সত্য ও সুন্দরের সাধনার অগ্রগামী পথিক ড. মীজান

শারমিন আহমদ
Published : 10 Jan 2015, 06:40 PM
Updated : 10 Jan 2015, 06:40 PM

২০০৭ সালের নভেম্বরে ড. মীজান রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। জেলহত্যা দিবস উদযাপন উপলক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে মন্ট্রিয়লে আগমন এবং সেখানেই পরিচয় ছোটখাট অবয়বের এই বিশাল মাপের মানুষটির সঙ্গে। তাঁর বিশালত্ব এখানেই যে, তিনি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় সদানিমগ্ন থেকেছেন সত্য ও সুন্দরকে ধারণের জন্যে। শিক্ষা-দীক্ষা এবং লেখনীর জগতে তিনি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছেন এবং পদ-পদবিতেও তিনি উচ্চে আসীন হয়েছেন। কিন্তু সে সবেরও অনেক শীর্ষে তাঁর অবস্থান ঐ সত্য ও সুন্দরের সাধনার এক অগ্রগামী পথযাত্রী রূপে।

বর্তমান বিশ্বে বুদ্ধির ব্যাপ্তিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই; অভাব রয়েছে সততালব্ধ ও স্বাধীন চিন্তাসম্পন্ন সত্যসন্ধানীর। অভাব রয়েছে ঘুণেধরা জরাজীর্ণ চিন্তায়, সংলাপে ও পরিবেশে সুন্দরের বীজ বপনের প্রত্যয়শীল ব্রতচারী মানুষের। আর এখানেই মীজান রহমান এক ব্যতিক্রমধর্মী আলোকিত ব্যক্তিত্ব। আচরণে বিনয়ী। জীবনযাপনে অনাড়ম্বর। ফলবাহী বৃক্ষ মাটির কাছে নত হয়ে পূর্ণতা পায়, এমনি ব্যক্তিত্ব।

তাঁর সঙ্গে আলাপের সূচনায় ড. মীজান হতে অনায়াসে 'চাচা' সম্বোধন শুরু হল। চাচা নিজ হাতে বানানো রসগোল্লা খাওয়ালেন এবং আমি তারিয়ে তারিয়ে সেই অতুলনীয় মিষ্টান্নের স্বাদ উপভোগ করলাম তাঁরই স্নেহধন্য হয়ে।

ওয়াশিংটনে যখন বেড়াতে এলেন তাঁকে নিয়ে শত বার দেখা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম পাড়ার প্রিয় স্থানগুলি আবারও ঘুরে দেখলাম। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আর্টস ভবনে, থমাস কোলের হৃদয়-আলোড়িত, গভীর দর্শনসমৃদ্ধ চিত্রকলা 'ভয়েজ অব লাইফ'; ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রত্নতত্ত্ব, নীলাভ হোপ ডায়মন্ডের জন্মকথা; এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামে চাঁদের মাটিকে দেখা ও স্পর্শ করা হল যেন নতুন করে; নতুনভাবে। একাত্ম হয়ে দেখায় অতি পুরাতনও কেমন ঝকঝকে নতুন হয়ে ওঠে।

মীজান চাচা, গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোস্টারিকায় আমার কাছে বেড়াতে এলেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দেশ পর্যবেক্ষণ করলেন বিজ্ঞানীর বিশ্লেষক চোখ ও কবিতার অন্তর দিয়ে। 'লা পাস'– শান্তি পার্কে হামিং বার্ড, টুকান, ম্যাকাও পাখির জমকালো উপস্থিতি, আকাশছোঁয়া ঘন সবুজ পাহাড় হতে নির্গত রূপালী ঝরনার স্রোতধারা, পোয়াজ আগ্নেয়গিরির ধুমায়িত গহ্বর, কফিবাগান ছাওয়া টুকটুকে লাল কফি বিনের সমারোহ তিনি দেখলেন ও মনে ধারণ করলেন কী পরম আগ্রহ সহকারে!

আমার আম্মা বলতেন যে, বয়সটা একটা ইলিউশন– মরীচিকা মাত্র। নবীন বয়সেও একজন অতি দ্রুত বার্ধক্যে পৌঁছে যেতে পারে জীবন ও পরিবেশ সম্পর্কে তার অনাগ্রহের কারণে। আবার একজন সংখ্যাভারে প্রবীণ হয়েও তারুণ্যের ঝলমলে আলোয় দীপ্তিমান হয়ে ওঠেন জীবন, পরিবেশ, সমাজ ও প্রকৃতিকে জানার বিপুল আগ্রহ হতে। ঐ ধরনের আগ্রহ থেকেই তো সৃষ্টি হয় নতুন দর্শন ও বিবর্তিত চিন্তার শতদল।

মীজান চাচার একাশিতম জন্মদিনটি (১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) উদযাপিত হয় কোস্টারিকায়। সেটি আমার পরম সৌভাগ্যও বটে। সারা জীবনের অভ্যাসমতো সেদিনও তিনি পাখিডাকা ভোরে উঠেছেন। নোট খাতা ভরে লিখে চলেছেন তাঁর নতুন দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা। খুব ডিসিপ্লিনড মানুষ তিনি।

বন্ধু আমিনা ও সোফিয়াকে নিয়ে তাঁর সারপ্রাইজ বার্থডে উদযাপনের আগে সেদিন তাঁকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম ন্যাশনাল থিয়েটারে। কফি রফতানির অর্থে ১৮৯৭ সালে রাজধানী স্যান হোসেতে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মনোমুগ্ধকর শিল্পকলা থিয়েটার ভবনটি। চাচা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তার স্থাপত্য, কারুকাজ করা দেয়াল, সিলিং, মঞ্চের ডিজাইন।

একতলা ঘুরে সোনালী ঝাড়বাতিতে ঘেরা দোতালার বড় হলরুমটিতে এসে থামলেন তিনি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ব্যস্ত এক কর্মচারীর কাজ দেখলেন মনোযোগ সহকারে। নিবিষ্টভাবে কর্মচারীটি কাজ করে চলেছেন। নকশা কাটা লাল, সবুজ, বাদামি, হলুদ কাঠের ফ্লোরের কোনা এবং আসবাবপত্রের নিচে লুকানো সামান্য ধূলাটিও তার চোখ এড়াচ্ছে না। চাচা বললেন: "একটি জাতি কতখানি উন্নত তা শুধু বড় বিষয় নয়, ছোটখাট ঘটনা থেকেও বোঝা সম্ভব। কাজ, তা যত ছোটই মনে হোক না কেন, তার প্রতি আন্তরিকতাই একটি জাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করে।"

এই হলেন মীজান চাচা, যিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন সমাজের অনু-পরমানুসম গতিধারা।

এ বছরের জুন মাসের শুরুতে চাচার আমন্ত্রণে আমার স্বামী আমর (ড. আমর খাইরি আবদাল্লা)সহ ওনার অটোয়ার বাড়ি বেড়াতে গেলাম। তিনি নিজ হাতে খিচুড়ি, মাছ, মুরগি, সবজিসহ নানা উপাদেয় পদ রান্না করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিলেন ও মুগ্ধ করলেন। ওনার প্রিয়তমা স্ত্রী প্রয়াত পারুল রহমান, দুই কৃতী পুত্র বাবু ও রাজার বড় হওয়া, কর্মব্যস্ত জীবনের বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি ছেড়ে শিগগিরই তিনি উঠে যাবেন এপার্টমেন্টে।

শান্ত-স্নিগ্ধ বাড়িটির ফ্যামিলি রুমের বড় জানালা দিয়ে বাইরে তখন দেখা যায় cardinal, blue jay ও বিভিন্ন পাখির আনাগোনা। আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি বাইরের বিশালকায় গাছের পাতার ফাঁকে লাল, নীল, সবুজ ডানার সমারোহ, বর্ণালি পাখিদের আনন্দময় আলাপচারিতা। ভেতরে কিচেনের টেবিলের পাশে বসে আমর ও চাচা আলাপে মগ্ন। গণিতের যশস্বী অধ্যাপক চাচা মতবিনিময় করছেন শান্তি ও সংঘর্ষ শিক্ষার অধ্যাপক আমরের সঙ্গে। গণিত, ফিবুনাচি সংখ্যাতত্ত্ব ও শূন্যর মূল্য হতে, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার রোয়াণ্ডা, বুরুন্দিতে ও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শান্তিশিক্ষার কার্যক্রম ও অভিজ্ঞতার মতবিনিময় হচ্ছে। যেন বাইরে ভেতরে চলছে একই সুরালাপ।

আজকের 'কেউ কথা রাখেনি'র যুগে চাচা এক বিরল মানুষ যার ওপরে নির্ভর করা যায়। তাজউদ্দীন আহমদের ওপরে তাঁর তিন সহকর্মীর সাক্ষাৎকার ইংরেজিতে অনুবাদের অনুরোধ যখন জানাই, তিনি বললেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুবাদ করে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। আমি অবাক করা খুশিতে আপ্লুত হই, যখন দেখি যে তিনটি নয়, তিনি নির্ধারিত সময়ের আগেই চারটি বিশাল অনুবাদ আমাকে করে দিয়েছেন। আর সে কী প্রাঞ্জল মনকাড়া অনুবাদ!

'তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা' বইটি যখন প্রকাশ হল, তিনি আমাকে শুধু প্রাণঢালা অভিনন্দনই জানাননি, আমার পাশেও এসে দাঁড়ালেন এক স্নেহময় অভিভাবকের মতোই পরম আন্তরিকতা নিয়ে। বইটি কেন্দ্র করে লিখলেন অসামান্য কিছু কথা। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে দু'ঘণ্টা পথ নিজে ড্রাইভ করে অটোয়া হতে মন্ট্রিয়লে এলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে, ঐ বইয়ের ওপর আলোচনা সভায় যোগ দিতে। এতটুকু যেন ক্লান্তি নেই। ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধা বা কষ্ট সম্পর্কে সহজে বলবেন না। করবেন না অনুযোগ। কিন্তু অন্যের কষ্টে তিনি নিজে হবেন বিচলিত, উদ্বিগ্ন।

এই হলেন ড. মীজান রহমান, আমার মীজান চাচা; এক স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। নির্ভেজাল খাঁটি মানুষ।

মেরিল্যান্ড; ৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

[লেখাটি লিখেছিলাম ড. মীজান রহমানের ৮৩তম জন্মদিন, ২০১৫ উপলক্ষে একটি স্মরণিকার জন্যে। ভাবছিলাম তাঁকে অবাক করে দেব, কিন্তু তিনিই আমাদের অবাক করে ৫ জানুয়ারি, ২০১৫ চলে গেলেন অমর্ত্যলোকে। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। আমিন।]