয়েছিল প্রায় দেড়শত। তবু একটা নির্বাচন হয়েছিল এবং নির্বাচনের পর মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম।

তারপর থেকে শুনেছি আন্দোলন হবে, সেই আন্দোলনে বেআইনি সরকার উৎখাত করা হবে। আমরা সবাই সেই আন্দোলন দেখার জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম; কখনও ভাবিনি আন্দোলনের অর্থ ঘরে বসে অবরোধ-হরতালের ডাক দেওয়া, আর সেই অবরোধ-হরতালের ডাকটি যেন মানুষের কানে পায় সে জন্যে পথে-ঘাটে যেখানে সম্ভব পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা। যত বেশি মানুষ মারা যাবে, পঙ্গু করা যাবে, তত সফল আন্দোলন।

রাজনীতির জন্যে আর সাধারণ মানুষের সমর্থনের প্রয়োজন নেই, দলের মানুষকে নৃশংস খুনি হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই হল। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির ভয় থাকলে টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, এক একজন মানুষকে খুন করার জন্যে বিশ হাজার টাকার চুক্তি। এই দেশে টাকার অভাব নেই। এক কোটি টাকার বাজেট করা হলে শ' পাঁচেক মানুষকে নিশ্চিন্তে পুড়িয়ে মারা যাবে; কী সহজ একটা হিসাব!

রাজনীতির এই হিসাব আমাদের দেশে ছিল না, এটা নূতন আনা হয়েছে। আফ্রিকায় 'বোকো হারাম', মধ্যপ্রাচ্যে 'আইএস' এ রকম অবলীলায় মানুষ মারতে পারে। আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য, এই দেশের বিএনপির মতো বড় একটা রাজনৈতিক দল জামাতের সঙ্গে একত্র হয়ে গেল, এখন বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্রটি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। এখন মানুষকে পুড়িয়ে মারা আর নৃশংসতা নয়, মানুষ হত্যা নয়– এটা খুবই সাধারণ একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।

আমার সঙ্গে বিএনপির কোনো রাজনৈতিক নেতার পরিচয় নেই, থাকলে তার একটি আঙুল ধরে তার নিচে একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দেখাতাম পুড়ে গেলে কী অমানুষিক যন্ত্রণা হয়। তারা এই দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, ৩৬ জন মারা গিয়ে যন্ত্রণায় অবসান ঘটিয়েছেন, বেঁচে থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আরও শত শত মানুষ।

৩.

বিশ্ব ইজতেমা এই দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্যে অনেক বড় একটি ব্যাপার। টেলিভিশনে একজনের বক্তব্য শুনছিলাম, হতদরিদ্র মানুষটি বলছিলেন, "আমার তো আর হজ্বে যাবার মতো টাকা নেই, তাই কোনোদিন হজ্বে যেতে পারব না। শুনেছি এটা হজ্বের পর সবচেয়ে বড় সম্মেলন, তাই এখানে এসেছি।"

আমরা সবাই ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই বিশ্ব ইজতেমার সময়টুকুতে অবরোধ তুলে দেওয়া হবে, দেওয়া হয়নি। শুধু যে তুলে দেওয়া হয়নি তা নয়, বিশ্ব ইজতেমা থেকে ফিরে আসা মুসল্লিদের বাসে পেট্রল বোমা মারা হয়েছে। নীলফামারীতে এভাবে একজন বিএনপি নেতার বাবা পুড়ে মারা গেছেন। বিএনপির সেই নেতা হতবাক হয়ে আছেন। এই ২৫ তারিখ সরস্বতী পূজা ছিল, কেউই আশা করেনি পূজার জন্যে অবরোধ তুলে দেওয়া হবে, কিন্তু অবরোধের সময় সেদিন আলাদাভাবে হরতাল ডেকে দেওয়া হবে সেটি বুঝতে পারেনি।

অবরোধ-হরতালের কারণে 'ও লেভেল', 'এ লেভেল' পরীক্ষাগুলো এদেশে বাতিল করতে হয়েছে; কাজেই এসএসসি পরীক্ষার সময় অবরোধ-হরতাল তুলে দিয়ে ছেলেমেয়েদের শান্তিতে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে সে রকম মনে হয় না। এই দুই দিনের অবরোধ-হরতাল হলে পরীক্ষা এক দুইদিন আগেপিছে নেওয়া যায়। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ, হরতাল থাকলে পরীক্ষা আগে পিছে নেওয়া যায় না, মনে হয় এই অবরোধ-হরতালের মাঝেই পরীক্ষা নেওয়া হবে। মা-বাবা তাদের সন্তানদের পরীক্ষা দিতে পাঠিয়ে দুর দুর বক্ষে অপেক্ষা করবেন।

এসএসসি পরীক্ষার সময় সন্ত্রাস, তাণ্ডব আরও বেড়ে যাবে কি না আমরা জানি না। যারা এই সন্ত্রাস, তাণ্ডব, নৃশংসতা করছে তাদের বলে কোনো লাভ নেই, তাই সে চেষ্টাও করছি না। খোদার কাছে দোয়া করি, আমাদের দেশের এই ছেলেমেয়েরা যেন ঠিকভাবে পরীক্ষা দিয়ে সুস্থ দেহে তাদের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারে।

৪.

আমরা খুব দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন খবরের কাগজে মানুষ পুড়িয়ে মারার ছবি দেখে, মানুষকে হত্যা করার খবর পড়ে দিন শুরু করতে হয়। মাঝে মাঝে খবরের কাগজটি সরিয়ে রাখি, যেন চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিলেই সেই দুঃসহ ঘটনাগুলো জীবন থেকে সরে যাবে। তারপরও আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, এই দেশ এর থেকে অনেক বড় বিপর্যয়ের পরও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মানুষ হত্যার এই নৃশংসতা নিশ্চয়ই এক সময় বন্ধ হবে। মা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর পর একটুখানি শান্তিতে থাকতে পারবেন। ট্রাক ড্রাইভারের স্ত্রী, হেলপারের আপনজনকে ভয়াবহ আতংক নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে না। একজন বাসযাত্রীকে পুলিশ প্রহরায় পথ চলতে হবে না। একজন ট্রেনের যাত্রীকে নিজের জীবন হাতে নিয়ে ট্রেনে উঠতে হবে না।

সাধারণ মানুষের জন্যে গভীর ভালোবাসার কথা মনে করে এই নৃশংসতা আর তাণ্ডব বন্ধ হবে সেটা আমরা কেউ মনে করি না। কিন্তু একটা রাজনৈতিক দল রাজনীতির কথা বলে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যে এক সময় রাজনৈতিক জগতে পুরোপুরি মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে, অন্তত সেই কথাটি মনে রেখে কি তারা এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে পারে না?

এই দেশের মানুষ তো খুব বেশি কিছু চাইছে না, শুধুমাত্র একটুখানি নিরাপদ জীবন চাইছে, সেটি কি খুব বেশি চাওয়া হল?

২৮ জানুয়ারি, ২০১৫

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।