একটি শিশুর মৃত্যু, একটি দুর্বল রাষ্ট্র ও অসংগঠিত সমাজ

Published : 31 Dec 2014, 03:56 AM
Updated : 31 Dec 2014, 03:56 AM

–এক–

তিন চার বছর বয়স্ক জিহাদ খুলে রাখা ডিপ টিউবওয়েলের পাইপের ফোঁকড় দিয়ে পড়ে যায়। এই ঘটনা সারা দেশের মানুষ গণমাধ্যমের প্রচারের মধ্য দিয়ে জানতে পারে। উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালে সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ ও মন্ত্রী মহোদয় নানা ধরনের বক্তব্য রাখেন। এই সব কথার প্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে আস্থা জন্মায় যে, জিহাদকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে কথা বলেছেন, অক্সিজেন দিয়েছেন, জুস দিয়েছেন, এমনকি জিহাদ দড়ি ধরে টান দিয়েছে সেটাও প্রচার করা হয়।

বেশ কয়েক ঘণ্টা প্রচেষ্টার পর সরকারি বাহিনী যখন জিহাদকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় তখন তাদের সুর ও কাজকর্ম পাল্টে যায়। তারা সরাসরিভাবে জিহাদ ও তার পরিবারকে দায়ী করে সন্তানকে লুকিয়ে রাখার জন্য। তার বাবাকে ১২ ঘন্টার মতো আটকে রাখা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের শাসানি দেওয়া হয়– "র‌্যাবের হাতে তুলে দেওয়া হবে'' পর্যন্ত।

শেষ পর্যন্ত উদ্ধার কার্যক্রম ত্যাগ করার কিছুক্ষণের মধ্যে সাধারণ মানুষ নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে জিহাদকে উদ্ধার করে। এর পরপরই সরকার উদ্ধারের সাফল্যের ব্যাপারে দাবি করতে থাকে যদিও তার কিছুক্ষণ পূর্বে তারা জিহাদের অন্তর্ধান একটি 'গুজব' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। গোটা মর্মান্তিক নাটকের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের বর্তমান চিত্র প্রতীকীভাবে উপস্থিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

–দুই–

এই নাটকে যারা জড়িত তারা হচ্ছেন, ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে রেলওয়ে বিভাগ ও ঠিকাদারি সংস্থা যাদের কাজ ছিল মুখ খোলা টিউবওয়েলের মুখ বন্ধ করে মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা এবং কর্মকর্তার কাজ ছিল নিরাপত্তার তদারকি করা। রেলওয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা কি না জানা নেই, তবে এই সংস্থার সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বার বার, খোদ মন্ত্রীসহ। কারও যে ডিপ টিউবওয়েলের মুখটা খোলা আছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব ছিল, এটা কি বলার দরকার?

কোনো এক নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছে, কোনো এক ঠিকাদারি সংস্থা কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু রেলওয়ে বিভাগের যে মৌলিক সংস্কার দরকার সে কথা বলাও হচ্ছে না, ভাবাও হচ্ছে না। হচ্ছে না এই কারণে যে, সরকার ও ঠিকাদারি সংস্থার সম্পর্কটা পারস্পরিক সুবিধার। সে ক্ষেত্রে এই সম্পর্কে আঘাত করার ইচ্ছা খোদ সরকারি সংস্থার থাকতে পারে এটা ভাবার কারণ নেই।

যে সম্পর্ক রেলওয়েতে বিরাজমান, সেই একই সম্পর্ক সরকারের অন্যান্য সংস্থাতেও রয়েছে। অতএব আগামীতে ডিপ টিউবওয়েল খোঁড়া হবে, পুরানোটার মুখ খুলে রাখা হবে, শিশু পড়ে যাবে, বাকিসব ঘটবে, কিন্তু নিরাপত্তা তদারকি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না, যেহেতু তাতে নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু নিয়ম থাকলে দুর্নীতি করা কঠিন। তাই দুর্নীতিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে– পাইপের মুখ খোলা থাকবেই।

–তিন–

পাইপের ভেতরে জিহাদ পড়ে যাবার পরের পর্যায়ে আসে তার উদ্ধার কার্যক্রম। বর্তমানে এই উদ্ধার কার্যক্রমের বিষয়ে মানুষের ক্ষোভ প্রচণ্ড। দু'টি কারণে এটি প্রধানত ঘটেছে:

১. রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতা, অযোগ্যতা ও যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা;

২. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের অসংলগ্ন কথাবার্তা। তারা প্রথম পর্যায়ে জিহাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল এটা দাবি করে, তাকে খাওয়া-দাওয়া করানো হচ্ছে সেটাও দাবি করে, শিশুটি দড়ি টানাটানি করছেন সেটাও বলে এবং মন্ত্রী গোটা বিষয়টি অবহিত আছেন সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন উদ্ধারকার্য বিপথগামী হয়ে যায় তখন তারা অন্য সুরে কথা বলা শুরু করেন। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ জানিয়ে দেন যে, পাইপের তলায় কেউ নেই এবং তাদের ক্যামেরাতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

মন্ত্রী মহোদয় সবাইকে ডিঙিয়ে গোটা বিষয়টি উড়িয়ে দেন এবং তার অধীনস্ত পুলিশ বাহিনী শিশুটির বাবাকে একজন আসামির মতো জেরা শুরু করেন কোথায় ছেলেকে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন জিজ্ঞেস করে। সরকারপক্ষ যখন গোটা বিষয়টি 'গুজব' বলে উড়িয়ে দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, ঠিক তখনই সম্ভবত মৃত জিহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকারীরা ছিল সমাজের সেই অংশের মানুষ যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে সাধারণত প্রবেশাধিকার পায় না।

–চার–

উপরোক্ত ঘটনা থেকে আমরা কয়েকটি বিষয়ে জানতে পারি।

১,

সেবা সংস্থাগুলোর দক্ষতা সীমিত এবং তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি;

২.

তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সীমিত এবং আগুন নেভানোর বাইরে এদের দক্ষতার মান সাধারণ অপ্রশিক্ষিত নাগরিকদের চেয়ে কম;

৩.

যে সব সরঞ্জাম কেনার জন্য বিনিয়োগ করা প্রয়োজন সরকার সে সব ক্ষেত্রে কোনো বিনিয়োগই করেনি;

৪.

জনগনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যে ধরনের জনযোগাযোগ ও সেবার কৌশল থাকা দরকার সেটা সরকারের নেই, অর্থাৎ স্বচ্ছ শাসন ও সেবা ব্যবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মানের নয়। এটা যে নিম্নমানের সেটা বোঝা যায় এবং সবাই জানে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে তাগিদ অনুভব করেনি বা করে না।

এর কারণটা খুব সোজা। জবাবদিহিতার ভিত্তিতে পৃথিবীর সকল ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা বলা যায় না। জবাবদিহিতা থাকলেই কেবল সেবা প্রদান নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু সেটা নেই তাই এটা কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সুবিধা অর্জনের একটি উত্তম পরিসর। এটা রাগ-দুঃখের কথা নয়, বাস্তবতা।

–পাঁচ–

কিন্তু বিষয়টি কি কেবল জবাবদিহিতার না কি এর তাত্ত্বিক সূত্রটা রয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্মাণে? বাংলাদেশ একটি দুর্বল রাষ্ট্র সেটা নিয়ে বিতর্ক নেই। দুর্বল রাষ্ট্রের সেবাপ্রদানকারী সংস্থাসমূহ দুর্বলই হয়ে থাকে, যেহেতু সেবাদান দুর্বল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হয় না, ক্ষমতাও থাকে না। সে কারণে সমস্যাটা তৈরি হয় কর্মকর্তা সৃষ্ট বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ার কারণে। মন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে অন্য কর্মকর্তারা বার বার জনমত ভুল পথে পরিচালিত করেন।

মনে হয় না এটা ইচ্ছুক ছিল। তবে অবশ্যই এটা অজ্ঞতা ও অবজ্ঞাপ্রসূত। তারা বিশ্লেষণ করে কি বলা যাবে বা যাবে না সেটা নিয়ে সময় নষ্ট করেননি। প্রবোধ দেবার জন্যে যেটা ইচ্ছা সেটা তারা বলেছেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং শেষমেশ ক্ষোভের শিকার হলে উল্টো অন্যদের উপরে দোষ চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। এই সাহসটা তারা পেলেন কোথা থেকে?

সেই সাহসের সূত্র হচ্ছে জনগণ থেকে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা। যেহেতু রাষ্ট্রের ভিত্তি জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ নয়, তাই সামগ্রিকভাবে জনগণকে অস্বীকার করে কাজকর্ম করা সম্ভব। যেটা না দিলে নয় সেটাই তারা দেন কিন্তু নিজেদের স্বার্থে। এইটুকু দেওয়ার বদলে তারা চালিয়ে যাবার অধিকারটা প্রয়োগ করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি বড় ভূমিকা স্বল্প কয়েক জনের জন্য সেবাপ্রদান। জনগণের সেবা এর মধ্যে আসে না। জিহাদের মৃত্যু সে কারণে একটি ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যকার সম্পর্ক ও ভূমিকার সূচক।

–ছয়–

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তৎপরভাবে সেবা করে সবচেয়ে বেশি গালি খেতে হয় এদেশের গণমাধ্যমকে। যেখানে রাষ্ট্র এত দুর্বল এবং সেবাবিমুখ, সমাজ সেবার জন্য চাপ দিতে অক্ষম সেখানে কেবল গণমাধ্যমই পারে এই বিষয়গুলি সবার দৃষ্টিগোচর করতে। যদি কেউ একটু চিন্তা করে দেখেন, আজকের এই আলোচনাটাও সম্ভব হত না যদি গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার না করত জিহাদের ঘটনা এবং সবার কাছে সরাসরি সরকারি সংস্থার অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তুলে না ধরত।

এটা অবশ্য ঠিক যে, তাদের ত্রুটি অসংখ্য, কিন্তু এই ত্রুটির মধ্যে তাদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে। যে ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে সেটা হচ্ছে কতটা সংবেদনশীলভাবে তারা এইসব বিষয়ে রিপোর্টিং করবে বা জড়িতদের সঙ্গে আলাপ করবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই কেবল এ ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটানো সম্ভব। তবে আবার প্রমাণ হয় যে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, সরাসরি বা ঘুরেফিরে হোক, তাদের কার্যকারণে সমাজের সুবিধা হয়, পরিস্থিতির স্বচ্ছতা বাড়ে।

–সাত–

এর মধ্যে সমাজের কী অবস্থান সে প্রশ্ন থেকে যায়। বর্তমানের দুর্বল রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের সাধারণ সুবিধা বা সেবা দিতে সক্ষম নয়। তাই সমাজকে নিজেই তার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি না করা যায় তবে আগামীতে আরও অনেক বড় বিপদ হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ জানে যে, কয়েক দিনের মধ্যে সবাই ব্যাপারটা ভুলে যাবে অর্থাৎ পরবর্তী বিপদ হবার আগে পর্যন্ত।

তাই সমাজের নিজস্ব শক্তি সঞ্চয় করে কাজ করা দরকার, যেহেতু সরকার সহায়তা করতে অক্ষম। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় এটা হবে সমাজ জানে না বা ভাবতে অভ্যস্ত নয়। বিকল্প ভাবনা ছাড়া এমন কোনো বিকল্প আছে বলেও মনে হয় না। সমাজের শক্তির উদাহরণ সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি তিন উদ্ভাবকের মাধ্যমে, রাষ্ট্রিক শক্তি হাল ছেড়ে দেবার পরে অবহেলিত অংশের যে তিন সদস্য শিশুটিকে উদ্ধার করে।

অতএব, সমাজের প্রাণশক্তি ও উদ্যম রয়েছে এটা প্রমাণিত। কিন্তু সুযোগ কম; তাছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহই বাধা হিসেবে সামনে আসছে। সেই কারণে সমাজের অগ্রগতি প্রবলভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

অনুন্নত ও দুর্বল রাষ্ট্র জনগণের সঙ্গে পেশিশক্তির সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী। জিহাদের বাবাকে শুনতে হয়েছিল যে, পুলিশের কাছে স্বীকার না করলে র‌্যাবের কাছে স্বীকার করতে হবে। পুলিশের চেয়ে র‌্যাব অনেক বেশি সরকারঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। বোঝা যায়, সেবা না দিতে পারলেও সরকার ধমক বা হয়রানি করতে সক্ষম। সেই কারণে এই রাষ্ট্রের কাছ থেকে খুব বেশি আশা করাটা বোকামি হবে।

কিন্তু সমাজ ও ব্যক্তি একটি দ্বন্দ্বের সম্পর্কে উপনীত হয়েছে এবং এটা কেউ চান বা না চান, অস্বীকার করতে পারবেন না। সমাজের রাষ্ট্রীয় শক্তির সঙ্গে বিবাদ করার ক্ষমতা নেই। যেটা তারা করতে পারে সেটা হচ্ছে, নিজেদের শক্তি বাড়ানো যাতে তাকে রাষ্ট্রের উপরে কম নির্ভর করতে হয়।

আফসান চৌধুরী: লেখক, সাংবাদিক ও অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।