রৌরব (কিস্তি ৫)

লীসা গাজী
Published : 1 March 2009, 03:59 AM
Updated : 1 March 2009, 03:59 AM

(কিস্তি ৪-এর পর)

বিয়ের পরে স্বামীর ঘর করতে যখন একটা ছোট্ট মফস্বল শহর ছেড়ে ফরিদা ঢাকায় এলেন তখন তার খুশির অন্ত ছিলো না। এমন না যে তিনি বিয়ে পাগলা মেয়ে ছিলেন, বা দশ বছর বয়স থেকেই পুতুল খেলার নামে নিজের
—————————————————————–
পেচাইতাছিস কেন, সমস্যা কুথায়?

– উনার বিয়া করার ক্ষমতা নাই।

… আম্মার কপালের দুশ্চিন্তা চোখে নেমে এলো। … মেয়ের চোখের দৃষ্টি এবার নিজেই সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেন। ধরে আসা গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করলেন।

– এই কথা কাক-পক্ষীও যেন টের না পায়। বড় বেটির কাম হইলো হজম করা, হজম কর — কপালে যা ছিলো হইছে। মানুষে যেন না হাসে — সেই সুযুগ কাউরে দিবি না। স্বামীর অপমান নিজের অপমান। এখন ঐ বাড়িই তোর সংসার, এই লোকই তোর স্বামী — যেমনই হোক।

আম্মার বলা প্রতিটা শব্দ হাতুড়ির বাড়ির মতো ফরিদার মগজে ঘা মারছিলো। অবশ্য তিনি জানতেন এই বিয়ে তাকে মেনে নিতে হবে, এখন নিজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তার নিজের।

—————————————————————-
সংসারের ছবি আঁকতেন, ব্যাপারটা মোটেও তা না। তবে সব সময়ই নিজের জিনিসের প্রতি তার অন্ধ টান, একরোখা মনোযোগ সব কিছুকে ছাড়িয়ে যেতো। আমার বাড়ি, আমার ভাইবোন, আমার ঘর, — এই 'আমার' বোধটা তার ভিতরে ছিলো বাড়াবাড়ি রকম সজাগ; স্বামী বা সংসারের চেয়ে নিজের আর কী হতে পারে। সুতরাং যেদিন তিনি স্বামীর সংসারে পা দিলেন সেদিনই 'আমার স্বামী' বা 'আমার সংসার' অবলীলায় 'আমার বাপের বাড়ি' বা 'আমার ভাই-বোন'-এর চেয়ে আপন হয়ে উঠলো। স্বামী-সংসারের কাছে আর সব কিছুই হয়ে গেলো ফেলনা। আরেকটা ব্যাপারে ফরিদার একাগ্রতা লক্ষ্য করার মতো ছিলো — তিনি যাই করবেন, তাতে যেন কোনো খুঁত না থাকে। লাভলি-বিউটির বিয়ের জন্য অনেক প্রস্তাবই এসেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণে ধরে কোনো পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে পারলেন না ঐ এক কারণে। প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো খুঁত বেরিয়ে এলো, একেবারে নিখুঁত পাত্র পাওয়া গেলো না। যার তার হাতে তুলে দিয়ে মেয়েগুলোকে পানিতে ফেলবেন নাকি! এই ভাবনাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ালো। যদিও মনটা তার আজকাল কিঞ্চিৎ টলে যাচ্ছে।

লাভলি এসে জানালো বিউটি ঘুমাচ্ছে। অসম্ভব বিরক্ত হলেন ফরিদা। 'এইটা কী! দিনের কুনো হিসাব নাই, কিছু না — আল্লাহর তিরিশটা দিন বারোটার আগে ঘর থাইকা বাইর হয় না। আইজ বোনটার জন্মবার, আইজ একটু সকাল সকাল উঠ… শয়তান, শয়তানের কঠিন শাস্তি পাওনা হইছে।'

নিজের মনেই ফরিদা ধমকে উঠলেন আর তার ভ্রূজোড়া ভীষণভাবে তেরছা হয়ে গেলো। লাভলিকে তৈরি হতে বললেন। তার তখনও আশা দরজা কয়েক বার ধাক্কা দিলে হয়তো মহারানী বের হবেন।

লাভলি বড় জোর পাঁচ মিনিটে তৈরি হলো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বুক হু হু করে উঠলো ফরিদার। বয়সের ছাপ স্পষ্ট হচ্ছে! এই ঘটনা কবে ঘটলো। মেয়েটা এমন বুড়িয়ে গেছে কবে থেকে। চোখ ভিজে উঠছে টের পেতেই মুখের কাঠিন্য জোরদার করলেন। বিউটির ঘরের দরজায় দুম দুম কয়েকটা কিল দিলেন। দরজা তো খুললোই না, ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া গেলো না। ক্লান্ত বোধ করলেন ফরিদা। সকাল থেকে রাত অব্দি সংসার টেনে নিয়ে যেতে হবে এই উপলব্ধি তাকে অসাড় করে ফেললো। এখন মেয়েটাকে নিষেধ করে দিতে পারেন, বিউটি যেহেতু দরজা খুলছে না আজকে আর বাইরে গিয়ে কাজ নাই, বা ওর জন্য অপেক্ষা করতেও বলতে পারেন তাহলে বের হতে হতে বারোটা সাড়ে বারোটা বাজবে, তখন বের হয়েই বা লাভ কী, দুপুরের খাওয়ার আগে তো ফিরতে পারবে না অথবা নিজেই দুই মিনিটে তৈরি হয়ে ওর সাথে যেতে পারেন। সেটাই করতে হবে ভেবে তৈরি হতে উঠলেন ফরিদা। কিন্তু তিনি গেলে রাঁধবে কে? হাঁসের মাংস, ইলিশ পোলাও… না, না তার যাওয়া চলবে না। এই সব ভাবতে ভাবতে শোবার ঘরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এলেন। কোনো উপায় নাই, কাল পরশুই না হয় যাক, হয় আমরা তিনজন গেলাম, না হয় ওরা দুই বোনে গেলো। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলেন কালো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে লাভলি খাবার টেবিলে চা সামনে নিয়ে বসে আছে। ওর কাঁধ ছাড়িয়ে দু'টা লম্বা বেণী অসহায়ের মতো ঝুলছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে না, তস্তুরিতে আনমনে চা'চামচ দিয়ে টুং টাং শব্দ করছে শুধু। বসে থাকার ভঙ্গিতে রায় শোনার ভাবটা স্পষ্ট। কোনো অভিমান না, প্রতিবাদ না, যা বলা হবে তাই নিঃশব্দে মাথা পেতে নিতে রাজি।

— যা, আর দেরি করিস না। দুপুরের খাওয়ার আগে আগে চইলা আসিস। পছন্দ কইরা তোর জন্য এক সেট কি দুই সেট শেলওয়ার কামিজের কাপড় কিনিস। বিউটির জন্যও কিনিস এক সেট।… থাক, দরকার নাই। হারামজাদী ঘুমাক।

নিজের বলা কথায় নিজেই চমকে উঠলেন। লাভলিকে একা যেতে বললেন। এইসব তিনি কী শুরু করেছেন?

— আম্মা, আমি একা যাবো?

ভীষণ মাত্রায় অসহায় শোনালো ওর গলা। যেন একা একা সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে বলা হচ্ছে।

— একা যাবি না তো পুলিশ পাহারায় যাবি না কী? খালি বেহুদা কথা।

তবুও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছে না লাভলি। আম্মা হয়তো এখনি বলবেন, 'দাঁড়া তোর সাহস আমি বাইর করতাছি… এ্যাহ্, একা একা গাওছিয়া যাবে, — আহ্লাদ কতো বড়!' — কিন্তু ফরিদা খানম এসবের কিছুই বললেন না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ঢুকে কী নিয়ে যেন রাবেয়ার মা'র উপর চড়াও হলেন। কোনো কথাই তখন লাভলির কানে ঢুকছে না, এবং সে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। চল্লিশ বছরের অভ্যাস কী আর এক কথায় উল্টে যেতে পারে! ফরিদা খানম বললেও পারে না।

— বেকুবের মতো বইসা আছিস কেন? বললাম না ঘুইরা আয়। সিএনজি নিয়া যাবি। যা চাবে তাই দিবি। ভাড়া নিয়া ঝগড়া করবি না। কালকে রাতে তোর আব্বা কতো টাকা দিছে, বারো শ' না দুই হাজার?

— দুই হাজার।

* * *

লাভলি ঘরের দরজা খুলে বাইরে পা দিতেই ভয় আর অনিশ্চয়তা ফরিদার বুকে দাঁত বসালো। জিহ্বা থেকে কণ্ঠনালী পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। প্রাণপনে বলতে চাইলেন, 'তুই একা কই যাস? তোর আস্পর্দা তো কম না হারামজাদী? … আমারে চিনস না, হাত পা ভাইঙ্গা লুলা বানায়া ফালায় রাখুম।' কিন্তু তার গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। ধীরে তার চোখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। তিনি কোনো রকমে নিজের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়ালেন। এই জানালা দিয়ে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা আর গলির মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন, কয়েক সেকেন্ড পরে লাভলিকে দেখলেন বড় লোহার গেইটের গায়ের ছোটো গেইটটা খুলে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো, মাথার উপর ওড়না দিলো আর কালো কার্ডিগেনের উপর শালটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ফরিদা ভাবলেন, লাভলি হয়তো মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকাবে, তাহলে উনি তাড়াতাড়ি যেতে বলবেন বা কিছু, কিন্তু লাভলি পিছন ফিরে ওপরে তাকালো না একবারও। গেইট খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন কী করা উচিৎ এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত না। তখনই ফরিদা প্রাণপনে চেঁচিয়ে উঠলেন।

— পিচ্চি এই পিচ্চি। মইরা থাকে সবগুলা।

— জি নানি?

— যা, শিগগির যা, বড় খালা গেইটের সামনে দাঁড়ায় আছে, গাউছিয়া যাবে, একটা সিএনজি ধরায় দিয়া আয়।

— আপায় একা যাইবো?

পিচ্চি তার আড়াই বছরের চাকরী-জীবনে কোনো আপাকেই কোথাও একা যেতে দেখে নাই, ঘাবড়ে গেলো একটু।

— খালি কথা, খালি কথা — থাপড়ায়ে মনে হয় দাঁতগুলা ফালায় দেই। এতোক্ষণে গলির মোড় পর্যন্ত চইলা গেছে। দৌড় দে। যাবি, সিএনজি ধরায় দিয়াই চইলা আসবি, বুঝছস?

মাথা নেড়ে সায় দিলো কি দিলো না ছুট লাগালো আর সঙ্গে সঙ্গে ফরিদার মনে কু ডাক দিয়ে উঠলো। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটাই যে আজকে তিনি করলেন এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। শীতের সকালেও ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে খাটের উপর বসলেন। একবার ভাবলেন গাউছিয়া যাবেন, কিন্তু উঠে দরজা খুলে রওনা হবার মতো কোনো শক্তি খুঁজে পেলেন না। এই প্রথম আরেকটা নতুন ভাবনা মাথায় এলো, বয়স তার বা মুখলেস সাহেব কারোরই কম হয় নাই, কয়দিন আর বাঁচবেন — মেয়ে দুইটার তখন কী হবে? এই দুনিয়ায় তাদের তখন একাই চলতে হবে। যাক ভালোই হয়েছে একা পাঠিয়েছেন। অভ্যাস হোক — এই সব ভেবেও ফরিদার শান্তি হচ্ছে না। হাত পা কেমন ঠাণ্ডা বরফের মতো হয়ে যাচ্ছে।

— খালাম্মা, হাঁসের মাংস গলছে। পিঁয়াজ কাটছি।

রাবেয়ার মার গলা প্রায় শোনাই গেলো না কিংবা হয়তো জোরেই বলেছে চিন্তার মধ্যে ছিলেন বলে ঠাহর করতে পারেন নাই।

— কী?

— মাংস গলছে।

— ঠিক কইরা বলো… নতুন বউয়ের মতো মিন মিন করতাছো কেন? পিঁয়াজ কাটছো?

— জি কাটছি।

— ফ্যান বন্ধ করো, বড় আপার বিছানা ঝাইড়া সুন্দর কইরা বিছাও।… আরে, কথা না শেষ করতেই দৌড় দেও কেন… পিচ্চি ফিরছে?

— জি।

— ওরে পাঠাও।

ঘরের কাছে এসে পিচ্চি দাঁড়ালো, হাতের স্পর্শে পর্দা নড়ে উঠলো।

— নানী ডাকছেন?

— তোরে না বলছি সিএনজি ধরায় দিয়াই চইলা আসবি, কথা কান দিয়া যায় না।

— ধরায় দিয়াই চইলা আসছি।

— ঠিক মতো সিএনজিতে উঠছে।

— জি উঠছে।

— সিএনজিওয়ালা বুড়া না জুয়ান?

— বেশি জুয়ান না, বুড়াই।

— সকালের কাজ শেষ হইছে?

— জি, নানা পেপার চায়।

— আমারে কস কেন? আমি কি পেপার নিয়া বইসা আছি। বসার ঘর থিকা নিয়া যা। নানায় কই?

— পিছনের বারান্দায় বইসা আছে।

* * *

মুখলেস সাহেবের মতো এরকম নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যদি তার হতো, কারো সাতে নাই পাঁচে নাই, আগে নাই, পিছে নাই — ধরতে গেলে কোথাওই নাই। একটা অস্তিত্বহীন নিঃসাড় জীবন কেমন আলগোছে কাটিয়ে যাচ্ছেন। বিয়ের কয়েক দিনের মাথায় প্রথম নাইওর গিয়ে ফরিদাও শুধু কয়েক দিনের জন্য এরকম নিঃসাড় হয়ে থাকলেন। ফরিদার মা খুব ডাকসাঁইটে মহিলা ছিলেন। তার কথায় অতো বড় পরিবার উঠতো আর বসতো। মা'র কথার নড়চড় তার দাদিজানও কখনও করতেন না। দেখতে ছিলেন ছোটখাটো একরত্তি মানুষ, কিন্তু চাল-চলন, ঠমক-ঠামক ছিলো সিংহিনীর মতো। যেখানে হাত দিতেন সেখানেই নাকি সোনা ফলতো। সেই পয়মন্ত মায়ের গল্প দাদিজান খুব গর্বের সাথে সবাইকে বলে বেড়াতেন। এমনকি বাড়িতে ফকির মিসকিন আসলে তাকেও শুনতে হতো।

— হায়দারের মা, ফকির বেটি কতোক্ষণ ধইরা বইসা আছে, এখনও দুই মুঠা চাইল দিতে পারলা না? — বুঝলা, মাইঝলা বউমা এই বাড়িত যেদিন পাও দিলো সেদিন ঘটনা হইলো অন্য রকম। আমগো ভাইগ্য আতখা এইখান থিকা এক লাপ দিয়া উঠলো এইখানে।

লাফটা যে কতো বড় তা দেখাবার জন্য ফরিদার দাদিজান তার ডান হাত উপুড় করে একদম মাটির কাছাকাছি রাখতেন আবার মুহূর্তে তার কাঁধ বরাবর নিয়ে আসতেন, তার চোখ থেকে হাসি চুঁইয়ে পড়তো। তখন হয়তো ফরিদার মা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, বা উঠানে বসে কোনো ভাইবোনের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন — দাদিজানের এইসব আলাপে তার কোনো আহ্লাদ হতো না।

— আম্মা, আপনে থামেন। চিনা নাই শুনা নাই সবের সাথে এতো গপের দরকার কী!

আম্মার ধমক খেয়েও দাদিজান পরমানন্দ লাভ করতেন আর যাকে বলছেন সে পয়মন্ত বউয়ের বেয়াদবী দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতো।

সেই আম্মাজান নাইওর বাসের দ্বিতীয় দিনে ফরিদাকে একান্তে ডাকলেন। ফরিদারা পাঁচ ভাইবোনের সবাই মা'কে যমের মতো ভয় পেতেন আর বাবা ছিলেন সবার কাছে দুধ-ভাত তুল্য। আম্মা কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার সত্যি জবাব দিতে হবে এই ছিলো নিয়ম, এই নিয়মের খেলাপ স্বয়ং দাদিজানও করতেন না।

— বিয়ার দুইদিন পরে বাপের বাড়ি আসছস, মুখ বেজার কেন? কী হইছে?

— কিছু হয় নাই আম্মা।

— হইছে ঠিকই… কথা হইতেছে তুই বলতে চাস কি চাস না।

ফরিদা দীর্ঘক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। এই চুপ করে থাকার সময়টুকু আম্মা কোনো তাগাদা দিলেন না। বালিশের ওয়াড়ে ফুল তুলছিলেন।

— আমি বলতে চাই না।

— বলতে না চাইলে বলবি না। কিন্তু বললে মনে হয় ভালো, আমি একটা উপায় চিন্তা করতে পারি।

— উপায় নাই।

এইবার ফরিদার মা খানিকটা সময় চুপ করে থাকলেন। ধীরে সুস্থে বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে সুঁই গেঁথে পাশে রাখলেন। কপালে দুশ্চিন্তার সরু রেখা চান-রাতের চাঁদের মতো দেখা দিলো কি দিলো না।

— রাহেলার বিয়ার পরে কতো দেইখা শুইনা তোর বিয়া ঠিক করলাম। রাহেলা যেমনে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার মুখ বুইজা সহ্য করে সেইটা আমার দুই চক্ষের বিষ। ভাবলাম বড় মেয়েরে এতো বড় পরিবারে বিয়া দিয়া যে ভুল করছি ছোট মেয়ের বেলায় সেই ভুল আর করবো না। তোরে বিয়া দিলাম এমন একজনের কাছে যার আগে পিছে কেউ নাই। দুলামিয়া সব দিক দিয়া সোনার টুকরা ছেলে। বড় চাকরি করে, দেখতে শুনতে ভালো, আদব লেহাজ আছে।… ফরিদা, আমার মুখের দিকে তাকা!

ফরিদার মাথা আরও এক বিঘা নিচে নেমে গেলো। সেই মুহূর্তে ফরিদা চাইছিলো মাটির সাথে মিশে যেতে। তার বয়স তখন ১৯। বিয়ের জন্য ১৯ বছর তখনকার দিনে ভালোই বয়স। তিন কূলে কেউ নাই এমন ছেলে খুঁজতে গিয়েই হয়তো এতোটা দেরি হলো।

— ফরিদা, আমার মুখের দিকে তাকা! এক কথা দুই বার বলা আমার পছন্দ না।

— উনি ভাইজানরে বলছিলেন বিয়া করতে চান না।

প্রাণপনে মুখ তুলে ফরিদা বললেন। আম্মার মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। কাটা মুরগির মতো তার চাউনি বার বার হোঁচট খেতে লাগলো।

— পুলাপান বয়সে আজাইরা কথা মানুষ কয়ই। আকবরের লগে পড়াশুনা করতো, বন্ধুর বইনের লগে বিয়ার প্রস্তাবে শরম পাইছিলো। পেচাইতাছিস কেন, সমস্যা কুথায়?

— উনার বিয়া করার ক্ষমতা নাই।

ফরিদা কথাটা এতোটাই আস্তে বললেন যে বাতাসের সাথে প্রায় মিশে গেলো। শুধু আম্মার কপালের দুশ্চিন্তা চোখে নেমে এলো। জীবনের প্রথম এবং শেষ তিনি তার মেয়ের সামনে দুর্বল হলেন। বিশাল খাটের প্রান্ত দুই হাতের শক্ত মুঠিতে ধরে থাকলেন আর হাঁ করে নিঃশ্বাস নিলেন। আম্মাকে এমন অবস্থায় দেখেও ফরিদা কিছুই করলেন না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন, এক চুলও নড়লেন না। কতোটা সময় যে পার হলো সেই হিসাব মা মেয়ে কারুরই জানা নাই। তবে অনেকক্ষণ পরে আম্মা নিজেকে সামলে নেয়ার ভান করলেন। পরম চেষ্টায় খাটের প্রান্ত ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। মেয়ের চোখের দৃষ্টি এবার নিজেই সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেন। ধরে আসা গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করলেন।

— এই কথা কাক-পক্ষীও যেন টের না পায়। বড় বেটির কাম হইলো হজম করা, হজম কর — কপালে যা ছিলো হইছে। মানুষে যেন না হাসে — সেই সুযুগ কাউরে দিবি না। স্বামীর অপমান নিজের অপমান। এখন ঐ বাড়িই তোর সংসার, এই লোকই তোর স্বামী — যেমনই হোক।

আম্মার বলা প্রতিটা শব্দ হাতুড়ির বাড়ির মতো ফরিদার মগজে ঘা মারছিলো। অবশ্য তিনি জানতেন এই বিয়ে তাকে মেনে নিতে হবে, এখন নিজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তার নিজের। সারা জীবনে ফরিদার একটাই অনুতাপ, — ঘরের খবর কোনো অবস্থাতেই আম্মাকে বলা ঠিক হয় নাই। এছাড়া আর কোনো অনুতাপ তার নাই।

এই ঘটনার পর আর বেশি দিন ফরিদা বাপের বাড়ি থাকতে চাইলেন না — চার দিনের মাথায় এক রকম জোর করেই ফিরে এলেন স্বামীর কাজের জায়গায়। চাচাতো ফুপাতো ভাইবোনরা মুখ টিপাটিপি করতে লাগলো। দুই দিনেই স্বামীর বাড়ির জন্য টান দেখে টিকা টিপ্পনি শ্লেষ কিছুই বাদ গেলো না। সব কিছুকেই কখনও লাজুক হেসে, কখনও রাগ করবার ভান দেখিয়ে বাপের বাড়ি থেকে সুখী চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ফরিদা। মুখলেস সাহেব যারপরনাই অবাক হলেন। আসবার মুহূর্তে ফরিদা আব্বা, ভাইজান, বড় কাকা, কাকিমা সবাইকে সালাম করলেন। আম্মাকে সবার শেষে সালাম করলেন। আম্মা জামাইয়ের সামনে এসে সরাসরি বললেন, "দুলামিয়া, ফরিদা আমার মেয়ে, আমার মেয়েরা বড় বেটি এইটুকু মনে রাখবেন।"

আম্মার এই কথা বলার কারণ কেউ খুঁজে পেলো না। কাজেই শ্বাশুড়ির এত বড় দেমাক কেউ ভালো চোখে দেখলো না। এমনকি প্রথম বারের মতো ফরিদার বাবাও স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হলেন। সেই কথা তিনি মেয়ে, মেয়ে-জামাই বিদায় নেয়ার পর ভয়ে ভয়ে স্ত্রীকে বললেন। স্ত্রীও প্রথমবারের মতো স্বামীর কাছে দোষ স্বীকার করে নিলেন কিন্তু গুমর ভাঙলেন না।

ফরিদারা রওয়ানা হওয়ার সময় আম্মা তাকে ঘরে ডাকলেন। সারা গায়ে গয়না, দুই হাতে গুচ্ছ খানেক চুড়ি, পায়ে নুপূর, — ফরিদা ঘরে ঢুকলেন অর্কেস্ট্রা সাথে নিয়ে। একটু নড়াচড়াতেই বাদ্যবাজনার কোলাহল। দেখতে বড় ভালো লাগছিলো ফরিদাকে। মিনিট খানেক মুগ্ধ চোখে মেয়েকে দেখলেন আম্মা।

— আমি বড় খুশি হইছি গো মা, বড় খুশি হইছি। তুই আমার সাচ্চা বেটি।

ফরিদা হাসি হাসি মুখে আম্মার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন মাতা উঁচু করে। উঁচু করতে করতে তার গলা জিরাফের মতো হয়ে গেলো। সেই যে উঁচু করলেন সেই মাথা আর কখনও নামে নাই।

* * *

— খালাম্মা কাপড় ভিজাইছি, সাবান দেন।

রাবেয়ার মা নিঃশব্দে কখন ঘরে ঢুকেছে ফরিদা টের পান নাই। দরজায় সাড়াশব্দ করবে, তারপর ফরিদা বলবেন কী দরকার তবেই হয় ঘরে ঢুকবে নয় দরজার কাছ থেকে যা বলার বলবে, চাকর-বাকরের জন্য এই নিয়ম। কিন্তু কথাটা কিছুতেই রাবেয়ার মা'র মাথায় ঢুকানো যাচ্ছে না। আজ ছয় বছর ধরে সে এই বাড়িতে আছে তাও না।

— তুমারে না বলছি হুটহাট ঘরে ঢুকবা না। এই কথা দেখি কিছুতেই তুমার মগজে ঢুকে না।

— দরজায় খাড়ায়া দুইবার ডাক দিছিলাম খালাম্মা।

— ডাক দিছি মানে? আমি তুমারে ঘরে ঢুকতে বলছি?

এর উত্তর রাবেয়ার মা'র কাছে ছিলো না, যথারীতি সে চুপ করে গেলো। ফরিদার মনে গভীর সন্দেহ হলো, তিনি কি এতোটাই নিমগ্ন ছিলেন যে দুইবার ডাক দেয়ার পরও শুনতে পান নাই। কেন যে রাবেয়ার মা ঘরে ঢুকলো সেটা আবার এখন মনে করতে পারছেন না। হতাশ বোধ করলেন ফরিদা।

— কী চাও?

— গুঁড়া সাবান লাগবো, কাপড় ভিজাইছি।

— বাথরুমে যাও আমি আনতাছি।

এই আরেক বাতিক আছে ফরিদার — চাল, আলু, পিঁয়াজ, তেল আর গুঁড়া সাবান তালাবন্ধ করে রাখা। কাজের লোকরা ইচ্ছামতো নিয়ে ব্যবহার করলে পথে বসতে হবে, ভাবখানা তাই। নিজের হাতে বের করে দিলে যে পরিমাণ তেলে হেসে-খেলে মাস চলবে — ওদের হাতে দিয়ে দিলে ঐ একই পরিমাণ তেলে পনেরো দিনও যাবে না। এটা অবশ্য কখনও পরীক্ষা করে দেখা হয় নাই কিন্তু বিশ্বাস বদ্ধমূল।

— রাবেয়ার মা শুইনা যাও।

রাবেয়ার মা ডাক শুনে আবার ফিরে আসে।

— ছোট আপা উঠছে? নাস্তা টাস্তা কিছু খাইছে না কি এখনও ঘুমাইতেছে?

— হ উঠছে। চুলে ডিম দিছে, গরম পানি করতে কইছে গুসল করবো। গুসলের বাদে নাস্তা করবো।

সেই মুহূর্তে মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। এই বাসায় কোনো টেলিফোন লাইন নাই, কোনোদিনও ছিলো না। মোবাইল কালচার চালু হওয়ারও বহুদিন পরে এই বাড়িতে মোবাইল ঢুকেছে। ফোনটা সব সময় ফরিদার ড্রেসিং টেবিলের উপর চার্জারের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। এই বাসায় কালে ভদ্রে ফোন আসে এবং অধিকতর কালেভদ্রে এই বাসা থেকে কেউ ফোন করে। স্প্রিং-এর মতো ফরিদা বসা থেকে উঠে পড়লেন — কে করলো, লাভলি না তো? কোনো কারণে দোকান বা কোথাও থেকে ফোন করেছে। কিন্তু লাভলির নাম্বারটা আদৌ মুখস্থ আছে কি না সেই ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ হলো ফরিদার। নাহ্, যাওয়ার সময় ওর হাতে ফোন নাম্বারটা লিখে দেয়া উচিৎ ছিলো। আজকাল এমন মারাত্মক সব ভুল হচ্ছে যে নিজের উপর আর বিশ্বাস ধরে রাখতে পারছেন না।

— হ্যালো? কে?

— ফরিদা না কি? আমি।

— আমি? আমি কে?

— আমি আবদুল বশির।

ফরিদা শীতরাত্রির মতো জমে গেলেন। কপালের উপর ভ্রূকুটি কেটে বসলো। কথা বলবেন না কি ফোনটা কেটে দিবেন মনস্থির করার আগেই ফোনের অন্য পাশে জনৈক আবদুল বশির অস্থির হয়ে উঠলেন।

— লাইন কাইটা গেলো নাকি? হ্যালো, হ্যালো ফরিদা?

— এই বাসার নম্বর কই পাইছেন?

— সে ম্যালা কিচ্ছা! হেই কিচ্ছা বয়ান কইরা ফায়দা নাই। তুমরা আছো কেমুন? লাভলি, বিউটি?

— আপনেরে না বলা আছে এই বাড়ির সাথে কুনু যুগাযোগ করবেন না। আপনের সাহস তো কম না।

ফরিদার গলা নিজের অজান্তেই খাদে নেমে আসে আর সাপের মতো হিসহিস করে ওঠে। যদি বিউটি বা লাভলি ফোনটা ধরতো, এই লোক যেমন ইবলিশ, ওদেরকে কী বলতো কে জানে! সেই কল্পিত আলাপচারিতার সম্ভাবনায়ও ফরিদা শিউরে ওঠেন। সমস্ত শরীরে রক্তশূন্যতা বোধ হয়, দুই পা অসাড় হয়ে আসতে চায়।
— আমি ভাইবা দেখলাম ফরিদা, এতোদিন তুমি আমারে ডর দেখাইছো আর আমি বেহুদাই ডর খাইছি। আমার বয়স হইছে। আমাদের সবারই বয়স হইছে। কেউ আমরা কচি খোকা না।

— কী চান আপনে?

— আমি লাভলি, বিউটিরে দেখতে চাই।

— অসম্ভব। ডর আমি দেখাই নাই। সত্য বলছি। আপনের বউ পোলাপান যদি জানতে পারে, আপনেরে বাড়িতে জায়গা দিবে?

— তাইলে তুমি খবরটা পাও নাই। খোদেজার মৃত্যু হইছে দুই মাস হয়। এখন আর এইসব বইলা লাভ নাই ফরিদা, আমি কুনু কিছুর ধার ধারি না।

— আপনেরে স্পষ্ট কইরা একটা কথা বলতেছি। আপনে আমার মেয়ে দুইটার সাথে কুনু রকম যোগাযোগের যদি চেষ্টা করেন আমি আগুন লাগায় দিবো।

— আগুন তুমি লাগাইতে পারবা না। আগুন লাগাইলে তুমিই প্রথম জ্বইলা মরবা। যার জন্য আমি এতোদিন চুপ ছিলাম সে-ই যখন নাই…।

ফরিদা ঘট করে ফোন কেটে দিলেন। তার ভিতরটা জ্যান্ত কই মাছের মতো তড়পাচ্ছে। হাতের মুঠির ভিতর ফোন এমন শক্ত করে ধরে রাখলেন যেন জনৈক আবদুুল বশির সাহেবের টুটি চিপে ধরেছেন। অনেকক্ষণ অথবা খুবই অল্প সময় ফরিদা কী কী সব আকাশপাতাল ভাবলেন। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলেন। চেহারার কাঠিন্য, দুশ্চিন্তা খানিকটা পাতলা হলো। ফোনটা সুইচ অফ করে জায়গা মতো রাখলেন। 'নিচের গেইট, কলাপসিবল গেইট সব বন্ধ আছে তো।'

রান্নাঘরে রাবেয়ার মা চুকচুক করে চা খাচ্ছে। ফরিদাকে ঢুকতে দেখে হাবিলদারের মতো বুকটান করে দাঁড়িয়ে পড়লো, চায়ের গ্লাস যে কোথায় রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না।

— বাথরুমে গুঁড়া সাবান দিয়া আসছি। কাপড় ধুইয়া আমারে ডাকবা। পিচ্চি হারামজাদায় কই? সকাল থিকা কুনু খুঁজ নাই।

— খালুজানের পাকনা চুল বাছে। ডাকুম?

— না, দরকার নাই। পিচ্চি আইসা নিচের গেইট লাগাইছে? চাবি কই? আচ্ছা থাক, আমি দেইখা আসি চাবি লাগাইছে কি না।

রান্নাঘর থেকে ভীষণ তাড়া খেয়ে যেন বেরিয়ে এলেন, কোনো মতে সামনের দরজা খুলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন ফরিদা। দোতালায় উঠবার মুখে লোহার গ্রিল দিয়ে দোতালা আর ছাদে উঠবার সিঁড়িকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, সেখানে ঢাওস সাইজের এক তালা ঝুলছে। শুধুশুধুই তালা টানাটানি করলেন, দেখাই যাচ্ছে লাগানো। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দু'পাশের ছোট ফ্ল্যাটগুলোর দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন দু'টা ফ্ল্যাটের একটা থেকে কেউ তাদের উপর নজরদারি করছে। যদিও একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা। গত মাসেই ভাড়াটে উঠে গেছে। এখনও বাড়ির গায়ে টু-লেট সাইনবোর্ড টাঙানো হয় নাই। ডান দিকের ফ্ল্যাটে অবশ্য ভাড়াটে আছে। মাঝবয়সী স্বামী-স্ত্রী। তাদের একমাত্র ছেলে বাইরে পড়ে, কোথায় কে জানে। ফরিদা কখনও জানতে চান নাই। ভাড়াটেদের সাথে আলগা পীড়িতি তার পছন্দ না। শুরুতে একতলাটাও তাদেরটার মতো একটা ফ্ল্যাট ছিলো। পরে চিন্তা ভাবনা করে বাঁ দিকে আরেকটা রান্নাঘর করে দু'টা ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। এখন দু'টা ফ্ল্যাট মিলে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া পান।

তালা টানাটানি করে নিশ্চিন্ত হয়ে ফরিদা আবার উপরে উঠে গেলেন। না, যে চাবিটা পিচ্চির হাতে থাকে সেটা এখন থেকে তার কাছে নিয়ে রাখবেন। দোকানে-টোকানে যাবার সময় তার কাছ থেকে আবার নিয়ে গেলেই তো হলো। এতোদিন যে কেন এই বুদ্ধিটা হয় নাই! তবে ফরিদা বাসায় না থাকলে কখনই চাবি পিচ্চির কাছে থাকে না, তখন সব সময়ের ব্যবহারের চাবিটা থাকে মুখলেস সাহেবের কাছে। বাসায় থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র চাবি পিচ্চির হাতে দিয়ে রাখেন তাও শুধু দিনের বেলায়। কারণ দিনের মধ্যে বত্রিশবার পিচ্চিকে কোনো না কোনো কারণে বাইরে পাঠাতে হয়। সন্ধ্যা নামার আগেই চাবি চলে আসে তার হাতে। এখন থেকে তাও করা যাবে না, ফরিদা মনে মনে ঠিক করলেন। নইলে কোনদিন দেখা যাবে আবদুুল বশির বসার রুমে বসে চা আর নোনতা বিস্কুট খাচ্ছে। গত সপ্তাহেই তো এরকম হলো। কলিংবেলের শব্দ শুনেই পিচ্চি চাবি নিয়ে দৌড়। আরে কে না কে আসছে আগে দেখ — বলার আগেই শয়তানটা হাওয়া। সেদিন অবশ্য সব্জিওয়ালা এসেছিলো। কিন্তু সব্জিওয়ালার বদলে বশিরও হতে পারতো। এই কথা ভেবেই বুকের ধুকপুকানি থেমে যাওয়ার জো হলো ফরিদার।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় ক্লান্তি অনুভব করলেন ফরিদা। ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো, ঢুকেই দরজার ডান পাশে খাবার ঘর বাঁ পাশে বসার। বসার ঘরে ঢোকার জন্য দরজা আছে। সেই দরজা বেশিরভাগ সময় ভিড়ানোই থাকে। প্রতিদিন সকাল বেলা পিচ্চি সব ঘরের সাথে বসার ঘরটাও ঝাড়ু দেয়, মোছে। জিনিসপত্রের ধুলা ঝাড়ে, তারপর দরজা ভিড়িয়ে দেয়। খাবার ঘরের সাথে লাগানো রান্নাঘর। ফরিদা খাবার ঘরে গিয়ে দেখলেন বিউটি নাস্তা করছে। মাথায় তোয়ালে পেঁচানো। ডিমের সূক্ষ্ম গন্ধ ঘরে পা দিয়েই টের পেলেন। বিউটি মাকে পাত্তা দিলো না, একমনে লুচি, ভাজি খেতে লাগলো। ছোট মেয়েকে দেখে ফরিদার মেজাজ সঙ্গে সঙ্গে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো।

— সকাল বেলা আমি লাভলি যে তোর দরজা ভাইঙ্গা ফালাইলাম, তাও তোর কুনো হুঁশ নাই। তুই এমন শয়তানের শয়তান হইছস।

ফরিদার ঝাড়িতে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হলো না তাকে। ধীরেসুস্থে লুচি মুখে দিলো।

— লুচির এই অবস্থা কেন? তেনা তেনা!

— এগারোটার সময় নাস্তা খাইতে আইসা রাজরানীর তেনা তেনা লাগতেছে। রাবেয়ার মা ভাজছে। দিমু দুইটা ভাইজা?

— দেন। আপা কই?

— গাউছিয়া গেছে?

— গাউছিয়া গেছে, কেমনে?

প্রশ্নটা করে বিউটি চাবাতে ভুলে গেলো। হাঁ করে ফরিদার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফরিদা তার হাঁ করা মুখের সামনে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে মোটেই রাজি না। বিউটি লুচির টুকরা মুখে না দিয়ে প্লেটে রেখে মাকে অনুসরণ করলো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা কাচা লুচির একটা তুলে তেলের কড়াইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন ফরিদা। তেল গরম হবে তবে লুচি ছাড়বেন। রাবেয়ার মাকে রান্নাঘরে দেখলেন না। কাপড় ধুচ্ছে নিশ্চয়ই।

— পিচ্চি কি আপার সাথে গেছে?

— পিচ্চি লাভলির সাথে যাবে কেন? ওর কাম নাই বাড়িতে?

— আপা তাইলে কার সাথে গেছে, আব্বার সাথে?

— না, কারও সাথে যায় নাই, একা গেছে।

— একা?

এমন আশ্চর্য কথা সে জীবনে শুনে নাই, প্রথমে বুঝতেই পারলো না ঘটনা কী, পরে প্রচণ্ড রাগ হলো বিউটির। তার কখনও কোথাও একা যাবার সুযোগ তো দূরের কথা প্রশ্নই ওঠে নাই, আর আপা কী সুন্দর একা একা গাউছিয়া চলে গেলো, তাও লুকিয়ে না, ফরিদাই পাঠিয়েছেন। এতো বড় অন্যায় চোখের সামনে ঘটতে দেখে মাথায় আগুন ধরে গেলো বিউটির। ফরিদার কাছে সব সময় দুইজনের জন্য দুই রকম বিচার।

— আপনে আমারে কুনুদিন কুথাও একা যাইতে দিছেন? আপারে দিলেন কেন? আমিও এক্ষণ গাউছিয়া যাবো।

— যায়া দেখ তুই। একা যাইতে দিছি সাধে — দরজা ধাক্কাইতে ধাক্কাইতে দুইজনের হাত ব্যথা হয়ে গেছে। লজ্জা নাই আবার কথা কয়, এক চড় খাবি। যা, টেবিলে যা, লুচি আনতাছি।

— আমারে কবে যাইতে দিবেন, বলেন?

— কুথায় যাইতে দিবো?

— সের আমি কী জানি, একা আমারে কবে যাইতে দিবেন, সেইটা বলেন?

— কুথায় যাইতে চাস সেইটাই তো জানস না। সারাদিন শুধু আজাইরা প্যাঁচাল। কুনু কাজ নাই কাম নাই, এতো বড় ধাড়ি মেয়ে, তোর লজ্জা লাগে না। যা আমার চোখের সামনে থিকা।

— আম্মা, আমি কিন্তু সত্যি বলতেছি, কালকে আমি একা বাইর হবো। আপারে সঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

ঠাণ্ডা গলায় কথা শেষ করলো বিউটি। এই বিউটিকে ভয় পান ফরিদা। সে কখনও মায়ের কথার অবাধ্য হয় না কিন্তু ফরিদা ঠিকই জানেন এই মেয়ে চাইলে অনায়াসে অবাধ্য হতে পারে। লাভলির সেই ক্ষমতাই নাই।

— বিউটি নাস্তা শেষ কর কইলাম।

— খিদা নাই। নাস্তা আপনে আপনের বড় মেয়েরে খাওয়ান।

— কত্তো বড় বেয়াদপ। তর দিন ঘনাইছে, কথাটা মনে রাখিস।

আর কোনো কথায় গেলো না বিউটি। সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। এখন আরাম করে আধশোয়া হয়ে হিন্দি সিনেমা দেখবে, 'যোধা আকবর'। আম্মাকে খুব ভালো রকম শাসানি দেয়া গেছে, বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে বিউটি। তবে একটা ব্যাপারে সে চমৎকৃত হয়েছে, আর তা হচ্ছে লাভলির সাহস। ফরিদা বললেন একা যেতে আর সেও রওয়ানা হলো! তাকে বললেই তো সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেতো। মুখে যতো হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক মারুক না কেন এই সাহস তারও হতো কি না সন্দেহ। আরে খেলা কথা না কি? জীবনে যে কোত্থাও একা যায় নাই তার জন্য তো বিশাল ব্যাপার। বড় বোনের প্রতি তার বেশ সমীহ বোধ হলো।

রচনাকাল: ২০০৮, লন্ডন

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ