এই বিতর্ক দিকনির্দেশনাহীন

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 4 Jan 2015, 12:35 PM
Updated : 4 Jan 2015, 12:35 PM

মাঠের রাজনৈতিক তৎপরতা শীতল হলেও শীতের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাকযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দ-উচ্ছাসও যেন নিস্প্রভ হয়ে যাচ্ছে বিতর্কের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটায়। বিতর্কের নামে কুতর্ক শব্দদূষণের মতো ভারি করছে বাতাস। সূর্যের উদয়ে দিন বদলায়, কিন্তু বদলায় না আমাদের চিন্তা-চেতনার জগত। স্বাধীনতার চার দশকের বেশি, কিন্তু একটা কপট ভাব দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় মুক্ত মন নিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। যে ইতিহাস কথা বলে, তার কথা আমরা শুনতে চাই না, অথবা শুনলেও মুখ ফিরিয়ে নিই অন্য দিকে।

পথনির্দেশক ইতিহাস উপেক্ষা করে সঠিক নির্দেশনায় পথ চলা যায় না। উত্তপ্ত বাকযুদ্ধে সাময়িকভাবে বাতাস ভারি করা যায়, কিন্তু পথপরিক্রমায় উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা নেই। ইতিহাসের নামে দুটি বড় দলের নেতা-নেত্রীরা যে বাকযুদ্ধে আত্মমগ্ন, তা সেই অনিশ্চয়তার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস বেশি দিনের নয়, জীবিত অনেকের চোখের সামনেই ঘটে গেছে ইতিহাসের ঘটনাবলী। ইতহাসের সাক্ষী যারা, তাদের দুঃখজনক নিরবতাই উম্মুক্ত করে দিয়েছে ইতিহাস-বিকৃতির দুয়ার। ইতিহাস-বিকৃতির এই মহড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা উৎসারিত নিছক দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ইতিহাস আর ইতিহাসবিদদের দখলে নেই, তা অপহৃত হয়ে চলে গিয়েছে রাজনীতিকদের হাতে। রাজনীতিকরা তাতে মনগড়া রং চড়িয়ে ফেরি করছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। ফলে শ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতাদের গায়েও উঠেছে দলীয় উর্দি, বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে পারিনি আমরা কাউকে।

তাঁদের গায়ে দলীয় উর্দি চড়িয়ে আমরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে অশ্রদ্ধাই প্রদর্শন করছি। তাঁদের আত্মাকে স্বর্গের সুখ না দিয়ে নরকের যন্ত্রণাই দিচ্ছি। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছি খণ্ডিত ইতিহাসের চর্চা করে। অথচ খণ্ডিত ইতিহাস ইতিহাস নয়, ইতিহাস নির্মিত হয় ধারাবহিকতায়। এক খণ্ড ইট যেমন প্রাসাদ নয়, আবার প্রাসাদও খণ্ড খণ্ড ইট ছাড়া হয় না। প্রাসাদের মতো ইতিহাস খণ্ড খণ্ড ঘটনা দ্বারা নির্মিত। আমরা প্রাসাদসম ইতিহাস তৈরি না করে খণ্ড খণ্ড ঘটনা খণ্ড খণ্ড ইটের মতোই নিক্ষেপ করছি পরস্পরের প্রতি। আর তাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে জাতির।

এই ইট-ছোঁড়াছুড়ির অপসংস্কৃতিই আমরা উপহার দিয়ে যাব আমাদের উত্তরসূরীদের। যার ফলে একটা দিকভ্রান্ত বা দিকনির্দেশনাহীন নবপ্রজন্ম আমরা রেখে যাব রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে।

অতীতে এক সময় ইতিহাস বলতে আমরা জানতাম রাজা-বাদশাহ বা শাসকদের জীবন-বৃন্তাত্ত ও তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ইতিহাস প্রণয়নের সে পদ্ধতি পাল্টে গেছে। আধুনিক যুগে ইতিহাসের উপাদান কেবল শাসকরা ও তাদের কর্মকাণ্ড নয়, জনগণ ও তাদের কর্মকাণ্ডও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিপ্লব-আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে সেসব ঘটনার নায়ক এক বা একাধিক যা-ই হোক, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া তা বাস্তব রূপ লাভ করেনি।

সে সব বিপ্লব বা আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন নেতা বা নায়কের অবির্ভাব ঘটলেও ইতিহাসের চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বা রায়ে প্রধান পুরুষ সাব্যস্ত হয়েছেন একজনই। তার অর্থ এই নয় যে, ইতিহাস অন্যদের ভূমিকার মূল্যায়ন করেনি কিংবা কাউকে অতিমূল্যায়ন করে অন্যদের অবমূল্যায়ন করেছে। ইতিহাসের এই নির্মোহ মূল্যায়নের কারণেই ভারতের মহাত্মা গান্ধী, চীনের মাও সেতুং, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, দক্ষিণ অফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার মতো অনেক মহান ব্যক্তি দলমত নির্বিশেষে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

তবে, সমসাময়িক কালের ইতিহাস রচনায় ইতিহাসবিদরা সব সময় সত্যনিষ্ঠ হতে পেরেছেন, এ কথা বলা যাবে না; বরং সমসাময়িক ব্যক্তি, ঘটনা ও মতামত দ্বারা নানাভাবেই প্রভাবিত হয়েছেন। যে কারণে পরবর্তী সময়ে রচিত ইতিহাসে অনেক কঠিন সত্য ও নিরপেক্ষ তথ্যের উদঘাটন ও সংযোগ হয়েছে।

বাংলাদেশে এখন যে রাজনৈতিক বিভক্তি বিরাজমান, তাতে নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার দুঃসাহস হয়তো কেউ দেখাবেন না। ইতিহাসের খণ্ডিত অংশ হিসেবে যেসব বই এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে, তা ব্যক্তি ও দলীয় রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত বলে প্রায়শ পক্ষপাতদুষ্ট। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইতিহাসও বদলায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে যে ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয়, বিএনপি সরকারের সময় তা পাল্টে যায়। অর্থাৎ সরকার ভেদে ইতিহাস বিকৃত হয়।

বিশেষত দুই বড় দলের এই সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের উত্তরসূরীরা গড়ে উঠেছে ইতিহাসগত বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে। অন্য কথায়, সঠিক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের অনুপস্থিতিতে আমরা একটা বিভ্রান্তিকর ও দ্বন্দ্বমুখর অধ্যায় অতিক্রম করছি, পরিণতিতে যার শিকার হচ্ছে নবপ্রজন্ম। বার্লিন প্রাচীরের মতো তাদের মনোজগতে যে বিভাজনের দেয়াল গড়ে উঠছে, তা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ না করে অনৈক্যের সুরকেই জোরালো করে তুলছে। আর এর দায় বহন করতে হবে প্রধানত আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন, এই ইস্যু কেন্দ্র করেই বর্তমান বিতর্ক ক্লেদাক্ত কলহে পৌঁছেছে। অথচ যাদের নিয়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জিয়াউর রহমান, তাঁদের জীবদ্দশায় তা কখনও উঠেনি। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর এবং পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখনও এ বিতর্ক ছিল না। বিতর্কটা শ্রুতিকটু হয়ে দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে, যখন ব্যক্তিগত আবেগ ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস উপস্থাপন করার প্রতিযাগিতা শুরু হয়েছে।

ভিন্ন ভিন্ন দলের ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সমগ্র জাতির ইতিহাস ও ইতিহাসের রায় একটাই হবে, যদিও তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কোনো জাতির জন্ম যেমন একদিনে হয় না, তেমনি কোনো জাতির ইতিহাসও একদিনে হয় না। একটা জাতির জন্মের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পর্যায়ে বহু ঘটনা ঘটে এবং সেসব ঘটনার নায়কও বিভিন্ন হতে পারেন।

বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের, তবে জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিহাসের যাত্রা পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে। ভারত বিভাগের মধ্য দিয়ে যুক্ত বাংলার স্বাধিকারের স্বপ্ন মিলিয়ে গেলেও পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জনগণের একটা রাজনৈতিক সচেতন অংশ সে স্বপ্ন লালন করেছে সরবে-নিরবে। এই প্রগতিশীল রাজনীতি ও চিন্তা-চেতনার ধারার সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ) আত্মপ্রকাশ নেহায়েৎ মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবেই ঘটেনি, এর প্রধান উদেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠা করা।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে 'একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' বলে যে ঘোষণা দেন, তা বাঙালি জনগণের সুপ্ত জাতীয়তাবাদী চেতনা আবার জাগ্রত করে তুলে। তাদের সোচ্চার প্রতিবাদ ছিল সেই জাতীয়তাবাদী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ, যা ঘটেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বিতীয় বছরেই। সুতরাং, জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাসের ঊষালগ্ন তখনই।

সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, দলটির জন্মের পেছনে জাতীয়তাবাদী চেতনা কাজ করেছিল, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আওয়ামী (মুসলিম) লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের মতো তখন দলের অনেক নেতা-কর্মীই ছিলেন বাম রাজনীতির অনুসারী। আওয়ামী লীগের উত্থান-পতনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহয়াওয়ার্দী, আতাউর খানের মতো আরও অনেক নেতা-নেত্রী। আর এর মধ্য দিয়েই কালক্রমে দলটির কর্ণধার হিসেবে আবির্ভূত হন শেখ মুজিবুর রহমান।

যে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক ছিলেন জিন্নাহ, 'একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার' ঘোষণা দিয়ে শিশু রাষ্ট্রটির মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করলেন তিনিই। কিছুদিন পর তিনিও মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পাকিস্তান দুই যুগের বেশি টিকে থাকতে পারেনি। জিন্নাহের মৃত্যুর পরও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অবস্থানে অনড় থেকে যায়।

এদিকে এ ব্যাপারে পূর্ব বাংলার জনগণও তাদের অবস্থানে ছিল আপোষহীন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বিশেষত সমাজের অগ্রসর অংশের তরুণরা, যাঁরা ছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী। আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন দিলেও এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত হয়নি। এ আন্দোলনে মুসলিম লীগ ব্যতীত সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্বে প্রাধান্য ছিল বাম ও প্রগতিশীল ধারার অনুসারীদের। যারা ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন তাদের অন্যতম আবদুল মতিন, গাজীউল হক, অলি আহাদ, (অধ্যক্ষ) আবুল কাসেম প্রমুখ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আরেকটি বড় ঘটনা ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন। শোষণ ও নির্যাতনের শিকার পূর্ব বাংলার গণআন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে উঠেছিল, তারই বিস্ফোরণ ঘটে গণঅভ্যুথানে। ছয়-দফা আন্দোলনের জন্য শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে গ্রেফতার ও বিচারকে তারা দেখেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আরেকটি গভীর চক্রান্ত হিসেবে। আইয়ুববিরোধী তীব্র আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে যে মাত্রা পেয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিল না ভিন্ন কারণেই।

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে সম্পৃক্ত হয়েছিল সমাজের সর্বস্তরের সকল মতাদর্শের মানুষ। পূর্ব পাকিস্তানে এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী (ওই সময় ন্যাপ-এর সভাপতি), যিনি ১৯৫৭ সালেই কাগমারী সম্মেলনে বিদায়ী সালাম জানিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানকে। তাঁর নেতৃত্বে যে বিশাল জঙ্গি মিছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হয়, তাতে আইয়ুব খানের তখতে তাউস কাঁচের ঘরের মতো খান-খান হয়ে ভেঙে পড়ে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়, শেখ মুজিবসহ মামলার সকল বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং আইয়ুবের পতন ঘটে।

কারামুক্ত শেখ মুজিব পান ব্যাপক জনঅভিনন্দন, আর তাঁর দল আওয়ামী লীগ পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তখন থেকেই তিনি জনপ্রিয়তার সোপান বেয়ে উঠে আসেন শীর্ষে।

১৯৭০ সালে প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়ে পূর্ব বাংলার উপকূলীয় জনপদের লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাদের ঘরবাড়ি। প্রাণের স্পন্দনহীন উপকূলীয় অঞ্চল পরিণত হয় মৃতপুরীতে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, এলএফওর (Legal Framework) অধীনে সাধারণ নির্বাচন হবে। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিশ্ববিবেক নড়ে উঠলেও শাসকগোষ্ঠী চোখ-কান বন্ধ করে বসেছিল পশ্চিম পাকিস্তানেই। পূর্ব পাকিস্তানের স্বজনহারা জনগণ তাতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

পল্টনে শোকার্ত মানুষের জনসভায় মাওলানা ভাসানীর বিখ্যাত উক্তি 'ওরা কেউ আসেনি' পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শেষবারের মতো জানিয়ে দিল, পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের শত্রু, বন্ধু নয়। তিনি শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়ার গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান না করা ও নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে নিজে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সারা দেশ ঘুরে-ঘুরে জনসভা শুরু করলেন। তাদের শোনালেন, স্বাধীনতাই একমাত্র মুক্তির পথ।

কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে শেখ মুজিবের অবস্থান ছিল ভিন্ন। নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি জনগণের ম্যান্ডেট গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিলেন। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি সঞ্চয় করলেন শক্তি, আবির্ভূত হলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রথমে তিনি অনেকের দ্বারা সমালোচিত হলেও, পরবর্তী সময়ের পদক্ষেপসমূহের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন তিনি ভুল করেননি।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যেসব প্রধান ঘটনা ঘটছে, এটা তার সার-সংক্ষেপ।

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সঙ্গেই রচিত হয় ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের শেষ অধ্যায়। সামরিক জান্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার চক্রান্তে মেতে উঠে। তাদের সঙ্গে চক্রান্তে শরিক হন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) জুলফিকার আলী ভুট্টো। সময়ক্ষেপণের জন্য ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু করেন শেখ মুজিব ও পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে।

পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এসব আলোচনার এক পর্যায়ে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থার। শেখ মুজিব ঢাকা থেকে আন্দোলন জোরদার করেন। তাঁর ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনসহ সর্বস্তরে অসহযোগিতা শুরু হলে এ অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। অচল অবস্থার মধ্যে পরিস্থিতি বিস্ফোরণমুখ হয়ে উঠে। এ অবস্থাতেই ৭ মার্চ রেস কোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইয়াহিয়া আঁতকে উঠেন: শেখ মুজিব কি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন?

ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের কাছে বার্তা পাঠালেন ১৫ মার্চ তিনি ঢাকায় আসছেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। ৭ মার্চ (১৯৭১) জনসভায় লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ যোগদান করল প্রবল আগ্রহ ও ঔৎসুক্য নিয়ে, শেখ মুজিব তাদের পরবর্তী কী দিকনির্দেশনা দেন। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা দিলেন: '…. এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তাঁর ঘোষণায় উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে একযোগে দাঁড়িয়ে ফেটে পড়ল আকাশবিদারী 'জয় বাংলা' শ্লোগানে।

অনেকেই শেখ মুজিবের এই ঘোষণাকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা মনে করেন না কিংবা অসম্পূর্ণ মনে করেন। তাদের নিশ্চয়ই প্রত্যাশা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি ঘোষণা দেবেন, 'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন' অথবা 'আজ এখান থেকে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি'। আবার সামরিক-বেসামরিক অনেকেই মনে করেন, ওই দিন শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিলে এত লোকক্ষয় হত না এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্যও দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের প্রয়োজন হত না।

তাদের এসব যুক্তি ও বক্তব্য বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, যা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য দীর্ঘ পরিসর দরকার। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ওই ঘোষণা ভিত্তি করেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী ঘটনাবলী ঘটেছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকায় ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ভেঙে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠে। জিয়াউর রহমানের (মেজর জিয়া) যে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এত বিতর্ক, তাও ঘটেছিল ঘটনার ধারাবাহিকতাতেই।

শেখ মুজিবের অবর্তমানে সৃষ্ট নেতৃত্ব-শূণ্যতায় ২৭ মার্চ একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা অনিশ্চয়তায় উদ্বিগ্ন সামরিক-বেসামরিক জনমনে কী প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এবং তা কীভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, তার সাক্ষী ওই চরম সংকটময় মুহূর্তগুলো। জিয়ার ঘোষণা শেখ মুজিবের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং জিয়ার ঘোষণা ছিল শেখ মুজিবের ৭ মার্চ ঘোষণার followup action– জিয়াউর রহমান নিজেই বলেছেন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণাই ছিল আমাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার গ্রিন সিগন্যাল। জিয়া তার সর্বশেষ ঘোষণাও দিয়েছিলেন শেখ মুজিবের পক্ষে থেকেই, যদিও তিনি তার প্রথম ঘোষণায় নিজেকে বাংলাদেশের Provisional President এবং Liberation Army Chief হিসেবে দাবি করেছিলেন।

তাছাড়া জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনেই, তাদের আদেশ-নির্দেশ মেনেই। প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে (তাঁর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) এবং কর্নেল ওসমানীকে করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। ১১ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত প্রথম ভাষণেও জিয়াউর রহমানের ভূমিকার প্রশংসা করেন।

২৫ মার্চ পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর শেখ মুজিবের অবর্তমানে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণই পরবর্তী ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করে। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, তাজউদ্দীন আহমদের কাছে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবাসী সরকার গঠন করেন। যে কারণে শেখ মনি ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা তাজউদ্দীনের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধও পরিচালিত হয় শেখ মুজিবের নামেই।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে তর্ক-বিতর্ক ও কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলছে তা শোনার পর প্রশ্ন জাগে: তাহলে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব কারা দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন কারা? দলীয় মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেই তাকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে রাজাকার, পাকিস্তান বা আইএসআইয়ের চর হিসেবে।

সবশেষে, এই অপবাদ থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকারও রেহাই পাননি। তিনি সমালোচিত হয়েছেন বিশেষত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী ও তার সমর্থকদের দ্বারা। তার প্রধান কারণ, তিনি তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত স্মৃতিচারণমূলক বইয়ে (১৯৭১: ভেতরে বাইরে) হতাশার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিব তাঁর ৭ মার্চ ভাষণে 'জয় বাংলা'র পর 'জয় পাকিস্তান' বলেছেন এবং সরাসরি প্রত্যাশিত স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু সমালোচকরা যা আমলে নেননি, তা হচ্ছে তিনি শেখ মুজিবকে own করেই এসব কথা বলেছেন, disown করে বলেননি।

সবচেয়ে দুঃখজনক জেনারেল শফিউল্লাহর মন্তব্য, যিনি একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি বলেছেন, এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধ করেননি। অথচ লিবারেশন আর্মির ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে একমাত্র এ কে খন্দকারই ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) ঢাকার রেস কোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

জিয়াউর রহমানকেও আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী ও তাদের সমর্থকরা আখ্যায়িত করেছেন পাকিস্তানের চর হিসেবে। তাদের ভাষায়, জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানের চর হিসেবে। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের কপালেও জুটেছিল এমনি নানা তকমা। শারমিন আহমদ তাঁর 'তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা' বইয়ে এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন যাতে আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে 'পাকিস্তানের এজেন্ট' বলে গালিগালাজ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, 'আইএসআই'এর টাকা খেয়ে শারমিন এই বই লিখেছেন।

লক্ষ্যণীয় যে, এসব তর্ক-বিতর্ক ও সমালোচনায় তথ্যের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে বাক্যবাণ, যা এলোপাতাড়ি নিক্ষিপ্ত হচ্ছে কেবলই চারিত্রহননের জন্য।

এই প্রতিযোগিতায় কয়েক ধাপ এগিয়ে লন্ডন থেকে বাংলাদেশের উত্তপ্ত হাওয়ায় অগ্নিবাণ ছুঁড়লেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান। তিনি বললেন, তার পিতা জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, শেখ মুজিব ছিলেন অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ও রাজাকার।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রেখে সামরিক জান্তা তাঁকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের নামে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারকে (পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) নির্দেশ দেন ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা থেকে বিরত করার জন্য। কিসিঞ্জার ইয়াহিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিক্সনকে নিশ্চিত করেন যে, শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে না।

শেখ মুজিবের মুক্তিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইস্যুতে দরকষাকষির অন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে পাকিস্তানি জান্তা। এ ব্যাপারে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থনকারী নিক্সন প্রশাসন। কিন্তু প্রবাসী সরকার মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের মুক্তি, উভয় ব্যাপারে অটল থাকে। শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান পাকিস্তানের শাসকচক্রের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা নয়, অনমনীয় অসহযোগিতাই প্রমাণ করে।

শেখ মুজিব 'রাজাকার', জিয়াউর রহমান 'পাকিস্তানের চর', এ কে খন্দকার 'আইএসআই'এর এজেন্ট, মেজর জলিল 'স্বাধীনতার শত্রু', তাজউদ্দীন আহমদ তনয়া 'আইএসআই'এর মদদপুষ্ট– তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হল কী করে? আমরা যারা তাঁদের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে সমালোচনা করছি, তারা কারা? এই আত্মঘাতী বিতর্ক জাতির মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি করছে তা আমাদের কেবল বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তেই ঠেলে দিচ্ছে, যেখান থেকে একদিন প্রত্যাবর্তনের পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে।

দৌড় প্রতিযোগিতায় একজন মাত্র অংশগ্রহণকারীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে তাকে 'ফার্স্ট' ঘোষণা দেওয়ায় কোনো গৌরব নেই। একশ'জন প্রতিযোগীর মধ্যে যে ফার্স্ট হবে, সেই হবে গৌরবের অধিকারী। শেখ মুজিবর রহমান তাঁর অনন্য ভূমিকার জন্য ইতিহাসে স্থান দখল করেছেন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। মওলানা ভাসানীর বৈশিষ্ট্য যে, তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে কোনো পদ-পদবী লাভের জন্য রাজনীতি করেননি। তিনি রাজনীতি করেছেন নির্যাতিত-বঞ্চিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যে কারণে ইতিহাসে তাঁর আসন নির্ধারিত হয়েছে একজন ব্যতিক্রমী পুরুষ হিসেবে।

তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করে ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে নায়কের আসনে সমাসীন হয়েছেন। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা চরম সংকট মুহূর্তে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। তাঁদের কাউকে বাদ দিয়ে কিংবা তাঁদের ভূমিকার অবমূল্যায়ন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস রচিত হলে তা নির্মোহ ও সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস হবে না অথবা ইতিহাসের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি হবে।

এছাড়া আমাদের ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে ভূমিকা পালন করেছেন, সে জন্য তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ আসন অবশ্যই সংরক্ষিত থাকতে হবে। এসব কৃতী পুরুষের পাশাপাশি আরও অনেকের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে যাঁরা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আমরা আজ ইতিহাসের এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যৎ ব্যর্থ হবে না। তার নজির তো আমরা দেখছি– শত বছর, এমনকি হাজার বছর আগের ইতিহাসের নানা অধ্যায় নতুন করে লিখিত হচ্ছে অথবা নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হচ্ছে।

ইতিহাস সূর্যরশ্মির মতো, অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়াবেই।


আমানুল্লাহ কবীর:
সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।