জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামির কারণ

মেহেদী আহম্মদ আনসারী
Published : 19 March 2011, 12:25 PM
Updated : 19 March 2011, 12:25 PM

জাপানে ভূমিকম্প এবং সুনামি প্রতি বছরই আসলে হয়। সুনামির একটা প্রিকন্ডিশন আছে। যখন কোন ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সমুদ্রের মধ্যে থাকে এবং তার মাত্রা ৭ বা ৭-এর অধিক হয় তখন টেকটোনিক প্লেট তুলনায় খাড়াভাবে উঠে এলে সুনামির সৃষ্টি হয়। ৮.৯ মাত্রার জাপানি ভূমিকম্পে একটা প্লেট আরেকটা প্লেটের তুলনায় প্রায় আট ফুট উঠে গিয়েছিলো। যেখানে সুনামি সৃষ্টি হয় সেখানে পানির গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৪ শ' থেকে ৫ শ' কিলোমিটার গতি লাভ করে। তারপর যখন এই ফুলেফেঁপে ওঠা পানি ডাঙার কাছে আসে তখন এর গতিবেগ শূণ্যতায় নেমে আসে এবং বাধা পাওয়ার কারণে উচ্চতা অনেক বেড়ে যায়। জাপানে এই ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এর উচ্চতা ছিলো প্রায় ৩০ ফিটের মতো। ডাঙার প্রায় ৬০ কিলোমিটার গভীরে ঢুকে গিয়েছিলা। এই সীমার মধ্যে যা কিছু ছিলো তার সব তছনছ করে ফেলেছে। জাপানে এই ভূমিকম্প এবং তার পরবর্তী সুনামির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে যে ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই নগণ্য। বরং ভূমিকম্প থেকে উদ্ভূত সুনামির কারণেই জাপানে এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও প্রায় ৭ হাজার ৩ শ' মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নিখোঁজ ১১ হাজারের মতো লোক। জাপানে যেহেতু প্রতি বছরই মোটামুটি বড় ভূমিকম্প ও সুনামির সৃষ্টি হয় তাই এদের বাসাবাড়ি এবং অন্যান্য স্থাপনাগুলো ভূমিকম্প-সহনীয় হিসেবে নির্মিত হয়ে থাকে।

এই বিষয়ে তাদের অভ্যস্থতার কারণেই ভূমিকম্প ও সুনামি পরবর্তী সময়ে তারা ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে বরং সুশৃঙ্খলভাবেই তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিয়েছে।

এই প্রসঙ্গে গত বছরে হাইতিতে ৭.৫ মাত্রার এবং চিলিতে ৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্প উল্লেখযোগ্য। এই ক্ষেত্রে হাইতির ভূমিকম্পটি অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও ওখানে যথাযথ ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন ও স্থাপনা না থাকায় প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার লোক প্রাণ হারায়। অন্যদিকে, চিলির ভূমিকম্পটি কয়েকগুন বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদের ভবন ও স্থাপনার নির্মাণ কৌশল ভূমিকম্প-সহনীয় হওয়ায় ৫ শ' জন প্রাণ হারিয়েছে।

আমাদের এখানে অনেকে চিন্তিত হলেও ভয়ের কোন কারণ নেই। ২০০৪-এ ইন্দোনেশিয়া যে ভূমিকম্প ও সুনামি হলো প্রায় দু হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী বাংলাদেশে এর কোন প্রভাব পরে নি। সেই তুলনায় জাপান বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি দূরে। অতএব আমাদের ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ই তাহলে সেটা দেশের ভিতরে এবং পার্শ্ববর্তী ভারত এবং মিয়ানমারে অবস্থিত ভূচ্যুতির (Fault) কারণেই সংঘটিত হবে।

এই অঞ্চলে ১৮৬৯ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬/৭ টি ৭ এবং ৭-এর অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিলো। এর মধ্যে ১৮৬৯ সালের কাছার ভূমিকম্প, ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল আর্থকোয়েক, ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯৩০ সালের ধুবরী ভূমিকম্প ও ১৯৩৪ সালের বিহার-নেপাল ভূমিকম্প উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ১৬৬৪ সালের অবিভক্ত বঙ্গে সংঘটিত ভূমিকম্প, ১৭৬২ সালের আরাকান ভূমিকম্প এবং ১৮৫৮ সালের মিয়ানমারে সংঘটিত ভূমিকম্প উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি ইউএনডিপির অর্থায়নে সংঘটিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই অঞ্চলের ভূমিকম্পগুলো প্রায় আড়াই শ' থেকে সাড়ে তিন শ' বছরের মধ্যে ঘটতে পারে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে।

উল্লেখিত সবগুলো ভূমিকম্পের মাত্রা ৭-এর ছিলো। ক্ষয়ক্ষতি বিপুল হলেও জনসংখ্যার ঘনত্ব কম থাকায় কোন ক্ষেত্রেই ১৫ শ' জনের বেশি প্রাণ হারায় নি। এ সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিলো মাত্র ৯০ হাজার। সেই তুলনায় ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের উপরে। ঐ সময়ে ঢাকায় পাকা বাড়ির সংখ্যা ছিলো শ' খানেকের মতো। এই শ' খানেক পাকা বাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো এবং এই বাসাবাড়ি ভেঙে পড়ার ফলে ১০ থেকে ১৫ জন লোক প্রাণ হারায়। এখন ঢাকায় পাকা বাসাবাড়ির সংখ্যা প্রায় সারে তিন লাখ। এইসব বাসাবাড়ির অনেকগুলোই ডোবা, নালা, খাল বিল ভরাট করে ভূমিকম্প-প্রতিরোধহীন হিসেবে নির্মিত। সরকার যদি এখনই নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প-সহনীয় হওয়ার বিষয়টি রাজউক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির পরিমাণ হবে বিপুল।

মেহেদী আহম্মদ আনসারী : অধ্যাপক ও ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞ।