মুজিবনগর সরকারের ভেতর বাহির

Published : 14 Dec 2014, 11:04 AM
Updated : 14 Dec 2014, 11:04 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকার গঠন একটি বিরাট ঘটনা যেটা স্বাধীনতা অর্জনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল। তবে এই সরকার গঠন, পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে জটিলতা সৃষ্টি হয় সেটিও উপেক্ষা করা ঠিক নয়। কেননা বিভিন্ন বাধা-বিপত্তিও আমাদের ইতিহাসের অংশ। এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে, এই ক্রিয়াকাণ্ডে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না, যার ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বসমূহ সামনে চলে আসে। তাই তাজউদ্দিন আহমদ এই সময় তাঁর যুদ্ধসঙ্গী ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে একটি কথা বলেছিলেন, "আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন রাজনীতি জানেন না, সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।"

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এসেই কেবল ভারতে আওয়ামী লীগের সকল নেতৃবৃন্দ একত্রিত হতে পেরেছিলেন।

১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে বক্তৃতা দেন তা কিন্তু সহজে বা সরলভাবে দেওয়া হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাবার পর তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোলক মজুমদারের যোগাযোগ হয়, যার মাধ্যমে তাঁর দিল্লি যাবার ব্যবস্থা করা হয়। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সাক্ষাৎ হয়। ইন্দিরা তাঁর কাছে জানতে চান শেখ মুজিব কোথায় ও কেমন আছেন। তাজউদ্দিন বলেন যে, দেশছাড়ার পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, কিন্তু তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরবর্তীতে ভারত সরকার শেখ মুজিবের অন্তরীন হওয়ার ব্যাপারটি জানিয়ে দেন তাঁকে।

ভারত সরকারের জন্য একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করা প্রয়োজনীয় ছিল। বিচ্ছিন্ন কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা তাদের জন্য অসুবিধাজনক হত। এ বিষয়ে একমত হওয়ায় সে সময় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন যে বক্তৃতা দেন, তার রচনায় হাত দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, অধ্যাপক রহমান সোবহান ও অধ্যাপক আনিসুর রহমান সে সময় দিল্লিতে পৌঁছান এবং সবাই মিলে যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা চালাতে থাকেন।

কলকাতায় ফিরে এসে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বগুলো সামনে চলে আসে। এই দ্বন্দ্বে মূল দুই ব্যক্তিত্ব হলেন, তাজউদ্দিন আহমদ এবং যুবলীগ প্রধান ও শেখ মুজিবের ভাগিনা শেখ মনি। শেখ মনি সরকার গঠনের বিরোধিতা করে বলেন যে, একটি বিপ্লবী সংস্থা দরকার, সরকার নয়। বর্তমান কাজ যুদ্ধ করা, প্রশাসন নয়।

এর মধ্যে অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, যেমন, কামরুজ্জামান কলকাতায় পৌঁছে যান। তিনি প্রথমে সরকার গঠনের বিরোধিতা করলেও পরে মত দেন। কলকাতার প্রিন্সেপ স্ট্রিটে একটি অফিসে তাঁরা জড়ো হয়ে সভা করেন। বিরোধীদের অন্যতম ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী যিনি পরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন জাতীয় পার্টিতে। কিন্তু আলোচনা করতে গিয়ে সরকার গঠনের বিরোধিতা অনেকটাই নমনীয় হয়ে যায়; কারণ সবাই বুঝছিলেন যে, 'বাংলাদেশ সরকার' না হলে ভারত সরকারের ভূমিকাও সীমিত হয়ে যাবে।

শেষ পর্যন্ত এমপিদের মতামত তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে যায়। কিন্তু তিনজনের মত তখনও পাওয়া যায়নি; তারা হলেন, খন্দকার মোশতাক, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরকার গঠনের পক্ষে রায় দেন। সিদ্ধান্ত হয় যে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করা হবে এবং শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিতে তিনিই হবেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। ধারণা করা হয়, এর ফলে সরকার গঠনে তাঁর আপত্তিও থাকবে না।

বাকি থাকেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তবে ১০ এপ্রিলের পর। তিনি খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন এ বিষয়ে, তাই প্রথমে মন্ত্রিসভার সদস্যপদ নিতে রাজি হননি। পরবর্তীতে তিনি যোগদান করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে, যে পদ তিনি চেয়েছিলেন। এর পরে এই দ্বন্দ্বসমূহ সাময়িকভাবে কমে যায়।

কিন্তু তাজউদ্দিন আহমদের প্রধান বিরোধী ছিলেন শেখ মনি, খন্দকার মোশতাক নয়। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দিনের বক্তৃতা প্রচার করার কথা এবং সেভাবেই রেকর্ড করা হয়। কিন্তু শেখ মনি এতে আপত্তি করেন এবং প্রচার না করতে তাজউদ্দিন আহমেদকে বলেন। ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বলেছেন:

"সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি, তাতে বিলম্ব হলে আমাদের উপর সন্দেহ পোষণ করবে ওরা।"

কিন্তু শেখ মনি তাজউদ্দিনকে জানিয়েছিলেন যে, তারা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। তাজউদ্দিন আহমদ এটা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল ভারত সরকারের অস্বস্তি এবং কিছুটা হলেও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতএব, তাঁরা বাজিয়েছিলেন রেকর্ড করা ক্যাসেট। তাঁদের আলাপচারিতায় বোঝা যায় যে, তাঁরা বাংলাদেশের যুদ্ধকে নিজেদের যুদ্ধ হিসেবেও নিচ্ছেন। অতএব, দলের অভ্যন্তরীন কোন্দল, যেটা পরবর্তীতে সংকট ও সমস্যা তৈরি করে, সেটা সামাল দেওয়ার চেষ্টাও ভারত সরকার করেছিল তাদের নীতির স্বার্থে।

তাজউদ্দিন আহমদের বক্তৃতা প্রচারিত হয় ১০ এপ্রিল। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১। যে দ্বন্দ্বগুলোর কথা আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি তার প্রভাব গোটা যুদ্ধের উপরে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ বা মুজিবনগরের ভেতরে চারটি প্রধান ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী অংশকে দেখা যায়।

প্রথম ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, যার প্রতি দলীয় সমর্থন কম ছিল, কিন্তু তিনিই ছিলেন সুসংগঠক। এ কারণে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁর পক্ষে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক দায়িত্বসমূহ তিনি সুষ্ঠুভাবে পালন করেন। ভারত সরকারের যে অংশ তাঁকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দেয়, তারা হচ্ছেন সোভিয়েতপন্থী আমলা ও রাজনীতিকবৃন্দ, যারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন; যেমন, ডি পি ধর, পি এন হাকছার প্রমুখ, যারা একাত্তরে ভারতে ক্ষমতার বেসামরিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন।

দ্বিতীয় ক্ষমতার ঘাঁটির নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, যিনি নিজেকে শেখ মুজিবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে দেখতেন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে এই বিষয়টি আরও প্রতিষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দিন আহমদ শেখ সাহেবের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেও, ক্ষমতার পরিসরে শেখ সাহেবের পরেই শেখ মনি নিজের অবস্থান সংহত করেন। অতএব তিনি যদি ভেবেই বা বলেই থাকেন যে, শেখ মুজিবের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি তিনি, সেটা ভাবার কারণ রয়েছে।

তৃতীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সিরাজুল আলম খান, যিনি আওয়ামী লীগের ভেতরে বাম অংশের নেতৃত্ব দিতেন ১৯৬২ সাল থেকে। তিনি শেখ মনির মতো শেখ সাহেবের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। কিন্তু সরকার গঠন বা এ ধরনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। পরবর্তীতে অবশ্য অবস্থা পাল্টে যায়। স্বাধীনতার পরে তিনি জাসদ প্রতিষ্ঠা করেন।

চতুর্থ ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। তিনি শেখ সাহেবের সহপাঠী ছিলেন এবং মনে করতেন যে, মুজিবনগর সরকারের প্রধান তারই হওয়া উচিত, জ্যেষ্ঠতার কারণে। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবার পর নিজেদের একটি ছোটখাট গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। খন্দকার মোশতাককে সমর্থন দিচ্ছিলেন ভারত সরকারের মার্কিনপন্থী অংশটি। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা অশোক রায়কে দায়িত্ব দেওয়া হয় মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য, যিনি সম্ভবত মার্কিন অংশের কাছাকাছি ছিলেন। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন:

"একজন সংগঠক হিসেবে খন্দকার সাহেব দারুণ লোক ছিলেন। যতদূর আলোচনা হয়েছে, উনি কোনো রকম পক্ষ দেখাননি। আমেরিকার সিআইএএর লোকেরা ওকে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। আমাদের যে ইন্টেলিজেন্স চিফ ছিলেন কলকাতায়, তার মতে, খন্দকার সাহেব কিছুই বলেননি। শ্রীমতি গান্ধী তখন ডি পি ধরকে বাংলাদেশের ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে বলেছিলেন। তাকে বোঝানো হয়েছিল যে, খন্দকার সাহেবকে সরিয়ে যদি আবদুস সামাদ আজাদকে বসানো যায় তাহলে ভালো হবে, উনি আমাদের লোক, যা বলব তাই করবে। খন্দকার ডানপন্থী লোক ছিলেন ঠিক, কিন্তু আওয়ামী লীগ অ্যান্টি-কমিউনিস্ট পার্টি। কাজেই আমার যেটুকু মনে হয় তা হল, তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ষড়যন্ত্রের শিকার।"

১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার ও আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। এর মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য। একটি হচ্ছে, খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাদাভাবে যোগাযোগ করা, যেটা ভারত সরকারের উপরও প্রভাব ফেলে। খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের এমপি জহিরুল কাইয়ুমের মাধ্যমে এ যোগাযোগ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাকের বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এই বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলা যোগাযোগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং তার সফর বাতিল করা হয়। বলা হয়ে থাকে এই কারণে তার মন্ত্রিত্ব চলে যায়।

খন্দকার মোশতাকের একান্ত সচিব ছিলেন কামাল সিদ্দিকী, তিনি লিখছেন:

"সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের দিকে খন্দকার মোশতাক মুজিবনগর সরকারের ভেতরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ছিল যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। … তখন থেকে তিনি প্রায় গৃহবন্দি ছিলেন। একবার তিনি গঙ্গার পাড়ে সান্ধ্যভ্রমণের অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দেন।"

যে কারণে মার্কিনিদের একজন ডানপন্থীর সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার আগ্রহ হয়েছিল, সেটি হচ্ছে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি। মার্কিনিদের ভাবনা ছিল, এত সংখ্যক প্রশিক্ষিত 'বামপন্থী' যদি বাংলাদেশে ফেরত যায় তাহলে মার্কিনি প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়বে ওই অঞ্চলে। অর্থাৎ, বাম ঠেকাতে তারা ডানদের প্রশ্রয় দিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়।

মজার বিষয় হল, ভারত সরকারের মুজিব বাহিনী গঠন করার অন্যতম কারণ ছিল, ভারত ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চরম বাম বা নকশালপন্থীদের ঠেকানো। মুজিব বাহিনীই ছিল তাজউদ্দিন সরকারের প্রধান 'বিকল্প' শক্তি। প্রশাসনের সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট তাজউদ্দিন আহমদ ভাবেননি যে, এই সরকার এমন একটি বাহিনী গঠন করবেন যেটি মুজিবনগর সরকারের সরাসরি অধীনস্ত নয়।

ছাত্র ও যুবলীগের শেখ মনি ছিলেন ডানপন্থীদের এবং সিরাজুল আলম খান ছিলেন বামপন্থীদের নেতা। তারাই ছিলেন তরুণদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের উপর তাদের প্রভাব ছিল না। মুজিবনগর সরকার ভারতকে এক লাখ প্রশিক্ষিত গেরিলা তৈরি করার কথা দিয়েছিল। প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানীকে বলেন যে, তারা এই 'সূর্য সন্তান'দের জোগাড় করে দেবেন।

তখন বাংলাদেশ সরকার একটি 'অনুমতি চিঠি' (Letter of authorization) দেয়, যার ভিত্তিতে মুজিব বাহিনী গঠন একটি সরকারি কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়, যদিও সেই সরকারের কোনো খবরদারি ছিল না। নেতৃত্বে চলে আসেন সিরাজুল আলম খান ও শেখ মনি এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের ভেতরে একত্রিত হন তাদের অধীনে।

এই বাহিনী গঠন তাজউদ্দিন ও তাঁর সমর্থকদের জন্য একটি মর্মপীড়ার কারণ ছিল, যেহেতু সরাসরি তাঁরা মুজিবনগর সরকারের বাহিনী ছিল না। অনেকেই তাঁদেরকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বগুলোর দিকে তাকালে তাঁদের জন্ম ও ভূমিকা বুঝতে সহজ হয়।

তথ্যের দিক থেকে এটা পরিস্কার যে, মুজিবনগর সরকার, যার অধীনে ছিল নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী, যে দু'টি মিলিয়ে হচ্ছে মুক্তিবাহিনী, তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ভারত সরকার। মুজিব বাহিনী, যেটা মুজিবনগর সরকারের এক ধরনের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, তারও পৃষ্ঠপোষক ছিল ভারত সরকার। এই সরকার কেবলমাত্র মুজিবনগর সরকারের উপর নির্ভর করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করেনি বলে মনে হয়। তাই মুজিব বাহিনী গঠন করে। খন্দকার মোশতাকের প্রচেষ্টার পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় সরকার ছিল না, তাই তারা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

আসলে তখন ভারতের সরকার ও রাজনৈতিক মহলের ভেতরও বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ছিল, তার কিছুটা প্রভাব মুজিবনগর সরকার ও মুজিববাহিনীর উপরও এসে পড়ে। কিন্তু ভারতের যুদ্ধ আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক ছিল না। তাই উভয় পক্ষ মিলিতভাবে অনেক ক্ষেত্রে কাজ করলেও, দু'পক্ষের ভাবনা, উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য ছিল।