শার্লি এবদো, জঙ্গিবাদ ও প্রি-প্রোবায়োটিক অ্যাপ্রোচ

শোয়েব সাঈদ
Published : 18 Jan 2015, 05:43 AM
Updated : 18 Jan 2015, 05:43 AM

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, অ্যান্টিবায়োটিক, প্রোবায়োটিক এবং প্রিবায়োটিক, এই শব্দত্রয় তিনটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ক্ষতিকর অণুজীব বা জীবাণু মেরে ফেলা হয় ঠিকই, কিন্তু তাতে আশেপাশের অনেক উপকারী অণুজীবেরও ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগে তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া অবধারিত। এর অবাধ প্রয়োগ জীবাণুর নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সাহায্য করে যাতে অ্যান্টিবায়োটিকের কর্মক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়।

প্রোবায়োটিক হচ্ছে উপকারি অণুজীব যাদের উপস্থিতিতে ক্ষতিকর অণুজীবের ক্ষতি করার ক্ষমতা কমে যায়। পেটের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্যে প্রোবায়োটিক খাওয়া হয় যাতে পেটের ভেতরে উপকারি অণুজীবের সংখ্যা বেড়ে এবং ক্ষতিকর অণুজীবের সংখ্যা কমে গিয়ে ক্ষতি করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে সার্বিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়।

প্রিবায়োটিক হচ্ছে এক প্রকার ইনগ্রেডিয়েন্ট বা রসদ যা প্রোবায়োটিক বা উপকারি অণুজীবের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে ব্যাপক বংশ বিস্তারে সাহায্য করে যাতে অবশেষে ক্ষতিকর অণুজীব বা জীবাণুর সংখ্যা কমে গিয়ে ক্ষতি করার ক্ষমতাই প্রতিহত হয়ে যায়।

অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে ডাইরেক্ট অ্যাকশন, তবে প্রতিহতের স্থায়ী সফলতা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রিবায়োটিক আর প্রোবায়োটিক হচ্ছে শিষ্টের লালন প্রক্রিয়ায় দুষ্টের দমন যাতে প্রতিহত আর প্রতিরোধ উভয় পন্থায় সফলতা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত হয়।

শার্লি এবদোর ঘটনার পর পশ্চিমা দেশগুলোতে জঙ্গি মোকাবিলায় অস্থিরতা লক্ষ্যণীয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার নিন্দায় ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ কিন্তু জঙ্গি মোকাবিলার পন্থা নিয়ে একমত নন। রাজনৈতিক মতলববাজির নানা ধান্দা তাদের চিন্তার ভিন্নতায় মূল অনুঘটকের ভুমিকা পালন করে থাকে। পন্থাটি কী হওয়া উচিত, অ্যান্টিবায়োটিক-নির্ভর, না প্রো বা প্রিবায়োটিক-নির্ভর, তাই নিয়ে ভাবছিলাম।

নর্থ আমেরিকা কিংবা ইউরোপে সম্প্রতি ইসলামের নামে যে সমস্ত জঙ্গি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, হোতাদের সবাই স্থানীয়, অর্থাৎ জন্ম বা বেড়ে ওঠা আক্রান্ত দেশটিতেই। পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মাদ্রাসার কোনো প্রোডাক্টের পক্ষে ঐসব 'আকাম' করা সহজসাধ্য ছিল না। পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত মুসলিমরা নাইন-ইলেভেনের পর থেকেই অস্থির সময় পার করছে। কারণ, সেখানকার স্কুল, কলেজ বা বিপণি বিতানে শ্যুটিং ও হত্যাকাণ্ড প্রায়ই ঘটে। আর সে সব ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার চাইতে হোতাদের পরিচয় বড় হয়ে দেখা দেয়। আক্রমণকারী সুস্থ না অসুস্থ মস্তিস্কের, ফ্যানাটিক না ড্রাগে আসক্ত, সবকিছু ছাপিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সে 'মুসলিম' কিনা সেই পরিচয় বড় হয়ে দেখা দেয়।

দেখা গেল, আক্রমণকারী ধর্ম-কর্মের ধারও ধারে না; পূর্ব-পশ্চিম‌, মসজিদ-মাদ্রাসা চেনে না, ইসলামের তকমাটা কোনোমতে গায়ে থাকলেই হল– কতিপয় মিডিয়া আর হিপোক্রেসি-নির্ভর রাজনীতিবিদের যেন কপাল খুলে যায়। তাদের কাছে সংকট উত্তরণে দিকনির্দেশনার চাইতে রাজনৈতিক ফায়দাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

৭ জানুয়ারির নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিকোলাস ক্রিস্টফের একটি লেখা পড়ছিলাম। শার্লি এবদোর ঘটনায় ইসলামকে ব্লেম করা যায় কিনা তাই ছিল তাঁর লেখার প্রতিপাদ্য। ক্রিস্টফের ভাষায়, ভয়ানক এই বিভেদটা ধর্মের মধ্যে নয়, টেররিস্ট আর মডারেটদের মধ্যে; সহনশীল আর উগ্রবাদীদের মধ্যে। সবচেয়ে ভয়ানক বিপদ হচ্ছে, এর গায়ে ধর্মের লেবাস পরিয়ে দেওয়া। সাবেক যুগোস্লাভাকিয়ায় মুসলিম নিধনযজ্ঞে সাধারণ খ্রিস্টানদের যেমন দায় নেই; মুসলিমবিদ্বেষী ফ্যানাটিকের হাতে নিহত ৭৭ নরওয়েবাসীর হত্যাকাণ্ডের দায় যেমন সাধারণ নরওয়েবাসীর নয়; 'আল্লাহ মহান' বলে বর্বরতায় পেশোয়ারে তালেবানদের হাতে ১৩২ শিশুর বীভৎস হত্যাকাণ্ডের জন্য যেমন সাধারণ পাকিস্তানিরা দায়ী নয়– তেমনি পশ্চিমা বিশ্বের কোথাও জিহাদিদের দুষ্কর্মের দায়ে সেখানে বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটিকে কোণঠাসা করতে হবে কেন? কোরআন পড়ে কেউ হয়তো মেয়েদের স্কুল উড়িয়ে দিচ্ছে; আবার ঐ একই কোরআন পড়ে কেউ আবার মেয়েদের জন্যে স্কুলের পর স্কুল তৈরি করে যাচ্ছে। কয়েকশ' বা কয়েক হাজার উগ্রবাদীর দায় ১.৬ বিলিয়ন মুসলিমের উপর বর্তাবে কেন?

পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত মুসলিমদের সংশ্লিষ্ট সমাজে আত্তীকরণের নিরন্তর প্রচেষ্টা সবসময়ই মতলববাজি রাজনীতির নানা কূটচালে উপেক্ষিত থাকছে। ২০১২ সালের ৩ জুলাই গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের টাইটেল ছিল এ রকম: 'মুসলিমরা খুব দৃঢ়ভাবে ব্রিটেনে আত্তীকৃত হয়ে আছে, কিন্তু বাহ্যত এটা কেউ বিশ্বাস করে না'। ব্রিটেনে বসবাসরত মুসলিমদের সঙ্গে ব্রিটেনের বন্ধন অন্যদের চাইতে কম নয় বরং বেশি; তারপরও তাদের দেখা হয় বহিরাগত হিসেবে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে অ্যাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা রিপোর্টের বরাত দিয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্রিটিশ নিজেদের এলাকায় মসজিদ বানাতে দেখলে উদ্বিগ্ন হয়। গড়পড়তা ৭৯ শতাংশ সাধারণ ব্রিটিশ যেখানে ব্রিটেনের নাগরিক হিসেবে গর্বিত বোধ করে, সেখানে মুসলিমদের মধ্যে এ হার ৮৩ শতাংশ। গড়ে ৫০ শতাংশ সাধারণ মানুষ ব্রিটেনের সঙ্গে শক্তভাবে সম্পৃক্ততা অনুভব করে; মুসলিমদের মধ্যে এ হার ৭৭ শতাংশ। নন-মুসলিম ব্রিটিশদের শতকরা ৬৩ শতাংশ যেখানে বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন ইথনিক প্রতিবেশির সঙ্গে বসবাস করতে চায়, সেখানে মুসলিমদের মধ্যে এ হার ৮২ শতাংশ।

এ রকম অসংখ্য পরিসংখ্যান মুসলিমদের আত্তীকরণের নিরন্তর প্রচেষ্টার সমর্থন করলেও, বাস্তবতা খুবই নিষ্ঠুর। নন-মুসলিম ব্রিটিশদের ৪৭ শতাংশ মুসলিমদের হুমকি মনে করে। মাত্র ২৮ শতাংশ ব্রিটিশ মুসলিমদের তাদের সমাজে আত্তীকরণের বিষয়টি বিশ্বাস করে। ৫২ শতাংশের ধারণা, মুসলিমরা 'প্রবলেমেটিক'। ৪৫ শতাংশ মনে করে, ব্রিটেনে মুসলিমরা গিজগিজ করছে। ৫৮ শতাংশ ইসলামকে উগ্রবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।

ব্রিটেনের এই পরিসংখ্যান কমবেশি সব পশ্চিমা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পশ্চিমা বিশ্বে সভ্যতার ইতিহাস গোত্রবিদ্বেষের ধারাবাহিকতার ইতিহাস। কখনও ফরাসি, কখনও চাইনিজ, কখনও জাপানি; আর স্নায়যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন উপাখ্যান হচ্ছে, 'মুসলিম'। কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জন এ ম্যাগডোনালড কানাডার প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের একজন হিসেবে খুবই সম্মানিত মানুষ। চাইনিজদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার কারণে সমালোচকরা তাঁকে 'রেসিস্ট' বলতেও দ্বিধা করেননি। ম্যাগডোনালড সমালোচনাটি উড়িয়ে না দিয়ে বলেছিলেন:

"রেসিস্টে পরিপূর্ণ একটি দেশ চালাতে গিয়ে রেসিজমে সমর্থন না করে উপায় কই?"

[রেফারেন্স: ন্যাশনাল পোস্ট, কানাডা; জানুয়ারি, ২০১৫ সংখ্যা]

সময়ের বিবর্তনে, সভ্যতার উৎকর্ষে পশ্চিমা বিশ্ব আজ অনেক বেশি মানবিক আর অ্যাকোমোডেটিভ। তারপরও অর্থ, ক্ষমতা আর রাজনৈতিক কূটচাল মানবিকতাকে অনেকটাই আপেক্ষিক করে ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডার কথাই বলা যায়। জাতিগত আর ধর্মীয় বৈচিত্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য গর্বিত এ দেশের সম্প্রীতির ঐতিহ্য আজ রাজনৈতিক ফায়দার কালিমায় অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে।

লেখার শুরুতে আমি অ্যান্টিবায়োটিক, প্রোবায়োটিক এবং প্রিবায়োটিকের কথা বলছিলাম। পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত মুসলিমদের আত্তীকরণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে প্রিবায়োটিকের ভুমিকা পালন করতে হবে। সন্ত্রাস দমনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে একটা কমিউনিটির 'ইনার ভয়েজ'। মুসলিম কমিউনিটির এই 'ইনার ভয়েজ' শক্তভাবে লালন করতে হবে আস্থা দিয়ে। সুশিক্ষিত, সহনশীল, মডারেট মুসলিম কমিউনিটি হচ্ছে প্রোবায়োটিকের মতো যা নিজ থেকেই দুষ্ট ক্ষতগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদের উন্মাদনায় সবচেয়ে বড় ভিকটিম মুসলিমরাই। শার্লি এবদোর ঘটনা যে দিন ঘটেছে, একই দিনে ইয়েমেনের এক পুলিশ কলেজের সামনে গাড়ি বোমায় নিহত হয়েছে ৩৭ জন।

জঙ্গিদের কোনো জাত নেই, ধর্মও নেই। জাতিগত বৈষম্য আর দারিদ্র উপেক্ষা করে জঙ্গিবাদকে শুধু ধর্মীয় লেবাসে দেখাও এক ধরনের নষ্ট রাজনীতি। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্যে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে দেখা গিয়েছে মুসলিমবিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার বিরুদ্ধে মিছিল করতে, তাতে নেতৃত্ব দিতে। কারও ধর্মীয় অনুভূতি আহত করে কিংবা মুসলিম-বিদ্বেষ উস্কে দেয় এমন প্রচারণা থেকে বেরিয়ে আসা ব্রিটিশ মিডিয়ার দায়িত্বশীলতাও প্রশংসার দাবি রাখে।

সন্দেহ নেই, 'প্রিবায়োটিক' পশ্চিমা রাষ্ট্র আর সমাজ ব্যবস্থায়, 'প্রোবায়োটিক' মুসলিম কমিউনিটির উত্থান জঙ্গিদের উৎপাত মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর বৈকি।