ক্ষুদ্রঋণ মডেল হ্যাঁ, ইউনূস না– কেন?

আনু মুহাম্মদ
Published : 10 March 2011, 02:36 PM
Updated : 10 March 2011, 02:36 PM

বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকে মুহম্মদ ইউনূসকে অপসারণের যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুহম্মদ ইউনূস ও বোর্ডের ৯ পরিচালকের দায়ের করা দুটো রীট আবেদন গত ৮ মার্চ হাইকোর্ট খারিজ করে দেওয়ায় সরকারের সিদ্ধান্ত এখনও বহাল আছে। অপসারণের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক মুহম্মদ ইউনূসের 'বয়স অতিক্রান্ত' বলে যুক্তি দিয়েছেন, মার্কিন-ইউরোপীয় দূত ও সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতে অর্থমন্ত্রীও একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান, যেহেতু বিশেষায়িত ব্যাংক হলেও এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্বের মধ্যেই কাজ করতে আইনত বাধ্য (Grameen Bank Ordinance, No. XLVI of 1983), এবং যেহেতু এই ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারেরও অংশীদারিত্ব আছে, সেহেতু বয়স বা অন্য যেকোন বিষয়ে বিদ্যমান আইন বা বিধির কোন ব্যত্যয় ঘটলে আইনানুগ যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের আইনগত কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের থাকবে এটাই যুক্তিসঙ্গত।

কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের পেছনে এটাই কি আসল কারণ হতে পারে? কাগজের নীতি বা আইনরক্ষার জন্য এই সরকার কি এতটাই সজাগ এবং সক্রিয়? তার অন্ধ অনুসারীও কি তা দাবি করতে পারবেন? খুনের মামলার আসামী ছেড়ে দেয়া, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে পথপ্রদর্শক এরশাদকে একের পর এক দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতিদান, পাড়ায় প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের লোকজনের সন্ত্রাস, হামলা, টেন্ডারবাজি, দখল ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষকতা এগুলো এই সরকারের সাম্প্রতিক সক্রিয়তার কিছু নমুনা। প্রথমে সিদ্ধান্ত আর পরে তার সঙ্গে আইনকে খাপ খাওয়ানো এটাই হল বাংলাদেশের ক্ষমতাবানদের কাজের পদ্ধতি। আগের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে বর্তমান সরকারও তাই করছে। সুতরাং নিছক আইন বা নীতি রক্ষার জন্য যে সরকার ইউনূস বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নেননি সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাহলে কেন?

ইউনূসের পেছনে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নানাশক্তির সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা আছে এটা তো এই সরকারের ভালভাবেই জানা। বস্তুত উভয়পক্ষের প্রভু অভিন্ন, উন্নয়ন নীতি ও দর্শনও অভিন্ন। এই দর্শন অনুযায়ী দারিদ্র বিমোচনের জন্য ক্ষুদ্রঋণ মডেল, উন্নয়নের জন্য বহুজাতিক পুঁজি, জনগণের অধিকার শুধু ক্রয় ও বিক্রয়। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সব অপতৎপরতার পেছনে আছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি, সেই একই রাষ্ট্রদূত ইউনূসকে নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে এখন মর্মাহত, তার সরকার বিচলিত। তাহলে কী কারণে সরকার এধরনের সিদ্ধান্ত নেবার ঝুঁকি গ্রহণ করলো? সরকার ইউনূসকে নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত বহাল রাখবার জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রে মার্কিনীদের, বা বৃহত্তর অর্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে আরও ছাড় দেবার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে কি না এটাও এখন এক বড় উদ্বেগের বিষয়।

গত কয়েক মাসে গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে যতটুকু কথাবার্তা হয়েছে এতটুকু আগে কখনোই হয়নি। বছরের পর বছর একধরনের নীরবতা ও ভক্তি দিয়ে মূলধারার প্রচার মাধ্যম ইউনূস, আবেদ, ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও মডেলকে রক্ষা করেছে চাপা অনেক ক্ষোভ ও অভিযোগ থেকে। নরওয়ের টিভিতে ডেনমার্কের একজন তথ্যচিত্র নির্মাতার বানানো তথ্যচিত্র প্রচারের পর পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। ইউনূসকে সমালোচনা করা যেখানে প্রায় ধর্মদ্রোহিতার সমান অপরাধ বলে বিবেচিত হচ্ছিল সেখানে ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কিনা সেসব প্রশ্নও আসতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তখন তাঁর 'সুশীল সমাজ' সমর্থকদের স্থম্ভিত করে দিয়ে ইউনূসকে 'রক্তচোষা' হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর অভিযোগ কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বহুবছর ধরেই উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোন বিস্তৃত তদন্ত বা অনুসন্ধান এখনও হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টগুলো এতদিন গোপন রাখা হয়েছে। এখনও তা দুষ্প্রাপ্যই আছে।

ডক্টর ইউনূস বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে মার্কিনী ও সহযোগীদের পাশাপাশি দেশীয় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিও, যারা 'সুশীল সমাজ' হিসেবে পরিচিত, মর্মাহত হয়েছেন, ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের বক্তব্যের মূল কথা হল, ইউনূস সাহেবের ক্ষুদ্রঋণের মডেল 'দারিদ্র বিমোচন' ও 'নারীর ক্ষমতায়ন'-এর একটি সফল মডেল। এই মডেলের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নারী নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন, এটা তাঁদের বদ্ধমূল বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের প্রমাণ হিসাবে তাঁরা যে তথ্যের উপর ভর করেন তা হল, তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হযেছেন এবং পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরষ্কার। তাঁদের মতে, বাংলাদেশকে ইউনূস সাহেব এসব পুরস্কারের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে এরকম আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য সবদিক থেকেই ক্ষতির কারণ হবে।

এটা অবশ্যই ঠিক যে, গ্রামীণ ব্যাংককে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবার ক্ষেত্রে ইউনূস সাহেবকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে। তিনি গরীবদেরকে ব্যাংকের আওতায় এনে বিশ্বব্যাপী ব্যাংক পুঁজির সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এটি ব্যবসায়িকভাবে খুবই সফল। শুধু এটাই নয়, গ্রামীণ ব্র্যান্ডে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন খুবই ব্যবসা সফল। গ্রামীণ ফোন এসব সফল ব্যবসার প্রধান দৃষ্টান্ত। এগুলো সবই হয়েছে গরীব নারীদেরই নামে, এই কারণে অনেক বাড়তি সুবিধাও তারা রাষ্ট্র থেকে নিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণসহ নানা বাণিজ্যিক তৎপরতায় লিপ্ত অন্যান্য এনজিওর ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।

কিন্তু এগুলোর মাধ্যমে 'দারিদ্র বিমোচন' ও 'নারীর ক্ষমতায়ন' সংক্রান্ত প্রথম বিশ্বাস বা সিদ্ধান্তটি কি ঠিক? প্রথম সিদ্ধান্তটি প্রমাণের জন্য কি দ্বিতীয় যুক্তিটি যথার্থ? বাংলাদেশে যারা বাস করেন, কিন্তু তথ্য প্রমাণ খুঁজে দেখার যাদের ধৈর্য নাই, তাঁরা কি সাদাচোখে দেশের দারিদ্র পরিস্থিতি দেখেন না? প্রায় তিন দশক এনজিও মডেল আর ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির হট্টগোলের পর যে দেশে এখনও শতকরা ৫০ জন বা প্রায় ৮ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন, সেটা এই শিক্ষিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁদের মনোযোগ থেকে বাইরে রাখেন কীভাবে? যদি খাদ্য ও কাজের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় তাহলে এই সংখ্যা ১২ কোটি দাঁড়াবে। এগুলো সরকারি এবং জাতিসংঘেরই হিসাব, যারা বরাবর ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও মডেলকেই দারিদ্র বিমোচনের পথ বলে স্তুতি করে থাকেন। আর বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে দারিদ্র পরিস্থিতি ক্ষেত্রে কিংবা নারীর সচলতা বা অবস্থানের মধ্যে কিছুটা উন্নতি দেখা যায় তা কি ক্ষুদ্রঋণের জন্যই? সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক বা ক্ষুদ্রঋণ ছাড়া আর কোন উপাদান ক্রিয়াশীল নয়? যেমন প্রবাসী আয়? গার্মেন্টস কিংবা অন্য শিল্পকারখানা? কৃষি মৎস্য বা হাঁসমুরগী খামারে নতুন কাজের সুযোগ? যোগাযোগ ব্যবস্থা? গ্রাম শহরের নিকটবর্তী হওয়া? বিদ্যুৎ? পরিসেবা খাতের সম্প্রসারণ?

গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু বৈশিষ্ট্য অন্যান্য বৃহৎ এনজিওগুলোর জন্যও প্রযোজ্য। তার মধ্যে এক-ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতা অন্যতম। কোন প্রতিষ্ঠান যদি এক-ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয়, যদি কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতার যথাযথ জবাবদিহিতা না থাকে, যদি স্বচ্ছতার অভাব থাকে তাহলে সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়ম, দুর্নীতি তৈরি হবে; এগুলো নিয়ে প্রশ্ন ও অভিযোগও তৈরি হবে। খ্যাতি ও প্রচারণা দিয়ে সবকিছুকে আড়াল করে রাখা কর্পোরেট জগতের একটা বৈশিষ্ট। কিন্তু তারও সীমা থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আসলে ক্ষুদ্রঋণ মডেল নিয়েই। ভুল গৌরব দিয়ে কোন দেশ তার নিজের মৌলিক সমস্যা দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখতে পারে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের দারিদ্রের জাল, ঋনগ্রস্ততার বোঝা, আর নিপীড়নের নানা ঘটনা কি কেবল পুরস্কারের স্তুতি দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে? দারিদ্র বিমোচনের গল্প সত্য হলে ৭০/৮০ লাখ গরীব মানুষই এখন ঢাকা ঘেরাও করতো, কোন সাড়াশব্দ তাঁদের দিক থেকে নেই। সাড়াশব্দ সব দূতাবাস আর বহুজাতিক পুঁজির নানা ঘাঁটিতে, কিংবা 'সুশীল সমাজে'।

দাবী করা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হলেন তার সকল গরীব, বিশেষত নারী ঋণগ্রহীতা। এই প্রচারণার উপর বিশ্বাস করে অনেক মুগ্ধতার বিস্তার ঘটেছে দেশে বিদেশে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি যে, এই কথিত মালিকেরা কীভাবে তাঁদের মালিকানা প্রয়োগ করেন। তাঁদের কাছ থেকে জমা নেয়া আগাম টাকার হিসাব কই? গ্রামীণ ব্যাংক ও সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ তাঁদের হাতে যায় না কেন? এসব প্রতিষ্ঠানের সব তৎপরতা সম্পর্কে সকল তথ্য তাঁদের কাছে যায় না কেন? বলা হয় পরিচালনা পর্ষদের ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জনই গরীব নারী ক্ষুদ্র্ঋণ গ্রহীতাদের প্রতিনিধি। কীভাবে তাঁরা এই প্রতিনিধি ঠিক করেন? কোথায় হয় এই নির্বাচন? আসলে কারা এই প্রতিনিধি ঠিক করেন? আসলে কে ঠিক করেন এই প্রতিনিধিদের? আর তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংকের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা পালন করেন? গ্রামীণ ব্যাংকের পুঞ্জিভূত পুঁজির গন্তব্য কে নির্ধারণ করেন? কেন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশার মতো প্রতিষ্ঠানে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি মালিকানার নতুন ধরন তৈরি করে?

মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিন বলেছেন, ক্ষুদ্রঋণ পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আর কোন মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তাঁর কোন আগ্রহ দেখা যায় নাই। গত তিন দশকে জনগণের আর কোন অধিকার নিয়ে তাঁর কোন কথা কোথাও শুনিনি। ক্ষুদ্রঋণ শুরুর পর ক্ষুদ্রঋণ মানবাধিকার, মোবাইল ব্যবসা শুরুর পর মোবাইল দিয়ে ক্ষমতায়ন, আইটি ব্যবসা শুরুর পর ইন্টারনেটের মাহাত্ম্য শুনেছি তাঁর মুখে, দইয়ের ব্যবসা শুরুর পর দইয়ের দারিদ্র বিমোচন ক্ষমতা নিয়ে শুনছি। তাঁর ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর কথা আন্তর্জাতিকভাবে খুব চমক সৃষ্টি করেছিল। দারিদ্র পরিস্থিতি নিয়ে নানা গবেষণায় এর উল্টো চেহারা সামনে আসার পর তাঁর মুখে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কথাবার্তা এখন কম শোনা যায়। এখন তার নতুন মনোযোগ সামাজিক ব্যবসা।

সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সদ্য নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মুহম্মদ ইউনূস রাজনীতিতে নামার জন্য খোলা চিঠি দিয়ে জনগণের মতামত চেয়েছিলেন। দেশে তখন জরুরী অবস্থা ছিল। অনেক কথা বলা তখন নিষেধ। কিন্তু ইউনূস সাহেব মতপ্রকাশের এই বাধা দূর করবার জন্য জরুরী অবস্থা তুলে দেবার পক্ষে কোন বক্তব্য দেননি। রাজনীতি নিয়ে বলেন কিন্তু যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন, বলেন এগুলো অতীতের বিষয়। সামরিক শাসন বিরোধী কোন বক্তব্য তাঁর থেকে কেউ শোনেনি। বিনাবিচারে অবিরাম হত্যাকান্ডে তাঁকে কখনো বিচলিত দেখা যায়নি। সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নিয়ে তিনিই কথা বলেন যিনি এরশাদের স্বৈরতন্ত্র এবং অভূতপূর্ব দুর্নীতিকাল নিয়ে নীরব থাকেন। দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন কিন্তু দেশের তেল গ্যাস কয়লা নিয়ে লুন্ঠনের যে বিশ্বজোট গঠিত হয়েছে, দুর্নীতির এতবড় লেনদেন তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে না। বাংলাদেশের তরুণদের মেধার অনেক প্রশংসা করেন তিনি কিন্তু তাদের হাতে দেশের সম্পদ রাখার কথা ভাবতে পারেন না। উন্নয়নের নামে দেশের শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ, তেল-গ্যাস-কয়লাখনি, পানি, শিক্ষা ,স্বাস্থ্য সবকিছু বাজারের অর্থাৎ দেশি বিদেশি দখলদারদের হাতে ছেড়ে দেয়ার আয়োজনে তিনি বরাবর সরব ও সক্রিয় সহযোগী। তাঁর সব কথার সারসংক্ষেপ হলো বাংলাদেশকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন কোম্পানির হাতে ছেড়ে দাও, তাহলেই উন্নতি নিশ্চিত। সেজন্য এরকম একটি খুঁটির প্রভাব ও ক্ষমতার যেকোন ক্ষয় নিয়ে মার্কিনীসহ আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রতিনিধিদের হয়রান হবারই কথা।

কিন্তু ইউনূস সাহেবের এসব চিন্তা ও তৎপরতার সঙ্গে বর্তমান সরকারের তফাৎ কোথায়? অভিন্ন নীতি, অভিন্ন প্রভুই যদি অব্যাহত থাকে, যদি ক্ষুদ্রঋণ মডেল ও গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত যাবতীয় অনিয়ম যথাযথভাবে উন্মোচিত না হয়, তাহলে ইউনূস বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত চিহ্নিত হবে ব্যক্তিগত সংঘাত কিংবা দখল পাল্টা দখলের একটি প্রকল্প হিসেবে। সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনে যদি ব্যক্তিগত সংঘাত কিংবা দখল প্রকল্পই থাকে তাহলে মুহম্মদ ইউনুসের পক্ষে তাঁর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার খুব সহজ হবে। গ্রামীণ ব্যাংক কয়েক দশকে ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে দিয়ে বিপুল মূলধনের মালিক হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিপুল সম্পদ ও অনিয়ম সবকিছুর দায় ও দায়িত্ব এখন সরকারের।
৯ মার্চ ২০১১

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।