অধ্যাপক মীজান রহমান: এক নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ

অভিজিৎ রায়
Published : 9 Jan 2015, 05:12 AM
Updated : 9 Jan 2015, 05:12 AM

আমি ডাকতাম মীজান ভাই বলে। অধ্যাপক মীজান রহমান। এই বরেণ্য মানুষটির মূল পরিচয় ছিল গণিতবিদ হিসেবে। শুধু গণিতবিদ বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে, তার মধ্যে মীজান রহমান ছিলেন অন্যতম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন তিনি; এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমএ) এবং কানাডার ব্রান্সউইকে (পিএইচডি)। তারপর সেই ১৯৬৫ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে একটানা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গণিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকের সম্মানসহ বহু সম্মানেই তিনি ভূষিত হয়েছেন।

শুধু শিক্ষক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান তা নন, শিক্ষায়তনে সাফল্য পেতে হলে যা যা দরকার, সবই তাঁর ঝুলিতে ছিল। গণিতের বিখ্যাত জার্নালগুলোতে খুঁজলেই যে কেউ পাবেন তাঁর অসংখ্য গবেষণাপত্রের হদিস; পাশাপাশি কিছুদিন আগে গণিতশাস্ত্রের পণ্ডিত জর্জ গ্যাসপারের সঙ্গে লিখেছেন মহামূল্যবান একটি পাঠ্যপুস্তক 'বেসিক হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ' (১৯৯০) শিরোনামে, যেটা প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই গণিতের ছাত্রদের জন্য অবশ্যপাঠ্য পুস্তক হিসেবে বিবেচিত।

ড. মীজান বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক প্রফেসর আলবার্তো গ্রুনবাম এবং নেদারল্যাণ্ডের গণিতবিদ এরিখ কোয়েলিংক প্রমুখের সঙ্গেও গণিত বিষয়ক বহু গবেষণা করেছেন। গণিতে তাঁর অবদান এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, ১৯৯৮ সালে কানাডার ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাঁকে 'এমিরিটাস অধ্যাপক' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অধ্যাপক মীজান পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'Distinguished Research Professor'-এর খেতাবও পেয়েছিলেন। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এশকি নাকি তাঁকে সিম্বলিক ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে 'মাস্টার'হিসেবে ডাকতেন। গণিত বিষয়ে বাংলাদেশের কিংবদন্তির তালিকা কেউ বানাতে বসলে মীজান রহমানকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু গণিতের কাঠখোট্টা জগতের বাইরেও তাঁর আরেকটা পরিচিতি ছিল। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তার প্রথম দিককার উপন্যাস 'লাল নদী' (২০০১) পড়ে আমি বিস্মিত, আলোড়িত হয়েছিলাম, সহসা আবিষ্কার করেছিলাম এক সমাজ সচেতন প্রগতিশীল সুলেখকের প্রতিচ্ছবি। পরে জেনেছি, এই নিভৃতচারী লেখকের এই একটি নয়, একগাদা ভালো ভালো বই আছে। তার মধ্যে রয়েছে, 'তীর্থ আমার গ্রাম, 'প্রসঙ্গ নারী', 'অ্যালবাম', 'অনন্যা আমার দেশ', 'আনন্দ নিকেতন', 'দুর্যোগের পূর্বাভাষ', ভাবনার আত্মকথন', 'শুধু মাটি নয়'প্রভৃতি।

সে সময় লজ্জিতই হয়েছিলাম তার বইয়ের সঙ্গে আগে পরিচিত না হওয়ায়। এর পরে যখনই সুযোগ পেয়েছি মীজান রহমানকে পড়বার চেষ্টা করেছি, নিজ উদ্যোগেই। এক ধরনের দায়িত্ববোধ থেকেই। তাঁর লেখা পড়ে কখনও হতাশ হইনি, বরং আলোকিত হয়েছি নানাভাবে। ভালোলাগা আরও বেড়েছে পরবর্তীতে যখন জানলাম তিনি একজন ধর্মমোহমুক্ত সত্যিকার মুক্তমনা মানুষ, একজন মানবতাবাদী। শুধু তাই নয়, দর্শনের জগতে আমরা যাদের 'স্কেপটিক'বলি, মীজান রহমান সেই গোত্রভুক্ত ছিলেন।

সে অনুভূতি আমার আরও দৃঢ় হয়েছে পরবর্তীতে মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো পড়ে। তিনি ধর্মগ্রন্থের বাণী কেবল নিনির্মেষ স্তব করতেন না, বরং সময় সময় প্রকৃত অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীর মতো ক্রিটিক্যালি দেখতে চাইতেন। তাই অন্য অনেকের মতো তাতে বিগ ব্যাং খুঁজে পাননি, বরং তাতে বহু সময়েই আবিষ্কার করেছেন অপবিজ্ঞান, কুসংস্কার, অসাম্য আর নিপীড়নের দীর্ঘদেহী করাল ছায়া। তিনি কোনো ধরনের অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতেন না। অদৃশ্য স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। তিনি পার্থিব জগতের কথা তুলে ধরে প্রায়ই বলতেন: "আমার স্বর্গ এখানেই"। তিনি আগে থেকেই মরণোত্তর দেহদান করে যাবার কথা বলে গেছেন।

কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি আমার লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। ব্লগে আমার অনেক লেখাতেই তাঁর মন্তব্য আছে, আছে অফুরন্ত প্রংশসাবাক্য–- যা এখন আমাকে লজ্জিতই করে দেয়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিশ্লেষণ বিভাগে আমি ঠিক এর আগে যে লেখাটি লিখেছিলাম, 'সবই ব্যাদে আছে' শিরোনামে-– আজ গিয়ে দেখলাম সেখানেও তিনি ছোট একটি মন্তব্য করেছেন। প্রশংসা করেছেন লেখাটির, একমত পোষণ করেছেন লেখাটির অভিমতের সঙ্গে।

ইমেইল করেও মাঝে সাঝে এই কাজ করতেন তিনি। শুধু তাই নয়। 'আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী' নামে একটা বই লিখেছিলাম আমি ২০০৫ সালের দিকে। 'কী কুক্ষণে' সেটা মীজান রহমানের চোখেও পড়ে গিয়েছিল। এর পর থেকেই তিনি আমার এ বইটি সবাইকে পড়তে বলতেন। তিনি বলতেন, এই বইটা পড়লে আর মীজান রহমানের লেখা বই পড়ার দরকার হবে না। (পাঠকেরা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই কথাটি তিনি এমনকি তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ 'শূন্য'-এর ভূমিকায় লিখে দিয়েছেন!)

মাঝে-সাঝেই আমি দূর-দূরান্ত থেকে ফোন কল পেতাম, মীজান ভাইয়ের উপদেশে নাকি তারা বইটি পড়েছেন এবং আমার সঙ্ যোগাযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরাও ছিলেন। অজানা অচেনা মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের ফোনকল পেয়ে লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে যেত।

তাঁর মতো একজন কৃতবিদ্য মানুষ আমার লেখার এভাবে প্রশংসা করছেন, মানুষকে বলে বেড়াচ্ছেন এটা আমি মানতে পারতাম না কিছুতেই। ফোন করে তাই মৃদু বকুনিও দিতাম 'এসব ঢং' করার জন্য। তিনি স্মিত হাসতেন। বড্ড প্রশ্রয়ের সে হাসি। পরের দিকে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। জানতাম মীজান রহমান এমনই।

আজ তিনি মারা যাবার পর এখান ওখান থেকে জানলাম, এ কাজটা শুধু তিনি আমার সঙ্গেই করেননি, আরও অনেক লেখকের সঙ্ই করেছেন। 'ডেইলি স্টার'এর কলামিস্ট মাহফুজুর রহমান 'মুক্তমনা'র ইংরেজি ব্লগে একটি লেখা দিয়েছেন, 'A tribute to Dr. Mizan Rahman' শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেছেন, 'ডেইলি স্টার'এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে অন্য কারও কাছ থেকে ফোন নম্বর যোগাড় করে মাহফুজ সাহেবের বাসায় ফোন করেছিলেন মীজান রহমান, সুদূর অটোয়া থেকে। এর আগে এমনকি চিনতেনও না তাকে। কত নিরহংকারী একজন মানুষ হলে এটা করা সম্ভব!

শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনন এবং চিন্তায় তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই হিমালয়স্পর্শী একজন মানুষ। অথচ কারও চিন্তার সঙ্গে ঐক্য হলে, কারও লেখা ভালো লাগলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আপন করে নিতে কুণ্ঠিত হতেন না কখনওই।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি কেবল প্রশংসাই করে গেছেন। যেখানে দরকার সমালোচনাও করেছেন বিস্তর। কিন্তু তাঁর শেখানোর পদ্ধতিটাও ছিল তাঁর মননের মতোই মার্জিত, আলোকিত। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা ‍তুলে ধরার জন্য প্রাসঙ্গিক হিসেবে কবি শামসুর রহমানের লেখা 'সুধাংশু যাবে না' শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটা তুলে ধরছি:

"লুণ্ঠিত মন্দির, আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো
'আখেরে কি তুমি চলে যাবে?'বেলা শেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।

স্বর বলে, 'লুটেরা তোমাকে জব্দ ক'রে
ফেলে আশে পাশে
তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে
পশুর চেহারাসহ ঘাতকের ছায়া,
আতঙ্কের বাদুড় পাখার নিচে কাটাচ্ছ প্রহর,
তবু তুমি যেও না সুধাংশু।'

আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজও সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।"

গত বছরের জানুয়ারিতে দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় কবি শামসুর রাহমানের ওই কবিতার চরিত্র 'সুধাংশু'কে টেনে এনে আমি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, 'সুধাংশু তুই পালা' শিরোনামে। আমার লেখায় হতাশা আর বিরক্তি প্রকাশ করে লিখেছিলাম, দেশের যা অবস্থা– এখন আমি রোমান্টিক কবির মতো 'এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও, পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না' বলে অহংকার করি না, বরং প্র্যাকটিকাল হয়েই ভাবি– 'আমার কাতর মিনতি বন্ধু সুধাংশু, এখনই তুই পালা'।

এর কিছুদিন পরেই মীজান রহমান আমার লেখাটির প্রত্যুত্তরে মুক্তমনায় লিখলেন:

"না, তারা যাবে না কোথাও।"

স্পষ্ট করেই বললেন মহামূল্যবান কিছু কথা, যা আমি নতমস্তকে শিরোধার্য করে আছি আজও:

''আমরা মুসলমান জাতি নই, আমরা হিন্দু জাতি নই, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান জাতি নই, চাকমা বা সাঁওতাল জাতিও নই, আমরা 'মানবজাতি'। আমরা একটি বাঙালি জাতি। আমাদের জাতিসত্তা এক, আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এক, আমাদের বর্ণগোত্র সব এক। এমনকি আমাদের ধর্মও এক— সেই ধর্মের নাম 'মানবধর্ম'। এই মানবধর্ম শব্দটি যাদের অভিধানের অন্তর্গত নয়, এই শব্দটি যারা উচ্চারণ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি বা উচ্চারণ করতে অনিচ্ছুক, তারা আমাদের দেশে অবাঞ্ছিত, অনাদৃত। দেশ যদি কাউকে ছেড়ে যেতেই হয় তাহলে সংখ্যালঘুরা ছাড়বে না— হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-চাকমা-সাঁওতালরা ছাড়বে না। ছাড়বে যাদের উপস্থিতি আমাদের পথের চলাকে বারবার, বার বার, প্রতিহত করেছে, আমাদের জাতীয় সম্মানকে খর্ব করে দিয়েছে, আমাদের জাতীয় পতাকাকে, জাতীয় সঙ্গীতকে, জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অপমান করেছে, তারা।''

আদ্যোপান্ত মানবতাবাদী ঋজু বাঙালি-এই হচ্ছেন মীজান ভাই। বয়সে আমার বাবার থেকেও বড়। কিন্তু আমাদের কাছে উনি সব সময়েই ছিলেন 'মীজান ভাই'। আমার স্ত্রী বন্যা অবশ্য আরও অনেক আগে থেকেই তাঁকে চিনতেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন কানাডার সকল মুক্তমনা এবং প্রগতিশীল তরুণ-তরুণীদের কাছে একেবারে ছায়ার মতোন। মণিকা রশীদ, লুৎফুন্নাহার লতা, ভজন সরকার, সাদেরা সুজন, ফেরদৌস নাহার, শফিউল ইসলামদের একেবারে কাছের মানুষ ছিলেন মীজান ভাই। ছিলেন বাঙালিদের আড্ডার মধ্যমণি।

মীজান রহমানের কিছু দিক ছিল যা হয়তো এমনকি তার কাছের মানুষেরাও অবহিত নন। তিনি সম্ভবত ছিলেন কানাডার প্রথম বাংলাদেশি অধ্যাপক। তিনি শুধু গণিতবিদই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের সময়টিতে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠিত করেছিলেন, তাদের দিয়ে তহবিল গঠন করে কোলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। প্রবাসে জনমত গঠন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যার সঠিক চিত্র তুলে ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারকে চিঠি পাঠানোসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন তিনি। তাঁর লেখালেখিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল স্পষ্ট। এমনকি মুক্তমনায় যে লেখাগুলো পোস্ট করতেন, সেগুলো তিনি শেষ করতেন 'মুক্তিসন' উল্লেখ করে।

তিনি ভালো রান্না করতেন। তবে সেটা যত না শখে, তার চেয়েও বেশি বোধ করি 'জীবনের প্রয়োজনে'। অনেকেই হয়তো জানেন না, মীজান রহমানের স্ত্রী মারা যাবার আগে দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। মীজান রহমান তখন একা হাতে সংসার সামলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করিয়েছেন, বাসায় ফিরে এসে রান্না করেছেন, স্ত্রীকে খাইয়েছেন, তাঁর যাবতীয় পরিচর্যা করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর ছোট দুই ছেলেকে একা হাতে মানুষ করেছেন। তাঁর দু'ছেলে, বাবু এবং রাজা, বলা যায় মীজান রহমানের হাতেই মানুষ হয়ে বাড়ির গণ্ডি ছেড়েছেন। এ ধরনের অনুপম দৃষ্টান্ত বাঙালি সমাজে খুব বেশি দেখা যায় না।

ছিলেন মনে-প্রাণে আমূল নারীবাদী। প্রথাগত জেন্ডার-রোলে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। রান্না করা, বাচ্চা মানুষ করা যারা মেয়েদের কাজ মনে করতেন, মীজান রহমান কেবল তত্ত্বে নয়, ব্যবহারিক প্রয়োগেও এই সমস্ত আপ্তবাক্য ভুল প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর সামনে নারীদের অপমানসূচক কোনো কথা বলা যেত না, তা যতই হাস্যরসে বলা হোক না কেন। কতবার আমার স্ত্রী বন্যাকে খোঁচাতে গিয়ে মীজান ভাইয়ের চোখরাঙানি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

আন্তঃধর্ম বিয়ের খুব বড় সমর্থক ছিলেন মীজান ভাই। এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা না হলেও তাঁর 'বায়াস' টের পেতাম। আমাকে এবং আমার স্ত্রী বন্যাকে তাঁর ভালোলাগার একটা বড় কারণ আমি বুঝি, তাঁর দৃষ্টিতে আমরা ধর্মীয় সংকীর্ণতা অতিক্রম করে জীবন সাজাতে পেরেছি। আমাদের কাছে এটা তেমন বড় ব্যাপার না হলেও পরে জেনেছি, এ ধরনের অন্য সকল দম্পতিও মীজান রহমানের খুব প্রিয়। তাঁর মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা ছিল না। আসলে চিন্তায়-মননে তিনি এতটাই অগ্রগামী ছিলেন যে, অনেক প্রগতিশীল তরুণদেরও লজ্জায় ফেলে দিতে পারতেন।

আর তাঁর লেখালেখি নিয়ে নতুন করে আর কী বলব? তাঁর গদ্যরীতির দারুণ ভক্ত ছিলাম আমি। তাঁর ভাষা ছিল খুব আধুনিক, ঝরঝরে। 'শূন্য' নামে একটি বই লিখেছিলেন, ২০১২ সালে। গণিতের বিষয়াদি নিয়ে বই। কাজেই অনেক কাটখোট্টা হবার কথা। কিন্তু মীজান রহমানের লেখনীর গুণে হয়ে উঠল ঠিক বিপরীত। ২০১২ সালে বই মেলায় প্রকাশিত বিজ্ঞান এবং গণিতের বইগুলোর মধ্যে 'শূন্য' বইটিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে আমি বিবেচনায় রেখেছিলাম। শুধু তাই নয়, বইটি সেটি পড়তে গিয়ে এবং রিভিউ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম যুগপৎ বিজ্ঞান এবং বাংলা সাহিত্যে এমন বই দুর্লভ। আর পাশাপাশি তিনি বোধকরি ছিলেন বাংলা ব্লগ-জগতের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগার। চিরতরুণ মীজান ভাই ছাড়া বিরাশি বছর বয়সে আর কেউ কি এভাবে বাংলায় ব্লগ করে গেছেন?

আমার সঙ্গে একটা বই লেখার কথা ছিল তাঁর। তার মতো সফল একাডেমিশিয়ান এবং সুসাহিত্যিকের আমার মতো ছাপোষা কারও সঙ্গে কিছু লেখার কথা নয়। কিন্তু লিখলেন। বিপুল উৎসাহে প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার একটা বই লিখে শেষ করে ফেললেন। পাণ্ডুলিপি শেষ করে আমরা দু'জন মিলে বইটার শিরোনাম দিলাম, 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব'। প্রচ্ছদও হয়ে গেল। বইটা নিয়ে দারুণ উচ্চাশা ছিল তাঁর। কথা হলেই শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। পাণ্ডুলিপি গত বছরই জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বইটি দেখে যেতে পারলেন না। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুলকে প্রায়ই ইমেইল করতেন বইটার ব্যাপারে। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বইটি শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারলেন না। শূন্যেই হারিয়ে গেলেন প্রিয় মীজান ভাই।

আজ হোক, কাল হোক বইটি হয়তো বেরুবে, কিন্তু আমি আমার 'যদ্যপি আমার গুরু' মীজান ভাইকে কোথায় খুঁজে পাব? কোন্ ঠিকানায় পাঠাব আমি বইয়ের প্রকাশিত কপিগুলো?

অভিজিৎ রায়: ব্লগার এবং বিজ্ঞান লেখক।