অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য ইবোলা: আমরা কতটুকু নিরাপদ

মুনীরউদ্দিন আহমদ
Published : 22 Nov 2014, 07:41 AM
Updated : 22 Nov 2014, 07:41 AM

পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে তিন মাস ধরে দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে। দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ইবোলা ভাইরসের বিস্তার রোধ করা না গেলে আগামী জানুয়ারির মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা চৌদ্দ লাখে পৌঁছে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ নিয়ে সারাবিশ্বে এখন এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চেন আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবকে এক 'জরুরি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সমস্যা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই ভাইরাস সংক্রমণ রোধে তিনি পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানোর আহবান জানিয়েছেন। ওদিকে ইবোলার সংক্রমণের শিকার সিয়েরা লিয়ন ও লাইবেরিয়াতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। এই দুটি দেশ ছাড়াও নাইজেরিয়া, মালি ও গিনিতে ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পোলিও এবং ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী 'সোয়াইন ফ্লু'র প্রাদুর্ভাবের পর তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য নিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করল। ১৯৭৬ সালে প্রথম ইবোলা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এবারকার সংক্রমণে সর্বোচ্চ ৫,৫৩৭ জন মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। ১৯৭৬ সালে কঙ্গোতে ৩১৮ জন আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ২৮০ জন মৃত্যুবরণ করে। ১৯৯৫ সালে কঙ্গোতেই আবার ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং ৩১৫ জন রোগীর মধ্যে ২৫৪ জন মারা যায়। ১৯৭৬ সালে সুদানে ইবোলার কারণে ২৮৪ জন রোগীর মধ্যে ১৫১ জন মৃত্যুবরণ করে।

১৯৭০ সালের পর আফ্রিকার বহু দেশে দুয়েক বছর পর পর এই রোগের আবির্ভাব ঘটেছে এবং আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশই মারা গেছে। ২০০০ সালে উগান্ডাতে ৪২৫ জন এবোলা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ২২৪ জন মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার দশটি দেশে ২৫ বার ইবোলা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং এতে ৩,৩৪৮ রোগীর মধ্যে ২,৫৫১ জন মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুর হার গড়ে ৭৬ শতাংশ।

এই পরিসংখ্যান শুধু এটাই প্রমাণ করে যে, ইবোলা সংক্রমণ পঁয়তাল্লিশ বছর পরও অপ্রতিরোধ্য এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য এক মহাবিপর্যয় ও চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখাটিতে প্রদত্ত পরিসংখ্যান দেখে যে কারও মনে হতে পারে যে, ইবোলা শুধু আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ এবং আমাদের এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কথাটি সত্যি নয় এবং অগ্রহণযোগ্যও। সংক্রামক রোগের কারণে বিশ্বের কোনো দেশের কোনো অঞ্চলের কোনো মানুষই শতভাগ নিরাপদ থাকতে পারে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অন্যান্য জীবজন্তুর মতো সংক্রামক রোগের মূখ্য বাহক কিন্তু মানুষ। শুধু গত বছর প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ বিমান ভ্রমণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেছে। ফলে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভয়ঙ্কর সংক্রামক রোগ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ভয়াবহ সংক্রামক রোগে পঁচিশ শতাংশ অর্থাৎ ১৭৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।

আগেই যেমন বলা হয়েছে, সংক্রামক রোগের বিস্তাররোধ মানবসভ্যতা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ এক শহর থেকে অন্য শহর, এক দেশ থেকে অন্য দেশ এবং এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ভ্রমণ করছে। রোগের বাহক হিসেবে মানুষের এই ভ্রমণের ফলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

দুর্ভাগ্যক্রমে এইডস, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, সার্স এবং ইবোলার মতো সংক্রামক রোগ মোকাবেলার জন্য আমাদের হাতে কার্যকর ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই। আর এ কারণেই সংক্রামক রোগের সার্বিক ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে, পৃথিবীর ধনী-দরিদ্র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এসব রোগের বিস্তার, প্রতিরোধ, প্রতিকার, চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আদান-প্রদান স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত কার্যকর ও উপযোগী উপায়গুলোর একটি হতে পারে।

কঙ্গোর একটি নদীর নাম ইবোলা। এই নদীর নামে নামকরণ করা হয় এই ভাইরাসের। একে আগে বলা হত 'ইবোলা হিমোরেজিক ফিভার' বা ইবোলা রক্তক্ষরণজনিত জ্বর। এটি মানুষের জন্য একটি ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী রোগ। এতে আক্রান্ত সর্বোচ্চ নব্বই শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। রেইন ফরেস্ট বা বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনভূমির নিকটবর্তী মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা গ্রামে এই রোগের উৎপত্তি। বন্য জীবজন্তুর মাধ্যমে এটি প্রথমে মানুষকে সংক্রমিত করে এবং পরে মানুষ থেকে অন্য মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। টেরোপোডিডি (Pteropodidae) প্রজাতির এক ধরনের বাদুড়কে ইবোলার প্রাকৃতিক বাহক হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রকৃতিতে পাঁচ ধরনের ইবোলা ভাইরাস রয়েছে। এগুলো হল, যথাক্রমে, বুন্ডিবিউগিও ইবোলা ভাইরাস (Bundibugyo ebolavirus), জায়ার ইবোলা ভাইরাস (Zaire ebolavirus), রেস্টন ইবোলা ভাইরাস (Reston ebolavirus), সুদান ইবোলা ভাইরাস Sudan ebolavirus) এবং টাই ফরেস্ট এবোলা ভাইরাস Tai forest ebolavirus)।

বুন্ডিবিউগিও, জায়ার এবং সুদান ভাইরাস আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইবোলা সংক্রমণের মূল কারণ। চীন ও ফিলিপিনে রেস্টন ইবোলার উপস্থিতি শনাক্ত করা হলেও, এসব ভাইরাসের কারণে এ পর্যন্ত কোনো সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি।

সংক্রামিত জীবজন্তুর রক্ত, শরীর থেকে নিঃসৃত জলীয় পদার্থ, হাঁচি, কাশি এমনকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংস্পর্শের মাধ্যমে ইবোলা মানবদেহে প্রবেশ করে। আফ্রিকাতে মানুষ কর্তৃক রেইন ফরেস্টে ইবোলায় আক্রান্ত শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ফলভুক বাদুড়, বানর, অ্যান্টিলোপ ও শজারুর মৃতদেহের সংস্পর্শে যাওয়া ইবোলা মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার রেইন ফরেস্ট উজাড় করে ফেলার কারণে জীবজন্তু লোকবসতি এলাকার কাছাকাছি চলে যাওয়ায় বিপদ বেড়েছে। আফ্রিকার বহু মানুষ এসব জীবজন্তু শিকার করে, স্বহস্তে কাঁটা-ছেঁড়া করে, রক্ত পান করে এবং মাংস খায়। এতে পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে। মৃতদেহ সংস্কার করার সময় মানুষ এর সংস্পর্শে গেলে এ রোগের বিস্তার ঘটে।

যৌনমিলনের কারণেওে ইবোলা সংক্রমণ হতে পারে। কারণ সংক্রমণ থেকে আরোগ্য লাভের সাত সপ্তাহ পরও বীর্যে ইবোলার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। আবার স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত রোগীর নিবিড় পরিচর্যা করার সময় যথাযথ সতর্কতা গ্রহণ না করার কারণে প্রায়শই আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ইবোলা সংক্রমণের শিকার প্রত্যেক রোগীকে অনতিবিলম্বে সংক্রমণ রোধকল্পে নিরাপত্তামূলক এলাকায় (Quarantine) সরিয়ে নিতে হয় এবং আরোগ্যলাভ না করা পর্যন্ত শুশ্রুষা চালিয়ে যেতে হয়।

এ ভাইরাসের সংক্রমণ ও রোগের উপসর্গ দৃশ্যমান হওয়ার মধ্যে সময় লাগে ২ থেকে ২১ দিন। উপসর্গগুলো বহুলাংশে বিভ্রান্তিকর। হঠাৎ জ্বর আসা, তীব্র দুর্বলতা অনুভূত হওয়া, পেশীতে তীব্র ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, গলাব্যথা ও প্রদাহ, শরীরে দানা দানা গুটির উদ্ভব হওয়া ইবোলা সংক্রমণের প্রধান উপসর্গ।

এর পরপরই দেখা দেয় বমি, ডায়রিয়া, র‌্যাশ, কিডনি ও লিভারের কার্যাবলী হ্রাস এবং অভ্যন্তরীন ও বহিঃস্থ রক্তক্ষরণ। রোগীর শ্বেত রক্তকণিকা ও প্ল্যাটিলেট সংখ্যা হ্রাস এবং লিভার এনজাইমের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কারও রক্ত ও শরীরের তরল পদার্থে যতক্ষণ ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাবে ততক্ষণ তাকে আক্রান্ত বলে বিবেচনা করতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার একষট্টি দিন পরও মানুষের বীর্যে এ ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে।

ইবোলা নির্ণয় করার আগে যেসব সম্ভাব্য রোগের কথা সমান্তরালভাবে বিবেচনায় নিতে হয় তার মধ্যে রয়েছে, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, শিগেলোসিস, কলেরা, লেপটোস্পিরোসিস, প্ল্যাগ, রিকেটসিউসিস, পুনরাক্রমণ জ্বর, মেনিনজাইটিস, হেপাটাইটিস এবং অন্যান্য রক্তক্ষরণজনিত জ্বর। তাই শুধু উপসর্গ দেখেই ইবোলা সংক্রমণ নিশ্চিত করা যায় না। এ জন্য দরকার পরীক্ষাগারে ভাইরাস শনাক্তকরণ।

পরীক্ষাগারে ইবোলা শনাক্ত করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিজেন শনাক্তকরণ পরীক্ষা, সিরাম নিস্ক্রিয়করণ পরীক্ষা, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, সেল কালচারের মাধ্যমে ভাইরাস পৃথকীকরণ, এনজাইম লিংকড ইমিউনোসরভেন্ট পরীক্ষা (ELISA) এবং রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেইজ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন পরীক্ষা। আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। তাই নমুনা সংগ্রহের আগে সংগ্রহকারীকে অত্যন্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।

২৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ইবোলার ওপর আমার একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। সেই প্রবন্ধের উপসংহারে আমি লিখেছিলাম, সরকার জরুরি ভিত্তিতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ইবোলা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে, তবে আফ্রিকার যেসব দেশে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী যে কোনো সময় দেশে ফিরতে পারেন, তাদের পরীক্ষা করে দেশে ঢুকতে দেওয়ার বিষয়ে আমার লেখায় জোর দেওয়া হয়েছিল।

তারপরও, ১২ অক্টোবর দৈনিক 'কালের কণ্ঠ' পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখলাম, ৬ ইবোলা-কবলিতলাইবেরিয়া-প্রবাসী ইবোলা পরীক্ষা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তারা ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে কোনো ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই বরিশালের গৌরনদী ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নিজ বাড়িতে পৌঁছে যান। তারা এলাকায় যাওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিলে, কর্তৃপক্ষের নেওয়া কথিত পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। দেশবাসী বা কর্তৃপক্ষ তখনও জানত না যে, আগত প্রবাসীরা ইবোলামুক্ত কিনা।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া লাইবেরিয়ার মতো একটি ভাইরাসকবলিত দেশ থেকে প্রবাসীদের নির্বিঘ্নে দেশে ঢুকতে দেওয়া কর্তৃপক্ষের নিছক অজ্ঞতা ও অবহেলারই প্রকাশ বলে আমি মনে করি। সৌভাগ্যবশত, ভাইরাস সংক্রমণ ও রোগের উপসর্গ দৃশ্যমান হওয়ার সময় ২ থেকে ২১ দিন ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। ৬ লাইবেরিয়া-প্রবাসী ইবোলামুক্ত বলে মনে হচ্ছে। তারপরও, এ ধরনের ঘটনার পুনারাবৃত্তি যাতে আর না হয় সেদিকে কর্তৃপক্ষ ও সরকার নজর দেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

কারণ এটি এখন আর শুধু পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়ন, গিনি, মালি ও নাইজেরিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই, আফ্রিকার সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত্যুহারও বাড়ছে। সম্প্রতি সিএনএন টেলিভিশন চ্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন সেন্টারের পরিচালক ড. টম ফ্রিডেন জরুরি ভিত্তিতে এক দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তব্য ব্রেকিং নিউজ হিসেবে একাধিক চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। তার কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস হেলথ প্রেসবাইটেরিয়ান হাসপাতালে ইবোলায় আক্রান্ত প্রথম রোগী 'থোমাস এরিক ডানকান' ১৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাকে শুশ্রুষা করতে গিয়ে 'নিনা ফাম' নামে একজন নার্স আক্রান্ত হয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এছাড়াও 'অ্যামবার জয় ভিনসন' নামের অন্য একজন নার্স ইবোলাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তারা দু'জনই পরে সুস্থ হয়ে যান।

'এরিক ডানকান' লাইবেরিয়া থেকে ডালাসে পৌঁছার কয়েক দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি লাইবেরিয়াতে থাকাকালে সংক্রমণের শিকার হন। সাম্প্রতিক খবর, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক নাগরিক, শৈল্যচিকিৎসক 'ড. মার্টিন সেলিয়া' ১৭ নভেম্বর নেব্রাস্কা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' পত্রিকার সূত্রমতে, তাঁকে খুব বিপন্ন অবস্থায় সিয়েরা লিয়ন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চুয়াল্লিশ বছর বয়সী এ চিকিৎসক সিয়েরা লিয়নে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

'এরিক ডানকান'এর দৃষ্টান্ত থেকে এটুকু বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না যে, সুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরলেও এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, কেউ আফ্রিকাতে ইবোলা সংক্রমণের শিকার হননি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাইরাস সংক্রমণ ও রোগের উপসর্গ দৃশ্যমান হতে কম করে হলেও ২ থেকে ২১ দিন সময় লাগে। সুতরাং যে সব বাংলাদেশি নাগরিক লাইবেরিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন তাদের অনতিবিলম্বে সংক্রমণ রোধকল্পে নিরাপত্তামূলক এলাকায় (Quarantine) সরিয়ে নেওয়া এবং তারা ইবোলায় আক্রান্ত কিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তামূলক এলাকায় তাদের বিছিন্ন রাখা একান্ত দরকার ছিল।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইবোলা-কবলিত অঞ্চল ভ্রমণ করে দেশে ফেরার পর তাদের ওপর কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তামূলক এলাকায় রাখা হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জ্বর ও অন্যান্য সন্দেহমূলক উপসর্গ নিয়ে দেশে ফেরার পর পর্যটকদের আর বাড়ি যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের সরাসরি হাসপাতাল বা অন্যান্য কোয়ারিন্টিন বা নিরাপত্তামূলক এলাকায় বিচ্ছিন্ন রেখে চিকিৎসা ও শুশ্রুষা দেওয়া হচ্ছে।

শুধু আমেরিকা নয়, পর্যটক বা প্রবাসীদের কারণে আরও অনেকগুলো দেশে ইবোলার বিস্তার ঘটছে। পর্যটকদের কারণে সারা বিশ্বে এটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বিশ্লেষককেরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। নাইজেরিয়ার এক পর্যটক লাইবেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরার পর তার অঞ্চলে রোগটির বিস্তার ঘটে, যদিও তা পরে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। একইভাবে সেনেগালের এক পর্যটক গিনিতে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অস্ট্রেলিয়ার একটি ঘটনা পড়লে আমরা বুঝতে পারব বিশ্বব্যাপী সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ ইবোলা বিস্তারের বিষয়টি কত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছে এবং এটি নিয়ন্ত্রণে কী কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সাতান্ন বছর বয়সী এক স্বেচ্ছাসেবী নার্স এক মাস সিয়েরালিয়নে ইবোলায় আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে কাজ করে দেশে ফেরার পর, ৯ অক্টোবর জ্বরে আক্রান্ত হন। তাকে জরুরি ভিত্তিতে বাসা থেকে হাসপাতালের নিরাপত্তামূলক এলাকায় নিয়ে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। প্রথম পরীক্ষায় জানা যায় যে, তিনি ইবোলায় আক্রান্ত নন। কিন্তু দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য তাকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত নিরাপত্তামূলক এলাকায় বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। দ্বিতীয় পরীক্ষায় চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন যে, রোগী ইবোলামুক্ত। তারপরও তাকে বাসার নিরাপত্তামূলক এলাকায় ২১ দিন থাকতে হবে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, তিনি ইবোলা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

একইভাবে নিরাপত্তামূলক এলাকায় বিচ্ছিন্ন রেখে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ফেরত আসা পর্যটকদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, চেক রিপাবলিক, ফ্রান্স, কেনিয়া, মেসিডোনিয়া, পোলান্ড, উগান্ডাসহ আরও অনেক দেশ। অথচ বাংলাদেশে লাইবেরিয়া থেকে ফেরত আসা ৬ বাংলাদেশি কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই, নিরাপত্তামূলক এলাকায় না থেকেই দিব্বি বাড়ি চলে গেলেন।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, ইবোলায় সংক্রমণের উপসর্গ দৃশ্যমান হওয়ার সময়সীমা ২১ দিনের মধ্যেই তারা তখনও ছিলেন। আরও একটি ব্যাপার আমাদের খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত, বাংলাদেশ বা চীনের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ইবোলা একবার ঢুকতে পারলে তার বিস্তার রোধ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

ইবোলার সংক্রমণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য এক দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইবোলা-কবলিত দেশগুলোর নার্স ও চিকিৎসকরা এই রোগ সামলাতে পারছেন না। ফলে উন্নত দেশ থেকে সেখানে যাচ্ছেন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের বেশ কয়েকজন পরে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নিচ্ছিদ্র আপাদমস্তক নিরাপত্তামূলক পোশাক-পরিচ্ছদ, উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি, ওষুধ-পথ্য ব্যবহার করেও নির্ভীক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ইবোলা-সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

তাই আফ্রিকার ইবোলা-আক্রান্ত রোগীদের জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এবং সুস্থ হওয়ার পর দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ভারত বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটলে তার নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তাররোধ ঠেকানোর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল, প্রযুক্তিগত জ্ঞান-বুুদ্ধি, যন্ত্রপাতি, সাহস, ধৈর্য নেই।

ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের তুলনা হয় না। ভারত এই খাতে অনেক এগিয়ে। তারপরও বিশেষজ্ঞরা ইবোলা-ম্যানেজমেন্টে ভারতের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। আর সে কারণেই আমাদের মতো ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশে ইবোলার প্রবেশ ও বিস্তার এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে বলে তা যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে।

পিটার পিয়ট, যিনি ইবোলা আবিষ্কার ও নামকরণ করেছেন, তিনি 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন:

"উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপ ইবোলার প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার দ্রুত ও সহজে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। আমি চিন্তিত এই ভেবে যে, ভারতের অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ও কর্মী হিসেবে পশ্চিম আফ্রিকায় কাজ করছেন। তাদের মধ্যে যে কোনো একজন যদি এবোলায় আক্রান্ত হয়ে ভারত ভ্রমণ করে, ইবোলার সুপ্তাবস্থায় (Incubation) আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং অসুস্থ হয়ে পাবলিক হাসপাতালে ভর্তি হয়, তবে তাতে এক মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে। ভারতের চিকিৎসক ও নার্সরা প্রায়শই নিরাপত্তামূলক হাতমোজা (Gloves) পরেন না। ফলে তারা রোগীর চিকিৎসা ও শুশ্রুষা করতে গিয়ে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। পরবর্তীতে তারা ইবোলার বাহক হিসেবে অসংখ্য মানুষকে সংক্রামিত করে এই প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার ঘটাবেন।''

আগেই বলেছি, বাংলাদেশের অবস্থা নিশ্চয়ই ভারতের চেয়ে ভিন্ন নয়, উন্নতও নয়। বরং অবস্থা এমন যে, ছোটখাট রোগের চিকিৎসায়ও আমাদের ভারতে দৌড়াতে হয়। ভারত সম্পর্কে একজন ইবোলা বিশেষজ্ঞের মতামত যদি এমন নেতিবাচক হয়, তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ও চিন্তাধারা কেমন হবে, তা বুঝে নিতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

কিছুদিন আগে জেনেভাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চেন বলেছেন, ইবোলার প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এক মহাসংকটের সৃষ্টি করছে। কারণ ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ইবোলা-সংক্রমণের কারণে মারা গেছেন ৫,৫৩৭ জন। এর মধ্যে লাইবেরিয়াতে ২,৮১২ জন, গিনিতে ১,১৬৬ জন, সিয়েরা লিয়নে ১,৫৪৫ জন, নাইজেরিয়াতে ৮ জন, মালিতে ৫ জন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ ইবোলায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯৬১ জন।

১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পঁয়তাল্লিশ বছরে আফ্রিকার দশটি দেশে ২৫ বার ইবোলা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে ৩,৩৪৮ জন রোগীর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছিলেন মোট ২,৫৫১ জন। অথচ শুধু গত তিন মাসে ইবোলা সংক্রমণে মৃত্যু হল ৫,৫৩৭ জনের। ড. মার্গারেট চেন বলেছেন, ইবোলা রোগীর সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে যে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আতঙ্কের ব্যাপার হল, এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর চল্লিশ শতাংশই ঘটেছে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে। সুতরাং সামনের সপ্তাহ, মাস বা বছরে কী ঘটবে তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না কেউ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ ড. ক্রিস্টোফার ডাই বলেছেন, ইবোলায় মৃত্যুর বর্তমান গতিধারা চলতি থাকলে আমরা প্রতি সপ্তাহে শত শত রোগী মারা যাওয়ার পরিবর্তে হাজার হাজার রোগী মারা যাওয়ার দৃশ্য দেখব। ড. ডাই আরও বলেন, বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে ৫ শত মানুষ ইবোলায় আক্রান্ত হচ্ছে। এই সংখ্যা আরও কত দ্রুত বাড়বে তা বলা দুষ্কর।

পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে ইবোলার প্রকোপ এতটাই মারাত্মক রূপ নিয়েছে যে, বলা হচ্ছে এইচআইভি এইড্সের পর এটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। গিনির রাজধানী কোনাক্রিতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে দাতব্য সংস্থা মেডিসিন সাঁ ফ্রঁতিয়াস। সংস্থাটি বলেছে, দ্রুত হারে এটি ছড়াতে থাকায় সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রেও এখন তারা হিমশিম খাচ্ছেন। গিনি, সিয়েরালিয়ন ও লাইবেরিয়ার রাজধানী শহরগুলোতেও রোগটি ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা।

কবে নাগাদ এই রোগের সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবের সমাপ্তি ঘটবে তা পরিষ্কার নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, ইবোলা প্রাদুর্ভাব ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তবে যদি পর্যাপ্ত অর্থ, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও সেবা-সামগ্রী প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়। আর এই কারণেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য উপাত্ত, সাহায্য-সহযোগিতার আদান-প্রদান ইদানিং সহজলভ্য হয়ে ওঠার কারণে অনেক বিপর্যয় সময়মত ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। একইভাবে ইবোলা সংকট মোকাবেলা করে বিশ্বের লাখো কোটি মানুষকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছ থেকে এখনও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই যে, ইবোলা রোগের চিকিৎসায় এখনও কার্যকর ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়নি। তবে অনেকগুলো ওষুধ কম্পানি ভ্যাকসিন আবিস্কারে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে এক বা একাধিক ভ্যাকসিন সীমিত ব্যবহারের জন্য হাতে পাওয়া যাবে।

এর মধ্যে গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন ওষুধ কোম্পানির একটি ভ্যাকসিন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালি ও সুইজারল্যান্ডের দু'শ' মানুষের ওপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে। এই ভ্যাকসিন নিরাপদ বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এটি ইবোলায় আক্রান্ত মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়নি, সুস্থ মানুষের ওপর প্রয়োগ করে এর নিরাপত্তার দিকটি পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে রয়েছে শিম্পাঞ্জি থেকে নেওয়া একটিমাত্র ইবোলা ভাইরাস জিন যা শরীরে প্রয়োগ করলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। তবে ভ্যাকসিনটি ইবোলা সংক্রমণ প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণে কতটুকু কার্যকর হবে তা এখনও নিশ্চিত নয়।

পরীক্ষাধীন আরেকটি ওষুধ জিম্যাপ (Zmapp) কিছু এবোলায় আক্রান্ত রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু এই ওষুধ সব রোগীকে সুস্থ করতে পারেনি। ওষুধটি গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের দু'জন এবং যুক্তরাজ্যের একজন স্বাস্থ্যকর্মী সুস্থ হলেও লাইবেরিয়ার একজন চিকিৎসক এবং স্পেনের একজন ধর্মযাজক মৃত্যুবরণ করেন।

এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর একমাত্র চিকিৎসা বিশ্রাম, শুশ্রুষা ও পানীয় পান। ইবোলা আক্রান্ত রোগী পানিশূন্যতায় ভোগে। তাই রোগীকে ঘন ঘন মুখে খাওয়ার স্যালাইন বা প্রয়োজনবোধে ইলেকট্রোলাইট (electrolyte) সমৃদ্ধ ইনজেকশন প্রদান করতে হয়।

এই প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে আমাদের অবশ্যই কিছু করণীয় আছে। ইবোলা-আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার এখনও হতাশাব্যঞ্জক হলেও তা কমিয়ে আনা দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। ব্যক্তিগত ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় আমরা যা করতে পারি তার মধ্যে রয়েছে:

১.

ভয়-ভীতি, শঙ্কা বা হতাশা নয়– পর্যাপ্ত বিশ্রাম, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, সুষম খাবার খাওয়া, ভিটামিন ডি গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে এ রোগ মোকাবেলা করতে হবে।

২.

অনেক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধের চেয়ে সেবা-যত্ন, ঘুম, পর্যাপ্ত পানি পান ও সুষম খাবার রোগীকে অতিদ্রুত আরোগ্যলাভে সাহায্য করে;

৩.

আমাদের মনে রাখা দরকার যে, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ও অন্যান্য ফ্লু নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে উঠেছিল এবং বিশ্বব্যাপী অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল। এসব আতঙ্ক সৃষ্টির পেছনে ওষুধ কোম্পানি, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও এক শ্রেণির চিকিৎসকের উস্কানি থাকে। ১৯৭৬ সালেও বিশ্বব্যাপী সোয়াইন ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য উপাত্ত, সাহায্য-সহযোগিতার আদান-প্রদান ইদানিং সহজলভ্য হয়ে উঠার কারণে অনেক বিপর্যয় সময়মতো ঠেকানো গেছে।

৪.

ইবোলা-প্রাদুর্ভাবের সুযোগ নিয়ে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল, বিশেষ করে চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে কোনো অকার্যকর বা ক্ষতিকর ওষুধ বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে লাখো কোটি নিরীহ মানুষের ক্ষতি সাধন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা ভুলে যাইনি যে, ১৯৭৬ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীর ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষকে প্রতিষেধক প্রদান করা হয়েছিল, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করেছিল।

৫.

ওষুধ দিয়ে ভাইরাস সংক্রান্ত সংক্রমণ ঠেকানোর এখনও কোনো পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়নি। ওষুধ আরএনএ (RNA) ভাইরাসকে কার্যকরভাবে টার্গেট করতে পারে না। তাই ইবোলাসহ সব ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

৬.

আফ্রিকার যেসব দেশে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস অসংখ্য জীবন কেড়ে নিয়েছে, সেসব দেশের কোনো মানুষ অসুস্থ অবস্থায় ভ্রমণ করছে কি না সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। ওসব দেশগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী রয়েছে। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব।

ভালো কথা যে, সরকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ইবোলা প্রতিরোধের ব্যাপারে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের বেলায় তাদের আরও তৎপর হতে হবে।

৭.

সংক্রামক রোগসহ সব রোগের প্রতিরোধ, প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হবে এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের পড়াশোনার আর জানার আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর তাই অতিসাধারণ রোগের বেলায়ও আমরা কী করব তা বুঝে উঠতে পারি না। মনে রাখবেন, জ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে আমরা প্রায়শই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদের মুখোমুখি হই।

পরিশেষে একটি প্রার্থনা। শুধু আক্রান্ত দেশের মানুষ নয়, আল্লাহ যেন বিশ্বের সব মানুষকে রোগমুক্ত জীবনযাপনের তৌফিক প্রদান করেন, এই আমাদের প্রত্যাশা।


ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ:
প্রফেসর, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।