রাজনীতির দাবাখেলা

Published : 12 March 2011, 06:51 PM
Updated : 12 March 2011, 06:51 PM

কলেজ জীবনে আমার অন্যতম প্রিয় খেলা ছিল দাবা। আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, যার সাথে মাঝে মাঝেই দাবা খেলতাম। পরে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলে সেখানেও খেলাটা চালিয়ে গিয়েছিলাম। কখনো আমি জিততাম, কখনো আমার বন্ধু – খেলা চলাকালীন যে হয়ে উঠত আমার প্রতিপক্ষ। দাবা অত্যন্ত জটিল এক খেলা, খেলাটির মধ্যপর্যায়ে একটি চাল দেবার মুহূর্তে কয়েক সহস্র চালের option থাকে, যার থেকে সর্বোত্তম চালটি বেছে নেন দাবারু। প্রশ্ন হচ্ছে সম্ভাব্য ক'টি চাল তিনি মনঃশ্চক্ষে দেখতে পান। এ ছাড়া রয়েছে নিজের স্ট্রাটেজি, প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য চালসমূহ ধারণা করা, ইত্যাদি। যিনি যত বড় খেলোয়াড় তিনি তত বেশি চাল দেখতে পান। দাবা খেলায় আমরা দু'বন্ধুই ছিলাম আনাড়ি, সমপর্যায়ের। আমরা দু'জনেই প্রচুর ভুল চাল দিতাম, যে জিততো, সে যে তার নিজের নির্ভুল চালের জন্য জিততো, তা কিন্তু নয়, জিততো অন্যপক্ষের ভুলের জন্য। অর্থাৎ দু'পক্ষই ভুল করতো, যে অপেক্ষাকৃত কম ভুল করতো, সে জিততো। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ব্যাপারেও এই একই তুলনা খাটে। যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দল এত বেশি ভুল চাল দেয় যে, বিরোধী দল প্রায় কোন চাল না দিয়েই 'নেগেটিভ ভোট' পেয়ে পরবর্তী নির্বাচন জিতে যায়। খেলাটা চলছে অনেকদিন ধরেই। অর্থাৎ নিজ দলের যোগ্যতায় নয়, জিতে যায় অন্যদলের ব্যর্থতায়।

বিপুল সম্ভাবনার বাংলাদেশ তো মূলতঃ বিপুল সমস্যার দেশ। এখানে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেয়া সহজ, তা রক্ষা করা কঠিন। আরো কঠিন হয়ে যায় যখন চারপাশে সুবিধাবাদী লুটেরার দল জড়ো হয়। এবারের বিজয়ী দলটির একটি প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সে পথে তারা এগুচ্ছে ঠিকই, তবে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এখানেও নির্বাচনী হিসাব কাজ করছে বলেই মনে হয়, এ টার্মে শুরু করব, কিন্তু শেষ করার জন্য প্রয়োজন আরো একটি টার্ম, সুতরাং আমাদের পুনর্বার ভোট দিন। অথচ তারা যদি এই টার্মেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করত, তবে পরবর্তীতে এই সাফল্য হত দুর্দ্দান্ত এক উদাহরণ। পুনঃনির্বাচিত হয়ে তারা আরো একটি বড় প্রকল্প (হতে পারে আরিচায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতু) হাতে নিতে পারত। বাংলাদেশ পেত দু'টি সেতু। অন্য নির্বাচনী অঙ্গীকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজটি বহুপূর্বেই শুরু করার কথা ছিল, সম্ভবও ছিল। এই মহাসড়কটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সুপারহাইওয়ে বলা যায়, অথচ এটি এখনো কোন আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন, তিনি নিজে একজন ঠিকাদার ছিলেন এবং তার নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

একই ব্যাপার ঘটছে বিদ্যুতের বেলায়। সেখানে জড়ো হয়েছে 'সকল কাজের কাজী' কিছু অবসরপ্রাপ্ত আমলা উপদেষ্টা, যাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান সীমিত এবং কর্মদক্ষতা প্রশ্নজড়িত। খাদ্যদ্রব্যের দাম, বিশেষ করে চালের দাম, কমিয়ে রাখা কেবল নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষাই নয়, গণ-অসন্তোষ থেকে বাঁচা, সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা ও পুনর্বার নির্বাচনে জয়লাভের জন্য জরুরী। এর আগেরবার ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম চমৎকার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। এবার তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের যিনি মন্ত্রী, ইনিও একজন ব্যবসায়ী, যিনি সিন্ডিকেটের রুই-কাতলাদের মিটিংয়ে এনে ধমক দেন এবং অনিবার্যভাবে পরদিন সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি হল, বাংলাদেশের মত কমমূল্যে পৃথিবীর আর কোথাও খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হয় না। ফলে যা হবার তাই হয়, সিন্ডিকেট আস্কারা পেয়ে আরো একদফা মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সরকারের এ সকল ব্যর্থতাকে পুঁজি করে বিরোধীদল আবারো ক্ষমতায় আসার সুবাতাস পাচ্ছে এবং আগ বাড়িয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের 'মামার বাড়ির আবদার' করছে। ছিয়ানব্বইয়ের মত আবারো টালমাটাল হয়ে উঠেছে শেয়ার বাজার। খাদ্যদ্রব্যের সিন্ডিকেটের মত সেখানেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় হাতিয়ে নিতে ধুরন্ধর সিন্ডিকেট কাজ করছে, সরকারকে তারা আবারো বিপদে ফেলছে। অর্থনীতির ছাত্র নন, এমন একজনকে দায়িত্ব দেবার ফলে সকল আন্তরিকতা নিয়ে তিনিও পারছেন না ঐ গ্যাঁড়াকল খুলতে। যথারীতি বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র 'আবিস্কৃত' হয়েছে। শেয়ারবাজার মুক্ত অর্থনীতির অংশ এবং সেখানে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করেন। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কথা নয়। তবু সিন্ডিকেটের কালো হাত ভেঙ্গে দেয়া, artificial manipulation ঠেকানো, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা করা সরকারেরই দায়িত্ব। কিছু লাগামহীন, নীতিবিবর্জিত, অতিলোভী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের হাতে সাধারণ জনগণের নিঃস্ব হওয়া আমরা আর কতকাল বসে বসে দেখব ও সহ্য করব?

দাবায় খেলাটি চলে রাজাকে ঘিরে; রাজার চলাচল সীমিত – অনেক স্থবির ও বুদ্ধিহীন রাজার মতই। তাকে পাহাড়া দিয়ে রাখে সৈন্যদল, হাতি, ঘোড়া, নৌকা। আর রয়েছে এক চতুর মন্ত্রী, যার চলাচল প্রায় সর্বত্র। প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য রাজা এর উপর নির্ভর করেন আর প্রায়শঃই প্রাণভয়ে আশ্রয় নেন দুর্গে। এই নির্ভরতা মন্ত্রীকে অসীম ক্ষমতা এনে দেয় যেমনটা দিয়েছে আজকের অনেক অমাত্যবর্গকে। রাজাকে বাঁচাতে প্রথমেই যাদের প্রাণ দিতে হয় তারা ইতিহাসের প্রান্তরের ও দাবার ছকের সৈন্যদল। ভুল চাল আর অহেতুক প্রাণবিসর্জনে খেলাটি ও আমাদের রাজনীতি আজ পর্যুদস্ত! আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেম ও সততা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, তিনি তাঁর মহান পিতার মতই দেশ ও জনগণকে ভালবাসেন। কিন্তু তিনিও তোষামোদ আর খাঁটি প্রশংসার পার্থক্য বুঝতে পারছেন না বলেই মনে হয়। তাকে ঘিরে থাকা সুবিধাবাদী মৌমাছিদেরও তাড়াতে পারছেন না। জানি রাজনীতির হিসাব অত্যন্ত জটিল, দাবা খেলার মতই। সেখানে বহুদিক হিসাব করেই চাল দিতে হয়, চালে ভুল হলে হারতে হয়। তবু বলব জনগণের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া উচিৎ, জনগণই তাদের পুনর্বার ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীন করতে পারে এবং বাংলাদেশের মানুষ যে ভাল কাজের স্বীকৃতি দিতে জানে তার প্রমাণ তারা অতীতে রেখেছে।

দাবা খেলায় বাকযুদ্ধের কোন স্থান নেই, যার যা কৌশল তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় দাবার ছকে। রাজনীতির খেলা বাকযুদ্ধ প্রধান, মাঠে কিছু না ঘটলেও একপক্ষের বাক্যবাণে ঘায়েল হন অন্যপক্ষ, তাদের কথার তোড়ে ভেসে যান প্রায় সকলেই। বাকযুদ্ধে রাজনীতিবিদরা বেশ পটু হলেও তারা যুক্তি নয়, আবেগ দিয়েই তা জিততে চান বিতর্ক; তথ্য উপস্থাপন না করে আক্রমণ করে বসেন, গলা কাঁপিয়ে যাত্রাদলের নটদের মত মুখস্ত সংলাপ আউড়ে যান। আমাদের যাত্রাপ্রিয় দর্শক অর্থাৎ জনগণ এদের মেকী দুঃখে কাঁদেন, মেকী সুখে হাসেন। প্রধান দুটি দলের পরস্পরবিরোধিতা, কাদা ছোঁড়াছুড়ি দৃষ্টিকটু রকমের বিশ্রী। বিরোধিতার স্বার্থেই বিরোধী দল সরকারী দলের বিরোধিতা করে, তাতে দেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হলেও পিছপা হবার নজির নেই। গণতন্ত্রের মাঝে সহনশীলতার যে নীতি রয়েছে, তার কোন প্রয়োগ দেখা যায় না এদের আচরণে।

আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর তৈরি নিয়ে বিরোধী দলের ডাকা সাম্প্রতিক হরতাল এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সরকার বিমানবন্দর তৈরির ঘোষনা থেকে সরে এলেও বিরোধী দল হরতাল থেকে সরে আসেনি। পরে আর কোন যুক্তি খুঁজে না পেয়ে দুই চিরবৈশিষ্ট্য ও অভিযোগ – দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর আইন-শৃঙ্খলার অবনতি – সামনে এনে সরকারকে বিব্রত করতে লেগে গেল, অথচ একেবারে দোড়গোড়ায় বিশ্বকাপ ক্রিকেট, যা নিয়ে গোটা জাতি উদ্বেলিত এবং এর সফল আয়োজনের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের সামর্থ্য ও জাতীয় সম্মান। আসলে জনগনের দুর্দশা নিয়ে বিরোধী দলটির কোন মাথাব্যাথা নেই, জনগন হচ্ছেন সেই বোধহীন সমষ্টির নাম, যার মাথায় কাঠাঁল রেখে বারংবার খাওয়া হচ্ছে। বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল, ছিল মহাপ্রতাপবান সিন্ডিকেট, তারা কিছুই করতে পারেনি বা করতে চায়নি। জনগনকে নিয়ে রাজনীতিবিদদের কান্না মায়াকান্না ছাড়া আর কিছুই নয়, এদের শোকও মাছের মায়ের পুত্রশোকের মত, এদের কান্না প্রবাদের নয়, সত্যিকারের কুমিরের চোখে জল। কেননা সত্যিই যদি তারা জনগণকে ভালবাসতেন তবে যে দু'বার তারা ক্ষমতায় ছিলেন তখন জনগণের জন্য কাজ করতেন, লুটপাট করতেন না।

এমনিতেই বিপুল জনসংখ্যা আর সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি; বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে চেপে বসেছে দুর্নীতি ও লুটপাট। বস্তুতঃ বাংলাদেশের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সমুখে এগুবার বা এখনো আছে, তাকে মলিন করে দিচ্ছে দুর্নীতি ও লুটপাট। গণতন্ত্রে উত্তরিত হয়েও আমাদের কোন উন্নতি হচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, গণতন্ত্র তেমন টেকসই কোন ব্যবস্থা বা মতাদর্শ নয়, তবে যেসব ব্যবস্থা বা মতাদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা আছে, তার মাঝে গণতন্ত্রই সবচেয়ে ভাল। একটি নির্বাচনে ভোট দিতে যায় শতকরা পঞ্চাশভাগ লোক, তাদের মাঝে যিনি বিজয়ী হন তিনি লাভ করেন ঐ ৫০% ভোটদাতার ৫০% বা কিছু বেশি ভোট। তাহলে এটা সংখ্যাগুরুর মতামত নয়, বরং সংখ্যালঘুর মতামতকেই প্রতিফলিত করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান দু'টি দলের মাঝেই যেখানে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চ্চা নেই, বছরের পর বছর ধরে কাউন্সিল অধিবেশন হয় না, দলের অভ্যন্তরীণ সমালোচনাকে সহ্য করা হয় না, সেখানে তারা আন্তরিকভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে – এটা ভাবা কষ্টকর! গণতন্ত্র আসলে তাদেরকে ক্ষমতাসীন হবার একটি গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেট দেয়, জনগণ এখনো প্রজাশিবিরে, ক্ষমতাসীন দল ও তাদের অমাত্যবর্গের আচরণ রাজণ্যবর্গের মতই। দু'টি দলেই রাজতন্ত্রের আদলে কিছুমাত্রায় পরিবারতন্ত্র চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থাকে কী বলা যায়? রাজগণতন্ত্র?

নির্বাচনে হারার পরে এদের মুখস্থ বুলিটি হচ্ছে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব হয়েছে, আর জিতলে বলবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোটকে, সে নির্বাচন ছিল অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা তাকে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলেছে। অথচ পরাজিত দলটি তা মেনে নেয় নি, জন রায়ের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান দেখায় নি। এখনো মাঝে মাঝেই তারা বলে ক্ষমতাসীন দল ষড়যন্ত্র ও কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হয়েছে। অথচ পুনর্বার (গোপনপথে) নির্বাচিত হবার অদম্য লোভে বর্তমান বিরোধী দলটি ক্ষমতায় থাকার সময়ে নির্বাচন কমিশনে মহাবিতর্কিত (এবং লজ্জাহীন) লোকদের নিয়োগ দিয়েছিল, জেষ্ঠতাবিধি ভঙ্গ করে এমন একজনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়েছিল, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে তাদের সমর্থন দিবেন বলে তারা বিশ্বাস করতেন। এই manipulation এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাসী সেনানায়কেরা এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল। আজ যতই সমালোচনা হোক না কেন, সে সময়ে সেনাবাহিনী দেশকে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে রক্ষা করেছিল। এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল রাজনীতিবিদরাই, তাদের অপরিণামদর্শিতা, একগুয়েমী এবং চিরঅমলিন শত্রুতা (জনশ্রুতি বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের দেয়া ভোজসভায় তারা একত্রেই 'ঐসব' গিলেন এবং খোশগল্প করেন)। সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনে বিরোধীদল ক্ষমতাসীন দলটি থেকে বেশি আসন ও ভোট পেয়েও চেঁচামেচি করছে এই বলে যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একটি আসন ছিনিয়ে নিয়েও অন্যটি নিতে না পারার ক্ষোভে বলছে ঐ আসনে ভোটে জালিয়াতি হয়েছে, প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে। এই যে মানসিকতা তা কি গণতন্ত্রের প্রতি কোন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে? করে না। সংসদ বর্জন এখন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করে আশায় থাকে তারা সংসদে গিয়ে তাদের কথা বলবেন, সেই জনগণের অপেক্ষা তীর্থের কাকের মতই হয়, মাননীয় সাংসদদের কাছে এলাকার সমস্যা নিয়ে ভোটারদের কান্না-কাটি হয় স্রেফ অরণ্যেরোদন।

দু'টি দলেরই রয়েছে বিপুল সংখ্যক ক্যাডারবাহিনী ও সমর্থক, যারা কোন আদর্শ নয়, বরং রাজনীতি করে গোষ্ঠিবদ্ধভাবে ক্ষমতাবান আর নিজের দলটি ক্ষমতায় এলে ধনবান হতে। নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে দুটি দলই এদের উপর নির্ভরশীল। এই রাজনৈতিক ঋণ শোধ করার দায়িত্বও বর্তায় বিজয়ী দলটির উপর। ফলে ঘরের ভিতরেই লেগে যায় বিবাদ। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর হতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে দাঙ্গা, মারপিট হয়েছে তা শুধু অভাবিত নয়, লজ্জাজনকও বটে। আর ঐসব কোন্দলের পেছনে কোন আদর্শ বা মতবাদের দ্বন্ধ নেই, রয়েছে স্বার্থের সংঘাত, আরো স্পষ্ট করে বললে, আর্থিক স্বার্থের সংঘাত। ছাত্রলীগের সুমহান ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের লোভী ছাত্র(নামধারী) নেতৃবৃন্দ। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের পুরসভা ও ওয়ার্ড নির্বাচনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয় এসব নির্বাচনে কারা অংশ নেয় এবং জয়লাভ করে। এদের প্রায় প্রত্যেকেই মাসলম্যান, এলাকার সন্ত্রাসী ও একাধিক মামলার আসামী। দুঃখ হয় দেশটিকে মুক্তিযোদ্ধারা দেহের রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছিল এইসব ঘৃণিত সন্ত্রাসীদের ক্ষমতার স্বাদ আর লুটপাটের মসনদে বসিয়ে দেবার জন্য? রাজনৈতিক দলগুলোর এদের ছাড়া চলেনা, প্রশাসনও এদের দৌরাত্ম্যে কাঁপে (যেমন কেঁপেছে পাবনায়)।

আড়িয়ল বিলে শুধু নয়, এখন বিরোধী দল বলছে নতুন বিমানবন্দরেরই কোন প্রয়োজন নেই। এ প্রয়োজন হয়ত এখন নেই, কিন্ত আজ থেকে ত্রিশ বা চল্লিশ বছর পরে অবশ্যই প্রয়োজন হবে একটি বৃহদাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ভুললে চলবে না রণকৌশলগত বিচারে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! কেননা আমরা রয়েছি ভারত ও চীন–এই দুই বৃহৎ দেশের মাঝখানে। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় দুটি দেশই দৈত্যাকার; ভবিষ্যত পৃথিবীর অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক হবে দেশ দু'টি। ভৌগলিক অবস্থানের এই সুবিধাজনক অবস্থা ধরে রাখতে হলে আমাদের প্রয়োজন ঐরূপ একটি বিমানবন্দর, বহির্সমুদ্রে বন্দরস্থাপন এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ। সমস্যা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা চেতনার পরিধি বড়জোর পাঁচ বছর, যে পাঁচ বছর তারা ক্ষমতাসীন থাকে, কীভাবে পাঁচ বছর টিঁকে থাকা যায় সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কোন দূরদর্শী রণকৌশলগত পরিকল্পনা নেই, যা প্রয়োজন দেশের সামষ্টিক উন্নয়নের জন্য। ভাল দাবা খেলায় স্ট্রাটেজী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তা গুরুত্বপূর্ণ সঠিকপথে দেশ পরিচালনায়। এখনকার ক্ষমতাসীন সরকার যদি এমন একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তবে তা কেবল বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করা, এর বিরুদ্ধে লেগে থাকা দেশপ্রেম না থাকারই উদাহরণ। দেশ নয়, তাদের উদ্দেশ্য সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা লোটা। আর এই কুমতলবের বিরোধিতা দেশকে কেবলই অগ্রযাত্রা থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। বহুকাল তারা ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে দেশবাসীকে অস্থির রেখেছে অথচ ক্ষমতায় এলে তারাই ভারতকে জো হুজুর জো হুজুর করেছে। অর্থাৎ পুরোটাই আইওয়াশ। বহির্সমুদ্রে নোঙর, ট্রানজিট, এশিয়ান হাইওয়ে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে দেশ বা দেশের উন্নয়ন নয়, এদের বিবেচনা ছিল কিছু মানুষের কূপমণ্ডূকতা ও পুরোনো সাম্প্রদায়িতকার মনোভাবকে উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা পড়েছি বিপদে, কেননা এই রাজনীতিকেরাই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে একটি কথা খুব প্রচলিত – 'ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়'। বাস্তবে আমরা আসলে কী দেখি? দেখি ঠিক এর উল্টোটা। যদি তারা তাদের উচ্চারিত কথামালায় বিশ্বাস করতেন, তবে দেশের ও রাজনীতির চেহারা হত অন্যরকম। প্রতিটি দলের মাঝেই কিছু ত্যাগী ও আদর্শবান মানুষ আছেন সত্যি, তবে তারা সংখ্যায় নগন্য, বেশীরভাগই সুবিধাবাদী প্রকৃতির, রাজনীতির এই মৌলবীরা হল, নজরুলের ভাষায়, মৌ-লোভী। উপরের দিকে অনেকেই আছেন যারা এ দল ও দল করে থিতু হয়েছেন সেই দলে যেখানে চৌদ্দ-পুরুষের হালুয়া-রুটির বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। এখন এদের গায়ে মার্কা লেগে গেছে বলে তারা আর সরকারী দলে ভিড়তে পারছেন না। নিচুস্তরের যারা, তারা প্রায়শঃই ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয়ে যান দলে যোগ দিতে, আর এটা করেন ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে সামনে রেখে। নেতা-নেত্রীরাও গদগদ হয়ে এদের শুভেচ্ছাগ্রহণ করেন আর দলবদলের পদস্খলনকে অনুমোদন দেন।

শুরুর উদাহরণের ঐ দাবা খেলাটি মূলত সারা বাংলাদেশেই বিস্তৃত। একটি গ্রামের সাথে আরেকটি গ্রামের, একটি পরিবারের সাথে আরেকটি পরিবারের স্থানীয় দ্বন্ধ রূপ পায় রাজনৈতিক দ্বন্ধে। বিরোধী পরিবার বা গ্রাম যে দলকে সমর্থন করে তার বিপরীত দলকে সমর্থন করে তারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুষ্টিমেয় কিছু রাজাকার-আলবদর ছাড়া গোটা বাংলাদেশই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। স্বাধীনতা লাভের পরে যেমন পাকিস্তান-সমর্থকরা কোনঠাঁসা হয়ে পড়েছিল, অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাদের দরকার ছিল একটি রাজনৈতিক ঠিকানা। বঙ্গবন্ধুর উদার ক্ষমা ঘোষনায় এরা প্রাণে বেঁচে যায়, জিয়াউর রহমানের সমর্থনে তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটো শিবিরের বিভাজন স্পষ্ট – একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ও অন্যপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের দল। রাজনীতির দাবাখেলার এই দুটি দলই এ একবার, সে অন্যবার জিতছে। দাবা খেলার মতই জনগনের কাছে তৃতীয় কোন option বা choice নেই, তারা সত্যিই দুর্ভাগা। শক্তিশালী দায়বদ্ধতা তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী তৃতীয়পক্ষ। এই তৃতীয় শক্তি হতে পারত বাম দলগুলো। কিন্তু তারা নিজেরাই সংগঠিত নয় এবং দীর্ঘদিন রাজনীতি করেও তারা জনগণের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারে নি। ধর্মভিত্তিক দলগুলো কোন বিকল্প নয়, কেননা তাদের রাজনীতি পশ্চাৎপদ, কূপমণ্ডূক ও সাম্প্রদায়িক। তাহলে কে হবে এই তৃতীয় শক্তি? দেশকে যারা সত্যিকারভাবে ভালবাসেন, রাজনীতি যাদের আখের গোছানোর পথ নয়, সেইসব দেশপ্রেমিক, সৎ মানুষেরা একটি পতাকাতলে একত্রিত হয়ে হতে পারেন তৃতীয় শক্তি। বাংলাদেশের রাজনীতির যে প্রবাহ তাতে মনে হয়না প্রধান দু'টি দল তৃতীয় কোন দলকে সহ্য করবে। খেলাটি চলতে থাকবে ঐ দু'দলের মধ্যেই। আমাদের প্রয়োজন দাবা খেলার মতই রাজনীতির খেলায় রাজনৈতিক কৌশল ও আদর্শিক রণনীতির সুষ্ঠু প্রয়োগ, অপর পক্ষকে সম্মান করা এবং নিয়ম ( rules) মেনে খেলাটি চালিয়ে যাওয়া, গায়ের জোরে নয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধে দুর্বল জনগণ যেন আর উলুখাগড়ার মত প্রাণ না দেন, অসমর্থ রাজাকে বাঁচাতে নিরুপায় সেনাদলকে যেন অনর্থক অতাকরে প্রাণ বিসর্জন দিতে না হয়!

কামরুল হাসান : কবি, প্রাবন্ধিক ও বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।