গণতন্ত্রের উদাহরণ সৃষ্টি করল শ্রীলঙ্কা

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 13 Jan 2015, 10:44 AM
Updated : 13 Jan 2015, 10:44 AM

গণতন্ত্রের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করল শ্রীলঙ্কা। একটি সফল ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের বিজয় কেতন বিশ্বে প্রতিভাত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অনুসারীরা বলিষ্ঠ কণ্ঠে গণতন্ত্রের দৃশ্যমান এই প্রক্রিয়া নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পেলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাই গণতন্ত্রের প্রত্যাশার প্রদীপকে উচ্চকণ্ঠে স্বাগত জানিয়েছেন।

নির্বাচনে বিজয়ের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে, ৯ জানুয়ারি, ২০১৪, কলম্বোর স্বাধীনতা স্কয়ারে বিপুল জনগণের হর্ষধ্বনির মাঝে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন নির্বাচনে বিজয়ী নতুন রাষ্ট্রপতি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিদ এবং দু'বারের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ ছেড়ে দিয়ে এবং নতুন বিজয়ী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শপথ গ্রহণের সুযোগ দিয়ে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। দেশের আপামর জনগণকে তিনি ধন্যবাদ জানালেন তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমে ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করার জন্যে।

মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষের দল ভোটদানে কারচুপি অথবা নির্বাচনকালে কোনো প্রকার অশুভ শক্তির প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আনেননি। মাত্র ৫১.২৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন মাইথ্রিপালা সিরিসেনা; রাজাপাক্ষে পান ৪৭.৫৮ শতাংশ ভোট। বোঝা যাচ্ছে, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে শোনা যায়, মাঝপথে রাজাপাক্ষের কিছু অনুসারী পরাজয়ের আভাস পেয়ে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার জন্যে অনুরোধ করেছিল যা সামরিক বাহিনী প্রত্যাখ্যান করেছে দৃঢ়ভাবে।

নতুন রাষ্ট্রপতি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ২০১০ সাল থেকে সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। নির্বাচন ঘোষণার পূর্বক্ষণে তিনি পদত্যাগ করেন এবং তার পক্ষে জনগণের বিপুল অভিমত আদায়ে সক্ষম হন। তিনি নতুন ধারার রাজনীতির ঘোষণা দেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রপতি একবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। এছাড়াও তিনি অঙ্গীকার করেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাই করবেন।

নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সিরিসেনা সংখ্যাগুরু সিংহলি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হলেও তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের বিপুল সমর্থন লাভ করেন। এর প্রধান কারণ হল, তিনি বারবার ভোটারদের কাছে গিয়ে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণকারী সকল মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করতে তিনি বদ্ধপরিকর।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপাক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচনকালে যে সকল অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে, তিনি তার শাসনামলে একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন এবং দেশের জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেননি। সকল ক্ষেত্রে দলীয় ভাবধারার প্রাধিকার দিয়েছেন এবং স্বব্জনপ্রীতি, পারিবারিক শাসন ও দুনীর্তিতে নিজেকে আবিষ্ট করে রাষ্ট্রীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান অবদান রাখতে পারেননি। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের অভিমতের সঠিক মূল্যায়ন করে তাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগও গ্রহণ করেননি। বিছিন্নতাবাদী তামিল লিবারেশন টাইগারদের অভিযান নির্মূল করার পর তাদেরকে শ্রীলঙ্কার মূলস্রোতে একীভূত করার চেষ্টাও তার ছিল না।

পক্ষান্তরে, নতুন রাষ্ট্রপতি সিরিসেনা যখন সংসদ নেতা ছিলেন, তিনি বিরোধী দলের অভিমতে সম্মান প্রদর্শন করে এক অসামান্য নজির স্থাপন করেছিলেন। সংখ্যালঘুদের প্রতি সমান আচরণ এবং সকল দল ও মতের অভিমতে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন তিনি। তাই অতি অল্পসময়ে নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনা করেও তিনি বিপুল জনগণের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছেন। জনগণ তাকে দেশের নেতা হিসেবে বিবেচনা করেছে, কোনো দলের বা তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে দেখেনি। দলের নেতা হতে হলে দলবাজি করতে হয়, আর দেশের নেতা হলে বিশাল মনের অধিকারী হতে হয়, এমন বাস্তবতার উপলব্ধি হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি।

গণতন্ত্রে যে বিষয় অতি জরুরি, তা হচ্ছে সহনশীলতা। অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা, ভিন্নমতের বাকস্বাধীনতা এবং তাদের সমাবেশ ও অভিমত প্রকাশের সুযোগ প্রদান। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চ্চা এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে গণতান্ত্রিক চেতনা ও সহনশীলতার অন্যতম নির্দশন। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের এখানেই বড় পার্থক্য।

গণতান্ত্রিক চর্চ্চার পথে সহনশীলতা প্রদর্শন তারাই করতে সক্ষম যারা তৃণমূল থেকে উঠে এসে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। আমলাতন্ত্রের প্রাক্তন কর্মী, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক অথবা বংশপরিচয়ে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে সহনশীলতা প্রর্দশনের নজির বিরল। এ শ্রেণির প্রাসাদ রাজনীতিতে আবদ্ধ নেতাদের পক্ষে তাদের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতার অভাব প্রায় সর্বত্র দৃশ্যমান। এখানেই হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে হঠাৎ করে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার সুযোগ পেয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া এমপি, মন্ত্রী, মিনিস্টারদের পার্থক্য।

আলোচনার বৈঠকে বসে ভিন্নমত ও পথের মধ্যে সমন্বয় করে যে কোনো প্রকার অস্থিরতা বা জটিলতার অবসান ঘটানোর মানসিকতা হচ্ছে বড় বিষয়। পাকিস্তানে গত বছর প্রখ্যাত ক্রিকেটার ইমরান খানের দল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলে। কিন্তু অবশেষে আলোচনার বৈঠকে তা স্তিমিত হয়। এমন উদাহরণ সৃষ্টির বিষযটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া। এখানে অহঙ্কারের সুযোগ নেই। তাই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে রাষ্ট্রনায়কের– পুরোপুরি দলীয় নেতার পক্ষে সমস্যার সমাধান করা কঠিন।

গণতন্ত্রের এমন শক্তিশালী মর্মবাণী উপলব্ধি করেই নেপাল রাজতন্ত্রকে বিদায় দিয়েছে, ভুটান গণতন্ত্রের চর্চ্চা শুরু করেছে। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী কয়েক বার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর পুনরায় গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন হস্তান্তর করছে। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের বিকল্প কিছু নেই। জনগণের গণতান্ত্রিক মানসিকতা অনেক সুদৃঢ় এবং পরীক্ষিত সত্য।

তাই গণতন্ত্রের সুরক্ষা করতে হলে প্রয়োজন উদার মানসিকতা, সকল মত ও দলের ভাবনার প্রতি সম্মান প্রর্দশনের প্রয়োজনীয়তা এবং সুযোগের সমান ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। ভাষা প্রয়োগে থাকতে হবে অধিক বিচক্ষণতা। অনেক সময় কথা বলার ভঙ্গি বা ভাষা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে শক্তি ও ক্ষমতা প্রর্দশন করার অহমিকা গণতন্ত্রের জন্যে সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদরা সাধারণভাবে এমন হন না, যেমনটা হন হঠাৎ করে রাজনীতিতে ঢুকে পড়া নেতারা।

দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে তৃণমূলে রাজনীতি করা লোকদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, দিনের পর দিন। বিত্তশালী এবং বনিক শ্রেণির লোকদের রাজনীতিতে বিচরণ বেড়ে যাচ্ছে যা দেশের সাধারণ নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। ফলে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

কয়েক মাস একটি সংগঠন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। লক্ষ্য ছিল বড় হলে তারা কে কী হতে চায়, অর্থাৎ তাদের জীবনের লক্ষ্য কী। তাতে একটি প্রশ্ন ছিল এ রকম যে, বড় হয়ে তারা রাজনীতিবিদ হতে চায় কিনা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, প্রায় ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা অভিমত দিয়েছে তারা রাজনীতিবিদ হতে চায় না। অনেকের ধারণা, রাজনীতি করার অর্থ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া বা সঠিক কথা না বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা। গণতন্ত্রের পক্ষে এ হচ্ছে একটি অমানিশার নির্দশন। তাই রাজনীতিবিদদের প্রমাণ করতে হবে যে, রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রপরিচালনা করার দক্ষ ও বিচক্ষণ মানুষদের সমাবেশ, যা দেশের কল্যাণে অনেক কাজ করতে পারে। একটি দুর্বল দেশকে উচ্চতার শীর্ষে আরোহণ করানো এবং জনগণের কল্যাণে অবদান রাখা রাজনীতিবিদদের পক্ষেই সম্ভব।

গণতন্ত্রের ভাষা বা পদ্ধতি যদি হরতাল অবরোধ, মিটিং মিছিল এবং পেশিশক্তির প্রদর্শন হয়, তবে গণতন্ত্র মানুষের মনে অন্যতম রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি হিসেবে স্থান লাভ করতে সক্ষম হবে না। বাংলাদেশে সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গণতন্ত্র বিজয়ী হবে এ প্রত্যাশা সমগ্র দেশবাসীর।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।