কে কীভাবে মরবে আজ

শামীম আহমেদ
Published : 24 Jan 2015, 09:03 AM
Updated : 24 Jan 2015, 09:03 AM

শিরোনামটি খুব নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে। কিন্তু এটাই কি আমাদের আজকের সময়ের নির্মম বাস্তবতা নয়? সপ্তাহ খানেক আগের এক সন্ধ্যায় গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলাম উত্তরা থেকে। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, ইজতেমার কারণেই কিনা কে জানে। আমার ছোটখাট গাড়িটিতে বিবিসির খবর শুনছি। দেশের খবর, বিদেশের খবর। নতুন বিচারপতি শপথ নিয়েছেন। বেলজিয়ামে ইসলামি জঙ্গি নিহত; প্যারিসে উত্তেজনা; নাইজেরিয়ায় জাতিগত দাঙ্গায় মুসলমান খুন; জার্মানিতে ইসলামের উত্থানের প্রতিবাদে একত্রিত হচ্ছে নব্য নাৎসিরা। কত খবর; কত তার রকম; কত না চিন্তারই জন্ম দেয়!

আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। একটু গরম লাগছিল। ভাবলাম, এসি চালু করবার দরকার নেই, জানালাটা হালকা করে খুলে দিই। খবর শেষ। সাহানা বাজপেয়ীর রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দিলা– ''তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে''– অদ্ভুত ভালো লাগছিল। কিন্তু হোটেল রিজেন্সির কাছে আসতে না আসতেই তীব্র জ্যাম। ডান পাশে একটা কাভার্ড ভ্যান। বাম পাশে যাত্রীবাহী বাস। সামনে প্রাইভেট কার।

হঠাৎ করেই অস্বস্তি শুরু হল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শহরটা অনিরাপদ হয়ে যায় আমাদের জন্য। শহরের নানা প্রান্তে একযোগে পেট্রোল বোমার হামলা হয়। বাস পোড়ে; গাড়ি পোড়ে; কাভার্ড ভ্যান পোড়ে; আর সঙ্গে পোড়ে মানুষ। নারী-পুরুষ-শিশু; অফিস-ফেরত লোক; হাসপাতালে যাবার সময় সাধারণ মানুষ; স্কুলের রাস্তায় শিক্ষার্থী– আরও কত পথে কত কী'

পরের দিন পত্রিকায় পোড়া লাশের ছবি আসে, মনে হয় এইচবিওতে 'মমি' মুভিটা দেখছি। অস্থির লাগে। এইসব চিন্তা করতে করতে গাড়ির জানালা তুলে দিই। এসিটা ছেড়ে দিই অন্যমনস্কভাবেই, মনে হয় একটা ফায়ার ডিস্টিংগুইসার কিনতে হবে সহসা। গাড়িতে আগুন লাগলে শুধু তা নেভাতে না, বরং নিজে গাড়ি থেকে নেমে পালানোর একটু সুযোগ তৈরি করে নেবার জন্য।

বেশ ক'দিন হয়ে গেল শহরটা ভালো নেই, দেশটা ভালো নেই। ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিল না সরকার। বিএনপি আন্দোলনের ডাক দিল। যদিও অনেকেই বলছেন, আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সাংবাদিকরা। বেগম জিয়ার মুখ দিয়ে জোর করেই তারা বলিয়ে নিয়েছেন অনির্দিষ্টকালের অবরোধের কথা; হতে পারে। কিন্তু দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দু'বারের বিরোধী দলীয় নেত্রী যদি সাংবাদিকদের প্ররোচনায় আন্দোলনের ডাক দেন, তার দায় কিন্তু তাকেই নিতে হবে।

বেগম জিয়া কেন এই মানুষ হত্যার আন্দোলনে নামলেন তা তিনিই বলতে পারবেন। আন্দোলনের জন্য ভালো সময় হল তখন, যখন সরকার দুর্বল থাকে, বিপদে থাকে। গত এক বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার সম্ভবত এই সময়টাতেই সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। অর্থনীতি শক্তপোক্ত, পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে, বড় কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই, আন্তর্জাতিক মহল সরকারকে বলা যায় মেনেই নিয়েছে, সামনে মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি আমরা, এমতাবস্থায় আন্দোলন– অনেকের মতো আমার কাছেও পুরোপুরি অপরিপক্ক মনে হয়েছে।

অন্যদিকে, বিবেকবান মানুষরাই যে শুধু বুঝতে পারছেন না তা নয়, বরং আমার মতো নাদান বান্দারাও কীভাবে বুঝবে যে ক্ষমতাসীন সরকার এত শক্তিশালী অবস্থানে থেকেও কেন বিএনপিকে একটা মামুলি জনসভা করতে দিল না। বেগম জিয়া গত এক বছরে জনসভা করেছেন ১৪টা; তার সবগুলো মিলেও এক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। এই সভাগুলোর একটিতেও এমন কোনো বক্তব্য আসেনি যা সাধারণ মানুষকে আলোড়িত করেছে, আলোকিত করেছে। সাদামাটা জনসভা বলতে যা বোঝায় তাই আর কী। এই এক বছরে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কোনো অবস্থানই তৈরি করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ছিল অত্যন্ত নিরাপদ অবস্থানে। এমতাবস্থায় যেচে পড়ে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দিয়ে বেগম জিয়াকে অং সান সুচির অবস্থানে নেবার রাস্তা তৈরি করে দেবার সিদ্ধান্ত যে কতটা আত্মঘাতী তা বুঝবার জন্য নিঃসন্দেহে রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

অফিসে, বন্ধুদের আড্ডায়, চায়ের দোকানে সবখানে একটাই প্রশ্ন– এরপর কী হবে, এ অবস্থার কবে শেষ হবে? আমি একজনকেও বলতে শুনিনি যে, তারা বিশ্বাস করেন এসব করে আওয়ামী লীগকে দিয়ে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করানো যাবে। সবার আশঙ্কা, দেশ আরও সহিংসতার দিকে যাবে, গত বছর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবার পরে এবার আবার লাগাম ছাড়াবে। আরও মানুষ পুড়বে, মরবে, সরকার আরও উন্নাসিক এবং আক্রমণাত্মক হবে, বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়ন বাড়বে। এরপর আবার সব নিস্তেজ হয়ে কিছুদিনের জন্য শীতনিদ্রা।

মানুষ শান্তিতে নেই। ঘর থেকে বের হতে টেনশন, ফিরতে টেনশন। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে ঘরে বসে বাবা-মায়ের প্রতীক্ষা– জীবন থমকে গেছে। সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে বিএনপির এই সহিংস আন্দোলনে মানুষ মরছে, বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হচ্ছে, জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। দু'টি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিকের গত এক বছরের জরিপে দেখা গেছে, সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং বিএনপি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। মানুষকে পুড়িয়ে, জান-মালের ক্ষতি করে ক্ষমতায় যাবার দিন যে শেষ হয়ে গেছে তা বিএনপি কবে বুঝবে কে জানে!

কিন্তু এটি সরকারের দায়িত্ব যে তারা সহিংসতা থেকে বাঁচাবে সাধারণ মানুষকে। প্রতিদিন দশ-বার জন মানুষ মারা পড়বে, কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হবে, আর সরকারের উচ্চপদস্থ মানুষজন বলবেন, আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে, কিন্তু আদতে কিছু করবেন না, সেটি আমাদের মেনে নেবার কোনো কারণ নেই। একটি আগুন ধরবার ঘটনাও পুলিশ ঠেকাতে পারবে না, কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না, এটি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে পুলিশ কিংবা সরকারের সম্পৃক্ততার কথা যদি কারও মনে দানা বাঁধে তবে তার দায়ও সরকারের।

ক্ষমতায় থাকার আর ক্ষমতায় যাবার এই অশ্লীষ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্লান্ত মানুষ। আমরা অবরোধ, হরতাল চাই না। মানুষ মারার এই খেলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা দেখতে চাই, দেখতে চাই একটি মধ্যম-আয়ের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তর তর করে– খুন-জখম-জিঘাংসা ছেড়ে– এতটুকুই।

খুব বেশি চাওয়া কি আমাদের?

শামীম আহমেদ: উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।