সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন: এক মহীয়সী মায়ের স্মৃতিকথন

শারমিন আহমদ
Published : 20 Dec 2014, 05:54 PM
Updated : 20 Dec 2014, 05:54 PM

ষাটের দশকের আদর্শবাদের সেই যুগে যখন আমার জন্ম হয় তখন নিপীড়িতের দুয়ারে নতুন প্রত্যূষ এনে দেবার স্বপ্ন ও অঙ্গীকারে জীবন উৎসর্গ করাটাই ছিল নেতৃত্বর সংজ্ঞা। আব্বু তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সেই শুদ্ধতম নেতৃত্বের প্রথম সারির একজন নেতা। তাঁর চিন্তা, লক্ষ্য ও কর্মের সঙ্গে যিনি একান্তভাবেই একাত্ম হয়েছিলেন তিনি হলেন আমাদের চার ভাইবোন, রিমি, মিমি, সোহেল ও আমার হৃদয়ের কেন্দ্র আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন।

১৯৫৯ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিতে আব্বু ও আম্মার প্রথম দেখা হয়। বিয়ে হয় ২৬ এপ্রিল। বিয়ের আগে আম্মা আব্বুকে বলেছিলেন যে, তিনি সোনার গয়না পছন্দ করেন না এবং বেলি ফুলের গয়না দিয়েই যেন বিয়ে হয়। আম্মার ইচ্ছা অনুযায়ী আব্বু নিয়ে আসেন একরাশ বেলি ফুলের গয়না যা পরে আম্মা আব্বুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বর্ণ ও স্থূল বিত্তের সুকঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা চেতনাহীন প্রথা আম্মা অতিক্রম করেন আত্মিক ঐশ্বর্যের অনির্বাণ দীপ্তি ছড়িয়ে।

তাঁদের প্রথম সন্তান, আমার শৈশবের এক সিংহভাগ সময়, আব্বু যখন জেলে কাটিয়েছেন তখন ওনার স্বপ্ন ও কর্মের সার্থক প্রতিভূ হয়েছেন আম্মা যাকে নানা, নানি আদর করে ডাকতেন 'লিলি' বলে। আমার জীবনের অসামান্য প্রেরণা আম্মাকে কেন্দ্র করে আমার প্রথম স্মৃতি কোনটি আমি মনে করার চেষ্টা করেছি। কী আশ্চর্য, আম্মার কথা মনে হলেই মনে একই সঙ্গে ভেসে উঠেছে নানা ফুলের সম্ভারে আলোকিত ও সুরভিত ফুল তোড়ার মতোই নানা বর্ণের স্মৃতি।

পড়ে যেয়ে ব্যথা পেলে হোমিওপ্যাথিতে ডিপ্লোমাধারী আম্মা একটি লালচে কমলা ইট বর্ণের টিনের বাক্সতে থরে থরে সাজানো ওষুধভর্তি কাঁচের শিশি থেকে তুলে নিতেন সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো 'আরনিকা' নামের মহাওষুধটি। ওষুধের মিষ্টি স্বাদ চাখতে চাখতেই আম্মার শাড়ির আঁচল থেকে নিতাম ওনার হাতের অতুলনীয় রান্নার সুবাস। আমার স্কুলে যাবার প্রথম দিনটিতে আম্মা আমার মাথার মাঝখানে সাদা ফিতা দিয়ে সুন্দর ঝুটি বেঁধে দিলেন এবং পরম উৎসাহে বাড়ির গেটের সামনে ও স্কুলের ভেতর আমার একরাশ ছবি তুললেন জাপানি ইয়াশিকা ক্যামেরা দিয়ে। (১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রীয় অতিথি রূপে বিদেশ সফরের সময় আব্বু ক্যামেরাটি কিনলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জেলে থাকার দরুণ আম্মাই ঐ ক্যামেরাটি ব্যবহার করতেন।)

স্কুল থেকে মাইল খানেক পথ পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরতেই প্রথম যাঁর দেখা পেতাম তিনি বারান্দায় অধীরভাবে পায়চারিরত এবং অপেক্ষমাণ আম্মা। ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটিতে আম্মা নিজ হাতে নানা পদের মাছ, নতুন আলু ও মটরশুটি দিয়ে রান্না করতেন। আব্বু, ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়-স্বজন পরিবৃত হয়ে আম্মা নতুন বছর পালন করতেন বাঙালি আচার-আপ্যায়নের মধ্যেই।

১ জানুয়ারি ও প্রতি ঈদে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ ডিজাইনার, আম্মার নিজ হাতে বানানো পোশাক পরতাম। আম্মার সেলাই মেশিনের ঘড় ঘড় শব্দ ও নেপথ্যে রেকর্ড প্লেয়ারে বাজানো তাঁর প্রিয় হেমন্ত, সন্ধ্যা ও সতীনাথের গান শুনতে শুনতেই এক সময় আবিস্কার করা শুরু করলাম এক অনন্য নারীকে। আমার বয়স যখন সাত বছর তখন স্কুল থেকে নিয়ে এলাম পুওর ফান্ডের আবেদন পত্র। ছয় দফার অন্যতম রূপকার আব্বু ১৯৬৬ সালের ৮ মে হতে আবারও জেলে বন্দি তখন। বাসা ভাড়া দিয়ে কোনোমতে আম্মা সংসার চালাচ্ছেন। পুওর ফান্ডের আবেদনের জন্য উপযুক্ত আমি, এই ভেবে শিক্ষক আমার হাতে ফর্মটি ধরিয়ে দিলেন।

আমি ফর্মটা আম্মাকে দিতেই আম্মা তাতে এক নজর চোখ বুলিয়ে দরাজ গলায় হেসে বললেন, "তোমার কি মনে হয় আমরা গরিব?"

আমি বললাম, "ঈদে আমরা এবার নতুন জামা কাপড় পরিনি। আব্বু জেলে। তাহলে তো আমরা গরিব। আমার ক্লসের ক'জন মেয়ে আমাকে সে কথাই বলেছে।"

আম্মা বললেন, "শোন, নতুন কাপড় পরলেই কেউ ধনী হয়ে যায় না। যার যতটুকু রয়েছে তার থেকে যে অকাতরে দান করতে পারে সেই ধনী। তোমার আব্বু দেশের জন্য নিজের জীবন দান করেছেন। ক'জনের আব্বু অমন করে দান করতে পারেন?"

আম্মার সব কথা বোঝার বয়স না হলেও তাঁর সেদিনের আত্মপ্রত্যয়-ভরা গর্বিত উক্তিটি আমার শিশুমনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। অন্তরের ঐশ্বর্য যে বস্তু ও বিলাস-সামগ্রী থেকে শ্রেষ্ঠ, তা তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। দেশ ও দশের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবার মহত্তম কর্মযজ্ঞে আব্বুর অসাধারণ অবস্থানটিও তিনি তুলে ধরলেন আমার পৃথিবীতে চলার ঊষালগ্নে।

১৯৭১ সালে, চার নাবালক সন্তান নিয়ে আম্মা দু'মাস ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে আশ্রয় নেবার পর কোনোমতে প্রাণ নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মে মাসের শেষে কোলকাতায় পৌঁছে ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলী সাহেবের বাসায় ওঠেন। গভীর রাতে মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারী স্বামী তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখা করতে এসে তাঁকে বলেছিলেন যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না, এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিবার ছেড়ে যুদ্ধ করছেন, সুতরাং তাদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওনাকেও যথাযোগ্য উদাহরণ রাখতে হবে।

আব্বুর ঐ সুকঠিন সিদ্ধান্ত শুনে আম্মার মনে কী অনুভূতি হয়েছিল তা তিনি আমাকে দেওয়া এক লিখিত সাক্ষাৎকারে (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৩) প্রকাশ করেন। আম্মা বলেন, "ঐ মুহূর্তগুলিতে এমন গৌরবমণ্ডিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে আমি প্রাণঢালা সমর্থন জানিয়েছিলাম। প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে নয়, দারুণ শিহরণ জাগানো ঐক্যমত পোষণ করেছিলাম উদ্ভাসিত গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি বুঝেছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। সেই সময়কার সেই মহান সিদ্ধান্ত যেন হাজার বছরের অমূল্য উপাদান। চলন্ত জীবনের কত ঐতিহাসিক ঘটনার উত্থান-পতনের সঙ্গে বারংবার তাকে নতুনভাবে আবিস্কার করেছি, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিসরে। এ যে কত বড় অমূল্য সাধনার প্রাপ্তি।"

এই ছিলেন আম্মা যিনি তাঁর আদর্শবাদী স্বামীর জন্য হাসিমুখে শুধু ত্যাগই স্বীকার করেননি, তিনি সেই আদর্শের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন বুকভরা গর্ব নিয়ে।

বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ কামরুজ্জামানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরে এবং দলের নেতা ও কর্মীদের জেল-জুলুমের কালে এবং আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে সর্বসম্মতিক্রমে এই আম্মার কাছেই যখন নেতৃত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল, তখন তিনি সেই একই আদর্শ ও ত্যাগের মশাল জ্বালিয়ে খাঁটি সেবকের রূপে দলের কাণ্ডারী হয়েছিলেন। তিনি দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে পুনর্জীবিত করেছিলেন বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে। জেনারেল জিয়াউর রহমান আরোপিত কঠোর বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, এমনকি সে সময়ের রাস্তাঘাটবিহীন যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এলাকাগুলি ভ্রমণ করে, বিশেষত তৃণমূল-কর্মী ও তরুণ প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

তাঁর সঙ্গে সে সময় যারা কাজ করেছেন তারা জানেন যে, আম্মার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর অসামান্য নীতিবোধ, নিরহংকার ও নির্লোভ মানসিকতা। নিজে কী পেলেন বা পেলেন না সে নিয়ে তিনি কখনওই মাথা ঘামাতেন না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সুবিধাবাদী ও দলাদলির পঙ্কিল রাজনীতিতে তিনি সুস্থ ধারা নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সহিংসতা-ক্লিষ্ট রাজনীতির বিপরীতে এই মহীয়সী নারীর জীবন-কর্ম যে হতে পারে সৎ ও পরিছন্ন রাজনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ ও অনুপ্রেরণা তা বলা বাহুল্য মাত্র।

নব্বই দশকে ওয়াশিংটন ডিসির জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে 'পলিটিক্যাল সাইকোলজি' নামে একটি কোর্স পড়ানো হত। রাজনীতির সঙ্গে মনস্তত্ত্ব যে নিবিড়ভাবে জড়িত এবং একজন রাজনীতিবিদের কর্মকাণ্ড বুঝতে হলে লোকচক্ষুর আড়ালের মুখোশহীন ব্যক্তিটির মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, ডেভলপমেন্ট প্রভৃতি জানার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তারই ওপর কোর্সটি দেওয়া হত। আম্মার রাজনৈতিক নেতৃত্বে যে গুণাবলী পরিলক্ষিত হয় সেগুলি ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। নিভৃতে নিজকে পরিশুদ্ধ করার মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রামের ফসল।

নিষ্কলুষ রাজনীতিবিদ, দুর্দিনের কাণ্ডারী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী, নারী ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নিবেদিত কর্মী পরিচিতির উর্ধ্বে ছিল তাঁর এই সযত্নে লালিত সুচারু-সূক্ষ্ম মানবিক চেতনাবোধ। আম্মা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির সীমানা পেরিয়ে সকলকে ভালোবাসতেন এমন উজাড় করে যে, প্রত্যেকই ভাবত আম্মা বুঝি তাকেই সবচাইতে বেশি ভারৈাবাসেন। প্রেরণা দেবার ক্ষেত্রেও কোনো কমতি ছিল না। আমার প্রথম প্রকাশিত দ্বিভাষিক শান্তি শিক্ষার বই 'হৃদয়ে রংধনু' (The Rainbow in a Heart), যা আম্মাকে উৎসর্গ করি, তা প্রকাশিত হয়েছিল আম্মারই ঐকান্তিক উৎসাহ ও প্রেরণায়। বহুল আলোচিত 'তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা' বইটির জন্যেও তিনি যুগিয়েছেন অজস্র তথ্য এবং অসামান্য প্রেরণা।

প্রকৃতিপ্রেমিক আম্মা বাগানের একটি ফুল ফোটা ও সুমিষ্ট বাতাসে গাছ ও পত্রপল্লবের তরঙ্গায়িত আন্দোলন দেখতেন কী এক অদ্ভুত একাগ্রতায়। তেমনি এক নিবিষ্টভাবে পড়তেন ও আমাদেরকে পড়ে শোনাতেন ইনকা, মায়া, আজটেক প্রভৃতি সভ্যতা ও তার রহস্য; মেরাজ শরীফ, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব ও পরপারের আলোর জগতের কথা। কিশোর বয়সে আমাদের সামনে তিনি উন্মোলিত করেছিলেন চিন্তা ও প্রতিফলনের এমনই এক বিশাল জগত।

আমেরিকা থেকে এসে আমি যখন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আম্মার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, তিনি ক্যানোলাবিহীন তাঁর ডান হাতটি দিয়ে আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন এমন মমতায় যেন কখনওই ছেড়ে যাবেন না। গলায় ঢোকানো খাদ্যের টিউব এবং নাক-মুখ চেপে বসা ব্রিদিং মেশিনের ভেতর থেকে কী আশ্চর্য রকমের জোর গলায় বললেন, "গান গা"।

হ্যাঁ, ঐ প্রচণ্ড যাতনার মধ্যেও তিনি গান শুনতে চাইলেন। আমি আম্মার ধরা হাতখানিতে নিজেকে সমর্পণ করে চোখের পাতা ভিজিয়ে গাইলাম তাঁর প্রিয় কিছু গান, "আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে", "কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া", "ধনধান্য পুস্প ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা", "পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে"।

গাইতে গাইতে দেখি আম্মা গানের সুরে সুরে তাল দিয়ে পায়ের পাতা নাচাচ্ছেন– ক্যানোলা করা তাঁর বাঁ হাতসহ দুই হাতেই তাল দিচ্ছেন কী অবাক করা শক্তিতে! বেদনার কোটর থেকে বের করে আনছেন আনন্দের অমৃত ধারা।

ঠিক তার দুদিন পরেই (২০ ডিসেম্বর, ২০১৩) গভীর ভালোবাসার মানুষগুলোর চোখের সামনেই তাদের দোয়া ও প্রেমের সিঞ্চনে নিজেকে পরিবৃত্ত করে আম্মা চলে গেলেন অনন্ত লোকের সেই আলোর জগতে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন আমাদের হৃদয়ের অনেকখানি। আবার নিজেকেই ফিরিয়ে দিলেন আমাদেরই মাঝে।

What we once enjoyed and deeply loved we can never lose, for all that we love deeply becomes a part of us.

— Helen Keller