হরতাল-অবরোধে বিপন্ন বিপর্যস্ত বাংলাদেশের কৃষককুল

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 14 Jan 2015, 04:07 AM
Updated : 14 Jan 2015, 04:07 AM

ধবধবে সাদা ফুলকপি ভর্তি ঝাঁকাগুলো। গত ৮ জানুয়ারির দৈনিক 'প্রথম আলো'তে প্রকাশিত ঝাঁকাভর্তি এই ফুলকপিগুলোর ছবিটিতে দেখা যায়, ঝাঁকাগুলো সামনে মাটিতে রেখে দুই সারি মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝখানে রিকশা-ভ্যান চলাচল করার মতো সরু রাস্তা। মানুষগুলোর কারও গায়ে শীতবস্ত্র নেই। মানে, এদের সকলেই সাধারণ কৃষক। কারও বুকে দুই হাত, কারও কোমরে। চেহারায় হতাশা এবং বিষাদ। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা আছে:

''ক্রেতাশূন্য: টানা অবরোধে সবজি চাষীদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে বগুড়ার অন্যকম পাইকারি সবজির মোকাম, 'মহাস্থান হাট'। গতকাল বুধবার মণপ্রতি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা দরে।''

মানে, প্রতিটি ফুলকপি এক টাকা বা তারও কম দামে। আমি নিশ্চিত, এই অসহায় মানুষগুলোর খোঁজখবর নিতে যাননি এলাকার নির্বাচিত এমপি, খোঁজ নেননি ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলার চেয়ারম্যান। এই তিনজনই কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধি; নির্বাচনী এলাকার মানুষজনের দুঃখ-কষ্ট, সমস্য-সংকটের সময়ে পাশে দাঁড়ানো তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। উপজেলা বা জেলা প্রশাসনের কেউও এমন খোঁজ-খবর নিয়েছেন, তা এতগুলো দৈনিক পত্রিকা বা টিভি চ্যানলের কোথাও কখনও দেখিনি।

তো এই গণতন্ত্রের দেশে কার কাছে যাবে এই মানুষগুলো আশা-ভরসার কথা শুনতে? এত শ্রম দিয়ে এত টাকা বিনিয়োগ করে কৃষক তাঁর অল্প জমিতে ফসল উৎপাদন করবেন, আর তাঁর উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম দামের নিশ্চয়তাও তিনি পাবেন না; ধারকর্জ করে বা স্ত্রীর অল্পস্বল্প অলংকার বন্ধক দিয়ে বা বিক্রি করে সেই টাকা কৃষিতে বিনিয়োগ করবেন তিনি, অথচ খরচ উঠাতে পারবেন কিনা তা তিনি জানেন না। ঝড় বৃষ্টি বাদল, খরা বন্যা, এই অবরোধ হরতাল, এই দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপদে এবং উপার্জনকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে বছরের পর বছর। ভারতে লক্ষ লক্ষ কৃষক ধারদেনা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন, এখনও প্রতিদিন এমন আত্মহত্যা চলছে। আমাদের কৃষকরা চরম বিপদেও এমন একটি চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। কিন্তু কতদিন তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে?

গার্মেন্টস মালিকদের গত বছর তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা, সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে বলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহম্মদ সেদিন, ২ জানুয়ারি, রানা প্লাজার নিহত আহত শ্রমিকদের ওপর '২৪ এপ্রিল: হাজার প্রাণের চীৎকার' নামের ৪৮০ পৃষ্ঠার ৫০০ টাকা দামের বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বলেছেন। এই তিন হাজার কোটি টাকার একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও যদি রানা প্লাজার নিহত আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে, কল্যাণে দেওয়া হত, তাদের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও প্রশমিত হত।

কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকরা তো গার্মেন্টস মালিকদের মতো সংগঠিত নন। গত জাতীয় সংসদে ৩৬ জন গার্মেন্টস মালিক সংসদ সদস্য ছিলেন, কিন্তু সংসদ সদস্য ছিলেন না একজন শ্রমিকও। ক্ষমতা প্রয়োগ করে টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা আদায় করার যে শক্তি-সামর্থ্য গার্মেন্টস মালিকদের আছে তার কিছুই তো নেই শ্রমিকদের। কিন্তু এঁরাই রক্ত, শ্রম, জীবন দিয়ে এই সেক্টরগুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন।

গত কুরবানির ঈদের আগে দেখলাম, যে তাজরিন গার্মেন্টসে ১১৩ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গেল, তার মালিক, সেই দেলোয়ার হোসেনের আরেকটি কারখানা তুবা গার্মেন্টসে শ্রমিকরা যখন তাদের অতি ন্যায্য বকেয়া বেতন-ভাতা আদায় করতে অনশন করতে থাকল, তাদের বিরুদ্ধে এবং একাধিকবার জেলখাটা মালিক দেলোয়ারের পক্ষে সংঘবদ্ধভাব অবস্থান নিলেন বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, নৌ পরিবহন মন্ত্রী 'সর্দার' শাহজাহান খান এবং শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক টুকু। তারা সভা, প্রেস কনফারেন্স করলেন আইন, বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনেই। এই ভবন নির্মাণে এবং উদ্বোধনে আলাদা আলাদাভাবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দুই প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন। গার্মেন্টস মালিকরা কত শক্তিমান, বলবান, তার আর কোনো উদাহরণের দরকার আছে?

দেশের রাজনীীততে তাদের মধ্যে যতই সংঘাত-সংঘর্ষ থাকুক না কেন, 'বিজিএমইএ'এর মতো সংঘবদ্ধ শক্তিগুলাকে সঙ্গে এবং পাশে রাখতে দুই নেত্রীই প্রবলভাবে আগ্রহী। আদম ব্যাপারিদের সংগঠন, 'বায়রা', ভূমিদস্যুদের সমিতি, বাস মালিক সমিতি, লঞ্চ-স্টিমার মালিক সমিতি, ব্যাংক-বীমার মালিক সমিতি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতি– প্রত্যেকটি সমিতির কাছেই প্রতিটি সরকার জিম্মি থাকছে। প্রবল জনমতের চাপেও এইসব সংগঠনের হত্যা-গুমের অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আমাদের সরকারগুলো সাহস পায় না।

আমাদের কৃষককুল যতই অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখুক না কেন, তাদের ক্ষয়ক্ষতি পোষানোর জন্য তাঁদের পাশে নির্বাচিত প্রতিনিধি বা প্রশাসন দাঁড়ায় না। কিন্তু তারা তিন হাজার কোটি টাকা সাহায্য দেয় এক বছরে গার্মেন্টস মালিকদের। তারপর, গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে এবং সদ্য যোগ দেওয়া 'চিফ ইকোনমিস্ট' ড. বীরুপাক্ষ পালের উপস্থাপনায় এই বছরের জানুয়ারি-জুন সময়কালের জন্য প্রস্তাবিত মুদ্রানীতির ওপর এক মতবিনিয় সভায় একজন বললেন যে, আমাদের ব্যাংকগুলো তাদের ঋণগ্রহীতাদের ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে। বিশ্বাস হয়? এদের বিপরীতে ওই বিপন্ন কৃষক, বিপন্ন শ্রমিকদের তুলনা করুন।

বিশ্বাস করবেন কি– এই ঋণগ্রহীতা এবং সুদ মওকুফ গ্রহণকারীদের মধ্যে দৈনিক ইনকিলাবের মালিক-সম্পাদক বাহাউদ্দিন এবং দৈনিক জনকণ্ঠের মালিক-সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদও আছেন? প্রথম জন একটি 'জঙ্গি' সংগঠন, এই 'ইনকিলাব' চালায়; আর অন্যজন, 'জঙ্গিবিরোধী' সংগঠন 'জনকণ্ঠ'। কিন্তু ব্যাংক ঋণখেলাপী হিসেবে দুজনের মধ্যে দারুণ সংহতি। তাই এই দুই পত্রিকায় ঋণখেলাপাীদের ওপর কোনো খবর থাকে না, ঋণখেলাপীদের উপর কোনো খবর, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় থাকে না, যেমন থাকে অন্য সব পত্র-পত্রিকায়।

দুই

শুধু ফুলকপি চাষীরা যে মাথায় হাত দিয়ে নিরবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছেন, তা নয়। আজ রোববার, ১১ জানুয়ারি, দৈনিক 'প্রথম আলো'র প্রথম পৃষ্ঠায় এমন আর একটি বড় রঙ্গিন ছবি– আগুনে ঝলসে যাওয়া একটি ট্রাকের সামনে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোল আলু। ছবিটির নিচে এই ক্যাপশন আছে:

''দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুন পুড়ে গেছে আলু বহনকারী ট্রাক। ঘটনা গত শুক্রবারের রাতে বগুড়ার বাইপাস সড়কের চারমাথা নিশিন্দারা এলাকার। ছবিটি তোলা গতকাল বেলা ১১টায়।''

আলু উৎপাদনের যথার্থ স্বীকৃতি আমাদের আলু চাষীরাও পাননি। এরশাদ জামানায় আমি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস ক্যাডারের অফিসার হয়েও আড়াই বছর কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করেছি। আমার চৌত্রিশ বছরের চাকরি জীবনের এই আড়াই বছরের প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করেছি, ৩০ মাসে ৫০ বার গ্রামে-গঞ্জে গিয়েছি, 'লিটারেলি' টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আমাদের কৃষি খাতে আমাদের অসাধারণ সব অর্জন প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য তখন আমার হয়েছিল। তখন বার্ষিক মোট আলু উৎপাদন ছিল, যতটুকু মনে পড়ে, ১৩ লাখ টন। এখন সেই ফিগার বোধহয় ৯০ লাখে উঠছে।

খাবার হিসেবে আলুর ব্যবহার অনেকভাবে, অনেক রকমের হতে পরে। গত বছর এই সময়ে আলুর দাম প্রতি কেজি যখন কোনো কোনো জায়গায় চার-পাঁচ টাকায় নেমে এল, তখন কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আলু উত্তরবঙ্গের কতগুলো জায়গায় রাস্তায় ফেলে রেখে দিয়েছিল, প্রতিবাদে। তখন আমি উত্তরায় আমার আশেপাশের কয়েকটি সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখলাম, 'গোল্ডেন হারভেস্ট' নামের বাংলাদেশি কোম্পানির কাঁচা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজের আধা কেজির প্যাকেটের দাম ৭৫ টাকা!! এখন দেখি সেই প্যাকেটের দাম ৯০ টাকা!! তো এই আধা কেজি কাঁচা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ বানাতে 'গোল্ডেন হারভেস্ট' কোম্পানির কাঁচামাল হিসেবে কত কেজি আলু লাগে প্যাকেটপ্রতি, লবণ-তেল-প্যাকেট খাতে কত খরচ হয় জানার আগ্রহ নিয়ে অনেক জায়গায় খোঁজ-খবর নিলাম। কিন্তু কেউ তেমন সাহায্য করতে পারলেন না।

মাস খানেক আগে 'প্রাণ' গ্রুপের চেয়ারম্যান জেনারেল আমজাদকেও জাতীয় জাদুঘরে এক সভার ফাঁকে আলুর 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ' তারা উৎপাদন করেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তার জবাব, তারা 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ' উৎপাদন করেন না। কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকারী দেশের এক নম্বর ব্যবসায়িক কোম্পানি– কিন্তু আলুর এই জিনিসটি উৎপাদন করেন না, বিশ্বাস হয়? তারা করেন না, কারণ হয়তো এখানে বিশাল অংকের লাভের সম্ভাবনা নেই। অথচ তারা দুনিয়ার বোধহয় আশি-নব্বইটি দেশে তাদের পণ্য রপ্তানি করে থাকেন।

কিন্তু এতটুকু দেশপ্রেম থাকলে তারা ভাবতেন, লাখ লাখ টন আলু কিনে প্রক্রিয়াজাত করে পাইকারি হারে বা একটু লোকসান মেনে নিয়েও হাসপাতাল, জেলখানা, স্কুল-কলেজে 'বাল্ক' পরিমাণে সরবরাহ করা যায়। এতে কৃষকরা যেমন উপকৃত হতেন, উপকৃত হত সাধারণ মানুষও। আমাদের মনে রাখা দরকার– এই তো চল্লিশ বছর আগেও এই দেশের মানুষজন আটার রুটি খেতে চাইত না। অথচ এখন? 'রিজনেবল' দামে 'ফ্রেঞ্জ ফ্রাইজ' কিনতে পারলে আমি আমার ডিপ ফ্রিজভর্তি করে রাখতাম। সারা দুনিয়ার শিশু কিশোর কিশোরীরা তো ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ ছাড়া আর কিছু খেতে চায় না।

প্রাণ গ্রুপের শুরু হয়েছিল বছর তিরিশ আগে– 'আরএফএল'- রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড দিয়ে। এখন এটি একটি মহীরুহ। 'আরএফএল' প্লাস্টিক সামগ্রী সারা দুনিয়াতেই জনপ্রিয়। প্রাণ গ্রুপের আরও উন্নতি-সমৃদ্ধি দেখতে চাই। সঙ্গে খেটে-খাওয়া কৃষক-শ্রমিকদের জন্য একটু মানবপ্রেমও।

তিন

ফুলকপি নিয়ে এখন একটি আমোদজনক অভিজ্ঞতা। ১৯৯৯তে আমি যখন ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রিন্সিপ্যাল, শ্রীলংকায় তখন আমাদের হাই কমিশনার আশরাফউদ্দৌলার চেষ্টায় এবং আগ্রহে ওখানকার ফরেন সার্ভিস একাডেমীর প্রিন্সিপ্যালের দাওয়াতে আমার কলম্বো সফরের একটি সুযোগ ঘটে। প্রথামত, এই শ্রীলংকান হোস্ট আমার জন্য একটি ডিনারের আয়োজন করেন। আট-দশ জন বিশিষ্ট মেহমানের মধ্যে তাদের পররাষ্ট্র সচিব এবং 'আঙ্কটাড'এর প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল শ্রীলংকার গামানী কোরিয়াও ছিলেন।

পরদিন শ্রীলংকান ফরেন সার্ভিস একাডেমীর ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, এক ভদ্রমহিলা, আমাকে দেশটির কতগুলো দর্শনীয় স্থানে নিয়ে গেলেন। গাড়িতে ভ্রমণকালে, ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন:

''গত রাতে তোমার সম্মানে আয়োজিত ডিনারে ফুলকপি ছিল, তা কি তুমি লক্ষ্য করেছ?''

বললাম:

''হ্যাঁ, ফুলকপি ছিল, তাতে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার কী ছিল?''

মহিলা বললেন:

''তোমাদের অনেকেই জান না, ফুলকপি বিশেষ বিশেষ মেহমানদের জন্য আয়োজিত ডিনারে পরিবেশন করা হয়ে থাকে, শ্রীলংকায়।''

আমি এই মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকি, আরও কিছু শুনতে। তখন তিনি ব্যাখ্যা করেন:

''শ্রীলংকায় ফুলকপি হয় না, ফুলকপি এই দেশে আমদানি করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। আমদানি করা হয় প্লেনে, 'ফ্রেশনেস' ধরে রাখার জন্য। এখন বুঝতে পারছ?''

জবাব দিই আমি:

''হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।''

এইবার আলু নিয়েও এমন একটি আমোদজনক অভিজ্ঞতা।

সেই ১৯৬৯এ লন্ডনের পাকিস্তানি হাই কমিশনে আমি যোগ দিয়েছি একজন থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে। বিদেশে আমার প্রথম পোস্টিং এই লন্ডনে। কয়েক মাস পর আমার ঠিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, হাই কমিশনের একজন কাউন্সেলর (Counsellor, Councillor নয়; কনসাল বা কনসাল-জেনারেলও নয়; Counsellor একটি কূটনৈতিক পদ, সাধারণত আমাদের ডেপুটি সেক্রেটারি পদমর্যাদার) বখতিয়ার আলী আমাকে পাশের দামি, ভালো মানের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন লাঞ্চে। গুরুত্বপূর্ণ, দামি আইটেমগুলোর একটি ছিল 'রোস্টেড পটেটো', চামড়াসহ। মানে, চামড়াসহ ঝলসানো আলু। ছুরি-চামচসহই মজা করেই 'আলু' সাহেবকে খেলাম সেদিন লাঞ্চে।

তারপর এখন টমেটো, বিলাতী বেগুনের কথা বলি। সেই '৭৫-'৭৬এ জেনেভায় থাকতে দেখেছি, একটি মুরগির ডিম এবং সমান সাইজের একটি টমেটোর দাম একই। জেনেভার উপকণ্ঠের বাড়িগুলোর কিচেন গার্ডেনে অবশ্যই পনের-বিশটি টমেটো গাছ থাকত। প্রতিটি গাছে দুই-আড়াই কেজির মতো টমেটো, লাল রঙয়ের এবং প্রায় একই গোল সাইজের। টমেটো আসলেই ফল না ফুল, এত বছর পরেও সেই প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে। গোল লাল টমেটো এমনিতেই মানুষজনকে আকৃষ্ট করে। তবে জেনেভার ওই পরিবারগুলোর টমেটোর দৈনন্দিন প্রয়োজন এই বাগান থেকে মেটানো হত। আমাদের দেশেও তো এখন টমেটো ছাড়া সালাদের ডিশ সম্পূর্ণ হয় না।

এখন সবশেষে টমেটো নিয়ে আর একটি অভিজ্ঞতা। আমরা তখন শিশু, ক্লাস টু থ্রিতে, স্থানীয় গঙ্গাধর মজুমদার মাইনর স্কুলে পড়ি। বাড়ির সামনে ছোট এক টুকরো জমিতে আব্বা শীতকালীন শাক-সবজি করতেন। শীতের সকালে প্রতিটি চারা আলাদা আলাাদাভাবে পরিচর্যা করতেন তিনি। কলসের পানি ঢালতেন প্রতিটির গোড়ায়। যথাসময়ে অন্যান্য সবজির সঙ্গে টমেটো তোলার সময়ও হল। ক্ষেতে কাঁচা-সবুজ, পাকা-লাল রঙয়ের অনেক টমেটো।

তো একদিন দুপুরে দেখি, মতিউর রহমান কাকু– 'দারোগা কাকু' বলেই আমরা তাকে ডাকতাম, তিনি আব্বার চাচাতো ভাই– একদিন দুপুরের দিকে ক্ষেত থেকে লাল টমেটো গাছ থেকে ছিঁড়ে, প্রথমে ফাটলেন হাতের চাপে, তারপর বীচিগুলো ফেলে সেই লাল টমেটো খেতে থাকলেন। আমরা শিশুরা হাঁ করে তাকিয়ে রান্না ছাড়া সেই টমেটো খেতে তাঁকে দেখলাম। জীবনে সেই প্রথম পাকা টমেটো কাঁচা খেতে দেখলাম, মতি কাকুকে।

ভাবতে থাকলাম, গরু-ছাগল-হাতি নানা রকমের কাঁচা জিনিস খায়, কিন্তু মানুষ কাঁচা লাল টমেটো খায়?

এখন আমিও ঢাকার বাইরে গেলে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ক্ষেতে পাকা টমেটো দেখলে মালিক বা তার পক্ষের কেউ আশেপাশে থাকলে, অনুমতি নিয়ে ছিঁড়ে কাঁচা লাল টমেটো বীচি ফেলে খেতে থাকি। গত বছর নিউ ইয়র্কের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃষি ফার্ম থেকে দু-তিনটি পাকা টমেটো খেয়ে লাঞ্চ সারি। এই প্রতিষ্ঠানের রেস্টুরেন্টটি সেদিন কোনো কারণে বন্ধ ছিল।

চার

বাংলাদেশ ব্যাংক আয়োজিত আলোচনা সভায় আমি গভর্নর ড, আতিউর রহমান এবং 'চিফ ইকোনমিস্ট' ড. বীরুপাক্ষ পালের কাছে আবেদন করি, তাঁরা যেন দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রবৃদ্ধি ৬ পারসেন্টের আশেপাশে, ঠিকই আছে। পাশের দেশ শ্রীলংকায় যদিও ৭.৫ পারসেন্ট। হরতাল-অবরোধ না থাকলে, দুর্নীতি ঠেকানো গেলে, সুশাসন দিতে পারলে আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধিও হয়তো আট-নয় পারসেন্ট হতে পারত।

প্রতি বছর আলু, টমেটো, মুলা, বেগুন নিয়ে চাষীরা বছরের একটা সময়ে ক্রেতার অভাবে বিপদে পড়েন। তারা কখনও কখনও মাঠেই তাদের সবজি ফেলে রাখেন। কারণ মাঠ থেকে তোলার বা বাজারে নিয়ে যাওয়ার খরচও উঠে না। হরতাল-অবরোধ থাকলে এই কৃষকরা তখন এতিম হয়ে পড়েন।

সেদিন এই দুইজনের কাছে তাই আমি আরও আবেদন করেছি, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনকারী কৃষকদের ওপরও যেন তাদের একটু রহমত বর্ষিত হয়, যেমন বর্ষিত হচ্ছে এখন প্রতি বছর গার্মেন্টস মালিক ও রপ্তানিকারকদের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও 'চিফ ইকোনমিস্ট' ড. বীরুপাক্ষ পাল 'প্রাণ' গ্রুপ এবং 'গোল্ডেন হারভেস্ট' কোম্পানির মালিক-মোখতারদের সঙ্গে কথা বলে 'মনিটারি পলিসি'র আওতায়ও কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা হয়তো দিতে পারেন। আমি জানি– আমাদের করনীতিতে, কর মওকুফসহ এতসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, মুদ্রানীতিতে তেমন সুযোগ নেই। ড. আতিউর আমাদের কৃষকদের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন গত পাঁচ বছরে।

বীরুপাক্ষ পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের নেতৃত্বেও ছিলেন বীরু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় বেতন-ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে কয়েক বছরের বিরতি নিয়ে তিনি দেশে এসেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেশের প্রতি তাঁর দরদ তাঁর লেখায় প্রায়ই প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর বাবা স্বর্গীয় নগেন্দ্র চন্দ্র পাল, শেরপুরের তারাগঞ্জ হাই স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে নন্দিত একজন মানুষ ছিলেন। আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষকের সন্তানের কাছ থেকে ওই দরদই প্রত্যাশিত।

কিন্তু সেদিনের সেই কঠিন টেকনিক্যাল আলোচনায় অর্থনীতির এতসব বিজ্ঞ এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তির সামনে আমার কথা বলার সময় তাদের নির্লিপ্ত ও অনাগ্রহী দেখেছি। হতে পারে, আমার কথাগুলোর জন্য এই ফোরাম হয়তো যথার্থ ছিল না।

এই সভায় এনসিবিবিএল, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, জাতীয় প্রেস ক্লাবের একজন সদস্য, নুরুল আমিন জানালেন, আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা 'রিজিলিয়েন্ট' বলেই এতসব হরতাল-অবরোধ সত্ত্বেও দেশকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার কথা শুনে মনে মনে হাসলাম; তারা যদি 'রিজিলিয়েন্ট' হয়, তবে প্রতি বছর তাদের তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা, সুযোগ-সুবিধা দিতে হয় কেন?

আসলে নুরুল আমিনরা জানেন না, এই দেশের আসল 'রিজিলিয়েন্ট' জনগোষ্ঠী হল আমাদের কৃষক, আমাদের শ্রমিক এবং আমাদের প্রবাসীরা। নুরুল আমিনরা নন।

'শিউলীতলা', উত্তরা; রোববার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৫।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।