জগলুল ভাইকে ভুলব কেমন করে

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 5 Dec 2014, 06:41 AM
Updated : 5 Dec 2014, 06:41 AM

জগলুল আহমেদ চৌধুরী, প্রিয় জগলুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের, সেই ১৯৭৪ সাল থেকে। তখন তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার একজন সাধারণ প্রতিবেদক। আমি নিয়োজিত ছিলাম বৈদেশিক বাণিজ্যিক বিভাগের সেকশন অফিসার হিসেবে আমদানি শাখার দায়িত্বে। ওদিকে, আমার সহকর্মী খায়রুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন রপ্তানি শাখার দায়িত্বে। দুই চৌধুরীর বাড়ি সিলেট জেলায়; তাই আসা-যাওয়ার গতিপ্রকৃতিও ছিল অবাধ, বলা যায় প্রতিনিয়ত।

অবশ্য তখন সচিবালয়ে ঢুকতে কারও পাশের দরকার হত না। আমরা সচিবালয়ের ভিতরে বসে ভিখারিকে ভিক্ষাও দিতাম। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া, সামনে কয়েকজন পুলিশ। যাতে বড় গাড়ি না ঢুকে পড়ে বা ব্যাপক জোরে হর্ন না বাজায়, এই ছিল তাদের প্রধান ভাবনা। নিরাপত্তার বিষয় অতটা মূখ্য ছিল না, এখন যেমন হয়েছে। তাই প্রায়ই বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের আলোচনা হত; তার মধ্যে বাণিজ্যিক ভুবনে বিচরণকারীদের সংখ্যাই বেশি। যেহেতু প্রিন্ট মিডিয়া ছিল প্রধান, তাই সাংবাদিক বলতে ছিলেন পত্রিকার সাংবাদিকরাই।

জগলুল ভাইও এমন একজন সাংবাদিক, তবে নিতান্তই ব্যতিক্রমধর্মী একজন বিশিষ্টজন। যেমন ছিলেন অগাধ তথ্যের ভাণ্ডার, তেমনি একজন কাছের মানুষ যাকে সাংবাদিক মনেই হত না। ভাবতাম, একজন নিতান্ত বন্ধু মানুষ যার কাছে জানা যায় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিবিধি। অতি সহজে তিনি মিশে যেতেন আমাদের সকলের সঙ্গে। কথার মাঝে কখন আমাদের কাছ থেকে গরম খবরটি নিয়ে যেতেন, আমরা বুঝতেও পারতাম না। তবে তিনি ছিলেন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নীতিবান এবং শিষ্টাচারের অগ্রদুত। তাই তাঁর সঙ্গে সরকারি বিষয় এবং ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে আদৌ সঙ্কোচ বোধ করতাম না।

জগলুল ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কৃতীমান ছাত্র হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা ছিলেন যুক্তফ্রন্ট আমলের আইনমন্ত্রী। অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে নিয়মিত ভাবতেন জগলুল ভাই। কারণ '৭০এর দশক ছিল এক ক্রান্তিকাল, যখন বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়ে যায় দ্রুতগতিতে। তখন আমেরিকার রাজনীতি পরিচালিত হত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘিরে। যেমন, বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা বিক্রি করেছিল বলে পিএল-৪৮০এর চালের জাহাজ বাংলাদেশের পথে যাত্রা করেও, চট্রগ্রাম বন্দরে কোনোদিন ভিড়ল না। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে ১৯৭৪এর দুর্ভিক্ষে প্রায় এক লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

তখন বিশ্ব বাণিজ্যে মুক্তবাজার অর্থনীতি ছিল না, ছিল ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফের বেড়াজাল। ডিউটি ও কাউন্টার-ভেউলিং ডিউটির চক্রজাল, যা রাজনীতিকে সবসময় বিব্রত রাখত। বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল রাজনীতি; মুক্তবাজার অর্থনীতির ভাবনা তখন বিকশিত হয়নি। তাই আমরা জগলুল ভাইয়ের কাছে অনর্গল শুনতাম, জানতে চাইতাম বাণিজ্যিক ভুবনের গতিবিধি।

বংশানুক্রমে তিনি ছিলেন উদার গণতান্ত্রিকমনা, সিংহ হৃদয়ের ব্যক্তিত্ব, অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার এক মূর্ত প্রতীক। তাঁর মতো মুক্তমন ও মুক্তচিন্তার মানুষ বাংলাদেশে বিরল। গণতন্ত্র ছাড়া মানুষের প্রতিভার বিকাশ হতে পারে না এবং মুক্তচিন্তা ভিন্ন কোনো ব্যাক্তি মহৎ হতে পারে না, এমন আদর্শ ও ভাবনা ছিল জগলুল ভাইয়ের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। তার উপর তিনি ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ, নিরহংকার এবং নির্মল হৃদয়ের একজন মানুষ। অগ্রজ বা অনুজ, ধনী ও নির্ধন, এমন ভাবনা স্থান পায়নি তাঁর চিন্তায় ও মানসিকতায়। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠা জগলুল ভাই তাই আমাদের নমস্য। সত্যি বলতে কী, পরশ্রীকাতরতা, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, হীনমন্যতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।

সমানভাবে লিখতেন বাংলা ও ইংরেজিতে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ঘটনার বিশ্লেষণ করতেন। কোনো ঘটনার রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণে তিনি অনেক গভীরে যেতেন এবং কোনো বিষয় হালকাভাবে নিতেন না। বড় কথা হল, আবেগ বা দলীয় মানসিকতা নিয়ে আপ্লুত হয়ে কোনো বিষয় উপস্থাপন করে পাঠককে বিভ্রান্ত করতেন না। তাই বাংলাদেশে যে ক'জন কলাম লেখক আছেন, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন ভিন্নমাত্রার অন্যতম একজন ব্যক্তিত্ব ও লেখক।

জগলুল ভাইয়ের ভাবনায় ছিল বেশিরভাগ সময় দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি; তাই তার উপর অতি বিশ্নেষণধর্মী নিবন্ধ রচনা করতেন তিনি। তাঁর প্রতিবেদন ছিল পাঠকের কাছে অনেক প্রিয়; কারণ তাঁর ভাষা ও উপস্থাপনা ছিল তুলনাহীন। গত বছর ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান এবং ভারতীয় কংগ্রেসের দুর্বলতম দিকসমূহ তিনি বিশ্লেষণ করেছেন নিখুঁতভাবে, ভারতীয় জনতা পার্টির বিজয় সম্পর্কে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কয়েকবার।

জনগণের মূল্যায়ন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যালটের মাধ্যমে তার প্রতিফলন সর্ম্পকে তিনি অনেক বিদগ্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য দিকদর্শনমূলক হতে বাধ্য। অনেক নিবন্ধে বার বার সুশাসনের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, দেশ হয়তো অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে বা যাচ্ছে, কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে সেই দৃশ্যমান অগ্রগতি টেকসই হবে না। রাজনীতি ও অর্থনীতি এমন সুন্দরভাবে তাঁর লেখায় এবং টক-শোর আলোচনায় তুলে ধরেছেন যা অনবদ্য এবং অসাধারণ।

জগলুল ভাইয়ের সঙ্গে যতবার আলাপ করেছি দেশ-বিদেশের রাজনীতি নিয়ে অথবা তাঁর কোনো একটি নিবন্ধের উপসংহার নিয়ে, কখনও সাধারণ আলোচনা প্রসঙ্গে– একটি কথা তিনি বার বার জোর দিয়ে বলতেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হলে আমাদের স্বাধীনতার ভাবনাই বৃথা। সমাজে বৈষম্য দূর করতে না পারলে স্বাধীনতার চেতনা হবে অর্থহীন।

তিনি মনে করতেন, গণমাধ্যমের প্রধান কাজ হচ্ছে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সত্য তুলে ধরা এবং জনগণের কণ্ঠস্বর বা তাদের ভাবনা বিকশিত করার প্রচেষ্টা বা সঠিকভাবে প্রকাশ করাই হচ্ছে গণমাধ্যমের প্রধান কাজ। তিনি গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা নিয়ে ভাবতেন এবং তাকেই সর্বাধিক প্রাধান্য দিতেন। তাই আমরা এখনও মনে করি, জগলুল ভাইয়ের প্রতি তখনই সঠিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন হবে, যখন গণমাধ্যম জনগণের ভাষা ও ভাবনা তুলে ধরবে সঠিকভাবে। সঠিক তথ্য উপস্থাপনে বা আলোচনায় রক্তচক্ষুর ভয় থাকলে চলবে না। লেখনিতে দিকদর্শন থাকবে না। তিনি জানতেন, সাংবাদিকতায় কোনো প্রকার ভাবাবেগের প্রভাব থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে কষ্ট হবে, জনপ্রতিনিধিগণ তাদের দায়িত্বপালনে জনগণের কথা ভাববেন না। তাই গণমাধ্যমকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে যথাযথভাবে।

জগলুল ভাই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমরা আশা করি, তার এই ভাবনা আমাদের মাঝে চিরজাগ্রত থেকে আমাদের সবাইকে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনায় বিকশিত হতে সাহস জোগাবে।

ধীরাজ কুমার নাথ: কলাম লেখক।