এইসব গল্প বললে সে কি মুক্তিযোদ্ধা হইয়া যাইব

ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা
Published : 15 Dec 2014, 05:06 AM
Updated : 15 Dec 2014, 05:06 AM

২০১১এর বর্ষাকাল। বন্ধু, সিনেমা নির্মাতা ফারজানা ববির সঙ্গে বীরাঙ্গনাদের উপর নির্মিতব্য 'বিষকাঁটা' সিনেমায় সঙ্গী হয়েছি। আমাদের গন্তব্য খুলনার রূপসা। ওখানকার বীরাঙ্গনা রঞ্জিতা মল্লিক। দীর্ঘ, শক্তপোক্ত গড়নের পঞ্চাশোর্ধ্ব হিন্দু নারী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশের গ্রামের প্রতাপশালী রাজাকারদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। একমাত্র কর্মক্ষম ভাই সামাজিক নানা চাপের কারণে পরিবারসহ গ্রামে টিকতে না পেরে অবশেষে শহরে গিয়ে ডোমের কাজ শুরু করেন। গ্রামে পিতৃভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকেন রঞ্জিতা। কন্যাসন্তানকে নিয়ে টিকে থাকতে বেছে নেন কবিরাজি পেশা। কিন্তু তাঁর জমিটুকু দখলের জন্য তাঁকেও একসময় 'বেশ্যা' নাম দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশিরা পিতৃভিটে ছাড়া করে।

মেয়েকে নিয়ে রঞ্জিতা গ্রাম ছেড়ে তিন গ্রাম দূরে এক মুসলিম সৈনিকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সে গ্রামের মানুষজন দাবি করেন, রঞ্জিতা মল্লিক তাঁর ধর্ম ছেড়ে ওই মুসলিম পুরুষের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সংসার করছেন। ওদিকে বোনের 'বেশ্যা' পরিচিতির কারণে তাঁকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন ভাই। কিন্তু রঞ্জিতা কি আসলে স্বাভাবিক মানুষ এখন? কীভাবে সম্ভব? রাস্তাঘাটে একাত্তরের রাজাকার আর আজকের জামাতের সেই সব নেতাদের চোখের সামনে দেখতে পেলে চিৎকার করে বিচার চান, গালিগালাজ করেন। গ্রামের মানুষ তাঁকে তাই 'পাগলি' বলে ডাকে।

সিনেমা নির্মাণের অংশ হিসেবে পরিচালক ববি আর আমি রঞ্জিতা আর তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জীবনের প্রতিকূলতার কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যে হয়ে এল। গাঢ় সবুজ চারপাশ তখন ভীষণ গাঢ় হয়ে উঠেছে। আমরা দুই বন্ধু ক্যামেরা নিয়ে রঞ্জিতার ছেড়ে আসা পিতৃভিটা দেখতে যাব। শহুরে গবেষক আমি যখন কাদায় ধীরে ধীরে পা দিয়ে দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ রঞ্জিতার স্বামী আমাকে প্রশ্ন করলেন, "আপা, এইসব কথা কইলে কি সে মুক্তিযোদ্ধা হইয়া যাইব?"

আমার চোখের সামনে ২০০৮ সালে দেখা সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো সারি সারি ছবির ফ্রেমগুলো ভেসে উঠল। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথার ছবিগুলো আর তার ক্যাপশনের ভাষা আমাকে সাহস জোগায়। দেয়ালের গায়ে সাঁটা ছবিগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে বীরাঙ্গনাদের ছবি, উদ্ধারকৃত বিবস্ত্র নিপীড়িত বীরাঙ্গনাদের কথা বলে। একটি ছবির নিচে বড় বড় অক্ষরে একটি ক্যাপশন লেখা দেখতে পেয়েছিলাম, "বীরাঙ্গনা বোন আমার!"

মনে হাজারও প্রশ্ন ভিড় করে, আমাদের সমাজ বাস্তবতায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ আর বীরাঙ্গনা সনদের মূল্য কি এক? বীরত্ব অর্জনের ইতিহাস কি একই সমতলে দাঁড়িয়ে আছে? আদৌ বীরাঙ্গনা সনদ বলতে কিছু কি আছে? বীরাঙ্গনার সন্তান কিংবা পরিবারের জন্য কোনো কোটা, রাষ্ট্রীয় সুবিধাও তো নেই। আমার মাথায় আরেকটি প্রশ্নে অজান্তে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের রাজনীতিতে কখনও কি বীরাঙ্গনা সনদ দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয়তার প্রমাণ দেওয়া সম্ভব?

২০১১ সালে ভিকারুন নিসা নুন স্কুলের এক শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষকের ধর্ষণের পর পাবলিক পরিসরে নানান আলোচনা চলেছে। শিক্ষক পরিমলের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করেছিল "ভিকারুন নিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য সংহতি মঞ্চ"। মঞ্চের সদস্যদের একজন ছিলাম আমি। ধর্ষণের শিকার সেই শিক্ষার্থী কিশোরটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। খেলাধুলা করত বলে মেয়েটির ডান হাতে আগে থেকেই প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। ধর্ষণের সময় অভিযুক্ত ধর্ষক পরিমল শিক্ষার্থীটির সেই ভঙ্গুর হাত মুচড়ে দিয়ে তাকে আহত করার চেষ্টা করেছিল। কক্ষের ভেতর থেকে মেয়েটির বারবার ব্যথায় কঁকিয়ে উঠার চিৎকার ভেসে আসছিল। আমার ভেতরটা সে ভয়াবহ কান্নায় কেঁপেকেঁপে উঠছিল।

পাশাপাশি বসতেই আমাদের দুজনের মধ্যে আমি একটা মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। শিক্ষার্থী মেয়েটি সুন্দর ছবি আঁকে। তার আঁকা ছবিগুলো দেখতে দেখতে আমি তাকে আমাদের অনেকের জীবনে ঠিক তার সমান বয়সে ঘটে যাওয়া শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতনের কথা বলে যাচ্ছিলাম। কীভাবে সে অভিজ্ঞতা আমাদের অনেককে এখনও তাড়া করে ফিরে, কীভাবে আমি নিজেও কাউকে কিছু না বলে, আইনের কাছে বিচার না চেয়ে আসলে ভীষণ বোকামি করেছিলাম, আমার ওর মতো সাহস ছিল না। আমি বলে যাচ্ছিলাম… এখন কেমন করে শিক্ষক হয়ে আমি আমার জীবনের ঘটে যাওয়া অতীত নিপীড়নের কথা বলতে পারি, বলবার মধ্যে দিয়ে আমরা অনেকেই এখন সাহস খুঁজে পাই।

আমার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ সেই শিক্ষার্থী মেয়েটা ধীর স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল, "এসব বললে কি আপনার বিয়ে হবে?"

সাহসী মেয়েটির এ প্রশ্ন শুনেই আমার মনে পড়ে যায় পলার (ছদ্মনাম) কথা। গ্রামের বনেদী পরিবারের সতের বছর বয়সী মেয়েটি একলা বাসায় ধর্ষণের শিকার হলেও পরিবারের কাছে গোপন রেখেছিল। কিছুদিন পর সে নিজেকে গর্ভবতী আবিস্কার করে। তখন ধর্ষণের কথা মেয়েটি পরিবারকে বললে ধর্ষক অস্বীকার করে। ধর্ষকের পরিবারের সঙ্গে কোনো রকম বিয়েকেন্দ্রিক সমাঝোতায় পৌঁছাতে না পেরে পলার পরিবার ৬ মাসের গর্ভাবস্থায় পলার অ্যাবরশন করাতে বাধ্য হয়।

ঘটনার ৪ বছর পর ধর্ষণের কথা গোপন রেখে, পরিবারটি প্রচুর যৌতুক আর পাত্রকে চাকরি দেবার সুযোগের বিনিময়ে পলার বিয়ে দেয়। বিয়ের ছ' মাসের মাথায় নিজের জীবনের নিপীড়নময় অভিজ্ঞতার কথা প্রেমময় বিশ্বাসে স্বামীকে বলে ফেলে পলা। এরপরের ঘটনা ভয়াবহ। পলার স্বামী তার বন্ধুদের নিয়ে সপ্তাহ খানেক ধরে নিজের বাসাতেই ধর্ষণ করে পলাকে। কোনো রকমে পরিবারকে বিষয়টি জানাতে পারে সে। পরে তার পরিবার জখম শরীরের মেয়েটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। চিকিৎসা শেষে স্বামী ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনীত গণধর্ষণের মামলার কারণে নিরাপত্তাহীন পলা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠে আসে।

২০০১ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর পলার সঙ্গে আমার দেখা ২০০৬ সালে। তখনও ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত ধর্ষকদল ফেরারি আসামি! আর পলা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্যুত 'আশ্রয় কেন্দ্রের নারী'! তার পরিবার ২০০১ সালে সেই যে তাকে আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে গেছে, বাড়িতে আর ফেরত নেয়নি। পলা আমাকে প্রশ্ন করছিল, "ধর্ষকের পাশে পরিবার থাকে, আমার পাশে থাকে না কেন?"

নারীর জীবনে ধর্ষণের অভিজ্ঞতা কোনো বিশেষ সময় বা বিশেষ ঘটনার কথা বলে না। খুন, ছিনতাই কিংবা ফৌজদারি অপরাধের অপরাপর যে কোনো ধরন থেকে ধর্ষণ তার সামাজিক অর্থের জন্য ভিন্ন হয়ে উঠে। সামাজিক অর্থে ধর্ষণ ঘটা মানে নারীর জীবনের 'সর্বনাশ' ঘটে যাওয়া, তার 'সম্ভ্রম' চলে যাওয়া, তার অস্তিত্ব কেবল একটি ধর্ষণের বাস্তবতার মধ্যে সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া, তার শরীরী শুচিতার পবিত্রতার ধারণা ভেঙে যাওয়া। একটি সমাজ-অনাকাঙ্খিত ব্যবহৃত 'নারী শরীর' মানেই 'ধর্ষণ'।

সমাজের চোখে এই সকল ঘটে যাওয়া নিপীড়নের দায়ভার আবার আমরা নারীদের উপরই বর্তায়। আমরা নারীরা কেবল 'ভোগের বস্তু' বলে নিজেদের যে কোনো আচরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে, নিজেদের অস্তিত্বের যে কোনো বিন্যাসে, যে কোনো সময় যে কোনো পরিসরে, যে কোনো 'পুরুষালী এজেন্টকে' কোনো না কোনোভাবে প্রলুব্ধ করবার সামাজিক দায়ভার নিয়ে নারী জীবন যাপন করে চলি। আমরা নারীরা শিষ খেতে খেতে নারী হয়ে উঠি, চলতে ফিরতে আমাদের নানাবিধ শরীরী মূল্যায়নের মন্তব্য শুনে যেতে হয়, ধর্ষণের আশঙ্কা আমরা কাজে, পরিবারে, রাস্তাঘাটে নানা জায়গায় নানাভাবে আপন ও পর সম্পর্কে ধারণ করে চলি।

২০০০ সালে টিএসসিতে মিলেনিয়াম উদযাপনের সময় বাঁধনের ওপর নিপীড়ন কিংবা ২০১২ সালের ডিসেম্বরে নারী চিকিৎসকের ধর্ষণের কারণে মৃত্যু– কোনোটাই এই পুরুষালী শরীরসর্বস্ব নারীত্বের ভাবনার বাইরে নয়।

মতাদর্শিক এই শেকড় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও সমান বিদ্যমান। 'দুই লাখ কী তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে এই স্বাধীনতা' এই ভীষণ জাতীয়তাবাদী 'পুরুষালী' বাক্য নারীর নিপীড়ন যতটা না প্রকাশ করে, তার চাইতে নারীকে সম্ভ্রমহীনই করে তোলে বেশি। এমন কোনো সুযোগ এই 'মহাবয়ান' তৈরি করে না যাতে বীরত্ব কেবল যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো নয়, ধর্ষণের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার মধ্যেও নারী সমান দুর্জয় বীরত্ব প্রদর্শনের ক্ষমতা রাখে।

আর এই না দেখতে পাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নির্যাতনের পরেও 'ধর্ষিতা' পরিচয় ধারণ করতে রাজি থাকি না আমরা, যে কারণে ভিকির শিক্ষার্থী মেয়েটি ধর্ষণের অভিজ্ঞতা প্রকাশের পর সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করে। ঠিক একই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে 'বীরাঙ্গনাদের' সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে সমাজ আমাদের কেবল তাদের সঙ্গে 'বোনের' সম্পর্ক পাতানোর শিক্ষা দেয়। আমাদের সমাজে শরীরী পবিত্রতার মধ্য দিয়ে নারীর জন্য বিয়ের যে সামাজিক 'স্বাভাবিকত্বের' ছবি তৈরি হয়, সেই ছবি ধর্ষণকে গ্রহণ করে না। কাঙ্খিত 'স্ত্রী', কাঙ্খিত আদর্শ 'মা', এমনকি কাঙ্খিত কন্যা, কাঙ্খিত বোন, সামাজিক শরীরী পবিত্রতার মধ্যে দিয়ে তৈরি হওয়া সম্পর্ক। তাতে ধর্ষিতার কোনো স্থান নেই।

বীরাঙ্গনা রঞ্জিতা মল্লিককে দিয়েই আজকের লেখাটা শেষ করতে চাই। আমি আর ববি যখন টানা কিছুদিন রঞ্জিতার বাড়িতে সিনেমার কাজে যাওয়া-আসা করছি, 'বীরাঙ্গনা হিসেবে রঞ্জিতার খোঁজে কেউ ঢাকা থেকে এসেছে, তাঁর বেদখলের জমি রঞ্জিতা ফিরে পেতে পারে'– এ খবর একাত্তরের সেই রাজাকারদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কাজের শেষ দিনে রাজাকারদের গ্রামের দু' ব্যক্তি সাইকেলে করে আমাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। পরিচালক ববি আমাদের দুজনের নিরাপত্তা চাইতে ধারণকৃত ভিডিও ক্লিপ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। আমরা দুই নারীকে রূপসার ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার জন্য রঞ্জিতা মল্লিক আমাদের সঙ্গে ভ্যানে চড়ে বসেন।

আমার দিকে তাকিয়ে এই বীরাঙ্গনা তাঁর পান-খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁটে দিলখোলা হাসি ছড়িয়ে বললেন, ''আমারে ডরায়.. আমি বীরাঙ্গনা না! হেরা আমার সামনে দাঁড়াইতে পারে না!"

ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা: শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।