রৌরব (কিস্তি ১০)

লীসা গাজী
Published : 18 May 2009, 06:09 PM
Updated : 18 May 2009, 06:09 PM

(কিস্তি ৯-এর পর)

ফরিদা টের পেলেন গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে, ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। গলা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করলেন একবার—দ্বিতীয়বার গলা খাকারি দেয়ার শব্দে মুখলেস সাহেব চোখ মেলে তাকালেন। ফরিদাকে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্কুলের ছাত্রের মতো প্রায় এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়তে চেষ্টা করলেন। যেন না দাঁড়ালে কড়া হেড মিস্ট্রেস তাকে এক্ষুনি নিল-ডাউন করিয়ে রাখবে। কিন্তু শরীর তাকে সেই অনুমতি দিলো না। তাই কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন।

—চা খাইবা?

মুখলেস সাহেবের ঘুমের ঘোর তখনও কাটে নাই। চোখ কচলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
—————————————————————–
অন্ধকারেই ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ার খুলে তার ভিতরের রাজ্যের জঞ্জালের নিচে ছুরিটা আপাতত লুকিয়ে রাখলো। এখন সবচেয়ে নিরাপদ কাজ নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া। কে যেন কবে বলেছিলো অন্ধকারে নামায পড়া যায় না—কে আর বলবে ফরিদাই বলেছিলেন সম্ভবত, কথাটা মনে পড়তে দোটানায় পড়ে গেলো লাভলি। শেষমেশ আলো জ্বালিয়ে নামাযের জায়গায় দাঁড়ালো। যা হবার হবে, মেরে তো আর ফেলতে পারবে না। মেরে ফেললে অবশ্য এর চেয়ে ভালো ছিল।
—————————————————————-
—চা খাইবা না কি?

—হ্যাঁ খাবো। লাভলি আসছে?

আচমকা ঘুম ভাঙার জন্যই বোধহয় মুখলেস সাহেব তার যাবতীয় বোধ-বুদ্ধি খুইয়েছেন। নইলে জ্ঞানত তিনি কখনও উস্কানিমূলক প্রশ্ন করেন না। ফরিদা প্রশ্নের আশ্চর্যরকম শান্ত উত্তর দিলেন। নিজের শান্ত গলার আওয়াজ শুনে খুব সন্তুষ্ট হলেন—" না, এখনও আসে নাই। আসবে সময় মতো।"

—হ্যাঁ হ্যাঁ, চইলা আসবে। চলো চা খাই মাথাটা ধরা ধরা।

কোনো রকমে লাভলির প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিয়ে বারান্দা থেকে বের হলেন। প্রায় সারাটা দিন আজকে তার বারান্দাতে বসেই কাটাতে হয়েছে। বেতের চেয়ারে এক নাগারে বসে থেকে কোমর থেকে শরীরের উপরের অংশে রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তাই একটু তাল হারালেন।

—কী হইছে? মাথা ঘুরে না কি?

—না না, অনেকক্ষণ বইসা ছিলাম…।

ফরিদার পাশ দিয়ে কুণ্ঠিত মুখলেস সাহেব বেরিয়ে গেলেন, ফরিদা তার পিছে পিছে গেল। খাবার টেবিলে চা দেয়া হয়েছে। সিঙ্গারাও হয়তো এক্ষুনি ভাজা হয়েছে কারণ ছয়টা সিঙ্গারা থেকে ছয়টা চিকন ধোঁয়ার সূঁতা সোজাসুজি উপরে উঠে যাচ্ছে। ফরিদা চেয়ার টেনে বসলেন। সিমেন্টের মেঝেতে ছেঁচড়ে আসায় বিশ্রী রকম আওয়াজ হলো। সেই আওয়াজ শুনে মুখলেস সাহেব তার চেয়ারটা সাবধানে টানলেন। টেবিলে সিঙ্গারা দেখে এমনিতেই তার মেজাজ ফুরফুরা হয়ে গেছে।

—দুপুর থিকা ঘুমাইতেছো। যাও, হাত-মুখ ধুইয়া সুন্দরমতো আইসা বসো।

মুখলেস সাহেব কোনো তর্কে গেলেন না। চেয়ার আবার যথাস্থানে রেখে হাত-মুখ ধুতে গেলেন।

—খালাম্মা ছোট আপারে ডাকমু? সিঙ্গারা জুরায় যাবে।

ফরিদা কী যেন ভাবলেন। কোনো রকম শব্দ এখন সহ্য হবে না। 'ডাকো' বললেই রাবেয়ার মা বীরবিক্রমে বিউটির দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

—থাক, দরকার নাই। ঘুমাইতেছে মনে হয়, একটু পরে নিজেই উইঠা যাবে। আপার জন্য ডাইল বাইটা রাইখো।

—জি, ছোট আপা বলছেন।

মুখলেস সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন চেয়ারে শব্দ না করে বসতে। মুখ তখনও ভেজা ভেজা। ফরিদা তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তারা দু'জনেই দু'টা করে সিঙ্গারা খেলেন। গ্লাসভর্তি পানি খেলেন। তারপর চায়ে ছোট ছোট চুমুক দিতে লাগলেন। ফরিদা প্রত্যহ যেমন টুকটাক সাংসারিক কথাবার্তা বলেন, আজকেও সেই চেষ্টা করলেন।

—বাড়িতে যাবা কবে ঠিক করছো?

—মিয়াভাই ফোন করলে রওয়ানা দিতে বলছেন। তারা কিনার মানুষ ঠিক কইরা আমারে খবর দিবেন।

—কী কিনার মানুষ ঠিক করবেন?

—দাদা মশাইয়ের কিছু ভালো ধানী জমি আছে সেইগুলা।

—এখনই বিক্রি করবা কেন, রাইখা দেও পরে কাজে লাগবে।

—এতদিন তারা কিছু দিতেই চায় নাই। এখন না গেলে সবই হাতছাড়া হবে। বেশি দিন তো না, চার পাঁচ দিন।

—তাইলে আমরা সবাই মিলাই যাই চলো।

ফরিদার প্রস্তাবে মুখলেস সাহেব বাক্যহারা হলেন। তিনি মুখভরা চা গিলতে ভুলে গেলেন। সকাল থেকে চেনা ফরিদা দ্রুত বদলে যাচ্ছেন। এতটাই দ্রুত যে তার পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। এরকম প্রস্তাব তাদের প্রায় বিয়াল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি আর শোনেন নাই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই তার নাই। কোনো রকমে চা গিলে কৃতার্থ হওয়ার মতো একটা ভাব করলেন।

—যাওয়া যাবে? থাকার জায়গা ফায়গা আছে?

—আছে নিশ্চয়ই। দেখি, মিয়াভাই ফোন করলে জিজ্ঞাস কইরা দেখব।

—হ্যাঁ দেইখো।

মেয়ে দু'টাকে নিয়ে কোথাও অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে তাই যেতেন ফরিদা। হঠাৎ করে গ্রামে গিয়ে থাকার ভাবনা তার কাছে সে কারণেই বেশ মনোঃপুত হলো।

* * *

৯ নভেম্বর, শুক্রবার, ২০০৭। দিনটা শীত-দিনের সমস্ত চরিত্র ধারণ করে দ্রুত ১০ নভেম্বরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সন্ধ্যা নেমেছে ১১৫/৩ মনিপুরি পাড়ার গলির উপর। দূরে কোনো বাসা থেকে কচি বাচ্চার সুতীক্ষè কান্নার শব্দ সন্ধ্যার ফিকে আলো আঁধারির সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে। স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না—না আলো, না আঁধারি, না কান্না। শুধু একটা চাপ ধরা অস্বস্তি ফরিদার শিরায় শিরায় অনুভূত হচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ হলো শোবার ঘরের জানালার পাশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মধ্যে যদিও জানালার পাশের বেতের চেয়ারটায় একটু বসবেন ভাবছেন, কিন্তু বসছেন না। জানালা দিয়ে গলির রাস্তা বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তিনি তাকিয়ে আছেন। রাত নামছে টের পাচ্ছেন। রাতের যা চরিত্র—সব কিছুকে অন্তত তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। জ্বর বাড়ে রাতে, ব্যথা বাড়ে রাতে, ভয় বাড়ে রাতে, প্রেম বাড়ে রাতে। তার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটছে। ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন। মেয়েটা ফিরবে কি ফিরবে না সেই সম্ভাবনার যন্ত্রণা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে। দোয়া পড়তেও ইচ্ছা করছে না। এক ধরনের বোবাবোধ গিলে ফেলেছে। কিছুই তিনি অনুভব করছেন না আবার করছেনও।

গলি দিয়ে যা-ই যাচ্ছে সেদিকে তার সমস্ত মনোযোগ, দৃষ্টি বিঁধিয়ে দিচ্ছেন। একটা রিকশা যাচ্ছে—তিনি টানটান হয়ে গেলেন, একটা সিএনজি—তার দম বন্ধ হয়ে এলো, আবার একটা রিকশা—তিনি স্থির, একটা কালো ট্যাক্সি—তার পুরো শরীর দু'পায়ের আঙুলে খাড়া।

এভাবে কতক্ষণ কেটেছে কে বলতে পারে। গলির মধ্যে একটা সিএনজি এগিয়ে আসছে, তিনি আশাহীন চোখে তাকিয়ে থাকলেন। সিএনজি তাদের গেট পার হতেই বুকের ভিতরের জমাট শ্বাস ফুস করে বেরিয়ে গেলো। সিএনজিটা অল্প এগিয়েই ঝাঁকিসহ থেমে গেল। ফরিদা সমস্ত সুখ মানত করলেন—খোদা লাভলি যেন হয়, জীবনে আমি আর কিছু চাই না। অনন্তকাল কেউ নামল না। তারপর এক সময় মেয়ের পরিচিত ক্লান্ত অবয়ব চোখে পড়ল, মাথা নুইয়ে সিএনজি থেকে নামল, ধীরে গেইট পযন্ত হেঁটে এল তারপর কোলাপসিবল গেইটের পেটের ছোট গেইট খুলে মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকলো। মেয়েটা মাথায় শাল জড়িয়ে নিলো। ফরিদা স্পষ্ট দেখতে পেলেন লাভলি মাথা নিচু করে মুহূর্তক্ষণ দাঁড়ালো—এইটুকু দেখে ফরিদা ধীরে চেয়ারে বসে পড়লেন। নিজেকে ধাতস্ত হবার জন্য কিছুটা সময় দরকার। বুকের ভিতরে যে ঘোড়দৌড় চলছে তার লাগাম ধরতে হবে একটু একটু করে। কষে টান দিলে ছিঁড়ে যেতে পারে।

বেল বাজছে, পিচ্চি দৌড়ে তার ঘরের সামনে এল।

—নানি, বড় খালা আসছে।

ফরিদা তখন চেয়ারে বসা, সামলে উঠতে কষ্ট হচ্ছে।

—ভিত্রে আয়।

বহু কসরত করে মাথা উঁচু করলেন। আঁচলের প্রান্ত থেকে চাবির গোছা খুলে দিলেন। পিচ্চি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এখন, এখন কী হবে?


সিঁড়ির মাথায় পিচ্চির বত্রিশ পাটির দাঁত দেখা গেল। লাভলি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। পিচ্চি তর তর করে নেমে আসলো বাকি ক'টা ধাপ। তালা খুলতে খুলতে তার মুখ ছুটলো।

—বড় খালা আসছেন। আমি যে ডরাইছি!

'আমি' শব্দটায় লাভলির কান আটকে গেল। তার মানে কি এই যে বাসার অন্য কেউ ভয় পায় নাই। ওর কি এতে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত। অবশ্য এত শিঘ্রী নিশ্চিন্ত হওয়াটা ঠিক হবে না।

—আম্মা কই?

—বাসাতই।

লাভলির আর কোনো প্রশ্ন মাথায় এলো না—সত্যি কথা বলতে কী, কোনো কিছু সম্পর্কেই ও এই মুহূর্তে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করছে না। তবে এই মুহূর্তে তার বাথরুমে যাওয়াটা জরুরি পর্যায়ে পড়েছে। বাসায় ঢুকে কারও মুখোমুখি হ'তে ইচ্ছা করছে না লাভলির। ও পিচ্চিকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ঠিক করল, সোজা নিজের ঘরে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাবে।

—(আপুমনি, উত্তম প্রস্তাব)—।

—তুমারে কেউ জিজ্ঞাস করছে?

মনে মনে মাথার ভিতরের লোকটাকে কড়া দাবড়ানি দিলো। দোতালায় উঠে দেখলো বাসার দরজা হাঁ করে খোলা কিন্তু আলো জ্বলছে না। প্রায়োন্ধকার হয়ে আছে জায়গাটা, এই বেশ সুবিধা হলো লাভলির। কাউকে জানান না দিয়ে বাসায় ঢুকলো। নিজের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে মায়ের ঘর পার হলো, ভিতরে আলো জ্বলছে কিন্তু ফরিদার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। আম্মা নিশ্চয়ই জানেন ও এসেছে, তাহলে ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছেন কেন? তার উপর তো এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। আর সবাই বা কোথায়—আব্বা, বিউটি। বাড়িটা ঠাণ্ডা, অসাড় হয়ে আছে। লাভলি ডানে বাঁয়ে তাকালো না। মাথা নিচু করে 'ইয়া নফসি' 'ইয়া নফসি' পড়তে পড়তে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। বিছানার উপর ধপাস করে বসল। যেন তার জ্ঞানহীন শরীরটাকে কেউ বিছানা অব্দি এনে হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়েছে। 'আহ্' শব্দে ওর সচেতন অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়লো ঘরে। আলো জ্বালালো না, দরজা ভিড়ালো না, বাথরুমে গেল না—বিছানার উপর বসে রইল। যদিও বাথরুমে যেতেই হবে অবস্থা। এক সময় উঠে ঢুকে গেল বাথরুমে, অনেকক্ষণ ধরে মুখ ধুল—পার্কের ধূলা-বালি ঘষে ঘষে পরিষ্কার করল। শেলোয়ারে আটকে রাখা ছুরিটা বের করে খয়েরি কাগজের মোড়ক খুলে ফেলল লাভলি—কী সুন্দর ছুরি! নাহ্, আজকে একা একা বাইরে যাওয়া সার্থক। বিউটি দেখলে খুশিতে ঝিলিক দিবে। খুব বেশি পছন্দ করলে নাহয় বিউটিকে দিয়েই দিবে ছুরিটা। ওদের দু'জনের একজনের কাছে থাকলেই তো হলো। ছুরিটা কোথায় লুকিয়ে রাখা যায় লাভলি সেটাই এখন ভাবছে। বিছানার জাজিমের নিচে রাখা যায়। কিন্তু রাবেয়ার মা বিছানা করতে গিয়ে খুঁজে পেলে তুলকালাম বাঁধাবে। অবশ্য একদম মাঝখানে রাখলে হদিস পাবে না। সেটাই করবে ঠিক করলো লাভলি।

সব শেষে ওযু করে নিলো—এখন দীর্ঘ সময় জায়নামাযে কাটানো যাবে। সারাদিনের নামায একসাথে ক্বাযা পড়তে হবে—সময় তো লাগবেই। ভালোই হবে, আশা করা যায় অন্তত নামাযের সময় ফরিদা তার উপর চড়াও হতে পারবেন না।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের অন্ধকারে থৈ পেলো না লাভলি। আলো জ্বালিয়ে দেয়া যায় কিন্তু দিতে ইচ্ছা করছে না। ওর জন্য কী ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করে আছে তা একমাত্র ফরিদা জানেন আর আল্লাহ জানেন। অন্ধকারের এই আড়ালটাই তাই লাভলির জন্য ভালো মনে হলো। অন্ধকারেই ড্রেসিং টেবিলের প্রথম ড্রয়ার খুলে তার ভিতরের রাজ্যের জঞ্জালের নিচে ছুরিটা আপাতত লুকিয়ে রাখলো। এখন সবচেয়ে নিরাপদ কাজ নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া। কে যেন কবে বলেছিলো অন্ধকারে নামায পড়া যায় না—কে আর বলবে ফরিদাই বলেছিলেন সম্ভবত, কথাটা মনে পড়তে দোটানায় পড়ে গেলো লাভলি। শেষমেশ আলো জ্বালিয়ে নামাযের জায়গায় দাঁড়ালো। যা হবার হবে, মেরে তো আর ফেলতে পারবে না। মেরে ফেললে অবশ্য এর চেয়ে ভালো ছিল। নামাযে বসে লাভলি সত্যিকার অর্থে খোদার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইল। নামায পড়তে পড়তেই টের পেল বিউটি ঘরে ঢুকে বিছানার উপর বসেছে। তখনও ওর অনেক রাকাত নামায বাকি। কিন্তু বিউটি ধৈর্যহারা হলো না। সালাম ফিরিয়ে লাভলি খেয়াল করলো বিউটি মাথা নিচু করে ঝিম ধরে বসে আছে। ও যে নামাযের বিছানা থেকে তাকে লক্ষ্য করছে তাও টের পেল না সে।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর লাভলি মোনাজাতে বসলো। হাত তুলে খোদার কাছে ও কিছুই চাইতে পারল না। হঠাৎ বিড় বিড় করে বললো, 'আল্লাহ আম্মা যেন লাল কাপড়টা পছন্দ করেন'! মিনিট পাঁচেক শূন্য মনে বসে থাকার পর মোনাজাত শেষ করলো। জায়নামাযে বসেই লাভলি বিউটির দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখল, একইভাবে মাথা নিচু করে বসে আছে তখনও।

—আম্মা কই?

কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। মাস কয়েক ধরে মাঝে মধ্যেই বিউটিকে এরকম আনমনা দেখাচ্ছে। আজকে হয়তো বেচারার উপরে অনেক ধকল গেছে। ফরিদা সমস্ত রাগ হয়ত তার উপরেই ঝেড়েছেন।

—আম্মা কই?

দ্বিতীয়বার বলার পর বিউটি মাথা তুলে ওর দিকে তাকাল।

—তুমি কই গেছিলা?

—রমনা পার্কে।

—ইয়ার্কি মারো?

—ইয়ার্কি মারবো কেন, সত্যি।

আসলেই সত্যি কি না শুধু ওকে লক্ষ্য করে নিশ্চিত হতে চাইলো বিউটি। চোখ সরু করে লাভলির দিকে তাকিয়ে রইলো।

—রমনা পার্ক চিনো তুমি? কেমনে যাইতে হয় জানো, আন্দাজে কথা কও যে। আমিই তো চিনি না।

—চিনা লাগবে কেন, সিএনজিরে বলছি নিয়া গেছে।

লাভলি নামায থেকে উঠলো এবং জায়নামায ভাঁজ করে আলনার উপর রাখল। বিউটি বিছানায় বসে চোখের দৃষ্টিতে বোনকে অনুসরণ করছে। বোনের মধ্যে আমূল বদল টের পাচ্ছে, বাইরের হাওয়া মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কি একজনকে এতটা বদলে দিতে পারে? ভীরু, পায়ের নিচের মাটি সব সময় দুলছে এরকম একটা মেয়ে এখন চোখে চোখ রেখে অবলীলায় বলছে ও না কি রমনা পার্ক গেছিল—ওর ধারণা আছে ফরিদা বিষয়টা জানলে কী গতি হবে ওর? চোখে চোখে বোনকে অনুসরণ করছে আর বিউটি ভাবছে—যতই ভাবছে ততই নিজের উপর ঘৃণায় ধিক্কারে মরে যেতে ইচ্ছা করছে—সে তাহলে লাভলির চেয়েও গাড়ল, অপদার্থ—বিউটির চোখ সাদা হয়ে গেল। ছুটে গিয়ে বোনের চোখ-মুখ ফালা ফালা করে দিতে ইচ্ছা করলো।

লাভলি টের পাচ্ছে বোনের দৃষ্টি ওর পিছে পিছে ঘুরছে। বাসায় ফিরেছে ঘণ্টাখানেক তো হবেই কিন্তু ফরিদার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না—ব্যাপারটায় ও যার পর নাই বিস্মিত হচ্ছে। ধীর পায়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিলো। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে, কিন্তু খাবার ঘরে কেউ নাই, মানে কোথাও কেউ নাই—অন্তত লাভলি দেখতে পাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর ভূতের কোনো ছবির মতো হয়ত যখন ও সবচাইতে বেশি বেখেয়াল, ঠিক তখন কেউ ঘটাং করে ওর টুটি ঠেসে ধরবে মাটির সাথে এবং ধরেই থাকবে। আশ্চর্য ঘটনা এইসব চিন্তা মনে আনাগোনা করা সত্ত্বেও ওর একটুও ভয় লাগছে না। শুধু কেমন এক ধরনের 'নাই' অনুভূতি ওকে আগাপাছতলা মুড়ে রেখেছে।

দরজার কাছ থেকে সরে আসলো লাভলি। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে বেণী খুলতে লাগলো।

—তুমার এত বড় সাহস কেমনে হইল?

বিউটির মুখ থেকে শব্দ না হলকা বের হলো। হলকা লাভলির প্রায় গা ছুঁয়ে গেল—আঁচ লাগলো ঠিকই কিন্তু পোড়াতে পারল না।

—কীসের সাহস?

—সকালে গেলা সন্ধ্যায় ফিরলা।

বিউটির সাথে কথা বলতে একদম ইচ্ছা করছে না লাভলির। বেণী খুলছে স্লো মোশানে, পুরো বাড়িটা দুলছে ওর সামনে স্লো মোশানে। ওর অনুপস্থিতিতে সারাদিন সবার কী দশা গেছে, ফরিদা কেন এখনও ওর খোঁজ করছেন না, কখন থেকে ওকে ঘরবন্দি করা হবে, না কি আজকের অপরাধের জন্য নতুন কোনো শাস্তির বিধান চালু হচ্ছে—এইসব বিষয়ের প্রতি লাভলি দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। মনে প্রাণে চাইছে বিউটি যেন এই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং এখনই।

—বিউটি, আমার মাথা ব্যথা শুরু হইতেছে—তুই যা, আমি লাইট নিবায়ে শুয়ে থাকবো।

—কী?

—আমি লাইট নিবায়ে শুবো, তুই যা।

বিউটি ওর স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিল জানে না। হঠাৎ ক্ষোভে দিশাহারা হয়ে গেল, কাণ্ডজ্ঞান সম্পূর্ণ লুপ্ত হল তার। খাট থেকে নেমে ঘোড়ার মত মাটিতে পা ঠুকতে লাগল আর চীৎকার করতে লাগল।

—তুমি কই গেছিলা একক্ষণ বলবা। একক্ষণ। আমি কুনোদিন কুথাও যাই নাই। সারা শহর তুমি ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা ঘুরবা। মগের মুল্লুক পাইছো? আম্মা এখনও তুমারে কিচ্ছু বলেন নাই, কেন বলেন নাই?—আম্মাই তুমারে পাঠাইছিলো, কই পাঠাইছিলো বলো?

চুল হেলাফেলা করে আঁচড়ালো লাভলি, তারপর বোনের তাণ্ডব নৃত্য আগ্রহহীন চোখে দেখল, একটা হাইও তুলল আর এই হাই তোলাতেই কাল হলো। তাণ্ডব দশা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ল। ঘরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল বিউটি—মাঝে মধ্যে থামে কিছু বলে, দাপায়, ফোঁসে আবার কিছু বলে।

—লাগে যেমুন, দুনিয়া উদ্ধার কইরা আসছো। আমার আলাপে তুমার হাই আসে… তুমার ফুটানি আজকে বার হবে। তেল কমানো হবে আজকে… সবাই একটা মজা পাইয়া গেছে… দেখাইতেছি, আমিও দেখাইতেছি।

দাপানো বন্ধ করে বিউটি ওর উপর এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়লো। লাভলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে—তাড়া খাওয়া বাঘের মতো বিউটিকে ওর দিকে ছুটে আসতে দেখে ঘুরে দাঁড়ালো। আয়নায় ওর আঁচড়ানো চুলের ঢল পিঠ ছাপিয়ে পড়েছে তারই পাশে বিউটির সাদাটে চোখের হিংস্রতা, তেড়ে আসার জন্য সিংহের মতো ফুলে থাকা চুল আর দু'হাতের মারমুখী উগ্রতা—আয়নায় চকিতে নিজের এই রূপ চোখে পড়লো বিউটির, মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালো, চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

বিউটির চীৎকারে রান্নাঘরের দরজার কাছে রাবেয়ার মা এসে দাঁড়ালো। হাতে রুটি বেলার বেলুন। বারান্দা থেকে পিচ্চি দৌড়ে আসলো মজা দেখার জন্য। কিন্তু ফরিদা বা মুখলেস সাহেব দু'জনের কেউই সামনে এলেন না। যদিও ফরিদা তার ঘর থেকে বিউটির আস্ফালন, চেঁচামেচি সবই শুনছিলেন, কিন্তু এক ইঞ্চি নড়লেন না। সেই যে বেতের চেয়ারটায় বসেছিলেন, বসেই থাকলেন। দুই মেয়ের কারুরই মুখোমুখি হবার শক্তি তার নাই। তিনি টের পাচ্ছেন বিউটি এবার তার দিকে তেড়ে আসছে। ইচ্ছা করলেই উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিতে পারেন—ইচ্ছাটাই করল না।

—আম্মা, আমি জানতে চাই বাসায় কী হইতেছে? আপা আসছে এক ঘণ্টার উপরে, সারাদিন উধাও থাইকা এখন আরামসে বইসা আছে, চুল আঁচড়াইতেছে, মুখে ক্রিম মাখতেছে—আর আপনে ঘরের মধ্যে ঘাপটি মাইরা বইসা আছেন! কেন? আপারে জিজ্ঞাস করবেন না—এতক্ষণ কই ছিলো, কী কইরা আসছে? না কি আপনে কুথাও পাঠাইছিলেন তারে? কই পাঠাইছিলেন?

—ঘর থিকা তুই যা। একক্ষণ যাবি।

—না যাব না। কী করবেন? ন্যায্য কথা জিজ্ঞাস কইরা দোষ কইরা ফেলছি। আরেক মেয়ে যে আল্লায় মালুম কী কইরা বাসায় ফিরছে ওরে কিছু বলবেন না, আমার উপরে যতো চোটপাট। কেন বলবেন না আমি সেইটাই জানতে চাই।

—আমার ইচ্ছা আমি বলমু না। তোরে কৈফিয়ত দিতে হবে? আমি যা করছি, করছি—তার জন্য আমার আল্লারেও কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি সবার কৈফিয়ত নিবো। বান্দির বাচ্চা বান্দি, আমারে জিগাইতে আসে। দাপরানি দেখো তার, শয়তান—বাড়িতে যাত্রা শুরু করছে। … তোরা মরছ না কেন?… বার হ ঘর থিকা, বার হ…

নদীর কুল ছাপানো পানির মত কথার তোড় ফরিদার অন্তরাত্মা ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। যতটা না জোরে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি ক্ষোভে আর ক্রোধে। সেই মুহূর্তে পুরো বাড়িটা জমে ঠাণ্ডা মেরে গেল—বিউটিও পাল্টা ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল কিন্তু ফরিদার মুখের দিকে তাকিয়ে গুটিয়ে গেল, ঘর থেকে বেরিয়ে এল ফুসতে ফুসতে। ফরিদা দরজা লাগিয়ে দিলেন।

মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে খাবার ঘরে এসে বিউটি জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো আর তার মনে হলো সে বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে বান্ধবহীন দাঁড়িয়ে আছে। মাঠটা ধীরে কিন্তু টের পাবার মতো দ্রুততায় চারপাশ থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে এবং সে খুব শীঘ্রী মাঠে, ঘাসে, হাওয়ায় বিলীন হয়ে যাবে। সে মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে দেখলো বারান্দার দরজার আড়ালে মুখলেস সাহেব দাঁড়িয়ে তাকে দেখছেন।—এবং নিশ্চিত করে বলা যায় মুখলেস সাহেবের পাশে পিচ্চি দাঁড়িয়ে আছে। সে টের পেলো বিভিন্ন ঘর থেকে সবাই তাকে দেখছে। আপার ঘর আলতো ভিড়ানো, কিন্তু সে হলফ করে বলতে পারে ওর যাবতীয় মনোযোগ এখন সে কী করছে সেইদিকে। কিন্তু বিউটির সব রাগ গিয়ে পড়লো মুখলেস সাহেবের উপর। এই মেনীমুখো লোকটা কি আসলেই তার বাবা। এত তেলতেলা পিচ্ছিল একটা লোক—বিউটির গা গুলিয়ে ওঠে।

—আপনে দরজার চিপায় কী করেন? কুনু কাজে-কামে নাই, কিন্তু সবখানে নাক দিয়া বইসা থাকবে। আস্তা ইয়া…

—বিউটি থাপড়ায়া তোর আমি দাঁত ভাঙবো। বাপের সাথে কেমনে কথা বলতে হয় তাও শিখে নাই। ইবলিশের বাচ্চা।

ফরিদা ঘরের ভিতর থেকে চীৎকার করে উঠলেন। বিউটি একদম চুপ মেরে গেল শুধু বারান্দার দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখলেস সাহেবের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল, বিউটির চোখ দু'টা ধ্বকধ্বক করছিলো। সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে মুখলেস সাহেবের মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু গায়ের চাদর দুলতে দেখা গেল। এক সময় মুখলেস সাহেব নড়ে উঠলেন, চাদরসহ অদৃশ্য হলেন। বিউটিও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। কিন্তু স্বভাবসুলভ বিকটা শব্দ তুলল না—দড়াম করে দরজা লাগাল না কিংবা ঠাস করে কপাট ফেলল না। পা টিপে টিপে যথেষ্ট সাবধানতা মেনে নিঃশব্দে ছিটকিনি তুলল। যেন এই বাড়িতে মৃত্যুপথযাত্রী কোনো রোগী ঘুমিয়ে আছেন, এতটুকু নড়াচড়ায় তার ঘুম ভেঙে যাবে আর বেঁচে থাকার জন্য এই ঘুমটুকুর খুব বেশি দরকার।

রচনাকাল: ২০০৮, লন্ডন

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ