সরকার পতনের ভ্রান্তিবিলাস

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 23 Jan 2015, 07:59 AM
Updated : 23 Jan 2015, 07:59 AM

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টানা ১৬ দিন 'অবরুদ্ধ' থাকার পর মুক্ত হলেও, দেশের মানুষকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৯ জানুয়ারি বেগম জিয়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন, পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে।

বেগম জিয়া সাংবাদিকদের সামনে এটাও দাবি করেছেন যে, সারাদেশে তার ডাকে অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। অথচ দেশের মানুষ দেখছে, টানা হরতাল ও অবরোধের নামে দিনের পর দিন দেশে কী ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে। পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে, গান পাউডার ছিটিয়ে, ককটেল ছুঁড়ে যানবাহন পোড়ানো হচ্ছে, মানুষ মারা হচ্ছে। সারাদেশে মানুষের জীবন কাটছে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে।

সবাই যখন এই সহিংসতার অবসান কামনা করছে, তখন বেগম জিয়া অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। তিনি অবরোধ ডেকেছেন, অথচ তার দলের নেতাকর্মীরা মাঠে নেই। জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসী বাহিনী, নিজ দলের কিছু ক্যাডার এবং ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ভীতি ও আতংক ছড়িয়ে দেশে 'গণঅভ্যুত্থান' ও সরকার পতনের স্বপ্ন দেখছেন বিএনপি নেত্রী। কিন্তু এটা তার ভ্রান্তিবিলাস।

নির্বিচারে মানুষ মেরে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করে, অর্থনীতি পঙ্গু করে আর যাই হোক, কোনো সফল গণঅভ্যুত্থান যে করা যায় না, এটা তিনি বুঝতে পারছেন না। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দেশের মানুষ উদগ্রীব হয়ে উঠেছে– এই অলীক ধারণা যে বা যারা বেগম জিয়াকে দিয়েছেন, তারা যে তাকে বিভ্রান্ত করেছেন, সেটা তিনি যখন বুঝবেন, তখন হয়তো আর তিনি ভুল সংশোধনের সময়ও পাবেন না।

নাশকতা ও মানুষ পুড়িয়ে মারার জন্য বিএনপি নেত্রী সরকারকে দায়ী করেছেন। অথচ এর মধ্যে পেট্রল বোমা নিক্ষেপের সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়া কয়েকজন সন্ত্রাসী জানিয়েছে, বিএনপি নেতাদের নির্দেশেই তারা বাস পোড়ানোর কাছে নেমেছে। কেউ স্রেফ টাকার বিনিময়ে এই অপকর্ম করছে, কেউ-বা দলের বড় নেতাদের খুশি করে ভালো পদ পাওয়ার লোভেও দুর্বৃত্তপনা করছে।

জনগণকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই নাকি বেগম জিয়ার বর্তমান আন্দোলন। অথচ ২০১৩ সালের শেষ দিকে শুরু করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তার নির্দেশে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করার জন্য জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা ইত্যাদি করা হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, এটা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়ার সিদ্ধান্ত যে কোনো রাজনৈতিক দল নিতে পারে। কিন্তু অন্যকে জোর করে ভোটে অংশগ্রহণ কিংবা ভোটদানে বিরত রাখার অধিকার কারও নেই। জবরদস্তি করা গণতন্ত্র নয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি এবং তার আগে বিএনপি যা করেছে তাকে কোনোভাবেই মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায় না। যারা ভোট দিতে যাবে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, মেরে ফেলে, ভোট কেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়ে, পুলিং অফিসার-প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা করে কীভাবে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া যায় সেটা তখন দেশের মানুষ বুঝতে পারেনি।

বলা হচ্ছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূলে আছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা ও প্রায় ভোটারশূন্য নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এই নির্বাচন একতরফা ও ভোটারশূন্য হয়েছে? বিএনপি কেন নির্বাচনে অংশ নেয়নি, কেন ভয়ভীতি দেখিয়ে অন্যদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত করা হয়েছে? যদি বলা হয়, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না, তাহলে প্রশ্ন আসে, পরিবেশ বিঘ্ন হয়েছিল কেন? পরিবেশ নষ্ট করার দায় কার?

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে জয়লাভের সম্ভাবনা নেই– এই আশঙ্কা থেকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়াকে যারা যুক্তিযুক্ত মনে করেন, তারা জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করেন না। নির্বাচনের আগেই যারা নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে চান তারা প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক চেতনা লালন করেন কিনা সে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে হারজিত দুটোই আছে। কিন্তু বেগম জিয়া কেবল জয়লাভ করার মধ্যেই গণতন্ত্র খুঁজে পান।

দেশে অনেকের মধ্যেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি হয়তো সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতাই পেয়ে যেত। ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর বিএনপিও ধরে নিয়েছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারাই জিতবে। তারপরও কেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার জেদে তারা অটল থাকল? ব্যাপক কারচুপি করে সরকার ভোটের ফলাফল পাল্টে দেবে– এই আশংকা থেকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি কার্যত আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে ওয়াকওভার দিয়েছে।

তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হয়নি, এ দায় আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপির কম নয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হলে দেশে যে প্রতিক্রিয়া হত, তারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খুনোখুনিতে মেতে ওঠায় তা আর হয়নি।

১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াকে গণতন্ত্রের কলংক হিসেবে মনে করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এত বিরাট সংখ্যক সংসদীয় আসনের ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারলে সেটা গণতন্ত্র হয় কী করে? সঙ্গত প্রশ্ন, কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা কেন ঘটল? ১৫৩টি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের প্রার্থী পছন্দের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করল কারা?

অবশ্য আমাদের দেশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অতীত রেকর্ডও আছে। তাই প্রশ্ন জাগে, ক'জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত তাকে 'জায়েজ' বলে ধরা যাবে? ১০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রের অঙ্গহানি হয় না, ১৫৩ জন হলেই আকাশ ভেঙে পড়ে? ড. কামাল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রের পুকুরে পদ্মফুল ফোটে, কিন্তু অন্যরা হলে গণতন্ত্রের দুধের সাগরে গোচনা ছিটানো হয় বলে মনে করা কি যুক্তিসঙ্গত?

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নাকি মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। যদি এটা সত্য বলেও ধরা হয়, তাহলেও বলার কথা এটাই যে, বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্ট ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি উপেক্ষা করে যারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, তারা তো তাদের মহান সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোট না দিলে যে দেশে গণতন্ত্র একেবারে না থাকার পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সে জন্য সব গণতান্ত্রিক মানুষের পক্ষ থেকে তাদের সাধুবাদ জানানো ও প্রশংসা করা উচিত। আপনারা একবার ভোট ঠেকানোর আন্দোলন করে শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নেবেন, আবার আপনারাই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলবেন। এক মুখে এত কথা বলে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যায় কি? তা যে যায় না তার প্রমাণ বিএনপির আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ না করা।

বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন 'অবৈধ'। দেশের মানুষ এই নির্বাচন মানে না। নির্বাচন বৈধ না অবৈধ তা নিয়ে লম্বা বিতর্ক করা যেতে পারে। তর্ক করে বিশেষজ্ঞরাও কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারবেন না। তাই সে ধরনের অহেতুক বিতর্কে না গিয়ে শুধু এ প্রশ্ন তোলা যায়, দেশের মানুষ যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণ করেনি, তা কীভাবে বোঝা গেছে? মানুষ তাদের আপত্তির কথা কার কাছে, কীভাবে প্রকাশ করেছে? ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর দেশের কোথাও কি এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছে?

১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর বেগম জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে যে রকম আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যে আন্দোলনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সংবিধান সংশোধন করে তড়িঘড়ি বিদায় নিতে হয়েছিল বেগম জিয়াকে, এবার শেখ হাসিনার বেলায় সে রকম হয়নি। বেগম জিয়ার মনোযাতনার কারণ কি এটাই? যে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রবল এত আপত্তি, সুশীল সমাজের এত ব্যাকুলতা-সমালোচনা– সে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে সাধারণ ভোটাররা মাঠে নামছে না কেন? কেন নির্বাচনের পর দেশের পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক হল?

এ সব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে হরতাল-অবরোধ দিয়ে আর যাই হোক সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে বলে মনে হয় না। একটি সরকার যতগুলো খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তার কোনোটাই এখনও নড়বড়ে হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারকে যতই স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা হোক না কেন, মানুষ কিন্তু দেখছে শেখ হাসিনার শাসনামলে বেগম খালেদা জিয়ার কোনো সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মনজুরুল ইমাম, মমতাজ আহমেদের মতো জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার শিকার হতে হলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির ওই মাপের কোনো নেতার ওপর কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি।

মানুষ দেখছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে দেশে জঙ্গিবাদের কেমন বিস্তার ঘটে, দেশের প্রায় সব জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়– আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তা হয় না। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও আওয়ামী লীগের অবস্থান বিএনপির মতো দোদুল্যমান ও অস্পষ্ট নয়। জামাতের সঙ্গে আওয়ামী লীগও একযোগে আন্দোলন করেছিল, এই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এখন আর খুব সহজ নয়। জামাতকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অংশীদার করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবের পতাকা তুলে দেয়নি। মানুষ এটা দেখছে যে বিএনপি আর জামায়াত এখন এক ও অভিন্ন। কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারে না।

আওয়ামী লীগ সরকার সব কিছুই ভালো করছে না, তারাও কিছু কিছু খারাপ কাজ করছে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি চলছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও উন্নয়নের চাকা সচল রয়েছে। কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। বছরের প্রথম দিন কোটি কোটি শিক্ষার্থী বিনামূল্যে নতুন বই পাচ্ছে। চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য হচ্ছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি কমে আসছে। বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরির কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আরও অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে।

মানুষ দেখছে, আওয়ামী লীগের হাওয়া ভবন নেই, তারেক রহমান নেই। আওয়ামী লীগ যেন আরও ভালো শাসন উপহার দেয়, সে জন্য তাদের ওপর চাপ রাখতে হবে; কিন্তু তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিএনপি-জামাতকে ক্ষমতায় এনে দেশে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম করতে চায় না দেশের মানুষ। চোরকে যারা অপছন্দ করে তারা ডাকাতকে স্বাগত জানাবে– এ রকম ভাবা কি ঠিক?

বেগম জিয়ার উচিত সরকার পতনের ভ্রান্তিবিলাস ও কঠোর আন্দোলনের অসময়োচিত সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে সরে আসা। তাতেই তার দল ও দেশের বেশি উপকার হবে।