ওবামার ভারত সফর: নতুন উচ্চতায় দুই দেশের সম্পর্ক

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 29 Jan 2015, 06:18 AM
Updated : 29 Jan 2015, 06:18 AM

প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার সদ্যসমাপ্ত তিন দিনের ভারত সফরকালে তিনি ভারতীয়দের মন জয় করতে মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ, শাহরুখ খান, মিলখা সিং, অলিম্পিক পদকজয়ী মেরী কম, এমন সব বিশিষ্ট ভারতীয়ের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায়। এদের মধ্যে শেষ তিন জন ভারতের সংখ্যালঘু তিন ধর্মের অনুসারী। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের এক শক্ত ভক্ত এবং অনুসারী রেভারেন্ড ড. মার্টিন লুথার কিংএর কথাও উল্লেখ করেছেন কয়েক বার। তাঁর নিজের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর 'কমন হাম্বল ব্যাকগ্রাউন্ড'এর উদাহরণ দিয়েছেন তিনি তাদের দুই দেশের 'ওল্ডেস্ট' ও 'লারজেস্ট' গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে। নরেন্দ্র মোদীর কুর্তা পরে প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর দেওয়া ভোজসভায় আসার ইচ্ছাও তাঁর ছিল, বলেছেন তিনি তাঁর ভোজসভার বক্তৃতায়।

প্রেসিডেন্ট ওবামার এটি দ্বিতীয় সফর ছিল ভারতে, তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমবার মুম্বাইতেই নেমেছিলেন তাঁরা, ২০১০ সালে। তখন দিওয়ালির উৎসব চলছিল। বারাক ওবামা এবং তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামা তখন ক'জন স্কুলছাত্রীর সঙ্গে নেচেছিলেনও। এইবার তারা নাচত পারলেন না বলে ওবামা কৌতুক করেছেন ফোর্ট সিরির অডিটরিয়ামে প্রায় দুই হাজার তরুণ-তরুণীর উদ্দেশে দেওয়া তাঁর প্রায় ৫০ মিনিটের বক্তৃতায়। প্রথম দিন, ২৫ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর ভোজসভায় তিনি কৌতুক করেছিলেন এই বলে যে, মুম্বাইতে সেই নাচের পর দিন একটি ভারতীয় পত্রিকা শিরোনাম করেছিল, 'মিশেল রকস ইন্ডিয়া'; মানে, 'মিশেল ওবামা ভারতকে নাচিয়ে ছেড়েছেন'। মিশেল ওবামার বিপরীতে তাঁর নাচে ভারতীয় গণমাধ্যম তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি, মুচকি হেসে 'ক্ষোভ' প্রকাশ করলেন তিনি।

ওবামা তাঁর এই সফরে হিন্দি ভাষারও ব্যবহার করেছেন কতগুলো জায়গায়। যেমন, নতুন দিল্লিতে ২৫ তারিখে নেমেই বললেন: ''মেরা পেয়ার ভরা নমস্কার।''

ফোর্ট সিরির বক্তৃতা শুরু করলেন 'নমস্তে' বলে। তারপর বললেন: ''বহুত ধন্যবাদ।''

শাহরুখ খানের নাম উল্লেখ করে তাঁর অভিনীত ১৯৯৫ সালের 'ব্লকবাস্টার' হিন্দি ছবি 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে'এর একটি ডায়ালগ বললেন: ''সিনোরিতা, বড়ে বড়ে দেশো মেঁ…।''

তরুণ-তরুণী ভরা অডিটরিয়ামের শ্রোতাদের উদ্দেশে তারপর তিনি প্রশ্ন করলেন, ''তোমরা বুঝতে পারছ তো আমি কী বলেছি?''

উপস্থিত তরুণ গোষ্ঠীও হাততালি দিয়ে জানান দিল, তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছে: ''The brave-hearted will take away the bride.''

তবে ওবামা-দম্পতির জন্য দুঃখ রয়েই গেল। তাঁরা সারা দুনিয়ার মানুষের প্রেম-ভালোবাসার একটি প্রতীক তাজমহল দেখতে যেতে পারেননি। কিং আবদুল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে এবং নতুন বাদশাহ সলমানকে অভিনন্দন জানাতে ভারতে তাদের এই সফর কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে তাঁরা ওয়াশিংটন ফেরার পথে ৪ ঘণ্টার জন্য রিয়াদ সফর করেন। তাতে তাদের তাজমহল সফর বাদ দিতে হয়।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এইবার ভারতের জাতীয় দিবসের প্যারেডে প্রধান অতিথি ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ২০০৬ সালে ভারতের এই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কিং আবদুল্লাহ প্রধান অতিথি ছিলেন। তখন বাদশাহ আবদুল্লাহ ভারতে তাঁর সফর শুরু করে পাকিস্তান এবং চীনও সফর করেছিলেন। ভারত সফরকালে বাদশাহ আবদুল্লাহ ভারতকে তাঁর 'সেকেন্ড হোম' হিসেবেও বর্ণনা করেছিলেন বলে মনে পড়ে।

এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করি যে, এই প্যারেডে প্রধান অতিথি হিসেবে ২০০০ সালে উপস্থিত ছিলেন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ওবাসানজো, তার পরের বছর আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা, ২০০২ সালে মরিশাসের প্রেসিডেন্ট কাসাম উত্তীন, তার পরের বছর ইরানের প্রেসিডেন্ট খাতামী, ২০০৪ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা এবং ২০০৫এ ভুটানের রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক। এই তালিকার প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গেই ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার এখন পর্যন্ত ভারতের এই অনুষ্ঠানটিতে প্রধান অতিথি হননি।

–দুই–

আমেরিকার একই প্রেসিডেন্ট ৫ বছরের ব্যবধানে দুই দুই বার ভারত সফর করেছেন। সফর করেছেন মাত্র ৫ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ওয়াশিংটনে। এই সফরকালে তিনি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' শ্লোগানে অনাবাসী ভারতীয় এবং দুনিয়ার সকল বিনিয়োগকারীকে ভারতে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান। তার আগে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও সফর করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রও সফর করেছেন ভারত। অন্তত প্রতীকী অর্থে দুই দেশের নেতৃবৃন্দের এমন সব উচ্চতম পর্যায়ের সফর দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।

প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সর্বসাম্প্রতিক সফর আগের যে কোনো উচ্চ পর্যায়ের সফরকে ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়।

বস্তুত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে যে আন্তরিক ব্যক্তিগত সম্পর্ক, 'কেমিস্ট্রি' স্থাপিত হয়েছে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে বড় এক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রোটোকল ভেঙে নিজেই বিমানবন্দরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তাঁকে তাঁর ফার্স্ট নেম 'বারাক' হিসেবে ডেকেছেন, নতুন দিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে হায়দারাবাদ হাউজের 'লন'এ হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে এবং পরে পাশাপাশি সোফায় বসে 'চায়ে কি চর্চা'তে, মানে, চা খেতে খেতে জটিল বিষয়গুলো সন্তোষজনকভাবে নিষ্পত্তি করেছেন; এসবের মধ্যে ভারতের দিক থেকে 'সিরিয়াস' আন্তরিকতা অবশ্যই প্রতিফলিত হয়েছে।

ওবামা তাঁর সফরের শেষ দিন, মানে, গতকাল, ২৭ জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদীর উপস্থাপনায় মোদীর সঙ্গে 'মন কি বাত', মানে, 'মনের কথা' নামের প্রায় ৫০ মিনিটের একটি প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে টেলিফোনে করা ভারতীয়দের কতগুলো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। জবাব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীও।

দুটো বিশেষ অনুষ্ঠান, ভারত ছাড়ার আগে তরুণদের উদ্দেশে দেওয়া প্রেসিডেন্ট ওবামার ভাষণ এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তাঁর 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে সারা ভারতের সকল শ্রেণির, সকল বয়সের মানুষের কাছে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে দারুণ জনপ্রিয়তা দিয়েছে বলে মনে হয়।

প্রেসিডেন্ট ওবামাও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টই কোনো ভারতীয় প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে যাবেন না। তারপর প্রধানমন্ত্রী মোদী এতবার বারাক ওবামাকে 'বারাক' ডেকেছেন, কিন্তু বারাক ওবামা একবারও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে 'নরেন' বা 'নরেন্দ্র' ডাকেননি।

তারপর আরও কথা আছে। ভারতের পত্রপত্রিকা এবং টিভি রেডিও বারাক ওবামার এই সফরে যেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে পরপর এই কয়েকদিন, তার ভগ্নাংশও দেখা যায়নি আমেরিকার গণমাধ্যমে। আজ বুধবারের 'দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস' পত্রিকার একটি শিরোনাম হচ্ছে: ''Barack Obama's India trip struggles to make it to US headlines.''

এখানেই প্রশ্নটা উঠে, আমেরিকা গণতন্ত্রের কথা যতই বলুক, মূলত এই দেশটিতে 'ক্যাপিটালিজম'এর পুজা করা হয়। ডেমোক্রেসির আগে, তাদের কাছে 'ক্যাপিটালিজম'ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিপতিরা চীনকেই একটি বেশি আকর্ষণীয় এবং সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে দেখে। চীন নামে 'কম্যুনিস্ট' হলেও, 'ক্যাপিটালিজম' চর্চা করে চলেছে কোনো রকমের সংকোচ, সংশয় ছাড়াই, সেই ১৯৮০ সাল থেকে। তার বিশাল ইতিবাচক ফলও পেয়েছে চীন। প্রায় ২০০ মিলিয়ন, ২০ কোটির মতো মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচ থেকে উপরে উঠিয়ে আনতে পেরেছে চীন; এতে সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি মধ্যবিত্ত। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি, বাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, দামি পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, দেশে-বিদেশে পর্যটন, ভ্রমণের চাহিদাও বেড়েছে এই দেশটিতে। আর এমন সব 'কনজুুমার ডিউরেবলস'এর জোগান দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে চীনে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সবগুলো 'ক্যাপিটালিস্ট' দেশ। আমেরিকার কাছেও এই বাজারের আকর্ষণে চীন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রেসিডেন্ট ওবামার সফরটি চীনে হলে মার্কিন গণমাধ্যমও বেশি আগ্রহ দেখাত, যেটি তারা দেখায়নি ভারতের ক্ষেত্রে।

–তিন–

ভারতও অবশ্যই পশ্চিমের 'ক্যাপিটালিস্ট'দের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। তবে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সমাজতান্ত্রিক নীতি আদর্শের বিপরীতে ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির 'ক্যাপিটালিজম'এর প্রতি অনুরাগ বিশ্বাস কোনো গোপন বিষয় নয়। বস্তুত গত মে মাসের যে সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী ভূমিধ্স বিজয় অর্জন করলেন, সেই নির্বাচনে ভারতের শিল্পপতি এবং পুঁজিপতিরা নরেন্দ্র মোদীর বিজয়ের জন্য বিশাল অংকের বিনিয়োগও করেছিল। প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ভোজসভায় ২৫০ জন অতিথির মধ্যে ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশিতভাবেই বড় সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর সরকারে এই শিল্পপতি, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আধিপত্য এবং গুরুত্বও তাই লক্ষ্যণীয়ভাবে দেখা গেল। ভারত এবং আমেরিকার বড় বড় কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীরাও প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে আলাদা সভা-সমিতি করেছেন। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ বর্তমানের ১০০ বিলিয়ন (প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসেবে এক বিলিয়নে বাংলাদেশি টাকায় ৮ হাজার কোটি টাকা) থেকে আগামী ৫ বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার আশা করছে দুই দেশের সরকার এবং ব্যবসায়ীরা।

গত ২৬ জানুয়ারি, 'রিপাবলিক ডে'তে 'একটি ইন্টারেস্টিং' এবং একই সঙ্গে উদ্বেগজনক ঘটনাও ঘটেছে। 'রিপাবলিক ডে' উপলক্ষে প্রচারিত সরকারি বিজ্ঞাপনে ভারতীয় সংবিধানের 'প্রিএমবেল'এর ''ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট, সেক্যুলার রিপাবলিক''এর 'সোশ্যালিস্ট' ও 'সেক্যুলার' শব্দ দু'টি বাদ পড়ে গিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই বাদ পড়া অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

নরেন্দ্র মোদীর সরকারটিকে যেভাবে সংঘ পরিবারের 'আরএসএস', (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দল চাপে রেখেছে তার প্রতিফলন নরেন্দ্র মোদী সরকারের কিছু নেতা-মন্ত্রীর কাজে এবং কথায়ও দেখা যাচ্ছে। মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার যে 'ওয়াফেসি' প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে কতগুলো জায়গায়, তার নিন্দা করেননি নরেন্দ্র মোদী। এই ইস্যুতে তাঁর একটি বিবৃতির দাবিতে লোকসভার অধিবেশন অচল করে রেখেছিল কতগুলো বিরোধী দল। কিন্তু তারপরও তিনি নিরবই থেকেছেন।

ভারতের তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে দেওয়া তাঁর বক্তৃতায় ওবামা ভারতের নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া স্বাধীনতার উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ''India's success depends on religious unity.''

তিনি জাতি, ভাষা, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও বলেছেন। কিন্তু গতকাল থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে বারাক ওবামার বক্তৃতার উল্লেখ করে বলছে, ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যেমন বেশি দেখা যাচ্ছে, তার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন তিনি। এই কথাগুলো বলার সময়ে ২০০২তে গুজরাটে মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে মুসলমান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে তার প্রতিও হয়তো তিনি ইঙ্গিত করে থাকতে পারেন। ওবামার নিশ্চয়ই মনে আছে, তাঁর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গুজরাটের এই দাঙ্গার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নরেন্দ্র মোদীকে ১০ বছর ভিসা দেয়নি। এখানে, প্রসঙ্গক্রমে কথাটি বলতেই হয় যে, জাতীয় স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো সিদ্ধান্ত রিভিউ করতে পারে, বদলাতে পারে। পারে যে কোনো দেশ জাতীয় স্বার্থে। পারে বাংলাদেশও।

–চার–

বিদ্যুৎ উৎপাদনে আণবিক শক্তির ব্যবহারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ভারতের মধ্যে যে চুক্তিটি ২০০৮ সালে সম্পাদিত হয়েছিল সেখানে একটি বিরোধ থেকে গিয়েছিল, ভারতে এমন কোনো স্থাপনায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়ভার কার হবে। এই প্রসঙ্গে ভারতের ভুপালে মার্কিন মালিকানাধীন কারখানার শিল্প দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু এবং আরও কয়েক লক্ষ লোকের পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা মনে রেখেই ভারতের দিক থেকে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ভারত বলছিল, দায়ভার হবে 'আ্যাটমিক রি-অ্যাক্টর' সরবরাহকারীর; আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছিল, দায়ভার হবে অপারেটরের– যারা 'রি-অ্যাক্টর' চালাবে, তাদের। এই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে এই মর্মে যে, অপারেটর, মানে ভারতই দায়ভার বহন করবে। তবে এর অর্ধেক বহন করবে ভারত সরকার; বাকি অর্ধেক ভারতের ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলো।

এখন আমেরিকার 'রি-অ্যাক্টর' প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ভারতে তাদের 'রি-অ্যাক্টর' রপ্তানির বিরাট বাজার পেয়ে গেল। এখানে উৎপাদন করে তারা হয়তো দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও তা রপ্তানি করতে পারবে। এখানে আরও উল্লেখ করা দরকার, 'ওয়েস্টিং হাউজ' নামের যে কোম্পানিটি 'রি-অ্যাক্টর' উৎপাদন করে, তার প্রধান নির্বাহীও ওবামার সঙ্গে ভারত সফরে এসেছিলেন।

যে তিনটি অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে এই সফরকালে দুই দেশের মধ্যে, তার একটি– দুই দেশের 'স্ট্র্যাটেজিক ভিশন'। ওবামা ভারতকে এই অঞ্চলের, মানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থিতিশীলতা রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বানে চীনকে ঘিরে রাখার একটি কুটকৌশল দেখতে পাচ্ছে চীন। চীনের সাবমেরিন দেখেছে ভারত, কলম্বোর পাশের সমুদ্রে। আবার ভারত চীনের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভিয়েতনামের সমুদ্রে তেল অনুসন্ধানের চুক্তি পেয়ে কাজ করছে। চীন যদি ভারত মহাসাগরে এবং ভারত-আমেরিকা যদি চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নামে, যার আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্যও 'টেনশন' সৃষ্টি করবে।

ওবামার ভারত সফরকালেই চীন বলেছে, পাকিস্তান ''Irreplaceable all-weather friend of China.'' প্রেসিডেন্ট ওবামা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের একটি স্থায়ী আসনের দাবিতে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান এ সমর্থনের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছে, কাশ্মিরের ওপর নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ভারত মানেনি; সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নেই ভারতের।

আমেরিকা এবং ভারত দুটো দেশই সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত। ওবামার সফরকালে সন্ত্রাস দমনে এই দুই দেশ আবার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। সন্ত্রাস লালন-পালনের কারণে পাকিস্তানের প্রতি এই দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই।

পাকিস্তানের অনেকেই মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর এই ভারত সফর দিয়ে পাকিস্তানকে 'স্নাব' করেছেন।

এত বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু– ভারতের সবচাইতে বড় অস্ত্র-জোগানদাতা– প্রথমে সোভিয়েট উইনিয়ন এবং এখন রাশিয়া, ভারতের নতুন মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই অঞ্চলে ব্যালেন্স রক্ষা করতে ভারতের জায়গায় নতুন মিত্র খুঁজতে পারে। আমরা তখন কোন দিকে থাকব?

'শিউলীতলা', উত্তরা; বুধবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৫।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।