নতুন বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কাছে প্রত্যাশা

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 6 Jan 2015, 10:58 AM
Updated : 6 Jan 2015, 10:58 AM

গত ২৫ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখ বিশিষ্ট আমাদের জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি সাধারণ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, ১৩ ও ১৫ নভেম্বর তারিখ দুটিতে অনুষ্ঠিত প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ১৭১ জন সাংবাদিককে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। এই সাধারণ বিজ্ঞপ্তিটি সই করেছেন শুধু সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদাল আহমেদ; তিনি আবার বিএনপির পত্রিকা, এখন বন্ধ, 'দৈনিক আমার দেশ'এর একজন সম্পাদক।

দশ বছর ধরে কোনো সাংবাদিককে সদস্যপদ না দিয়ে এখন এক নোটিশেই এতজনকে কেন সদস্যপদ দেওয়া হল, বিজ্ঞপ্তিতে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দৈনিক জনকণ্ঠে প্রবীণ সাংবাদিক সফিকুর রহমানের একটি সাম্প্রতিক লেখা ছাড়া এই বিষযে কোনো আলোচনা, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় চোখে পড়েনি। অথচ আমাদের এই এক ঢাকা শহর থেকেই ৩১৩টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে বলে আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়। এতগুলো পত্রিকা ছাড়াও দেশে এখন ২৬টি টিভি চ্যানেল এবং প্রায় সমসংখ্যক এফএম রেডিও আছে। ঢাকা শহরের এসব গণমাধ্যমে এখন দুই আড়াই হাজার সাংবাদিক কাজ করছেন। অথচ আমাদের জাতীয় প্রেস ক্লাবের বর্তমান সদস্য সংখ্যা মাত্র আটশ'র মতো এবং এই আটশ'র জন্য কয়েকশ' কোটি টাকার সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি!!

এই প্রসঙ্গে খুবই আমোদজনক একটি বিষয় হল, শফিক রেহমান, তাসমিমা হেসেন, নাইমুল ইসলাম খান, আলতামাশ কবীর, তৌফিক ইমরোজ খালিদী, কাদির কল্লোল—এদের মতো সিনিয়র সাংবাদিকরাও এত বছর পর প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হলেন!!

বছর খানেক ধরে সাংবাদিক শাবান মাহমুদসহ আরও কয়েক জন প্রেস ক্লাবের সদস্যপদের দাবিতে নানান কিসিমের আন্দালন করে আসছিলেন। কিছুটা হুমকিও প্রয়োগ করেন তারা। প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ লাভে ব্যর্থ হয়ে ঢাকার সাংবাদিকদের বড় সংখ্যার একটি গ্রুপ সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পাশে 'ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি' নামের প্যারালাল একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে প্রেসক্লাব যেমন সরকারের দেওয়া জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত, 'ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি'ও তাই। এখানে আরও একটি আমোদজনক বিষয়, নতুন কেউ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে মন্ত্রী হলে তাকে একটি সংবর্ধনা দেয় এই 'ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি'। তার কাছে কিছু দাবি-দাওয়াও পেশ করেন তারা। তাদের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ড এবং সুযোগ-সুবিধা প্রসারিত করার জন্য আশেপাশের কয়েকটি ঘরবাড়ি তাদের স্থায়ীভাবে দলিল করে দিতে হবে। ইতোমধ্যে বোধহয় তারা সফলও হয়েছেন।

কোনো গণপূর্ত মন্ত্রীই কোনো সাংবাদিক গোষ্ঠীকে চটাতে চাইবেন না। প্রায় সকল গণপূর্ত মন্ত্রীই বাড়িঘর, জমিজমা বরাদ্দে অনিয়ম, বেনিয়ম, দুর্নীতি করে থাকেন। সেই মীর্জা আব্বাস থেকে সর্বসাম্প্রতিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের নাম এই মুহূর্তে বেশি বেশি মনে পড়ছে। সাংবাদিকদের মন-দিল জয় করা গেলে অনিয়ম-বেনিয়মের খবরও গণমাধ্যমে কম আসে। এত বড় জমির ওপর একটা প্রেস ক্লাব থাকার পরও আরও কেন জমি-বাড়ি দিতে হবে, কোনো মন্ত্রী সেই প্রশ্ন করেন না।

'ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি' শুরু হয়েছিল, এখন বিলুপ্ত ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম গোলাম রসুল মল্লিকের বাড়ির এই ফ্ল্যাটে। মনে হচ্ছে, পাশের আরও দুটি জায়গা এখন 'ডিআরইউ'এর দখলে যাচ্ছে। এখানে একটি অবধারিত প্রশ্ন, সরকার থেকে এতসব অনুগ্রহ, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে লেখালেখি করলে তাতে 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট'– স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্নটিও কি দেখা দেয় না?

এই একই প্রশ্ন জাতীয় প্রেস ক্লাবের ক্ষেত্রে তোলা যায়। সরকারি জমির কথা না হয় বাদই দিলাম; কিন্তু যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য নিয়ে প্রেস ক্লাব সাজানো হয়েছে, সেইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কি আমাদের এই প্রেস ক্লাবের সদস্যরা লেখালেখি করার নৈতিক অধিকার রাখেন? এমন আনুকূল্য যদি ঋণখেলাপী বেক্সিমকো গ্রুপ, হলমার্ক গ্রুপ, ডেসটিনি গ্রুপ, দেশের কোনো ভূমিদস্যু, কোনো আদমব্যাপারী দিতে চায়, প্রেসক্লাব কি তা গ্রহণ করবে? সকল প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালো-মন্দ লেখার অধিকার সংরক্ষণের জন্যই তো কারও কছ থেকে কোনো সাংবাদিক সংগঠনের কিছু নেওয়া অনৈতিক, কারও কোনো চাপে না থাকাটা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

'ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি'র বাধ্যবাধকতা তবু বোঝা যায়। প্রেস ক্লাব যদি তাদের সদস্যপদ দিত, তাহলে তাদের হয়তো সেগুনবাগিচার এই প্যারালাল অফিস প্রতিষ্ঠা করতে হত না। কিন্তু প্রেস ক্লাবের নেতা-নেত্রীরা গত দশ বছর কাউকে সদস্যপদ দেননি; কারণ তারা তাদের পক্ষের মতবাদের ভোটার চেয়েছেন। সম্ভাব্য ভোটার হিসেবে সদস্যপদ প্রার্থীরা যথেষ্ট আনুগত্য দেখাতে পারেননি বলেই এতদিন সদস্যপদ প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে মনে হয়। এমনটি করে থাকে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। শিক্ষক পদপ্রার্থীরা যতই যোগ্য হোন না কেন, ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন নির্বাচনে শিক্ষক পদপ্রার্থী কাকে ভোট দেবেন, তা যাচাই বাছাই করে তবেই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, বা প্রত্যাখ্যান।

তো, যেসব সম্পাদক-সাংবাদিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন দলীয়করণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে থাকেন, তাদের লেখালেখি এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে, তারা কি এতটুকু খেয়াল করেছেন যে, তারাও একই অপরাধে অপরাধী?

–দুই–

জাতীয় প্রেস ক্লাব আমাদের অকার্যকর জাতীয় সংসদের চাইতে বেশি কার্যকর, এই কথাটি আমি গত পনের বছরে অন্তত তিরিশ বার লিখেছি, বিভিন্ন সভা-সমিতিতেও বলেছি। কিন্তু প্রেস ক্লাবের এতসব কৃতিত্ব সত্ত্বেও, এই প্রেস ক্লাব আমাদের স্বাধীনতার কবি– কবি শামসুর রাহমানকে সদস্যপদ দেয়নি। এই কলংক থেকে সাংবাদিক সমাজ, জাতীয় প্রেস ক্লাব কীভাবে অব্যাহতি পাবে? অথচ লক্ষ্য করতেই হয়, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নুরুল আমিন এখনও এই প্রেস ক্লাবের একজন সদস্য!! এমন উদাহরণ তো আরও আছে। এসবের ব্যাখ্যা কী?

আরও আমোদ এবং উদ্বেগের বিষয়, ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের সভাপতি পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসক!! সেই ষাট বছর আগে যখন এই প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি সরকারি জমি দিয়েছিলেন এই প্রেস ক্লাবকে। ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবও জেলা প্রশাসককে ইজ্জত, মর্যাদা দিয়ে আসছে। তো, এই প্রেস ক্লাবের পক্ষে জেলা প্রশাসনের সমালোচনা করার ন্যূনতম অধিকারও কি আছে? কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকও ওখানকার প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন পদাধিকারবলে। কিন্তু সেই প্রথা কয়েক বছর আগে বাদ দেওয়া হয়েছে। কতগুলো বিষয়ে, যেমন সভাপতির পদ, এমনসব সংগঠনের একটি 'কমন স্ট্যান্ডার্ড' থাকা উচিত।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হিসেবে যে ১৭১ জনকে সেদিন গ্রহণ করা হয়েছে, এক সাংবাদিক আমাকে হিসাব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে নয়া দিগন্তের ১১ জন, ইনকিলাবের ৭ জন, দিনকালের ৬ জন, সংগ্রামের ৪ জন, আমার দেশের ৪ জন রয়েছে। এখানে সকলকেই স্মরণ করতে বলি, দৈনিক 'নয়া দিগন্ত'এর মালিক মীর কাশেম আলী এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন যুদ্ধাপরাধী। একই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আর দুই আসামি কাদের মোল্লা এবং কামরুজ্জামানও এই প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। কিন্তু, আবারও বলি, কবি শামসুর রাহমান এই প্রেস ক্লাবের সদস্য হতে পারেননি।

আরও শুনেছি, এই ১৭১ জনের তালিকায় জামাতপন্থীদের সংখ্যা বেশি, বিএনপিপন্থীদের তুলনায়। তাই বিএনপিপন্থীরাও ক্ষুব্ধ। বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের আশংকা, জামাতপন্থীদের দাপটে বিএনপিপন্থীরা ম্লান হয়ে যাবে।

উপরে যে ৫টি দৈনিক পত্রিকার ৩০ জন সাংবাদিকের কথা উল্লেখ করেছি,তারা সকলেই বিএনপি-জামাত ঘরানার, আবদাল আহমেদ ও রুহুল আমিন গাজীদের গোত্রভুক্ত। এমন খবরও শুনেছি, সাংবাদিকের পরিচয়পত্র দিয়ে কোনো কোনো পত্রিকার পিওন চাপরাসীকেও সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, গোত্রের ভোটার সংখ্যা বাড়ানো।

এখন আমাদের কিছু 'জঙ্গিবিরোধী' ইনকিলাবী সাংবাদিকের চরিত্র বর্ণনা করি।

দুর্বৃত্ত ইনকিলাবীদের 'সর্দার' বাহাউদ্দিনকে একটি ক্ষেত্রে তারিফ করতেই হয়। তার জানমাল রক্ষা করার জন্য এই লোক তার ইনকিলাব নামের 'জঙ্গি' সংগঠনটিতে কিছু আওয়ামী সাংবাদিককে নিয়োগ দিয়েছে। বাহাউদ্দিন এবং তার ইনকিলাব যখন বিপদে পড়ে, তখন সে এই আওয়ামী সাংবাদিকদের 'অ্যাকটিভেট' করে আওয়ামী সরকারের আমলে; আর বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরা রাস্তায় নামে বিএনপি সরকারের আমলে। বিএনপির এক জেনারেল-সেক্রেটারি মান্নান ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে, তার চরিত্রহনন করে, কত সব লেখা এই দুবৃর্ত্ত 'সর্দার' ইনকিলার নামের আবর্জনানামায় ছেপেছে। তার অনেকগুলোর উন্মোচন করেছিলেন শফিক রেহমান তাঁর 'যায় যায় দিন' পত্রিকায়। দৈনিক 'দিনকাল'এর তৎকালীন সম্পাদক কাজী সিরাজও তখন ইনকিলাবকে ধিক্কার জানিয়েছিলন তাঁর অনেকগুলো লেখায়। তার এই স্ট্র্যাটেজির সাফল্যে, তার এতসব অপরাধ সত্ত্বেও তাকে গত তিরিশ বছরের একদিনের জন্যও জেল খাটতে হয়নি। তবে বারবার জেলে যেতে হয়েছে তার সাংবাদিক এবং বার্তা সম্পাদককে।

এই লেখায় যে 'বোধহয়', শুনেছি' এসব লিখছি, তার কারণ এই প্রেস ক্লাব সম্পর্কে আমাদের পত্রপত্রিকা, টিভি এবং রেডিও স্টেশনগুলো একেবারেই নিরব। আমাদের এই প্রেস ক্লাবটির গুরুত্ব, তার কিছু অতীত নন্দিত ভূমিকা সর্ম্পকে কোনো দিন কোনো সিরিজ প্রতিবেদন কোনো পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়নি।

প্রেস ক্লাবের ভিতরের বিষয়গুলা সম্পর্কে 'স্ট্রিক্ট সিক্রেসি' অনুসরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মারকগ্রন্থ বেরিয়েছে, এই স্মারকগ্রন্থে অনেক কৃতিত্বের বর্ণনাও আছে। স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার আন্দোলনে এই প্রেস ক্লাব এক সময় তীর্থস্থান ছিল। কিন্তু এই প্রেস ক্লাব চত্বরে পঁচিশ বছর আগে কর্নেল ফারুক-রশীদদের ফ্রিডম পার্টির সমাবেশও হয়েছে। এখান থেকে বিভিন্ন সময়ে 'মিলিটারি ডিকটেটর'দের তোষামোদীও হয়েছে। তো, এমন একটি উগ্র রাজনৈতিক দলকে এখানে সভা করার অনুমতিটা কোন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দিয়েছিলেন জানতে খুব আগ্রহী।

জাতীয় প্রেস ক্লাব যদি অকার্যকর জাতীয় সংসদের বিকল্প হয়, তাহলে জাতীয় সংসদ এবং তার সদস্যদের সম্পর্কে যত আলোচনা-সমালোচনা হয়, জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং তার সদস্যদের সম্পর্কেও তো কিছুটা আলোচনা হতেই হবে।

এই পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট কার্টারের প্রেস সেক্রেটারি জডি পাওয়েল (Jody Powell) 'দ্য আদার সাইড অব দ্য স্টোরি' বইটির ২৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আমেরিকান কংগ্রেসম্যান এবং আমেরিকান সাংবাদিকদের মধ্যে তুলনামূলক এই পর্যবেক্ষণটি খুবই প্রাসঙ্গিক:

''I must say, that the inability to handle criticism is worse in the press than it is in government. It is not because of the quality of the personnel, since there appear to e an equal number of rascals and rounders in both institutions. It is because there is no established mechanism for rooting out and exposing ne'er-do-wells in the fourth estate.''

''I am impressed, most of all, as I indicated at the the beginning of this book, by the similarity between the problems that beset those in politics and those in journalism.''

এখানে লক্ষ্য করতে হবে যে, একজন প্রফেশনাল সাংবাদিক, আমেরিকান প্রেসিডেন্টের একজন প্রেস সেক্রেটারি, আমেরিকার মতো একটি দেশের সাংবাদিকদের সম্পর্কে এই নির্মম কথাগুলো বলেছেন। তাহলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অবস্থাটা কী তা ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো 'রকেট সায়েন্টিস্ট' হওয়ার দরকার নেই।

–তিন–

বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সম্পর্কে এত কিছু 'ক্রিটিক্যাল' বলার পরও আমি মনে করি, আমাদের দেশে এখনও যা কিছু গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন আছে, তা থাকছে মূলত আমাদের সাংবাদিকদের কারও কারও প্রখর দৃষ্টি এবং ভূমিকার কারণেই। এই সাংবাদিকরাই ঝালকাঠির লিমনের ওপর 'র‌্যাব'এর নিষ্ঠুরতা এবং নির্যাতনের কথা তুলে এনেছেন। গতকাল পত্রিকায় দেখলাম, 'র‌্যাব'এর বিদায়ী মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান বলেছেন, 'র‌্যাব' মানবাধিকার রক্ষায় সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই একই দিন আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪তে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের তালিকা দিয়েছে।

টিভি চ্যানেল এবং সাংবাদিকদের তীক্ষ দৃষ্টির কারণেই শিশু জিহাদের লাশ স্বরাষ্ট্র্র প্রতিমন্ত্রী আসাদ উজ জামান খান গুম করে দিতে পারেননি; শিশু জিহাদের বাবা নাজির ফকিরকে জেলে ভরে রাখতে পারেননি। ''বকশীবাজারে সেদিন আদালত প্রাঙ্গনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করেনি, তারা আশেপাশে কোথাও ছিল না''– স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই দাবির বিপরীতে টিভি এবং পত্রিকাগুলো অনেকগুলো ছবি ছাপিয়ে প্রতিমন্ত্রীকে সত্য বিকৃতকারী বানিয়ে ছেড়েছে।

তারপর ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক সাভারনিবাসী হাসিনা দৌলাকে সরকারি অনুদানের টাকা লুণ্ঠনকারী হিসেবে প্রমাণ করেছে আওয়ামী মালিকানারই এক টেলিভিশন স্টেশন 'চ্যানেল ৭১' কয়েক দিন আগে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন কোনো একটি বটগাছের নিচে পূজা-পার্বণ করেছে, সেই গাছটিও নাকি বরাদ্দ দিয়েছে হাসিনা দৌলা!! কোটি কোটি টাকা লুটের অভিযোগ এই মহিলার বিরুদ্ধে। এই সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছিলেন তথ্য অধিকার আইনে দৈনিক 'প্রথম আলো'র এক সাংবাদিক। কিন্তু ছয় মাসেও তথ্য দেয়নি সাভারের সংশ্লিষ্ট অফিস। তখন তথ্য কমিশনে মামলা করেছেন দৈনিক পত্রিকাটির সাংবাদিক। সাভারের কর্মকর্তারা প্রার্থিত তথ্য না দিয়ে তারিখ চেয়েছে, আর তারিখ ফেলেছে তথ্য কমিশন! এত মাস সময় নিল হাসিনা দৌলার লোকজন। তারপর আরও সময়!!

এমন শত শত ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে এই দেশে। গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা এসব ঘটনার কিছু কিছু তুলেও আনছে। কিন্তু এই ঘটনাগুলোতে, আমার দৃষ্টিতে, ব্যর্থতাও হচ্ছে– হাসিনা দৌলার কোথাও ছবি ছাপা হয়নি; কোথাও তার কাজ, স্বামীর সংসারের কোনো বর্ণনা নেই; তার পেশা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, কোন চালের ভাত খায়– কোনো ঠিক চিত্র নেই এই মহিলা লুণ্ঠনকারীর। সাভারের সাবেক এমপি তওহিদ মুরাদ জং বা রানা প্লাজার রানার সঙ্গে তার অতীত কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা জানা দরকার।

–চার–

শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬-২০০১এ প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী, এই দেশের মানুষজনের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৯৯তে দেশের বিরাট এলাকা পানির নিচে ছিল প্রায় ৭০ দিন, পানি নামছিল না। তখন বিবিসি টিভি পর্যন্ত খবর প্রচার করল, কয়েক লাখ লোক মারা যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনা তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান বাতিল করলেন; দেশে অবস্থান করে তিনি বন্যাপরিস্থিতি মোকাবেলা করলেন; তার দলকে দূরে রেখে সামরিক বাহিনী এবং সিভিল প্রশাসনকে দিয়ে রিলিফ সামগ্রীর সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করলেন।

একটি লোককেও তিনি মরতে দিলেন না, কত বড় এক সাফল্য!

সেই একই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয়-তৃতীয় আমলে, হাসিনা দৌলারা কীভাবে এমন লুণ্ঠন চালাতে পারে, বুঝতে পারি না। আমাদের সাংবাদিকদের ব্যর্থতা, তারা শেখ হাসিনার এই অসাধারণ সাফল্যের কথা এখন কোথাও বর্ণনা করে না; তুলনা করে দেখায় না, তখন তিনি এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এখন নন কেন?

শেখ হাসিনার কোনো কোনো সাফল্য এখনও যথার্থভাবেই নন্দিত হচ্ছে। যেমন, আজ শুক্রবারের পত্রিকায় সারাদেশে প্রায় ৩৪ কোটি বই বিতরণের উৎসব। গতকাল বই হাতে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের উচ্ছ্বাস, মনভোলানো হাসির ছবিগুলো যে কোনো নির্জীব নৈরাশ্যবাদীকে উজ্জীবিত করবে। কিন্তু এসবের বিপরীতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে খুনোখুনি; সন্ত্রাস; বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, নদীনালা, হাটবাজার, খাসজমি, বনভ'মি দখল প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যগুলো ম্লান করে দিচ্ছে!!

পদ্মা সেতু দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের এক 'লাইফ লাইন'– ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ লেনের মহাসড়ক– কখন যে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত বছর ভালোই অর্জিত হয়েছে, এই বছরও ধারা অব্যাহত থাকবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্তসাপেক্ষে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও তো বাড়ছে। এক শ্রেণির মানুষ মালয়েশিয়া এবং কানাডায় বাড়ি-গাড়ি করছে। আর, আরেক শ্রেণির মানুষের জন্য বস্তি এবং ফুটপাত– বর্ষাবাদল, শীত-গ্রীষ্মে একমাত্র আশ্রয়স্থল। বাসে ওঠা যায় না, ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায় না, হাসপাতালেও ডাক্তার থাকে না, গ্যাসের মূল্য নির্ধারিত দামের ডাবল, একমাত্র মোবাইল ফোন সেক্টর ছাড়া আর সব ছবিই তো করুণ।

অন্যায়, অবিচার, র‌্যাব, হাসিনা দৌলা, তওহিদ মুরাদ জং, রানা প্লাজার রানা, তাজরিনের দেলোয়ার হোসেন– আদম পাচারকারী, গার্মেন্টসের শ্রমিক নির্যাতনকারী, ভূমিদস্যু– এদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সোচ্চার থেকেছে অতীতে। গণমাধ্যম প্রবলভাবেই আক্রান্ত ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, গরিব, দরিদ্র, শ্রমিক, বস্তিবাসী, ছিন্নমূল মানুষদের পক্ষে থেকেছে; আগামী দিনগুলোতেও যে থাকতে হবে।

পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন তুলে আনছে অদম্য মেধাবী সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীদের। দেশের কোথায় কোন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করছেন, রিকশা চালাচ্ছেন তাও জানতে পারছি আমাদের সাংবাদিকদের অনেকেরই সরব ভূমিকার কারণে। কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি, কোনো এমপি, কোনোদিন তার এলাকার একজন বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কিছু করেছেন, শুনিনি। অথচ তারা প্রত্যেকেই ব্যক্তিজীবনে 'আমীর' শ্রেণির মানুষ। তারা বা তাদের ক্যাডাররা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে রাস্তার পাশে শত শত তোরণ বানাবে, কিন্তু একজন বিপন্ন বীরাঙ্গনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। এমন অপচয় করার জন্য চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করে বিশাল সম্পদ অর্জন করে তারা। কিন্তু একজন অটিস্টিক শিশুকে তারা সাহায্য করে না।

আমাদেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। প্রবল ক্ষমতাশালী বা ক্ষমতাবান নির্বাহী বিভাগকে সাংবিধানিকভাবে সংযত করতে পারছে না আমাদের জাতীয় সংসদ এবং বিচার বিভাগ। আমাদের নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দুর্বলতা আমাদের গণমাধ্যমে প্রায় খবর হচ্ছে।

সাংবাদিকদের যে কত প্রতিকূল অবস্থায় কাজ করতে হয়, তাও কিছু কিছু জানি। প্রথমত, কয়টা পত্রিকা তাদের নিয়োগপত্র দিয়ে থাকে? তারপর, নিয়মিত বেতন-ভাতা কয়জন সাংবাদিক পেয়ে থাকেন? আমাদের অনেকগুলো গণমাধ্যমে সাংবাদিকদের চাকরিটি কখন আছে কখন যায় নিয়মিতই এই নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করতে হয়। মালিকের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক এবং নানান কিসিমের ধান্দাবাজির লাঠিয়াল হিসাবেও সাংবাদিকদের কখনও কখনও কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

তাই এবং তারপরও দেশের মানুষের, বিশেষ করে বিপদগ্রস্ত এবং বিপন্ন মানুষের ভরসা– আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের সাংবাদিকরা।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শুক্রবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৫।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।