সউদি আরব: বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 25 Jan 2015, 10:28 AM
Updated : 25 Jan 2015, 10:28 AM

বাংলাদেশের চলমান সংকটটি দেশের সবগুলো গণমাধ্যম– টিভি, রেডিও এবং পত্রপত্রিকাগুলোকে সঙ্গত এবং যথার্থ কারণেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে নতুন বছরের শুরু থেকেই। বিএনপি এবং জামাতের সন্ত্রাসীদের হামলায় নিরীহ মানুষজন– শিশু, কিশোর, যুবক, প্রবীণ, বাস হেলপার, ছাত্রছাত্রী কতসব নিরীহ মানুষের অগ্নিদগ্ধ লাশের ছবি। দেশের হাসপাতালগুলোতে বোমা হামলা বা অগ্নিসংযোগে মানুষের অগ্নিদগ্ধ, সারা শরীর ব্যান্ডেজে আবৃত, যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার– এমনসব ছবি এবং ছবির র্বণনা। বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষজনকে এসব ছবি এবং খবর আরও অসহায় করে তুলছে প্রতিদিন। পত্রিকা হাতে নিতে বা টিভির খবর শুনতে এখন রীতিমতো ভয়ই করে, ছবিগুলো যেন দিন দিন বীভৎস থেকে বীভৎসতর হয়ে উঠেছে।

দেশে যখন এমন মানুষ হত্যার মহোৎসব চলছে, দুনিয়ার অনেকগুলো জায়গায়ও সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দেড় মাস আগে পেশাওয়ারের একটি স্কুলে ১৩২ শিশুকে হত্যা, প্যারিসে তিন সপ্তাহ আগে ১২ সাংবাদিকসহ ১৬ জন হত্যা, সিরিয়া এবং ইরাকের উত্তর সীমান্তে 'আইসিস'এর মানুষহত্যার যজ্ঞ, নাইজেরিয়াতে বোকো হারামের ধর্মযুদ্ধের ঘোষণা এবং এই সিরিজে লিবিয়া এবং ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধ– দুনিয়ার প্রায় সবগুলো গণমাধ্যমেই প্রধান প্রধান খবর হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছিল এবং এইসব ঘটনা-দুর্ঘটনা দুনিয়াটাকে কেমন নাড়াবে, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের পণ্ডিতরা তার আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

আরব দুনিয়ায় এমন টালমাটাল অবস্থার মধ্যে শুক্রবার বাংলাদেশ সময় ভোরে সউদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ নব্বই বছর বয়সে মারা গেলেন। পরিণত বয়সেই তিনি মারা গিয়েছেন, তিনি অসুস্থও ছিলেন কয়েক বছর। সুতরাং এমন একটি খবর অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু সউদি আরবের মতো দুনিয়ার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে ক্ষমতার পালাবদলটা কেমন হল, আগামী দিনগুলোতে এই দেশটিতে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখা দেবে না তো, এমন সব চিন্তা-দুশ্চিন্তা, আশঙ্কার কারণে শুক্রবার ভোর থেকে বিবিসি টিভি, সিএনএন এবং আল জাজিরাসহ দেশ-বিদেশের সব ধরনের গণমাধ্যমে খবরটি প্রত্যাশিতভাবেই প্রাধান্য পাচ্ছে।

–দুই —

আয়তনের দিক থেকে আরব দেশগুলোর মধ্যে আলজিরিয়ার পরই সউদি আরব। বাংলাদেশের ৫৪ হাজার বর্গমাইলের বিপরীতে সউদি আরবের আয়তন ৮ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গমাইল। কিন্তু বাংলাদেশের ১৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার বিপরীতে সউদি আরবের জনসংখ্যা মাত্র ২৯ মিলিয়ন; এর মধ্যে আবার ৮ মিলিয়ন বিদেশি!

যদিও সউদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা জানা কষ্টকর, তবু অনুমান করা হয়, এই সংখ্যা দুই মিলিয়ন বা প্রায় বিশ লক্ষ হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের শ্রমিকদের নিয়োগ সউদি আরবে বন্ধ ছিল: কিন্তু মাত্র সেদিন আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন তার সউদি আরব সফরকালে এই জট সফলভাবেই খুলতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। সউদি আরব যে বাংলাদেশের জন্য কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা এই দেশ থেকে আমাদের প্রবাসী ভাইদের পাঠানো টাকার অংক থেকে বোঝা যায়। প্রতি বছর আমরা যে এখন প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বৈধপথে পাচ্ছি, তার বৃহত্তম অংশ আসছে এই দেশটি থেকে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে, ২০১৪এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়কালে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিচ্যান্সের অংক হচ্ছে ৭.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এক সৌদি আরব থেকেই এসেছে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারপর আমিরাত থেকে ১.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তৃতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রেমিট্যান্সের অংক ১.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এই যে তেলের দাম ছয়-সাত মাস আগের প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের ওপর থেকে এখন ৫০ মার্কিন ডলারের নিচে নেমে এল এবং তাতে সউদি আরবের আয়ও যে বিশাল পরিমাণে কমে গেল, তাতে সউদি আরবের অনেক কলকারখানা; রাস্তাঘাট, বাড়িঘর নির্মাণকাজ; দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে অন্যসব দেশের লোকজনের মতো আমাদের বাংলাদেশের মানুষজনের চাকরি-বাকরিও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। এই আশঙ্কা অন্যসব তেল উৎপাদনকারী দেশ, যেমন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমানের জন্যও কমবেশি প্রযোজ্য।

তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে তেল আমদানিতে আমাদের এখন হাজার হাজার কোটি টাকার সাশ্রয়ও হবে। তবে একদিকে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে তেল আমদানিতে সাশ্রয়, লাভ লোকসান প্রকৃতই কী দাঁড়াবে, তা এখনই হয়তো বলা যাবে না। কারণ তেলের দাম কমাতে সউদি আরব এবং এমন অন্যসব দেশের অর্থনীতি কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সউদি আরব, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন দুনিয়ার তিনটি বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। তেলের দাম ছয় মাসে অর্ধেকে নেমে এল, কিন্তু তারপরও তেলের দাম বাড়ানোর জন্য উৎপাদন কমাবে না সউদি আরব। এখানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সউদি আরব একটি বিতর্কিত ভূমিকা রাখছে। রাশিয়া, ইরান এবং পশ্চিম গোলার্ধের দেশ ভেনেজুয়েলা তেল রপ্তানির আয়ের ওপর 'হেভিলি' নির্ভরশীল। তেল রপ্তানিতে আয় কমার কারণে এই দেশ তিনটির অর্থনীতি দারুণ হুমকিতে পড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধের প্রথম দিকের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে; বিশেষ করে ইউক্রেন নিয়ে।

ভেনেজেুয়েলাকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতভাবে সম্ভব দুর্বল করার নীতি প্রবলভাবেই অনুসরণ করছে। আর ইরানের ওপর কয়েক বছর ধরেই অবরোধ আরোপ করে রেখেছে জাতিসংঘের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরান যদি আণবিক বোমা বানাতে কোনোভাবে সফল হয়, তা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে, এমন একটি আশঙ্কা ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতম 'ফ্রেন্ড অ্যান্ড প্রোটেক্টর' কিছুতেই হতে দিতে পারে না। শিয়াদের দেশ ইরানকে সুন্নি ওয়াহাবিদের দেশ সউদি আরব এবং আর সব সুন্নিপ্রধান আরব দেশগুলোও সহ্য করতে পারছে না। ইরানের বোমা বানানোর সাফল্যে আতঙ্ক বাড়বে সউদি আরব এবং আশেপাশের দেশগুলোতেও। এখানে সউদি আরব এবং ইজরাইলের প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি ইরানের প্রতি।

–তিন–

বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর 'সিনিয়র মোস্ট' জীবিত ভাই 'হিজ রয়েল হাইনেস' ক্রাউন প্রিন্স সলমান এখন 'হিজ ম্যাজেস্টি' কিং সলমান। শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে সউদি আরবে। কিন্তু সউদি আরবের উত্তরে, উত্তর-পূর্বে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে যেমন অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, নতুন বাদশাহ তা কেমন দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করবেন, তার ওপর সারা দুনিয়ারই দৃষ্টি থাকবে।

একটু আগেই উল্লেখ করেছি, সউদি আরবের উত্তর পূর্বের দেশ ইরান সউদি আরবের রাজতন্ত্র একদম পছন্দ করে না। ইমাম খোমেনি তাঁর জীবদ্দশায় বারবার এই রাজতন্ত্র উৎখাতের পক্ষে উস্কানি দিয়েছেন। সউদি আরবের পূর্বাঞ্চল, যেমন কাতিফ, শিয়া-অধ্যুষিত। তাদের আনুগত্য যত না সউদি আরবের প্রতি, তার চাইতে অনেক বেশি শিয়া-অধ্যুষিত হওয়ার কারণে ইরানের প্রতি। আবার এ অঞ্চলটিতেই সউদি আরবের তেলের সবচােইতে বেশি রিজার্ভ। ইরান সুযোগ পেলেই এই শিয়াদের উস্কায় সুন্নি ওয়াহাবি সউদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আবার, ২০১১ সালে শিয়া-প্রধান বাহরাইনের সংখ্যালঘু সুন্নি শাসকদের বিরুদ্ধে শিয়াদের বিক্ষোভ দমনে সউদি আরব এই দেশটিতে ট্যাংক এবং সৈন্যও পাঠিয়েছিল।

উত্তরে, সউদি আরবের সীমান্তের ওপারে আছে কুয়েত, ইরাক এবং জর্ডান। আশির দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধ সউদি আরবকে দারুণ টেনশনে রেখেছিল। তারপর, ১৯৯০তে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নিল, তখন কুয়েতের আমীর আস সাবা আশ্রয় নিলেন সউদি আরবের তায়েফে। আবার কুয়েত যখন দখলমুক্ত হল, তখন আস সাবা তায়েফ থেকে শাসনভার গ্রহণ করতে ফিরে গেলেন কুয়েতে।

ইরাকের পশ্চিম সীমান্তে আছে সিরিয়া। এই দেশ দুটোতে শিয়া-সুন্নিদের যুদ্ধ এবং 'আইসিস'এর উত্থান সউদি আরবসহ আশেপাশের দেশগুলোকে 'নার্ভাস' করে রেখেছে। এই দুটি দেশই এখন বলতে গেলে ব্যর্থ রাষ্ট্র। তারপর, সউদি আরবের দক্ষিণের ইয়েমেনেও এখন গৃহযুদ্ধ চলছে এবং কয়েক মাস ধরে এই দেশটিতে কার্যকর কোনো সরকার নেই। ইয়েমেনের ওপারে, সোমালিয়াও প্রায় বিশ বছর ধরে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। চারপাশের এতগুলো ব্যর্থ রাষ্ট্র নিয়ে সউদি আরবের নিরাপদ বোধ করার কোনো কারণ নেই। এক ব্যর্থ আফগানিস্তান এবং প্রায় ব্যর্থ পাকিস্তান– দুনিয়ার সন্ত্রাসীদের কেমন লালনভূমি এবং 'নার্সারি' হয়ে উঠেছে তা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি।

সউদি আরবের পূব পাশের দেশ কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক বলে সন্দেহ করে উপসাগরীয় অন্য আরব দেশগুলো। এই দেশগুলো মুসরিম ব্রাদারহুডকে তাদের দেশগুলোতে প্রায় সকল সমস্যার মূল কারণ হিসেবে সন্দেহ করে। মিশরের বর্তমান আলসিসি সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী এই মুসলিম ব্রাদারহুডেরই একটি 'এক্সটেনশন'। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনের অভিযোগে 'গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল' থেকে একসময় কাতারকে বহিষ্কার করার কথাও চিন্তা করেছিল অন্য সব সদস্য দেশ। সউদি আরবেও বেশ কয়েক বার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এইসব হামলায় নিরীহ নিরপরাধ মানুষজন নিহত হয়েছে; ঘরবাড়ি. অফিস-আদালত সন্ত্রাসী হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে।

দেশের ভেতরেও সউদি আরবকে কতগুলা 'চ্যালেঞ্জ' মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গণতন্ত্র, দেশের মানবাধিকার, মেয়েদের সামাজিক অবস্থা, শরীয়া আইনের প্রয়োগ, একদিকে আধুনিকতার দাবি, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী থেকে, আর বিপরীতে কট্টর ওয়াহাবি মতবাদ এবং কঠোর রক্ষণশীলতা– এত সব সাংঘর্ষিক বিষয় কীভাবে সামাল দেবেন নতুন বাদশাহ, তা সারা দুনিয়াই লক্ষ্য করবে।

বাদশাহ আবদুল্লাহর ওপর সউদি প্রগতিবাদীদের যেমন চাপ ছিল, তেমন চাপ ছিল ওয়াহাবি রক্ষণশীলদেরও। তারপরও, যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে তিনি কতগুলো ক্ষেত্রে সংস্কার চালু করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে কৃতিত্বও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। তবে নূতন বাদশাহ সলমান কিন্তু বাদশাহ আবদুল্লাহর মতো এমন উদার মতবাদের শাসক নন বলে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মন্তব্য করছেন। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারা আর কত দিনই-বাআটকে রাখা যাবে। আমাদের নবী (দ:)এর জমানায় মেয়েরা উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করেছেন; কিন্তু তার চৌদ্দশ বছর পরও সউদি মহিলারা গাড়ি চালাতে পারবেন না, একটি চা দোকানও চালাতে পারবেন না, এমন অবস্থা তো চলতে পারে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র এবং পশ্চিমা দুনিয়ার দেশগুলো কিছুতেই ভুলতে পারে না যে, নাইন-ইলেভেনে টুইন টাওয়ার, ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে এবং ভার্জিনিয়ায় বিমান হামলাকারী মোট ১৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই ছিল সউদি। সউদি নাগরিক ছিল ওসামা বিন লাদেনও। লাদেন এবং তার আল-কায়েদাও সউদি রাজতন্ত্রের উৎখাতের ঘোষণা দিয়েছে বারবার। সউদি আরব আবার প্রবলভাবেই সাহায্য করেছিল ওসামা বিন লাদেন এবং তালেবানদের বিশাল অংকের আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করতে। আফগানিস্তানের মোল্লা ওমর সরকারকে তখন স্বীকৃতি দিয়েছিল মাত্র তিনটি দেশ– সউদি আরব, পাকিস্তান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। তালেবানদের পৃষ্ঠপোষকতায় সউদি আরবেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল।

পবিত্র কাবা শরীফ দখল করে রেখেছিল জুহাইমিন আল ওতাইবীর নেতৃত্বে কিছু চরমপন্থী– নতুন হিজরি শতাব্দীর শুরুতে, ১৯৭৯এর ২০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। জুহাইমিন ওতাইবী নিজেকে তখন ইমাম মেহেদি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তাদের প্রতিবাদ ছিল সউদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে। পরে তাদের ধরে শরীয়া আইনে বিচার করে কতল করা হয়।

সউদি আরবের নতুন বাদশাহকে দেশের ভেতরের চরমপন্থীদের মোকাবেলায় এবং আশেপাশের দেশগুলোর অস্থিতিশীল অবস্থায় দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী দিনগুলোতে অনেক পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হবে।

–চার–

বাংলাদেশকে সউদি আরব স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরদিন, ১৯৭৫এর ১৬ আগস্ট। তবে বঙ্গবন্ধু দেখা করেছিলেন সউদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে আলজিয়ার্সে, ১৯৭৩এ, জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে। তারপরও সউদি আরব বিভ্রান্তই থেকে গেল পাকিস্তান এবং জামাতের গোলাম আযমদের অপপ্রচারে।

বাংলাদেশ থেকে প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার এবং মিনিস্টার পর্যায়ে গত উনচল্লিশ বছরে শত শত সফর হয়েছে সউদি আরবে। তাদের যখন যিনি সউদি বাদশাহর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন, প্রত্যেকেই বাদশাহকে বাংলাদেশ সফরে দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াতের এই সংখ্যাও বোধহয় একশতই হবে। কিন্তু গত উনচল্লিশ বছরেও সউদি বাদশাহদের মধ্যে বাদশাহ ফয়সাল, বাদশাহ খালেদ, বাদশাহ ফাহাদ, বাদশাহ আবদুল্লাহ– কোনো বাদশাহরই সময়-সুযোগ হয়নি, দুনিয়ার দ্বিতীয় বা তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশটি সফরে আসার। এ পর্যন্ত সউদি আরব থেকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফরটি হচ্ছে সেকেন্ড ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার এবং ডিফেন্স মিনিস্টার প্রয়াত প্রিন্স সুলতানের, ১৯৮৬তে। তাঁর আগে এসেছিলেন সউদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স সউদ আল-ফয়সাল এবং তার আগে পরে সউদি অর্থমন্ত্রী আবা আল-খেইল।

আমাদের সরকারপ্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সফর করেছেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত আমি যখন জেদ্দায় আমাদের অ্যাম্বেসিতে উপ-প্রধান, তখন তিনি সফর করেন ৫ বার। আমি বদলি হয়ে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফিরে আসার পর আরও দুই বার। আমাদের প্রেসিডেন্ট-প্রাইম মিনিস্টাররা ক্ষমতা দখল করার বা ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রথম সফরটি করেন সউদি আরবে, মক্কা ও মদিনায়। কখনও কখনও নির্বাচনে যাওয়ার আগেও। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়।

সবশেষে আরও দুটি তথ্য। ১৯৩২ সালে 'কিংডম অব সউদি আরাবিয়া' প্রতিষ্ঠা করেন কিং আবদুল আজিজ ইবনে সউদ। তার আগে 'সউদি আরব' নামে কোনো রাষ্ট্র এই দুনিয়াতে ছিল না। শুনেছি, বাদশাহ আবদুল আজিজ অসিয়ত করে গিয়েছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর 'সিনিয়রিটি' অনুযায়ী তাঁর ছেলেরাই একের পর এক বাদশাহ হবেন। মোটামুটিভাবে সেই রীতিই এখনও অনুসরণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় তথ্য, বাদশাহ আবদুল্লাহকে দাফন করা হয়েছে একটি অচিহ্নিত ('আনমার্কড') কবরে, যেমন করা হয়েছে আগের সব বাদশাহকে, এমনকি সউদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ কিং আবদুল আজিজকেও। সউদি আরবে কোনো রাজা-বাদশাহর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন পালন করা হয় না। কোনো কুলখানি, চেহলাম বা মিলাদও নয়। সউদি আরবে আমাদের অ্যাম্বেসিতে মিলাদ পড়ানোর সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতাম যেন বাইরে শব্দ যেতে না পারে। ওয়াহাবি মতবাদেে এইসব উদযাপন, মিলাদ, চেহলাম গ্রহণযোগ্য নয়।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৫।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।