দুনিয়ার প্রথম বাংলা টেলিভিশনের পঞ্চাশ বছর

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 29 Dec 2014, 07:30 PM
Updated : 29 Dec 2014, 07:30 PM

গত ২৪ ডিসেম্বর দুনিয়ার প্রথম বাংলা টেলিভিশনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রচারিত অনুষ্ঠান সকাল থেকে 'চ্যানেল ৭১' এবং 'চ্যানেল আই'তে ঘন্টা তিনেক এবং বিকাল-সন্ধ্যায় বিটিভিতে ঘণ্টা চারেক দেখলাম। 'চ্যানেল ৭১'এ খ ম হারুনের সাক্ষাৎকার নিলেন ইশতিয়াক রেজা। খ ম হারুনের নাম শুনলেই আমার মনে পড়ে তাঁর প্রযোজিত সিরিয়াল নাটক 'শুকতারা'র কথা। এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আলী আহসান সিডনী। প্রতিটি পরব ৬০ মিনিটের, ২৬ পরবে নাটকটি শেষ হয়েছিল। সিরাজের প্রেমিকার নাম ছিল হাসিনা, অভিনয় করেছিলেন রওশন আরা হোসেন। 'শুকতারা'র এই কাহিনি লিখেছিলেন মমতাজ হোসেন। তাঁর আরেকটি অসাধারণ সফল সিরিয়াল 'সকাল সন্ধ্যা'।

মনে আছে, বাংলাদেশের উত্তরের এক জেলা, কুড়িগ্রাম সফরকালে এই নাটকটির একটি পর্ব দেখার জন্য এখানে ওখানে অনেক খোঁজখবর করে এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সম্মতিতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হা হতোস্মি, 'লোড শেডিং'এর কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং নাটকের সেই পর্বটি আর দেখা হল না।

আরও একটি স্মৃতি এই প্রসঙ্গে– শহীদ জননী জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' বইটির প্রধান চরিত্র রুমীর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা পড়ছিলেন 'শুকতারা'র সিরাজ একটি পর্বে। জাহানারা আপা তখন তাঁর ছোট ছেলে জামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পর্বটি তিনি দেখতে পারেননি তখন। কিন্তু আমি তখন ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার- 'ভিসিআর'এ টিভিতে প্রচার করার সময় প্রতিটি পর্ব রেকর্ড করতাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল তখন আমি, আমাদের বিদেশি দূতাবাসগুলোতে নিজ উদ্যোগে এই পর্বগুলো আমাদের ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে পাঠাতাম। আমার কাছে মাস্টার কপি আছে জানিয়েছিলাম জাহানারা আপাকে, তাঁর দেশে ফেরার পর তাঁর হাতিরপুলের বাসা 'কণিকা'য়। আগ্রহী হলেন তিনি দেখতে এই পর্বটি। শেরেবাংলা নগরে আমার মিনিস্টার্স হোস্টেলের বাসায় এক সন্ধ্যায় এসে এই বিশেষ পর্বটি দেখতে দেখতে তিনি নিরবে কেঁদেছিলেন।

'শুকতারা' নাটকটি নিয়ে একটি অতি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথাও খুব মনে পড়ছে। ১৯৮৫ সালের ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় এই নাটকের একটি পর্ব দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অডিটরিয়ামে জড়ো হয়েছিল কয়েকশ' ছাত্র, কর্মকর্তা, কর্মচারি এবং ছাত্রদের 'গেস্ট'। অনেক বছরের পুরনো ভবন, তার ওপর প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল সেই সন্ধ্যয়। নাটকটি যখন চলছিল, তখন ছাদটি ভেঙে পড়ল এতজন মানুষের মাথার ওপর, মারা গেল ৪০ জন– তাদের মধ্যে ২৫ জন ছাত্র, বাকি ১৫ জন হলের কর্মচারি এবং ছাত্রদের অতিথি। এদের স্মরণে জগন্নাথ হলের সামনে পরে একটি স্মারক নির্মিত হয়। এখনও বোধহয় প্রতি বছর এই দিন সকালে এই স্মারকে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয় ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে।

'শুকতারা' এবং 'সকাল সন্ধ্যা'র লেখক মমতাজ হোসেন এখনও বেঁচে আছেন, থাকেন এই উত্তরাতেই ৪ নম্বর সেক্টরে। বেঁচে আছেন খ ম হারুনও, এখন একটি বেসরকারি চ্যানেলের দায়িত্বপূর্ণ পদে।

টেলিভিশন চ্যানেল এখন ২৬টি। বিটিভিও আছে। কারিগরি প্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটেছে ইতোমধ্যেই। প্রতিভাবান কিছু প্রযোজক, শিল্পীর জন্ম হয়েছে গত পনের বছরে। তবে এখন আর নেই 'শুকতারা' বা 'সকাল সন্ধ্যা'। এখন বিজ্ঞাপন-সন্ত্রাসের ফাঁকে ফাঁকে মোট ১৮ মিনিটে আধ ঘণ্টার নাটক। বাকি ১২ মিনিট বিজ্ঞাপন! মানে ঘণ্টায় ২৪ মিনিট বিজ্ঞাপন! ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই এই বিজ্ঞাপন-সন্ত্রাসীদের ওপরও।

তারপরও এইসব টিভির মালিকরা কর্কশ কণ্ঠে বলেই চলেছেন তাদের চ্যানেল ভারতে দেখানো হয় না। কিন্তু কেন দেখানো হয় না, এই নিয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা কোনো টিভি বা পত্রিকায় দেখিনি। ভারতে বিদেশি চ্যানেল প্রচারের নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন সম্পর্কে এই দেশের অনেক মানুষই অনেক কিছু জানে না। কিন্তু একটা সময় তো বাংলাভাষী ভারতীয়দের কাছেও বিটিভি জনপ্রিয় ছিল; আমাদের বিটিভিতে যখন জনপ্রিয় নাটক বা সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে, তখন ভারতের 'দূরদর্শন'এ প্রচার করা হত হয়তো নিউজিল্যান্ডের কৃষিখামার বা সুইডেনের কাগজ উৎপাদনের কারখানা।

কিন্তু তারপর এমন হল কেন? আমরা এত পিছিয়ে গেলাম, আর ওরা এত এগিয়ে গেল!! ওদের সিরিয়ালে দেখার জন্য বউয়েরা, বোনেরা, মায়েরা আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াতও গ্রহণ করতে চান না।

তারপর ভারতে এই দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর প্রচার সম্ভব না হলেও বাংলাদেশের কয়েকটির মালিকের অর্থনৈতিক তরক্কি বছর বছর যেমন বাড়ছে দেখছি, তা আমাদের ৬ পারসেন্ট জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা গার্মেন্টস খাতের ১৫/২০ পারসেন্ট বার্ষিক প্রবৃদ্ধির চাইতে অনেক বেশি। বাংলাদেশি দর্শকরা কেন ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর প্রতি আসক্ত তার ওপর কোনো দর্শক জরিপ নেই আমাদের টিভি মালিকদের। কিন্তু ভারতে তাদের চ্যানেলগুলোর প্রচারের দাবিতে তারা আর্তনাদ করেই চলেছে।

তারপর, এই মালিকদের চরিত্র সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে তাঁর এক প্রেস কনফারেন্সে টিভি চ্যানেল মালিকদের সংগঠন 'অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল অউনার্স'-'অ্যাটকো'র সভাপতি পদে কাকে নির্বাচিত করা হয়েছে, তার অর্জিত ধন-সম্পদের উৎস কী, এইসব প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু টেলিভিশনের কয়েক জন বিশিষ্ট সদস্য আমাকে জানিয়েছেন যে, সভাপতি পদে এনটিভির মালিককে প্রস্তাব করেছিলেন 'চ্যানেল ৭১'এর মালিক এবং এক 'মিলিট্যান্ট' আওয়ামী লীগার মোজাম্মেল বাবু।

তবে, আমার জানামতে, মোহনা টেলিভিশনের মালিক মিরপুরের একজন এমপি, কামাল মজুমদার অ্যাটকোর সভাপতির চেয়েও নিম্নমানের একজন লোক। কামাল মজুমদার টিভি প্রযোজকদের কোটি কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করছেন না, 'প্রডিউসাররা' পাওনা চাইলে তিনি হুমকিও দিয়ে থাকেন বলে শুনেছি।

আমাদের টিভি এবং পত্রপত্রিকার মালিক-সম্পাদকরা নাকি 'সমাজের বিবেক'। তবে এই বিবেকরা কেন বিজ্ঞাপন-সন্ত্রাস বন্ধ করে না, তার জবাব তারা দেয় না কখনও, কোথাও। তারা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-নেতাদের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা চায়; কিন্তু তারা কার কাছে জবাবদিহিতা করছে? 'চ্যানেল আই' এতসব জমকালো সব অনুষ্ঠান করে গ্রামীণ ফোন এবং আর সব মোবাইল কোম্পানির 'স্পন্সরশিপ', সাহায্য, সহযোগিতা নিয়ে; তো 'চ্যানেল আই' এই সব মোবাইল কোম্পানি থেকে কত টাকা পায় এমন সব অনুষ্ঠান আয়োজনে, তা তারা কোনো দিন জানাবে না। তথ্যমন্ত্রী, তথ্য সচিব, বিটিভির 'ডিজি'র বেতন-ভাতা এবং অন্যসব সুযোগ-সুবিধা সরকারি গেজেটেই পাওয়া যায়। এইসব তথ্য ইন্টারনেটেও দেখা যায়। আমাদের সচিবদের বেতন নূতন পে কমিশনের সুপারিশে বর্তমানের চল্লিশ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আশি হাজার টাকা করা হবে– এই তথ্য সব রকমের গণমাধ্যমে দেশের সকলেই জেনে গেছেন। তাহলে আমাদের তথ্য সচিবের বেতন এখন কত এবং বাড়ালে কত হবে সবই 'পাবলিক নলেজ'।

কিন্তু 'চ্যানেল আই'এর মালিকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা কোথাও কি পাওয়া যাবে? 'চ্যানেল আই'এর একটি বিজ্ঞাপনে দেখানো হচ্ছে, কোনো এক সুন্দরী প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠান তারা এইবার আয়োজন করবে কাতারে। কত শত শত লোককে কাতারে নিয়ে যেতে হবে এই অনুষ্ঠানের জন্য। তাতে কত কত কোটি টাকা খরচ হবে? এই টাকা কে দিচ্ছে? কেন দিচ্ছে?

কিন্তু, এই শীতকালে কোনো একজন দুঃস্থ লোককে 'চ্যানেল আই' একটি কম্বল দিয়েছে বলে কি কোথাও কোনো খবর কেউ দেখেছে? 'Greed is Great', 'In Greed We Trust' নীতিতে দেশের গার্মেন্টস মালিক, আদম ব্যবসাযী, ভূমিদস্যুদের মতো 'অ্যাটকো'র এইসব সদস্যও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তবে, 'অ্যাটকো'র সব সদস্য সমানভাবে সফল হচ্ছে না। কোনো কোনো চ্যানেল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু, সকল সদস্য 'করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি'র কথা হয়তো কোনোদিনই শোনেনি।

দুই

বাংলা ভাষার প্রথম টিভি চ্যানেলটি চালু হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথমে একটি পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট হিসেবে। তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম টিভি স্টেশনটি চালু হয়েছিল লাহোরে, তারপর ঢাকায়। উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তানের লৌহমানব প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৬৫এর ২ জানুয়ারি, মানে ঢাকাতে এই টিভি স্টেশন চালু হওয়ার মাত্র ৭ দিন পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচন হয়। প্রার্থী ছিলেন এই ফিল্ড মার্শাল, তার তিন প্রতিদ্বন্দ্বী– মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের বোন মোহতারেমা ফাতিমা জিন্নাহ এবং এক বাঙালি— তার নাম ছিল কামাল; অন্য জন আরেক পশ্চিম পাকিস্তানি, এখন আর নাম মনে করতে পারছি না। প্রেসিডেন্ট পদে এই পরোক্ষ নির্বাচনে ভোটার ছিল মোট ৮০ হাজার– পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ হাজার, বাকিরা পশ্চিম পাকিস্তানের। তাদের বলা হত 'বেসিক ডেমোক্রেটস', সংক্ষেপে 'বিডি'— পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের এক প্রধান বিচারপতি, এম আর কায়ানীর (মালিক রুস্তম কায়ানী) বর্ণনায় 'বার্ডস অ্যান্ড বিস্টস অব পাকিস্তান', বাস্তবে এরা ছিল তখনকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য।

প্রত্যাশিতভাবেই আইউব খান নির্বাচনে বিজয়ী হলেন; তবে, সারা পাকিস্তানের সবচাইতে কম ভোট পেলেন আমাদের ফেনীতে; সব থেকে বেশি ভোট পেলেন ফাতিমা জিন্নাহ। ফেনী তখন একটি মহকুমা, 'সাবডিভিশন'।

১৯৬৬ এর ৭ জুন ৬ দফা দাবির আন্দোলনে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এই দিন মনু মিয়াসহ ১০ জন নিহত হন, আহত হন অনেকেই। কিন্তু টিভিতে এর কোনো উল্লেখ ছিল না, যেমন থাকে না এখন বিটিভিতে বিরোধী দলগুলোর কোনো খবর। তবে উল্টো কিছু ঘটনা তখন বাঙালিদের আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। টিভি রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তখন। ঘোষণা করলেন ফিল্ড মার্শালের বাঙালি তথ্যমন্ত্রী, ঢাকার নওয়াব এবং খাজা পরিবারের এক সদস্য, খাজা শাহাবউদ্দিন। এই 'নওয়াবজাদা' আইউব খানকে নিয়মিতই উস্কাতেন বাঙালিদের বিরুদ্ধে।

আইউব খানের বাঙালি-বিদ্বেষের এই প্রকাশ দেখি ১৯৬৭তে প্রকাশিত তার 'ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স' নামের ২৭৫ পৃষ্ঠার বইটির ১৮৭ পৃষ্ঠার এই কথাগুলোতে:

'It would be no exaggeration to say that up to the creation of Pakistan, they had not known any real freedom or sovereignty. They have been in turn ruled either by the caste Hindus, Moghuls, Pathans, or the British. In addition, they have been or still are under considerable Hindu cultural and linguistic races and have not yet found in possible to adjust psychologically to the requirements of the new-born freedom.'

বাংলা ভাষার প্রথম টিভি চ্যানেল চালু হল ঠিকই, কিন্তু বাঙালির ভাষা, আশা-প্রত্যাশা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চর্চার বাহন হয়ে উঠতে পারল না এই টিভি স্টেশনটি, ১৯৭১এর মার্চের আগে। মার্চ মাসে জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলেন ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ। আর তখন থেকে টেলিভিশনের বিক্ষুব্ধ বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা যে ঐতিহাসিক নন্দিত ভুমিকা রাখলেন, তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গৌরবজনক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কিন্তু এই টেলিভিশনে– স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভিতে কলঙ্কের সৃষ্টি হল যখন টেলিভিশনের ৪ জন কর্মকর্তাকে হত্যা করা হল ১৯৭৫এর নভেম্বরে। দ্বিতীয় কলঙ্কটি হল, বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণে কারফিউ জারি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে– জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসনামল এবং খালেদা জিয়ার প্রথমবারের শাসন পর্যন্ত– অর্থাৎ প্রায় একুশ বছর, মাঝখানে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েক সপ্তাহ ছাড়া। খালেদা জিয়া পরে, ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় এলেন, তখনও কারফিউ জারি ছিল বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণে।

মূলত বাংলা ভাষার এই প্রথম টেলিভিশনটি চালু হয়েছিল জামিল চৌধুরীর নেতৃত্বেই। তাঁকে শুরু থেকেই প্রবলভাবে সাহায্য করলেন সঙ্গীত জগতের এক বাতিঘর, কলিম শরাফী। এই জামিল চৌধুরীকে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছিল রামপুরার টিভি ভবনে সেদিন, কিন্তু আগেই তাঁকে কেউ সতর্ক করে দিয়েছিল বলে তিনি সেদিন অফিসে যাননি।

জামিল চৌধুরীর ভূমিকার কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এই টিভিতে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু করলেন। চেক লিখতে শুরু করলেন বাংলায়। ব্যাংক যখন আপত্তি তুলল, প্রশ্ন তুলল, তিনি বললেন, কেন বাংলায় লেখা চেক গ্রহণ করা হবে না, তা লিখিত জানাতে হবে। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর এমন অঙ্গীকার পরে আরও দেখেছি অনেক বার। ১৯৬৪ সালে জামিল চৌধুরী যখন টিভির দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর বয়স ত্রিশের আশেপাশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকসের এক তরুণ শিক্ষক।

জামিল চৌধুরী ১৯৭৫এর নভেম্বরে রামপুরার টিভি ভবন সেই যে ছাড়লেন, আবার গেলেন সেখানে, মাত্র সেদিন, প্রায় চল্লিশ বছর পর, বিটিভির পঞ্চাশ বছর উদযাপনের প্রস্তুতিসভায়।

তিন

বিটিভি অনেক কিছু দিয়েছে এই দেশ, এই জাতিকে। এই বিটিভিতেই মেধা-প্রতিভার চমৎকার বিকাশ দেখা গেল মোস্তফা মনোয়ার, আবদুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, খালেদা ফাহামি, নওয়াজেশ আলী খান, মোস্তাফিজুর রহমান, ম. হামিদ, হানিফ সংকেত এবং সরকার ফিরোজদের প্রযোজিত অনুষ্ঠানসমূহে।

তবে, বিটিভি একাত্তরের মার্চের পর বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রচারে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। কিন্তু, বিটিভির কোনো কোনো বিষয়ে 'সমাজের বিবেক'দের মাতম আর্তনাদে আমি কৌতুক বোধ করি। বিটিভি সরকারের একটি প্রচারযন্ত্র– তাদের একটি নিরন্তর অভিযোগ। তো, বিটিভি যদি নিউজ বুলেটিনগুলোতে মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতানেত্রীদের কথাবার্তা, কর্মকাণ্ডে বেশি বেশি আচ্ছন্ন থাকে, প্রাইভেট চ্যানেলগুলোও তো তাদের মালিক, মালিকদের স্ত্রী, মা, বোন, বোন জামাইদের প্রচারের বাহন হয়ে উঠেছে।

'সময়' টেলিভিশন আমি দেখা বন্ধ করে দিয়েছি; কারণ এই চ্যানেলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে কি দেখতেই হবে প্রতিদিন প্রতিটি নিউজ বুলেটিনে? বাচাল স্বভাবের এই মন্ত্রীপ্রবর তার মন্ত্রিত্ব ধরে রাখার জন্য উগ্র কথাবার্তা বলেই চলেছেন। তিনি শেখ হাসিনার আগের সরকারে আইন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে কয়েক হাজার দাগী অপরাধীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। শুনি, কাগজপত্রে এই চ্যানেলের মালিক এই খাদ্যমন্ত্রীর ভাই– মোরশেদুল ইসলাম। তো, এই মোরশেদুল ইসলাম নাকি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব– আলী জাকের, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদদের গোত্রের একজন। এমন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের এমন অধঃপতনটা হল কেন?

তারপর, ট্যাক্স না দিলে 'একুশে' টেলিভিশনের মালিক আবদুস সালামের বিরুদ্ধে কি তদন্ত চালানো যাবে না? তা-ও কি রাজনৈতিক হয়রানি হিসেবে 'একুশে' টিভির খবরে প্রচার করতে হবে?

বিটিভি একসময় বিশাল পরিমাণে লাভ করেছে, এখন দিচ্ছে লোকসান, কোটি কোটি টাকা। না, এই অবস্থা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। আদমজী জুট মিলস যদি বন্ধ হয়ে যায়, বিটিভিও যদি প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে, স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধ হয়ে যাবে। বিটিভির লোকসানের টাকা দিয়ে লক্ষ লক্ষ শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ বেশি জরুরি; রানা প্লাজা ও তাজরিন গার্মেন্টসের নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি মালিকানার পত্রিকা দৈনিক বাংলা, ব্যক্তিমালিকানার পত্রিকা দৈনিক আজাদ, দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বোধহয় দৈনিক ইনকিলাব এবং দৈনিক জনকণ্ঠও বন্ধ হয়ে যাবে। ইনকিলাবের জায়গা দখল করে নিয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত; আর জনকণ্ঠও এখন 'বাংলার বাণী' হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথবা আওয়ামী লীগের 'দিনকাল'।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইংরেজি সাপ্তাহিক 'নিউজ উইক' এক বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দুনিয়ার এক নম্বর বিমান সংস্থা 'প্যান অ্যাম' বন্ধ হয়ে গিয়েছে ত্রিশ বছর আগে। নতুন ধ্যান-ধারণা, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে বন্ধ হয়ে যাবে, তাই তো 'ক্যাপিটালিজম'এর মূল কথা। এই দেশে তো এখন 'ক্যাপিটালিজম'এরই রমরমা অবস্থা। বিটিভি বন্ধ হয়ে গেলেও দেখতে হবে এটি যেন বাংলাদেশের লুটেরা ক্যাপিটালিস্টদের হাতে না পড়ে। ঋণখেলাপীরা যেন রুগ্ন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আরও ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার জমিজমা, ভবন, বাড়িঘর, যন্ত্রপাতি দখলে নিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আর যদি বিটিভিকে রাখতেই হয়, টেরেস্ট্রিয়াল সুবিধা উন্মুক্ত করে দিতে হবে; সকল চ্যানেল যেন সমানভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

চার

আশির দশকে বিটিভির সুবর্ণ সময় গিয়েছে বলে মনে হয়। তখন এরশাদ জমানা। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় নাটকগুলোর প্রচারও তখন থেকে শুরু। বিটিভির মানুষজন স্বীকার করেন যে, এরশাদ সামরিক স্বৈরশাসক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু অনুষ্ঠান নির্মাণে তার বা তার সামরিক সরকারের তেমন কোনো হস্তক্ষেপ, আপত্তি ছিল না। তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছেন নিউজ বুলেটিনগুলো; তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তাকে, তার অফিসিয়েল স্ত্রী রওশনকে, তার বান্ধবীদের এবং তার সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে 'ক্রিটিক্যাল' কিছু প্রচার করা যাবে না। প্রবলভাবেই সফল হয়েছিলেন তিনি এই ক্ষেত্রে।

তবে বিটিভির খবরের ক্ষেত্রে যে ঘাটতি ছিল তা তখন পূরণ করে দেয় 'বিবিসি বাংলা', 'ভয়েস অব আমেরিকা'। এই বিদেশি রেডিওগুলোতে প্রচারিত দেশের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। এখনও আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা দেশীয় গণমাধ্যমের চাইতে 'বিবিসি বাংলা' রেডিওতে একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ বোধ করেন। 'বিবিসি বাংলা'র গুরুত্ব এত সব দেশীয় গণমাধ্যমের বিস্ফোরণ সত্ত্বেও প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। বিবিসির 'বাংলাদেশ সংলাপ' এখন আমাদের অকার্যকর জাতীয় সংসদের ভূমিকাই পালন করে চলেছে। এখানে সরকার পক্ষ, বিরোধী পক্ষ, নির্দলীয় পক্ষ– সকল পক্ষেরই উপস্থিতি থাকে। 'বাংলাদেশ সংলাপ'কে কোনো পক্ষই বর্জন, বয়কট করে না।

আমি বিশ্বাস করি, এরশাদ যে এত বছর ক্ষমতায় থাকলেন, তার অনেকটুকু কৃতিত্ব এই বিটিভিরই। তিনি হাঁটুজলে হাঁটছেন, মানুষের সঙ্গে মিশছেন, হঠাৎ হঠাৎ নিজে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা শহরের অবস্থা দেখতে বের হচ্ছেন, এমনসব দৃশ্য মানুষজনকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছে তখন। সে অবস্থা অবশ্য বাংলাদেশের চব্বিশটি টিভি চ্যানেলের সরব উপস্থিতির কারণে এখন আর নেই।

চল্লিশ বছর আগের তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী থেকে শুরু করে মাঝখানে আকবর কবীর, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আকবর কবীরের জামাতা নাজমুল হুদা এবং এখনকার বিপ্লবী তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুরা, কেউই তো বিটিভিকে প্রত্যাশিত ভূমিকায় রূপান্তর করতে পারলেন না। তার মানে, বাংলাদেশের সবগুলা বড় দলের এত জন তথ্যমন্ত্রী যখন বিটিভিকে বদলাতে পারলেন না, তখন বিটিভিকে আর পরিবর্তন করা যাবে না। অথবা বলা যেতে পারে, আমরা যেমন চরিত্রের, তাই প্রতিফলিত হচ্ছে বিটিভিতে। সুতরাং এই পাপ আপনার, আমার– আমাদের সকলের।

এখন, টেলিভিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে একটি আমোদজনক অভিজ্ঞতা।

পঁচিশ বছর আগে আমি তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। আমার অফিসে একদিন আমার পাশের গ্রামের একজন, বয়স তিরিশ-পঁয়ত্রিশ, পেশায় বিটিভির এক ক্যামেরাম্যান, খুব গল্প করছিলেন– তাঁর এলাকায় তিনি কতসব উন্নয়নমুলক কাজ করে যাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এতসব সরকারি সাহায্য তিনি কীভাবে যোগাড় করছেন। একটু হাসতে হাসতে বললেন: ''স্যার, আমি মাননীয় মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে বলি, আমাকে আমার চাহিদামতো সাহায্য করলে আপনার মুখের ছবি তুলব, কিন্তু আমার কথা না শুনলে আপনার ঠ্যাংএর ছবি যাবে খবরে। জানেন তো স্যার, আমাদের মন্ত্রীরা প্রচারের জন্য কত কাতর থাকেন।''

তাঁর কথায় সেদিন প্রত্যক্ষভাবেই বিটিভির ক্ষমতা আবার বুঝেছিলাম। তারপর, মন্ত্রী-নেতাদের এমন চরিত্র আরও দেখেছি। এখনও দেখছি।

সেদিন বিটিভির পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আরেকটি আমোদজনক দৃশ্য দেখলাম। 'এসএসএফ'এর এক কর্মকর্তা একটি চিরকুট দিলেন বক্তৃতারত তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওই চিরকুটে তথ্যমন্ত্রীকে বক্তৃতা সংক্ষেপ করতে বলা হয়েছিল। বুঝলাম, বিটিভির ক্যামেরাম্যানদের চাইতে 'এসএসএফ'এর এই 'বালকরা' অবশ্যই বেশি ক্ষমতাবান।

'শিউলীতলা', উত্তরা; শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৪।

মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক; শৌখিন মিডিয়া মনিটর।