ডক্টর ইউনূস: রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরিস্থিতির শিকার

ফরহাদ মজহার
Published : 1 July 2009, 11:10 AM
Updated : 4 March 2011, 02:47 PM

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন প্রফেসর ডক্টর ইউনূস। এই ক্ষেত্রে তাঁর দোষ বা অপরাধের মাত্রা কতটুকু নাকি পুরাটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরিস্থিতির ফলাফল–সেই তর্ক বিস্তর করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা এখন হবে কূটতর্ক। তাঁর নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেবার যে নজির আমরা দেখছি তার নিন্দা না জানিয়ে উপায় নাই। এটাও লক্ষ্যণীয় যে তাঁকে হেনস্থা করবার কৌশল হিসাবে আইন-আদালতের ঘাড়ের ওপর বন্দুক রাখা হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার আইন-আদালতকে নিজেদের স্বার্থে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে এই নালিশ নতুন কিছু নয়। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ১৪(ক) ধারাকে এবার কাজে লাগানো হয়েছে। ডক্টর ইউনূস জানিয়েছেন তিনি আইনী জায়গা থেকে লড়বেন। বলা হয়েছে তাঁর ৬০ বছর বয়স অনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে, এখন তাঁর বয়স ৭০। আইন দিয়ে সব কাজকে যুক্তিসিদ্ধ করা যায় না। বাংলাদেশে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে এমন মন্ত্রীও আছেন যাঁদের ৬০ বছর বহু আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রেসিডেন্টের বয়স নিয়েও আমাদের কোন অভিযোগ নাই। অতি বিনয়ের সঙ্গেই বলছি, যদি আমাদের অর্থমন্ত্রী পুরা বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় সক্ষম হতে পারেন, তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ডক্টর ইউনূস পালন করতে পারবেন না কেন? ডক্টর ইউনূস তাঁর পদ ধরে রাখতে চান বলে মনে হয় না, তিনি পরিষ্কার বলছেন, তিনি সুন্দরভাবে তাঁর নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে সরে আসতে চান। এই ভদ্রতা ও সৌজন্য পাবার অধিকার তাঁর আছে। তাঁর সমালোচনা-পর্যালোচনা এক কথা, কিন্তু তাঁকে হেনস্থা করবার এই প্রক্রিয়াকে নিন্দা জানানো অবশ্যই দরকার। বিশেষভাবে আমরা যাঁরা ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচীর সমালোচক এবং এক এগারর ঘটনাঘটনে তাঁর ভূমিকা এবং সেই সময় তাঁর রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়াকে সমালোচনা করেছি। তিনি সৎ ও সজ্জন। তাঁর ব্যক্তিগত সততা সম্পর্কে সন্দেহ অমূলক ও অর্থহীন। গ্রামীন ব্যাংক পরিচালনায় ভুলত্রুটি বা অনিয়ম ঘটেছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখবার ক্ষেত্রেও তিনি কখনই আপত্তি করেন নি।

মানি যে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত সরকারের ক্ষমতারোহনের সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু তাকে সামনে রেখে সেনা সমর্থিত সরকার গঠনের প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেন নি। যে কারণে ফখরুদ্দিন আহমদকে আমরা প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে পেয়েছি, ডক্টর ইউনূসকে নয়। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতা যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন নতুন দল করবার ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ তৎপরতার সুযোগ পাওয়াকে সহজভাবে নেবার সুযোগ খুব কম। কিন্তু তিনি তো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য সেই সময়টা তাঁর জন্য অসময় ছিল। আমরা আশা করতে পারি তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সময়মত গুটিয়ে নিয়েছেন। এটাও ঠিক তাঁকে কেন্দ্রে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলোর চেষ্টা এতে বন্ধ হয়ে যায় নি। যে কারনে তারা জোট বেঁধেই ডক্টর ইউনূসের পক্ষাবলম্বন করছে। জোট সরকারের ওপর নানা ধরনের কূটনৈতিক চাপ দিয়ে চলেছে। ফলে অর্থমন্ত্রীকে সভা ডেকে ঢাকার কূটনৈতিক মহলকে বোঝাতে হয়েছে যে কোন বিদ্বেষবশত ডক্টর ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয় নি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আর কোন উপায় ছিল না। এটা নাকি নিছকই আইনী ব্যাপার। বলাবাহুল্য, আমরা তাঁর কথা বিশ্বাস করতে পারি নি।

তাঁকে যখন "গরীবের রক্তচোষা" বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গালি দিলেন তখন আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল চার রকম বা চার ধরনের। প্রথমে খুবই খারাপ লাগলো। অন্য আরো অনেকের মতো আমি ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচীর সমালোচনা করে এসেছি বরাবরই। উন্নয়ন নীতি হিসাবে বা যদি আরো বৃহৎ পরিসরে বলি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তর দূরে থাকুক এই কর্মসূচী দিয়ে ইতিবাচক অর্থনৈতিক সংস্কারের সম্ভাবনা কতোটুকু সেই বিষয়ে অনেকেই সবসময় সংশয় প্রকাশ করেছেন, সন্দেহ করেছেন। এতে গরিবী আসলে কমে কিনা সেটাও সংশয়াপন্ন। ক্ষুদ্র ঋণ বা সুদের কর্মসূচীকে নৈতিকতার জায়গা থেকে সমালোচনা করেও আমরা বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারব না। যেমন, বলা হয়ে থাকে, ডক্টর ইউনূস সুদখোর মহাজনের ভূমিকা পালন করেছেন। নৈতিক অধঃপতনের অধিক সমালোচনা বামপন্থীদের কাছ থেকেও আমরা পাই নি। নিউ লিবারেলিজম বা অর্থনৈতিক নয়া উদারনীতিবাদ বা অবাধ বাজার ব্যবস্থা যে যুগে আন্তর্জাতিক মূদ্রা ব্যবস্থা বা মূদ্রার বিচলনের মধ্য দিয়ে নিজের পুঞ্জিভবন নিশ্চিত করে সে দিকে নজর না দিলে আমরা ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্ম ধরতে পারব না। মুদ্রাপুঁজির যে বিশ্বব্যাপী চলন সে প্রক্রিয়া থেকে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী বিচ্ছিন্ন বা আলাদা কিছু নয়। একে কুসিদজীবিতা বলে নিন্দা করলে সুদ সম্পর্কে মোল্লা মওলানাদের সমালোচনার মতোই শোনায়। যেমন সুদ খাওয়া হারাম, ইত্যাদি।

প্রগতিশীল জায়গা থেকে মূল প্রশ্নটা সবসময়ই ছিল একটি সফল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সকল প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক সমূলে উচ্ছেদ করে দিয়ে বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের 'দ্রুত ও ত্বরান্বিত' বিকাশ কীভাবে সম্পন্ন করা যায়। যদি তা না হয় তাহলে পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া একটা দীর্ঘ, কষ্টকর ও নির্মম প্রক্রিয়ার মধ্যে খাবি খাবে এবং জাতীয় চরিত্র বর্জিত হবে। বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতির ব্যর্থতা যে বিশাল ফাঁকি তৈরি করেছে তার মধ্যেই ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির উত্থান এবং তার পেছনে ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলোর সমর্থনের রাজনীতি আমাদের বুঝতে হবে। এই তর্কগুলো আমরা জারী রাখতে পারি, কিন্তু এখন ডক্টর ইউনূস রাজনৈতিক কারনে যেভাবে হেনস্থা হচ্ছেন তাতে এই সকল জাতীয় প্রশ্নের কোন মীমাংসা হবে বলে মনে করবার কোন কারন নাই।

গরীবদের ঋণ দেবার জন্য একটি বিশেষ ব্যাংক তো থাকতেই পারে। ব্যাংকের শেয়ারের মালিক গরিবরাই কিনা, এতে গরিবী কমে কিনা বা গরিবের ক্ষমতায়ন হয় কিনা ইত্যাদি উন্নয়নবাদী তর্কেও যাবার দরকার নাই। ব্যাংক মাত্রই একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই গরিবদের ঋণ দেয় এমন একটি ব্যাংক যদি গরিবদের টাকা ভাড়া দিয়ে সুদ তুলে সেই সুদ দিয়ে নিজেই নিজের খরচ চালাতে পারে, তাহলে সেটা কম কীসের! এর খারাপ দিক তো থাকবেই, এই ধরনের ব্যাংকের সুদের হার বেশী হতে বাধ্য। অন্য ব্যাংক নানানভাবে টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে পারে বলে তাদের সুদের হার তারা কম রাখতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব কি? কিন্তু ডক্টর ইউনূস নিজে মুনাফা কামাবার জন্য বা নিজের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন নি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদ মতলবে টাকা সরিয়েছেন সেটা বিশ্বাস করাও কঠিন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকগুলো গরিবদের ঋণ দেয় না, তিনি একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন গরিবদের জন্যই। কিন্তু গরিবদের রক্ত চুষে নেবার জন্য তিনি নিজের জীবন ব্যয় করেছেন– এর চেয়ে নিষ্ঠুর কোন মন্তব্য আর হতে পারে না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তিনি গরিবের রক্তচোষার বিশ্বব্যবস্থা থেকে আমাদের নজর সরিয়ে এনে জনগণের ক্রোধ ব্যক্তি ইউনুসের দিকে ধাবিত করতে চেষ্টা করেছেন। এতে তাঁকে মহৎ মনে হয় নি।

দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হোল এরকম: সরকার যদি বাংলাদেশে গরিবের রক্তচোষাদের আসলেই খুঁজে বেড়াতে চান তাহলে তো ভালই হয়। রাজনীতি ও ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে নিশ্চয়ই আরো ভয়ানক ও ভয়ঙ্কর 'রক্তচোষা'-দের খুঁজে বের করা যাবে। তাহলে তো মন্দ হয় না। এটা করতে গেলে জাতীয় সংসদের পুরাটাই বোধহয় খালি হয়ে যাব। এমনকি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আরো যে সকল বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গরিবদের রক্ত চুষে বেড়াচ্ছে সরকার নিশ্চয়ই তাদেরকেও আচ্ছা শিক্ষা দেবেন, ব্যবসায়ী মহলেও তুমুল হৈ-হট্টগোল বাঁধবে। কিন্তু তেমন কোন তৎপরতা আমরা দেখলাম না। নিজের আশে পাশে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা আর কাউকে খুঁজে পেলেন না। বেশ।

তৃতীয় প্রতিক্রিয়া হোল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বৃত্তি বা নজরদারি সম্পর্কে। শেখ হাসিনা সম্ভবত ঠিকই ধরেছেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামাত জোট তাঁর প্রতিপক্ষ হবার মতো অবস্থানে সহজে যেতে পারবে না। দমন পীড়নের মুখে তারা দাঁড়াতেও পারছে না। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার জন্য জনগণ বিকল্প পথের সন্ধান খুঁজবে। সেই দিক থেকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে সেই এক এগারর সুশীল সমাজ। সে ক্ষেত্রে ডক্টর ইউনূস আসলেই এখনও রাজনৈতিক হুমকি হয়েই বিরাজ করছেন। ডক্টর ইউনূস রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইতেই পারেন, ন্যাড়া বেলতলায় দ্বিতীয়বার যায় না, বলেছেন তিনি। কিন্তু কূটনৈতিক মহলের তৎপরতা দেখে মনে হয় তারা এখনও আশা ছাড়ে নি। এই বিবেচনা থেকে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ডক্টর ইউনূসকে জনগণের চোখে হেয় ও অপদস্থ করা রাজনৈতিক দিক থেকে দরকারী কাজ মনে করতেও পারেন। কিন্তু এর ফলে ডক্টর ইউনূসের প্রতি সাধারণ মানুষের সহমর্মিতা বাড়বে। সরকারের আচরণকে ভালভাবে নেবে না সাধারণ মানুষ।

চতুর্থ প্রতিক্রিয়া হোল, এই মন্তব্যের ফলে রাজনৈতিক মেরুকরণের রূপ কী হতে পারে? বলাবাহুল্য, বিএনপি এই সুযোগটা নিজেদের দলীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইবে। ডক্টর ইউনূসের পক্ষাবলম্বন করাটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। তারা সেটাই করেছে এবং করবে। এর ফলে তাদের রাজনীতির ঝুড়িতে নগদ কোন অর্জন জমা হবে হবে কিনা সেটা এই মূহুর্তে বলা মুশকিল। বাংলাদেশের জনগণের মন ডক্টর ইউনূস কতোটা জয় করতে সক্ষম সেটা তার রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রচেষ্টার সময় আমরা দেখেছি। কিন্তু ইতোমধ্যে পানি অনেক গড়িয়েছে এবং বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া মহাজোট সরকারের রূপ ও চেহারাও জনগণ দেখছে। ডক্টর ইউনূস রাজনীতি করবেন না, ঠিক আছে, কিন্তু তিনি চান বা না চান তাঁকে কেন্দ্র করে রাজনীতির একটা মেরুকরণ ঘটবে যেখানে পরাক্রমশালী দেশগুলো ভূমিকা রাখতে দ্বিধা করবে না। দ্বিধা করছেও না। ডক্টর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে তারা যে খুব খারাপ চোখে দেখছে সেটা তো এখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ্যেই তারা বলছে। তারা 'অসন্তুষ্ট ও বিচলিত' (দেখুন প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০১১)।

অনেকে এই বলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ডক্টর ইউনূসের অপসারণের নিন্দা জানাচ্ছেন যে এতে শুধু সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এমনকি শুধু ডক্টর ইউনূস বা গ্রামীণ ব্যাংকও নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। সাধারণ মানুষের দিক থেকে যদি আমরা দেখি ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হোল, কিম্বা বিরোধী দল খুশিতে বগল বাজালো তাতে কী এসে যায়! অনেকের দাবি, তাঁকে দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশের 'ব্রান্ডিং' করছি। কথাটা একদম উড়িয়ে দেবার নয়। কিন্তু এই 'ব্রান্ডিং' কাদের ব্রান্ডিং? সাধারণ মানুষের স্বার্থের জন্য? নাকি বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার জন্য হাজির করছি ডক্টর ইউনূসকে যিনি এখন শুধু গরিবের জন্য ঋণের কথা বলেন না, বহুজাতিক কোম্পানিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা ও মুনাফা কামাবার সুযোগ করে দেবার জন্য 'সোশ্যাল বিজিনেস'-এর কথাও বলেন। তিনি নোবেল পুরস্কার পান নি, পেয়েছেন নোবেল 'শান্তি' পুরস্কার। এই পুরস্কার দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। পরাশক্তির অন্দরমহলে তাঁর কদর নিয়ে তর্কের কিছু নাই। তাঁর আগে কোন বাংলাদেশী যেখানে ধারে কাছে পৌঁছাতে পারে নি সেখানে ডক্টর ইউনূস পরাশক্তির ঘরের মধ্যে স্থান পেয়েছেন। সেটা অবশ্যই তাঁর কৃতিত্ব। তাঁর এই অর্জনকে আমরা হাল্কা করে দেখব না। পরাশক্তির অন্দর মহলে যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করা হোত, যে বাংলাদেশ অনাহার, অপুষ্টি ও অসুখের দেশ, বন্যা ও দুর্যোগের দেশ ইত্যাদির অধিক কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে নি, সেখানে বাংলাদেশ ডক্টর ইউনূসের দেশ বলে এখন স্বীকৃত। ভাবমূর্তির এই দিকটাকে আমরা গৌণ করব না। কারন আমরা বাংলাদেশে এমন কোন মহাবিপ্লব করে ফেলতে পারিনি যাতে আমরা ভিন্ন কিছু নিয়ে জনগণের পক্ষ হয়ে গর্ব করতে পারি। ডক্টর ইউনূসকে সমালোচনা ও নিন্দা করা সহজ, কিন্তু নিজেদের ব্যর্থতার দিকেও সমানভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
কিন্তু ভাবমূর্তির কথা তুললে প্রশ্ন ওঠে, কান টানলে মাথা আসে। ডক্টর ইউনূসের এই ভাবমূর্তি বাংলাদেশের পরাধীনতার প্রক্রিয়াকে বেগবান করবার কাজে লাগতে পারে, কিন্তু বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবার ক্ষেত্রে কী কাজে লাগবে? বিদেশী মোবাইল কোম্পানি বলি, হাইব্রিড বীজের কম্পানি বলি, বা দইয়ের কম্পানি বলি – ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির ওপর সোয়ার হয়েই তারা বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিয়েছে, নিচ্ছে এবং নিতে থাকবে। ক্ষুদ্র ঋণই দারিদ্র বিমোচনের পথ কিনা সেই তর্কও আমরা তুলে রাখতে পারি না। ক্ষুদ্র ঋণে গরিব আরো গরিব হয়েছে, অনেকে কিস্তি দিতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছে তার নজির আছে। অতএব ভাবমূর্তির কথা বলে ডক্টর ইউনূসকে সমর্থন করবার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

বরং আমাদের অবস্থান হবে সোজা এবং সিধা। অর্থমন্ত্রী ডক্টর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। ডক্টর ইউনূস রাজনৈতিক বিদ্বেষ বা আক্রোশের শিকার, এটাই বরং স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ডক্টর ইউনূস রাজনীতি করতে না চাইলেও বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক শক্তির হস্তক্ষেপের অজুহাত হয়ে ওঠেন, এটা আমরা চাই না। দ্বিতীয়ত, ডক্টর ইউনূস সম্মানের সঙ্গে তাঁর নিজের হাতে গড়া সংগঠন থেকে সরে আসতে চাইছেন। তাঁকে তার মত করে সম্মানজনকভাবে সরে আসার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। আইন-আদালত করে তাঁর এইভাবে বেরিয়ে আসতে হবে কেন?

এমনকি নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর একদমই বেরিয়ে আসারই বা কী দরকার? এই ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে সবচেয়ে ভাল পদক্ষেপ হবে তাঁকে পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে রাখা। পরিচালনা পরিষদ এরপর গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য একজন যোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে বের করুক।

২০ ফাল্গুন, ১৪১৭। ৪ মার্চ ২০১১।