সংকটে নেতৃত্ব: প্রেসিডেন্ট কেনেডি ও চেয়ারম্যান ক্রুশ্চেভ

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 22 Jan 2015, 02:41 AM
Updated : 22 Jan 2015, 02:41 AM

জন এফ (ফিটজেরাল্ড) কেনেডি আমার প্রিয় বিশ্বনেতাদের একজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জন কেনেডি ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী রিচার্ড এম (মিলহাউস) নিক্সনকে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। নিক্সন তখন ছিলেন প্রেসিডেন্ট ডুইড ডেভিড আইসেন হাওয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট; আর কেনেডি ছিলেন ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের একজন সিনেটর।

কেনেডি তাঁর ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তাঁর এই দলেরই আর দুই মনোনয়ন-প্রত্যাশী লিন্ডন জনসন এবং অ্যাডলাই স্টিভেনসনকে পরাজিত করে। প্রেসিডেন্ট পদে দলের নমিনেশন চূড়ান্তভাবে পাওয়ার পর কেনেডি এই লিন্ডন জনসনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁর সঙ্গে নির্বাচন করার জন্য বেছে নেন। আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর অ্যাডলাই স্টিভেনসনকে জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি/রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি।

রিচার্ড নিক্সন ১৯৬০এর নির্বাচনে পরাজিত হয়েও পরে ১৯৬৮ সালে আবার রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিউবার্ট হরেশিও হামফ্রেকে পরাজিত করে (সংক্ষেপে, H.H.H. ) এইবার সফল হন। একবার পরাজিত হয়ে পরে আবার প্রার্থী হয়ে আবার প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হওয়ার এমন উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। এই রিচার্ড নিক্সনই ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন! অবস্থান নিয়েছিলেন পাকিস্তানের এক মাতাল প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পক্ষে। অদৃষ্টের কী পরিহাস, সেদিন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইরত বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান নেয়নি গণতান্ত্রিক আমেরিকা, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ও পাশে ছিল তখন একদলীয় শাসনের দেশ কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন! তা অবশ্য আর এক কাহিনি।

–দুই–

আমার মতো অনেকের কাছেই জন কেনেডি একজন 'হিরো' ছিলেন। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দুনিয়ার প্রধান পরাশক্তির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, দেখতে খুবই হ্যান্ডসাম ছিলেন, সারা দুনিয়ায় তখন শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন মেরিলিন মনরোকেও তিনি হোয়াইট হাউসে টানতে পেরেছিলেন। তার স্ত্রী জ্যাকুলিন (জ্যাকি) কেনেডিও সেই জমানায় দারুণ 'গ্ল্যামারাস' এক সুন্দরী মহিলা ছিলেন। আর তাদের ছিল ফুটফুটে প্রজাপতির মতো দুটি শিশু সন্তান, ক্যারোলিন এবং জন-জন জুনিয়র।

কেনেডি যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন তিনি কখনও কখনও ক্র্যাচ চাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেভির একজন অফিসার হিসেবে তিনি আহত হয়েছিলেন। প্রথম ভাই জোসেফ কেনেডি জুনিয়র মারা যান এই যুদ্ধে। আর তৃতীয় ভাই রবার্ট কেনেডি মারা যান আততায়ীর গুলিতে ১৯৬৮ তে, যখন তিনি সে বছরই অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির নমিনেশনের জন্য 'ক্যাম্পেইন' করছিলেন। তাঁদের চতুর্থ ভাই সিনেটর এডওয়ার্ড (টেড) কেনেডি বাংলাদেশের পক্ষে প্রবল এক অবস্থান নিয়েছিলেন একাত্তরে, শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছিলেন এক হাঁটু কাদামাটিতেও; আর বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি মিশিয়ে কেঁদেছিলেনও তখন শরণার্থীদের দুর্দশা, দুরবস্থা দেখে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি এসেছিলেন ১৯৭২এ। দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি সারাজীবন বাংলাদেশিদের কাছে। মারা গেছেন টেড কেনেডি কয়েক বছর আগে।

তবে এই কেনেডিও বড় দুই ভাইয়ের মতো ছিলেন এক 'ফিলান্ডারার'। সুন্দরী মহিলা দেখলে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতেন। এই ছোট কেনেডি ঘরে বউ রেখে পার্টি করতে গেলেন মেরি জো কোপেকনের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে এবং গভীর রাতে ফেরার পথে চাপাকুইডিক নামের এক জায়গায় ব্রিজ থেকে গাড়িসমেত ছিটকে পড়লেন নিচের গভীর নদীতে; তাতে মারা গেলেন মেরি জো কোপেকনে। আর সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ল, ডুবে গেল এই টেড কেনেডির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও।

অভিশপ্ত এই কেনেডিদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট কেনেডির একমাত্র ছেলে জন-জন জুনিয়র কেনেডিও তাঁর হেলিকপ্টার চালিয়ে নিউইয়র্ক থেকে বোস্টন যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে সস্ত্রীক নিহত হন সাগরে, কয়েক বছর আগে। জন এবং জ্যাকি কেনেডিদের একমাত্র জীবিত সন্তান, মেয়ে ক্যারোলিন এখন জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।

–তিন–

জন কেনেডিকে আমাদের এত ভালো লাগার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর 'সেন্স অব হিউমার', তাঁর রসিকতাবোধ। যেমন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জ্যাকুলিন কেনেডিকে নিয়ে একবার ফ্রান্স সফরে গেলেন; সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, ফটোগ্রাফাররা জ্যাকি কেনেডিকে এখানে সেখানে এমন ছেঁকে ধরতে থাকল যে, পরে কেনেডি বলেছিলেন, ''আমি যখন জ্যাকির সঙ্গে ফ্রান্স সফরে যাই…।''

শিশু-কিশোরদের মানসিক অবস্থা তিনি কেমন বুঝতে পারতেন, এখন তার একটি উদাহরণ।

বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথকে তিনি ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিলেন ১৯৬১ তে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর। কিন্তু গলব্রেথের কিশোর ছেলে পিটার তার বাবার সঙ্গে নতুন দিল্লিতে যেতে অনাগ্রহী। সুতরাং তিনি ১৯৬১এর ২৮ মার্চ হোয়াইট হাউসের প্যাডে নিজের হাতে সই করে এক অসাধারণ চিঠি লিখে পাঠালেন পিটারকে, তার বাবা অধ্যাপক গলব্রেথকে না জানিয়ে।

চিঠিতে প্রেসিডেন্ট কেনেডি বললেন পিটার গলব্রেথকে এই যে, ''তুমি দিল্লি যেতে চাইছ না, এখানে তোমার বন্ধুদের ছেড়ে নতুন দিল্লিতে গেলে তোমার যে কষ্ট হবে তা আমি ঠিকই বুঝতে পারি। কারণ আমাদের তেমন কষ্ট হয়েছিল যখন বিশ বছর আগে আমাদের বাবাকে (জোসেফ পি কেনেডি সিনিয়র) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত করে লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের এখানকার বন্ধুদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এই ছেড়ে যাওয়ার একটি উজ্জ্বল দিকও আছে– দিল্লিতে তুমি নতুন বন্ধু-বান্ধব পাবে; তোমার এই বন্ধুদের কাছে তুমি আমাদের দেশটিকে তুলে ধরতেও পারবে।''

কেনেডি আরও লিখলেন এই কিশোরকে– ''শুনেছি তুমি পশুপাখি খুব ভালোবাস। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, তুমি ভারতে গেলে অনেক রকমের পশুপাখি– হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক সিংহ কোবরা দেখতে পাবে।''

(ভারতে রাষ্ট্র্রদূত হিসেবে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ও অনেক স্মৃতির বিবরণ দিয়ে জন কেনেথ গলব্রেথের লেখা ৫৫৬ পৃষ্ঠার 'আ্যাম্বাসেডরস জার্নাল' বইটির ২৯২ পৃষ্ঠায় কেনেডির এই চিঠিটির পুরো ফটোকপি তুলে দিয়েছেন গলব্রেথ।)

প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির এই চিঠির কথা জানতে পেরে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার এবং ক্যামেরাম্যানরা যখন কিশোর গলব্রেথের পিছু নিল, তখন সিনিয়র গলব্রেথ মন্তব্য করেছিলেন, ''প্রেসিডেন্টের এই চিঠির কারণে এই কিশোর বয়সেই আমার মতো প্রবীণ মানুষের বিপরীতে রাতারাতি 'সিলেব্রিটি' হয়ে উঠল পিটার।''

–চার–

জন কেনেডির চরিত্রের যে দিকটা আমাদের মুগ্ধ করেছিল, তা ছিল তাঁর নেতৃত্ব– তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা এবং প্রয়োজনে নমনীয়তা। তিনি নিহত হন ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এক শহরে, ডালাস সফরকালে। তাঁর ক্ষমতার এই পৌনে তিন বছর সময়কালে তিনি কতগুলো 'ক্রাইসিস' মোকাবেলা করেছেন সাফল্যের সঙ্গে।

তাঁর আমলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে ভোটাধিকার দেওয়ার উদ্যোগ তিনি প্রথমবারের মতো নেন সফলভাবেই। তিনিই 'সিভিল রাইটস অ্যাক্ট' মার্কিন কংগ্রেসে পাঠান এবং তা গৃহীত হয় তাঁর নিহত হওয়ার পর, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকারী লিন্ডন জনসনের আমলে, ১৯৬৪তে। মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের এক কট্টর শ্বেতাঙ্গ গভর্নর রস বার্নেট ১৯৬২ তে ওখানকার মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাল রঙএর জেমস মেরেডিথকে ভর্তি হতে দেবেন না; সুতরাং, কেনেডি ন্যাশনাল গার্ডসকে পাঠালেন, গভর্নরকে প্রতিহত করতে।

বস্তুত, জন কেনেডি প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ষাটের দশক শেষ হওয়ার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠাবে। তা সফল হল ১৯৬৯এর জুলাইতে যখন মার্কিন নাগরিক আর্মস্ট্রং চাঁদে প্রথম পা রাখলেন। জন কেনেডিকে মনে রাখার আরেকটি বড় কারণ ছিল, তাঁর 'পিস কোর'। আমেরিকার তরুণ ছেলেমেয়েদের একটি বড় গ্রুপকে তিনি পাঠালেন দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে জনকল্যণমূলক কাজে। প্রেসিডেন্ট কার্টারের মা লিলিয়ান কার্টারও এই কোরের একজন সদস্য হিসেবে ভারতে এসেছিলেন। সারা দুনিয়ার 'পিস কোর'এর সদস্যরা তাদের কাজের জন্য প্রশংসিত হয় এবং 'কেনেডি চিলড্রেন' হিসেবে পরিচিত পায়।

বিদ্বান, পণ্ডিত, গুণী ব্যক্তিদের প্রেসিডেন্ট কেনেডি ইজ্জত মর্যাদা সম্মান দিতেন। এখনও মনে আছে, ১৯৬২তে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকসে পড়ার সময় ক্লাসে তখনকার তরুণ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছিলেন, কেনেডি প্রেসিডেন্ট হওযার পর হোয়াইট হাউজে তাঁর পরামর্শদাতা এবং কর্মকর্তা হিসেবে হার্ভার্ড, এমআইটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকদের আনাগোনা এত বেড়ে গেল যে, হোয়াইট হাউজের 'করিডোরে' তাদের মধ্যে চলাফেরার সময় ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটতে লাগল।

–পাঁচ–

জন কেনেডি তখনও দুই বছর শেষ করেননি প্রেসিডেন্ট হিসেবে, তখন দেখা দিল এক চরম সংকট ১৯৬২এর অক্টোবরে, কিউবাতে সোভিয়েট মিসাইল মোতায়েন নিয়ে। ১৯৫৯এ কিউবার দুর্নীতিগ্রস্ত ডিকটেটর বাতিস্তাকে তাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করেন কম্যুনিস্ট নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো। আর মাত্র ৯০ মাইল দূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথায়ও যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পশ্চিম গোলার্ধের একটি দ্বীপরাষ্ট্র কিউবায় কম্যুনিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখলের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখল তাদের জন্য এক বড় হুমকি হিসেবে; দেখল ল্যাটিন আমেরিকার অন্যসব দেশও, কখনও কখনও আমেরিকার উস্কানিতে। আমেরিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অন্যসব ক্লায়েন্ট দেশগুলোও দেখল, কম্যুনিজমের প্রভাবে তাদের লুটপাট, অপশাসনও আর চলবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ঘোষণা দিল, ক্যাস্ট্রো এবং তাঁর কম্যুনিস্ট সরকারকে তাড়িয়ে ওখানে আবার গণতন্ত্র এবং 'ফ্রিডম' ফিরিয়ে আনবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; পশ্চিম গোলার্ধ্ব বিপদমুক্ত করবে তারা। লাখ লাখ কিউবানকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে কাছের অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডাতে। এমন কিছু শরণার্থীকে ট্রেনিং দিয়ে কিউবাকে পুনরুদ্ধার করতে ফ্লোরিডা থেকে কিউবা পাঠাল আমেরিকার সিআইএ। 'বে অব পিগস অপারেশন' নামের এ অভিযান তখন এবং পরে সারা দুনিয়াতে নিন্দিত হয়েছিল। কিন্তু যেমন আশা করা হয়েছিল, কিউবার মানুষজন ক্যাস্ট্রোর বিরুদ্ধে জেগে উঠে রাস্তায় নামবে, তার কিছুই ঘটল না। হাজার হাজার সিআইএ এজেন্ট ধরা পড়ল ক্যাস্ট্রোর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে, শত শত পড়ল মারা। এমনটি ঘটল কেনেডির প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায়, ১৯৬১এর ১৭ এপ্রিল।

কম্যুনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সোভিয়েট ইউনিয়ন বিপুল অংকের আর্থিক সাহায্য এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ কিউবার পাশে দাঁড়াল। কিন্তু ১৯৬২এর ১৫ অক্টোবর জানা গেল যে, কিউবাতে সোভিয়েট ইউনিয়ন আণবিক বোমা মোতায়েন করছে। আর তখনই দেখা দিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমূহ আশংকা।

আমেরিকা হুমকি দিল, তার বাড়ির পাশে এমন বিধ্বংসী অস্ত্র কিছুতেই থাকতে দেওয়া যাবে না, এগুলো ধ্বংস করতে হবে অথবা সরিয়ে নিতে হবে। আর দুনিয়ার অন্য পরাশক্তি সোভিয়েট ইউনিয়ন বলল, আত্মরক্ষার জন্য যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার আছে কিউবার।

তের দিনের মাথায় এই সংকটের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হয়, কিউবা থেকে এসব অস্ত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় সোভিয়েট ইউনিয়ন। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অঙ্গীকার করে, কিউবাকে আর কখনওই তারা আক্রমণ করবে না।

–ছয়–

এই সংকট এবং তার সমাধানে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ কখনও কখনও কেমন দৃঢ় এবং শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, আবার কখনও কখনও দুনিয়াকে আর একটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে টেনে উঠিয়ে আনার জন্য নমনীয় হয়েছেন, তার উৎকৃষ্ট বর্ণনা গতকাল রাতে আবার দেখলাম 'মিসাইলস অব অক্টোবর' নামের ১৯৭৪ সালে নির্মিত ১৫০ মিনিটের 'ডকুড্রামা'টিতে।

১৯৭৮এ আমি যখন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ডাইরেক্টর, তখন ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে ছবিটি প্রথম দেখি। তারপর গত বিশ বছরে ছবিটি আবার দেখার তীব্র আগ্রহ জাগে; কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলাম না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে কেমন নেতৃত্ব দিতে হয়, তা বুঝতে ছবিটি আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বছর খানেক আগে আমার ছোট মেয়ে লরাকে এই ছবির কথা জানালে সে কী কী কেরামতি করে তার গ্রিন রোডের বাসা থেকে ইন্টারনেটে আমার ল্যাপটপে আমাকে পাঠিয়ে দেয়। লরার প্রথম ডিগ্রি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএও করেছে সে। সে আমাকে কম্পিউটারের কিছুই বোঝাবে না; কারণ দুয়েকবার চেষ্টা করে সে বুঝেছে, ফেসবুক, টুইটার, ব্লুটুথ– এসব আমার আয়ত্তের বাইরে। সুতরাং আমাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া তার সময় এবং শ্রমের অপচয়। তবে নেট থেকে খুঁজে খুঁজে আমার প্রিয় বিশটির মতো ছবি লরা আমাকে পাঠিয়েছে।

'মিসাইলস অব অক্টোবর' ছবিটিতে দেখা যায়, কেনেডির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতি; চেয়ারম্যান কমরেড ক্রুশ্চেভের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্র চালাচালি; ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, মস্কো, লন্ডন, প্যারিসে কূটনৈতিক তৎপরতা; সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল, এয়ার মার্শাল এবং এডমিরালদের কঠোর, আগ্রাসী সুপারিশের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট কেনেডির সেই সব সুপারিশ অগ্রাহ্যকরণ; কোনো হঠকারিতায় না গিয়ে কেনেডি এবং ক্রুশ্চেভের সংকট-সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা; কেনেডির মন্ত্রিসভার সদস্য এবং অন্যসব পরামর্শদাতাদের ভূমিকা।

ছোট ভাই এবং অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির ওপর প্রেসিডেন্ট কেনেডির নির্ভরশীলতা চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে 'ডকুড্রামা'টিতে। প্রেসিডেন্ট কেনেডি দায়িত্ব দেন রবার্ট কেনেডিকে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে আলোচনা করে একটি 'কনসেনসাস' সুপারিশ যেন তাঁকে দেওয়া হয় দুই তিন দিনের মধ্যে। কারণ সময় খুবই কম, আকাশ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায় আণবিক বোমা 'অপারেশনাল' হবে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে। আর 'অপারেশনাল' হয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে আণবিক হামলা চালাতে পারবে কিউবা। তার আগেই সরিয়ে নিতে বাধ্য করতে হবে সোভিয়েট ইউনিয়নকে, অথবা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হবে এসব স্থাপনা।

উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ সভায় অ্যাডলাই ন্টিভেনসন বলেন, কিউবায় হামলা চালালে সোভিয়েট ইউনিয়ন কাছের বিভক্ত শহর বার্লিন দখল করে নিতে পারে; অথবা প্রতিবেশি তুরস্কে আমেরিকার যেসব মিসাইল আছে, সেগুলোতে হামলা চালাতে পারে। তখন কী হবে?

রবার্ট কেনেডি দিনে রাতে এমন কয়েকটি আলোচনা সভায় চিৎকার করে বলতে থাকেন, ছোট একটি দেশ কিউবাতে হামলা চালিয়ে আমরা দুনিয়াকে কী মেসেজ দেব, এই দেশটির যে কিছু 'ভ্যালুজ' আছে সেগুলোও তো মিশে যাবে বোমা হামলায়। সমান চিৎকার করে রবার্ট কেনেডিকেও জবাব দেন সামরিক বাহিনীর প্রধান ম্যাক্সওয়েল টেলর। প্রেসিডেন্ট কেনেডি সারাক্ষণ হাতে-মুখে চুরুট নিয়ে এমন চিৎকার-প্রতিচিৎকারে আমোদ পান, মুখ টিপে হাসেন। আবার কখনও কখনও মাথায় দুই হাত দিয়ে ভাবতে থাকেন কী করবেন।

শেষে তিনি গ্রহণ করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারার প্রস্তাব– কিউবার চারপাশে মার্কিন নৌ-জাহাজ মোতায়েন করে 'কোয়ারেন্টাইন' বা 'ব্লকেড' আরোপ করা হবে, যেন কোনো রকমের সোভিয়েট জাহাজ অস্ত্র নিয়ে কিউবায় ঢুকতে না পারে। তারপরও যখন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও সোভিয়েট যুদ্ধজাহাজ প্রায় মুখোমুখি হয়, প্রেসিডেন্টের সম্মতি নিয়ে ম্যাকনামারা মার্কিন যুদ্ধ জাহাজগুলোকে আরও পিছিয়ে আসতে বলেন, যেন আলোচনা করে সংকট সমাধানে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। তিনি তাঁর এডমিরালকে তাঁর নির্দেশ মানতে চিৎকার করেই নির্দেশ দেন, 'অপারেশন' রুমে।

এমন সিরিয়াস এক সংকটেও প্রেসিডেন্ট কেনেডি ছোট ভাইয়ের সঙ্গে রসিকতা করেন। মুচকি হাসিতে একবার বলেন, ''আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে তোমার যে ডিনার ছিল, তা থেকে তোমাকে বাদ দিলাম। তুমি সে সময় ওয়াশিংটনে তোমার বন্ধু সোভিয়েট রাষ্ট্র্রদূত আনাতোলি ডোব্রিনিনকে ডেকে জিজ্ঞাসা কর, কিউবাতে মিসাইল মোতায়েনের কথা সে জানে কিনা।''

আর একবার তিনি বলছেন, ''তোমাদের প্রেসিডেন্ট এখন ঘুমাতে যাবে, কিন্তু তোমরা সারারাত কাজ করে আমার পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান ক্রুশ্চেভকে পাঠানোর জন্য একটা চিঠি তৈরি কর।''

রবার্ট কেনেডিও কখনও প্রেসিডেন্টকে 'স্যার' বলছেন, আবার কখনও 'মিস্টার প্রেসিডেন্ট'।

প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারি পিয়ারে স্যালিংগারও প্রচণ্ড চাপে কাজ করছেন। এমন সব তৎপরতার কিছুই তাকে জানানো হচ্ছে না। কিন্তু সাংবাদিকরা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে, তাঁর কাছে তথ্য চাইছে, তিনি দিতে পারছেন না। দুনিয়ার অনেক জায়গায় আমেরিকাবিরোধী বিক্ষোভ চলছে, আমেরিকার পতাকা পোড়ানো হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট তাঁকে শান্ত করেন এই বলে– ''ইউ ডোন্ট নো দ্যাট ইউ আর সো লাকি, ইউ ডোন্ট নো।''

এই সংকট উত্তরণে ওয়াশিংটনে সোভিয়েট দূতাবাসের উপ-প্রধান আলেকজান্ডার ফোমিন সাহায্য চান 'এবিসি' টিভি নেটওয়ার্কের এক সাংবাদিক জন স্কালির। জন স্কালিও তখন দারুণ এক ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি বার্তা পৌঁছে দিয়ে।

–সাত–

'কনভেনশনাল' কূটনীতির বাইরেও যে সফল আলোচনা চালানো হয় কখনও কখনও, এটি তার একটি অনুসরণীয় উদাহরণ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের এক প্রবীণ সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমদও এমন ভূমিকা পালন করেছিলেন।

জাতীয় সংকটে খোলামেলা, 'ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফ্রি' আলোচনা কেমন হওয়া উচিত তা দেখা যায় বিভিন্ন মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের বক্তব্যে। আর সরকারপ্রধানর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও তিনি যদি যোগ্য হন তাহলে তিনি যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন, তা দেখি ছোট ভাই রবার্ট কেনেডির ভূমিকায়, দেশপ্রেমে। ছবিটির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, ''ডোব্রিনিন কি সত্য কথা বলেছে?''

উত্তরে রবার্ট কেনেডি বলেন, ''স্যার, আমিই কি তাকে সত্য বলেছি?''

রবার্ট কেনেডির 'থার্টিন ডেইজ' বইটির অনুসরণে নির্মিত এই ছবিটি নেতৃত্বে এবং প্রশাসনিক পদে যারা আছেন, তাঁরা দেখলে অনেক কিছুই শিখবেন। শীতল যুদ্ধের চরম মুহূর্তেগুলোতে দুই নেতার মধ্যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু কেনেডি যখন নিহত হলেন, শোক বইতে স্বাক্ষর করতে ক্রুশ্চেভ গেলেন মস্কোতে মার্কিন দূতাবাসে।

সবশেষে, ১৯৬১এর ২০ জানুয়ারি কেনেডি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে যে অসাধারণ ভাষণটি দিয়েছিলেন সেখান থেকে এই একটি লাইন:


''Let us never negotiate out of fear. But let us never fear to negotiate.''

'শিউলীতলা', উত্তরা; রোববার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৫।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।