লিলনকে খুন করা প্রসঙ্গে একটি বেআইনি রচনা

সেলিম রেজা নিউটন
Published : 17 Nov 2014, 02:10 PM
Updated : 17 Nov 2014, 02:10 PM

প্রসঙ্গটা আমার জন্য ব্যক্তিগত। স্থায়ীভাবে গোরস্তানে বসবাসরত একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বোঝাপড়া। জাতির উদ্দেশে জ্ঞান বিতরণ এই রচনার কাজ নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম আমার কাছে নিতান্তই 'লিলন ভাই'। চিনি তাঁকে কুড়ি বছর হল। হত্যাকাণ্ড তো কতই ঘটে! যদি 'নিউজ ইজ সামথিং নিউ' হয়, তো হত্যাকাণ্ড কোনো নিউজ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমি তো নিউজ-মিডিয়া নই। লিলন ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড আমাকে তাই বিচলিত করেছে। নতুন করে।

রাষ্ট্রে ও সমাজে খুনখারাবি, আইনকানুন, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি নিয়ে আবারও ভাবতে বসতে হচ্ছে: হত্যাকাণ্ড কি অবৈধ? হত্যাকাণ্ড জিনিসটা কি সত্যিই অবৈধ? সামাজিক দিক থেকে, বা আইনগত বিচারে? কাফনে সারা শরীর মোড়ানো লিলন ভাইয়ের অমলিন-অকাতর মুখটার খুব কাছে নিজের চোখজোড়া স্থাপন করে দেখি তাকিয়ে আছেন লিলন ভাই। খুলে গেছে তাঁর আপাত-বন্ধ দুটো চোখ। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সেই চোখ-জোড়া জানতে চাইছে: হত্যাকাণ্ড কি আসলেই অবৈধ?

হত্যাকাণ্ডের বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কেননা তাঁর জানের ওপর হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সমান্তরালে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে মহাপুরাতন, মুখস্ত সব কথামালা। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে একই কথাবার্তা। উচ্চ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন প্রফেসর থেকে নিরক্ষর নিম্নবর্গ পর্যন্ত ঐ একই আলাপ। কারা তাঁকে হত্যা করল? কেন তাঁকে হত্যা করা হল? এই হত্যার বিচার আদৌ হবে কি? হত্যাকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কোনোদিন পাবে কি?

একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন: রাত হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়-সম্প্রদায়ের অনেক অনেক মানুষ– ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকা– জানাজার নামাজ এবং তারপর একবার তাঁদের প্রিয় মানুষটার মুখখানা দেখার জন্য ধীর তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। মুহূর্তগুলো দীর্ঘ হয়ে উঠছে। ওদিকে ধোয়ানো চলছে লিলন ভাইয়ের মরদেহ। মাইকে বলা হচ্ছে: শীঘ্রই শুরু হবে জানাজা নামাজ। অপেক্ষায় দাঁড়ানো কাতারবন্দি মানুষ। অথচ আমাকে (আরও অনেককেও কি?) অবাক করে দিয়ে জানাজার আগে শুরু হল কর্তৃপক্ষীয় সরকারি প্রটোকল। লিলনের মরদেহ সামনে শুইয়ে রেখে, ধুইয়ে রেখে। নামাজের জন্য, অধ্যাপক লিলনকে এক নজর দেখার জন্য, সারবাঁধা মানুষকে অপেক্ষায় রেখে।

মাইকে বাজতে থাকল কর্তাদের কণ্ঠস্বর: 'আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন, সরকারদলীয় সংরক্ষিত মহিলা আসনের মাননীয় সাংসদ, রাজশাহী এলাকার অন্যতম সরকারদলীয় মাননীয় সাংসদ, সিটি কর্পোরেশনের সম্মানিত প্রাক্তন মেয়র তথা রাজশাহী আওয়ামী লীগের সদ্য-পুনঃনির্বাচিত সভাপতি মহোদয়, মাননীয় উপাচার্য, মাননীয় উপ-উপাচার্য' ইত্যাদি প্রভৃতি। শুরু হল বক্তৃতা। চলল পাক্কা আধা ঘণ্টা ধরে। যেন কোনো রুটিন সরকারি অনুষ্ঠান চলছে। মাননীয় মহিলা সাংসদ ছাড়া এঁরা সকলেই কমবেশি বক্তৃতা করলেন। 'বিচার চাই'। 'দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই'। 'যেন আর কোনোদিন …'। কোথায় নেমেছি আমরা? কোন অতলে?

প্রতিটা সামরিক-বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের পরে উপর্যুপরি উৎপাদিত ও পুনরুৎপাদিত হতে শুরু করে এইসব নির্লিপ্ত-অভ্যস্ত-মুখস্ত কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, বয়ান-বাৎচিৎ। জানা কথা: পত্রিকা, টেলিভিশন, টকশো আর লেখালেখিতে এই পুরাতন চিন্তনবাদ্যই বাজতে থাকবে আজ থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত। পরবর্তী হত্যাকাণ্ডটি বা অন্য কোনো বিপর্যয় ঘটা পর্যন্ত। যেন বা জেলজুলুম তথা বলপ্রয়োগ করেই সমস্ত অপরাধ আর খুনখারাবির সমাপ্তি ঘটানো যাবে– তা সে ফৌজদারিই হোক বা রাজনৈতিকই হোক। যে কোনো অন্যায়, অপরাধ বা গলদের একমাত্র সমাধান যেন রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ।

স্লোগানটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল উন্মাদ পত্রিকা: 'মাইরের উপরে ঔষধ নাই'। পরে দেখা গেল গোটা অন্তত শিক্ষিত সমাজই এই ঔষধের ব্যাপারে উন্মাদ। এই প্রশ্নে বাস্তবত সব শাসকই খতম-লাইনের লোক। সকলেই মনে মনে বাংলা ভাই। আরবি ভাই। লিবারালবাদ-লাদেনবাদ-লেনিনবাদ কেউ বাদ নাই। গায়ের জোরের উপায়ে দেশের-দশের মঙ্গল করার চিন্তা শাসকশ্রেণির প্রধানতম, বা বলতে গেলে, একতম উপায়-চিন্তা। আর কোনো উপায় যে জগতে থাকতে পারে সে চিন্তা বাতুলতা মাত্র– তাদের কাছে। ধর-কাট-মার। ব্যস্, সবাই সোজা হয়ে যাবে। মঙ্গলের অনন্ত মল প্রবাহিত হতে শুরু করবে অলিতে-গলিতে।

তা-ই বইতে শুরু করেছে শাসক-বাহাদুরগণের বহু শত বছরের সাধনায়। সেই মলে এখন খাবি খাচ্ছি আমরা বিমলচিত্তে। আমরা– আমজনতা। শাসকশ্রেণির লোকেরাও বাদ পড়ছেন না। এঁর হাতে মারা পড়ছেন ওঁ। পার্টিতে বনাম পার্টিতে তো বটেই, একই পার্টিতেও। একই উপদলে পর্যন্ত। উপরন্তু মারধরের রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো তো আছেনই। তাঁরা বেসামরিক-বিরাষ্ট্রীয় লোকজনকে যেমন মারেন অকাতরে, বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে আবার নিজেরা নিজেদের প্রাণসংহারেও কার্পণ্য করেন না। সাম্প্রতিক বিডিআর বিদ্রোহ, নিকট ও দূর অতীতের নানাবিধ সেনাবিদ্রোহ তারই সাক্ষী।

কর্তৃত্বনীতি তথা বলপ্রয়োগ-নীতির ধর্মই এই। ঐ একটা ভাষাই সে জানে। বলপ্রয়োগের ভাষা। সুতরাং প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সর্বদাই আন্তরিকভাবে ঐ ভাষাতেই কথা বলেন উপ-পাতি-মহা-নাতি সকল প্রকার শাসকবর্গ ও শাসক-ব্যক্তির ঐ একটাই ভাষা। টুঁটি টিপে ধর। বিষফোঁড়া কেটে ফেল। একেবারে নিকেশ করে দাও। নির্মূল করে দাও। জামাত, জেএমবি, জাসদ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, হেফাজত, কমিউনিস্ট পর্যন্ত ঐ একই ভাষা।

বন্ধু, আপনজন, সহকর্মী, ছাত্রের মরদেহকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য অন্তিম অপেক্ষায় রেখে কী অবলীলায় শাসক-রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ রুটিন বক্তৃতা করে যেতে পারেন! ব্যক্তিগতভাবে এঁরা সকলেই সজ্জন। আমি এঁদের সকলেরই কোনো না কোনো প্রকারের শুভানুধ্যায়ী অন্তত। মঙ্গলই চাই তাঁদের। সকলের। বিশেষ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো নালিশ আমি এখানে তুলছি না মোটেও।

আমি যেটা বলতে চাই সেটা অনেক পুরাতন কথা, মিখাইল বাকুনিনের বহুল উচ্চারিত কথা: 'পাওয়ার করাপ্টস দ্য বেস্ট'। রাষ্ট্র-রাজনৈতিক ক্ষমতার দূষণ আমাদের সমাজকে দূষিত করে ফেলেছে। আমাদের জানাজার নামাজগুলো পর্যন্ত সেই দূষণ থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। রাষ্ট্রক্ষমতার বলয়ের বাইরে মানুষে-মানুষে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা 'সমাজ' বলে যে একটা জিনিস চিরদিন ছিল আমাদের, সেটা দিন দিন অথর্ব ও অপদার্থ হতে হতে একেবারে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। সমাজ এখন আর নিজের মতো করে একটা জানাজা নামাজ পড়াতেও সক্ষম নয়।

অথচ চিরকালই 'রাষ্ট্রক্ষমতা' আর 'সমাজ-সত্তা' দুটো আলাদা জিনিস ছিল। 'সমাজশক্তি', 'আত্মশক্তি' ধরনের কিছু কথা ছিল। সবকিছু উধাও করে ফেলছে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রশক্তি। সক্রিয়-সচেতন ব্যক্তি তো বিলুপ্তিরই পথে! রাষ্ট্রের পথে কাঁটা বলে গ্রাহ্য তাঁরা। ব্যক্তির সক্রিয়তা বা সচেতনতা বলতে এখন বোঝায় এই পার্টি বা ঐ পার্টির দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ানো। পুরো সমাজই বিচূর্ণ হওয়ার পথে। মানুষে-মানুষে সর্বমাত্রিক বিচ্ছিন্নতাই আজ একমাত্র সত্য। সবাই অসংগঠিত, সবাই আলাদা, সবাই একাকী।

একমাত্র সংগঠিত শক্তি বলতে রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র, পলিটিক্যাল পার্টি, নানারকম সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী এবং বিরাষ্ট্রীয় ও মাফিয়া টাইপের বিভিন্ন সশস্ত্র শক্তি। এক কথায় বন্দুকধারীরা, নানা মাত্রায় সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীরা এবং তাঁদের তাঁবেদার পত্রপত্রিকা-মিডিয়া অথবা চেম্বার অফ কমার্স জাতীয় বাণিজ্য-জোট– এরা সবাই মিলে সমগ্র এই বিচূর্ণ সমাজের ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউই নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না এঁদের হাত থেকে– গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে অধ্যাপক পর্যন্ত।

এ রকম সামাজিক পরিস্থিতিতে নিত্যদিন খুনখারাবি, রাহাজানি, জুলম ও জবরদস্তি ছাড়া আর কী আশা করা যায়? যে সত্তা এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারত, 'সমাজ' নামক সেই জিনিসটাই তো নেই প্রায়! সামাজিক অর্থে (প্রশাসনিক ইউনিট অর্থে নয়) পাড়া নেই, মহল্লা নেই, গ্রামসমাজ নেই, পঞ্চায়েত নেই, আড্ডা নেই, আখড়া নেই। সর্বত্র নানা ধরনের সরকারি বা বেসরকারি প্রত্যক্ষ বন্দুকধারী বাহিনী বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় কমিটি। সর্বত্র সর্বোচ্চ সতর্কতা। সর্বত্র সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। সর্বত্র থানা-পুলিশ, মাস্তান বাহিনী, আইন-আদালত, কারাগার, ক্রসফায়ার। এই পরিস্থিতিরই শিকার আজকে লিলন ভাই– আগামীকাল বা পরশু আমাদের মধ্যকারই কেউ। অথবা নাম-না-জানা কেউ। যাঁকে নিয়ে এ রকম রচনা লিখতে বসব না আমি।

বলপ্রয়োগ-নির্ভর জনসম্মতি এবং জনসম্মতি-নির্ভর বলপ্রয়োগের একচ্ছত্র পাটাতনের ওপর দাঁড়ানো থানা-পুলিশ, আইন-আদালত, শাসক-কর্তৃপক্ষের ভাষাই এখন হয়ে উঠেছে সমাজের ভাষা। দীর্ঘকালের দীক্ষায়ন, ট্রেনিং, প্রশিক্ষণের ফলে। এই ভাষায় কথা বলছে কবিতা-নাটক-উপন্যাসও। কলুষিত হয়ে পড়েছে পুরো সংস্কৃতি-জগৎ। বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী থেকে বলদ-বঞ্চিতরা পর্যন্ত সকলেই এখন বলপ্রয়োগের বৈধতাকে সামাজিক সম্মতির ভিত্তি ধরে নিয়ে কথা বলেন। এইটাই হচ্ছে আমাদের যাবতীয় হত্যাকাণ্ডের গোড়ার কথা।

এই গোড়া অক্ষুণ্ণ রেখে 'বিচার চাই, শাস্তি চাই' এর বুলি আওড়াতে থাকা প্রহসন, ভণ্ডামি, অপোগণ্ডামি। পুরো বিচারপ্রথাটাই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিশোধ-পরায়নতার ওপর। তুমি কাউকে খুন করেছ, রাষ্ট্র তোমাকে খুন করবে। রাষ্ট্রের ওপর ভরসা না পেলে বিরাষ্ট্রীয়-অরাষ্ট্রীয় কেউই সেটা সম্পাদন করবেন। খোদ খুন কোনো সমস্যা না। ব্যক্তি করল, নাকি রাষ্ট্র করল, সেটাই একমাত্র প্রশ্ন।

মানবজাতির কুড়ি লক্ষ বছরের বিকাশধারায় কিন্তু বলপ্রয়োগ ও প্রতিশোধ-পরায়ণতার এই ভাষা কিংবা নিকেশ ও নির্মূলের এই ভাষা সমাজের ভাষা ছিল না। ভাষাটা ছিল সংহতি, সহযোগিতা, সৃজনশীলতা, বোঝাপড়া, সমঝোতা ও লেনদেনের ভাষা। এখনও তার অবশিষ্ট নিশানা-চিহ্ন-ইঙ্গিত আছে গানে-কবিতায়, সাহিত্যে ও প্রকৃতিতে– মূলধারার ও আদিবাসীদের সমাজে, সংগঠনে ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তা নিয়ে সুপর্যাপ্ত আলোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-প্রমাণও হাজির আছে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, অ্যাকটিভিস্ট, লেখক ও সমাজকর্মীদের তরফে। বাংলা ভাষাতেও ইদানিং এ নিয়ে চিন্তা-উদ্দীপক আলাপ-আলোচনা, রচনা ও অনুবাদের বিকাশ সূচিত হয়েছে, হচ্ছে, আরও হবে।

সমাজের এই আদি ভাষাটাই তুলে ধরেছেন অধ্যাপক লিলনের একমাত্র পুত্র, ঢাবি-সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী জেভিন। জেভিন কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন যা জানানোর এবং সেটা তাঁর প্রিয়তম পিতার এই বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ডের মাত্র দু মাস আগেই। ফেসবুকে। গত ১১ সেপ্টেম্বর। বাবার টাইমলাইনে বাবার একটা ছবি পোস্ট করে জেভিন লিখেছিলেন: 'যে মানুষটাকে আমার এখন বেশি করে দরকার সে হচ্ছ তুমি, বাবা। তুমিই একমাত্র মানুষ যে আমার চোখ থেকে বেরুনো প্রত্যেকটা আওয়াজ বুঝতে পারে। তুমিই একমাত্র মানুষ যে আমার প্রত্যেকটা অশ্রুবিন্দু পাঠ করতে পারে। আমি আজ এ পর্যন্ত এসেছি, কারণ তুমি ছিলে আমার সঙ্গে। আই লাভ ইউ।' (ইংরেজি থেকে বঙ্গানুবাদটুকু বর্তমান লেখকের।)

স্থানীয় সমাজ ও হাসপাতাল-প্রণালী এভাবে ভালোবাসার ভাষায় কথা বলেননি মহাবিপন্ন লিলন ভাইয়ের সঙ্গে। মাথায় অতগুলো খতরনাক কোপ নিয়েও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন লিলন ভাই। নিজের মোটরবাইকটাকেও দাঁড় করিয়েছিলেন। গল গল করে রক্ত বেরুচ্ছে তাঁর মাথা থেকে। গোটা দেহ, গোটা বাইক ভিজে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে অনন্ত প্রাণশক্তিসম্পন্ন একটা মানুষের শরীরের সব রক্ত। ঐখানে পরিচিত অটোচালক তানভীর পৌঁছানোর পরও প্রায় আধা ঘণ্টা কোনো মানুষ তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেননি। দাঁড়িয়েছিলেন। গোল হয়ে। ভিড় করে। কেউ তাঁর মাথাটাতে একটু কাপড় বেঁধে রক্তক্ষরণ কমানোর চেষ্টাটুকুও করেন নি। তানভীর ছাড়া কারও আত্মার ভেতরে 'আই লাভ ইউ' ধ্বনি বেজে ওঠেনি (একজন রিকশাচালক ছাড়া যাঁর সাহায্যে অটোতে তুলে রওনা হয়েছিলেন তানভীর)।

কিন্তু কেন ওঠেনি? কেন? কারণ এইসব ফৌজদারি কেসে আপনি জড়াবেন, তো পরের দিনগুলোতে থানা-পুলিশ, আইন-আদালত, সাক্ষী-হাজিরা দিতে দিতে আপনার অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে। কতদিনের জন্য তা কেউ জানবেন না। আপনি এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজেও ফেঁসে যেতে পারেন আইনের গ্যাঁড়াকলে। এই আমাদের আইনের শাসনের অবস্থা। কাকে দোষ দেবেন আপনি? সাধারণ মানুষকে?

আমি দেব না। আমি দেব সার্বিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে। বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে ধীরে ধীরে। শত বছরের সাধনায় তাঁরা সমাজের কাছে সশস্ত্র বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে– তফাৎ যাও, দূর হঠো, ভাগো! আইনের কাজ আইনকে করতে দাও। আইন নিজস্ব শম্বুক গতিতে চলবে। ততক্ষণে যদি কেউ রক্ষক্ষরণে মারা যান, তাতে তোমার মাথায় ব্যথা কীসের? তোমার মাথায় কি চাপাতির কোপ বসেছে?

|| দুই ||

হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা কীভাবে কথাবার্তা বলি তার ওপরই নির্ভর করে সিরিয়াল হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী এপিসোডের সম্ভাব্যতা। মুখস্ত কথাবার্তা, মুখস্ত আইনের শাসন, মুখস্ত শাস্তি-দাবি, মুখস্ত দৃষ্টান্তমূলকতার আহবান– এই সমস্ত কিছু মিলে তৈরি করতে থাকে মুখস্ত হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্লট। যতদিন আমাদের শুধু মুখ থাকবে, যতদিন আমাদের কথাবার্তা স্রেফ মুখ-ঠোঁট-জিহবা তথা বাক্যন্ত্র থেকে উচ্চারিত হতে থাকবে, যতদিন আমাদের উচ্চারিত শব্দগুলো মস্তিষ্কের ঊর্ধাংশের সেরিব্রাম থেকে উৎসারিত না হবে– ততদিন স্রেফ জিহবার কথা দিয়ে রক্ষা করা যাবে না জীবন। নিজের এবং অপরের জীবনরক্ষার তাড়না একটা সহজাত তাড়না। প্রজাতিগত তাড়না। আমাদের ভেতরকার– অন্তর্জাত– এই প্রজাতি-সত্তাটি আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি।

আশ্চর্য ঘটনা হল, লিলন ভাই সেটা হারাননি। পায়ে এবং মূলত মাথায় ও ঘাড়ে মৃত্যুর মতো ধারালো চাপাতির কয়েকটা মোক্ষম কোপ খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরও তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। একা। নিজেই শুধু উঠে দাঁড়াননি, টেনে দাঁড় করিয়েছেন কোমরের নিচ থেকে ছিটকে যাওয়া তাঁর প্রিয়তম বাইক-বাহনটাকে। শক্ত করে ধরে রেখেছেন সেই বাইকের হাতল। হাতছাড়া করেননি প্রিয় মোবাইলটা। ব্যাটারিচালিত অটোতে করে মানুষের বাচ্চা অটোচালক তানভীর তাঁকে মেইন গেট পর্যন্ত আনার পর যখন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাসে করে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন ড. এক্রাম, লিলন ভাই তখন তাঁকে ধরে থাকতে মানা করেছেন দৃঢ়ভাবে। বলেছেন, 'আমাকে একটু আরাম করে বসতে দাও'। স্রষ্টার সান্নিধ্যে তিনি বোঝাপড়া করে চলেছেন তখনও– মৃত্যুর সঙ্গে। নিজস্ব ভঙ্গিতে।

বলছিলেন আমাদের বন্ধু-সহকর্মী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ক্যাম্পাসের শিক্ষক-ক্লাবে লিলন ভাইয়ের নিত্যদিনের খেলার অন্যতম সাথী এক্রাম উল্যাহ। তখনও ধোয়ানো হচ্ছে লিলন ভাইয়ের মরদেহ। রাবি-র কেন্দ্রীয় মসজিদের প্রাঙ্গনের এক পাশে। বন্ধু এক্রামকে ঘিরে ধরে তাঁর জবানিতে আমরা শুনছি লিলন ভাইয়ের শেষ মুহূর্তগুলোর দ্রুত ধাবমান রূপকথাক্রম। স্বভাবতই সদা-ঋজু ও দীর্ঘদেহী এক্রামের স্থির-শান্ত-নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে। তাঁর দাঁড়ানোর অবিচলিত ভঙ্গিতে যেন ভর করেছে সদ্য-দেহান্তরিত লিলন ভাইয়ের আত্মা। সেই আত্মমগ্ন বলছে: 'বল, সবাইকে বল, এক্রাম! বল, আমি ভয় পাইনি। বল, আমি স্বাভাবিক ছিলাম সশরীরে উপস্থিত মৃত্যুর সাক্ষাতেও'।

অর্পিত সেই দায়িত্বই যেন পালন করছিলেন এক্রাম তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষদের সামনে। নিতান্তই ধীর বাক্যে। অধ্যাপক এক্রামের বিবরণীতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠেন লিলন ভাই। শক্ত হাতে ধরে আছেন তিনি নিজের মোবাইলটা। মাইক্রোতে সোজা হয়ে বসে আছেন ঘাড় সোজা করে। অলৌকিক প্রাণশক্তিতে তখনও ভরপুর এক মনুষ্যসন্তান অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম। বলে যাচ্ছেন কথা অনর্গল: 'আমাকে আরাম করে বসতে দাও, প্লিজ! ধর না– আমাকে ধরার দরকার নেই। কী হয়েছে আমার! আমি ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি।'

বাল্মিকীর ঘটনা আমরা জানি। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার ঘটনা জানি। সবচাইতে অধঃপতিত মানুষও নিজেকে নিজের চেষ্টায় স্থাপন করতে পারেন ঊর্ধ্বতর স্তরে। এগুলো আসলে কোনো অতিকথনের কেচ্ছা নয়। এগুলো স্রেফ যে কোনো মানুষের জীবনে ঘটার জন্য অপেক্ষমান আগামীর ইতিহাস। জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও কানাগলি অতিক্রম করেও মানুষ খুঁজে নিতে পারে পথ। অনন্তের দিশা। মানুষই পারে। চিন্তাদাসত্বের আনুগত্যে চিরকালের মতো আটকে পড়া কতিপয় দুর্ভাগার কথা বাদ দিলে এটাই মনুষ্যস্বভাব। মনুষ্যজীবনের সারসত্য ও সারসত্তাকে উপলব্ধি করা এবং মনুষ্য-কর্তব্যের দিশা খুঁজে পাওয়ার প্রধানতম লক্ষণ হল মৃত্যুভয় অতিক্রম করতে পারার সক্ষমতা অর্জন করা। অনিবার্য মৃত্যু মোকাবেলা করার মতো প্রাণশক্তি নিজের ভেতরেই আবিষ্কার করতে পারা।

আমার বিশ্বাস, লিলন ভাই সেটা শুরু করতে পেরেছিলেন। তা সে যে তরিকায়ই হোক না কেন– যত মত তত পথ, যত কাল্লা তত আল্লা, যাঁর যাঁর মত-পথ তাঁর তাঁর। তাঁর অনুসৃত বাউল-ফকিরী পন্থার ব্যাপারে লিলন ভাইয়ের সঙ্গে আমার সহমর্মমিতা কমই। আমাকে ও আমার স্ত্রী সুস্মিতাকে যেতে বলেছেন বারবার তাঁর বাসায়। পরম আগ্রহে। আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেটা এখানে বড় কথা নয়।

আসল কথা হল, নিজের ভেতরে, নিজের মতো করে, আল্লাহ-খোদা-স্রষ্টার নিখিল জগৎসত্তা একান্তভাবে অনুভব, আবিষ্কার ও অনুশীলন করতে শুরু করেছেন যে মানুষ, অন্তরাত্মা যাঁর দেখতে শুরু করেছে 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত' আদি নূরের আভা– ভয়ভীতি-সাহসের ঊর্ধ্বে তখন চলে যান তিনি। তিনি তখন ভয়মুক্ত নন, কিন্তু তিনি ভীতুও নন।

পৃথিবীর বৃহত্তম বিপজ্জনক পরাশক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে মোকাবেলা করতে করতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যেমন এক সাক্ষাৎকারে জন পিলজারকে বলেন, 'ব্যাপারটা এমন নয় যে ভয় জিনিসটা অনুপস্থিত। কিন্তু সাহস আসলে ভয়ের ওপরে বৃদ্ধিবৃত্তির প্রভুত্ব। তার উপায় হচ্ছে ঝুঁকিগুলোকে ভালো করে বোঝা এবং সেসবের ভেতর দিয়েও নিজের পথ কীভাবে খুঁজে বের করে নেওয়া যায় তা উপলব্ধি করতে পারা।'

এ রকম মানুষকে ভয় দিয়ে আটকে রাখবে কে? এঁরা তো আর সে রকম অর্ধমৃত প্রাণি নন যাঁরা নিজের ভয় নিয়ে নিজেই ঢোল পিটিয়ে ভয়ের উৎসগুলো শক্তিশালী করে তুলবেন। লিলন ভাইয়ের মুখ থেকে তাই সরেনি হাসি। আনন্দ তার আদমসুরতে আরও বেশি করে প্রস্ফূটিত হয়ে উঠছিল প্রতিদিন। একটু একটু করে।

আমার অন্তর্গত ইনটুইশন বলছে: অধ্যাপক লিলন জানতেন, যে-পথ তিনি দীর্ঘ জীবন-পরিক্রমায় খুঁজে-পেতে বেছে নিয়েছিলেন সেই পথে নানান রকমের আঘাত আসতেই পারে। কিন্তু তিনি পরোয়া করেননি। অতিক্রান্ত জীবনের পটভূমি যা-ই হোক, সত্যসন্ধানী মানুষ মানেই বিনীত-কিন্তু-বেপরোয়া মানুষ। সে মানুষ ঘাড়ে-মাথায় চাপাতির কোপ নিয়েও নিজে নিজে উঠে দাঁড়ান নিজের অন্তর্জাত শক্তিতে। অবলীলায় জিজ্ঞেস করতে পারেন, 'কী হয়েছে আমার?'

|| তিন ||

ইত্য-অবসরে উপদেশ-পরামর্শের ফিসফিসানি উচ্চারিত হচ্ছে যার যার আপনজনের কানে-কানে, ফোনে-ফোনে, অন্যান্য মাধ্যমে। 'এত রাত করে চেম্বারে বসে কাজ কোরো না', 'সাবধানে চলাফেরা কোরো একটু, দেশের অবস্থা ভালো না', ইত্যাদি প্রভৃতি। উপদেশটা স্পষ্ট: 'চাচা আপন জান বাঁচা'। কিন্তু নিজের প্রতি তথা নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি দায় ব্যক্তিমানুষের দায় সবচেয়ে বড় দায়। অটোচালক তানভীর, জনৈক সেই রিকশাওয়ালা, ড. এক্রাম উল্যাহরা সেই দায়িত্ব পালন করেছেন যথাসাধ্য। আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে লিলন ভাইয়ের জীবন তাঁরা বাঁচিয়ে রাখার দিকে এগিয়ে গেছিলেন বহুদূর। তাঁরা আমাদের আরাধ্য। আমরা যেন তাঁদের মতো হই। কিন্তু বাধ সেধেছে চূড়ান্ত মাত্রায় জনবিচ্ছিন্ন, তথাকথিত 'আইনের শাসন'-এর সর্বগ্রাসী সংস্কৃতি। বাধ সেধেছে আমলাতন্ত্রের অমোঘ বিধান– এমনকি হাসপাতালেও।

হ্যাঁ, হাসপাতালও এমন একটা জায়গা যেখানে জীবনের চেয়ে আইন বড়, চটজলদি চিকিৎসার চেয়ে চিন্তাহীনতার সদা-প্রশান্ত শিথিলতা বৃহৎ, জান বাঁচানোর ফরজের চেয়ে ফরম পূরণের গরজ বড় দায়। সবচেয়ে বড় বালাই চাকরি রক্ষা। আফটার অল, এ অঞ্চলের বৃহত্তম সরকারি হাসপাতালটাও তো বৃহৎ একটা চাকরি-প্রতিষ্ঠানই বটে। সৌভাগ্যক্রমে সেটা সশরীরে গিয়ে যাঁরা দেখেননি এখনও, ডাক্তার-শিক্ষক-সাহিত্যিক মামুন হুসাইন তাঁর 'হাসপাতাল বঙ্গানুবাদ' গ্রন্থে তাঁদের জন্য মজুদ রেখেছেন অমূল্য মানবীয় সাক্ষ্য। সেই সাক্ষ্যের আরও একটা মামলা মাত্র হয়ে রইলেন অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম।

বন্ধু এক্রাম উল্যাহ, আমার চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু তিনি লিলন ভাইয়ের, বলে যাচ্ছিলেন পরিস্থিতির বিবরণ। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে পৌঁছানোর পর থেকে অপারেশন থিয়েটার পর্যন্ত পৌঁছাতে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে আমার সহকর্মীদের। রক্ত জোগাড় করে দৌড়াচ্ছেন এক্রাম। সঙ্গে ততক্ষণে অন্য সহকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি মহোদয় স্বয়ং। ক্যাম্পাসে ডিউটি-করা পুলিশরা এবং তাঁদের অফিসার সবাই মিলে যা কিছু সম্ভব করছেন। একে বলছেন তাকে ধমকাচ্ছেন। কিন্তু কীসের কী! এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল প্রায়।

আমলাতান্ত্রিক নিয়মকানুন সেরে স্ট্রেচার-ট্রলিতে শুইয়ে লিলন ভাইকে নিয়ে যতক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছেন হাসপাতালের কর্মচারীরা, ঠিক তখনই ঠোঁটটা শুকিয়ে গেল লিলন ভাইয়ের। এক্রামের চোখের সামনে। বন্ধ হয়ে গেল তাঁর কথা বলা। হাত থেকে পড়ে গেল এতক্ষণের আঁকড়ে ধরে থাকা মোবাইল ফোনটা। তখনও প্রাণ আছে, হাত-পা নড়ছে। তারপর সব শেষ। কখন? কীভাবে? কেন? তা আপনি-আমি-এক্রাম বলার কে? আবারও বলি, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নালিশ তুলছি না আমি। কিন্তু সে ব্যাপারে আরও অনেক সময়ক্ষেপণ করে অবশেষে ড. এ কে এম শফিউল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাহেব– দেখলাম আজকের পত্রিকায়। সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র।

কাল রাতে আমি যখন হাসপাতালে দেখতে যাই লিলন ভাইকে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার সব সহকর্মীরা ফিরে গেছেন ক্যাম্পাসে। লিলন ভাইয়ের লাশ তখন মর্গে– লাশকাটা ঘরে।

সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া গেলে, সময়মতো তাঁর দেহে একটুখানি রক্ত দেওয়া গেলে সম্ভবত বেঁচে যেতেন লিলন ভাই– অধ্যাপক এক্রামের এই বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি এখানে যদি করি, সেটা কি আইনত রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হবে?

|| চার ||

এরই মধ্যে বুঁজে যাওয়া গর্ত খনন করে লিলন ভাইয়ের জীবনের নানান চড়াই-উৎরাইয়ের আকথা-কুকথা টেনে বের করে আনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন যারা, তারা আসলে নিজেদের অধঃপতিত-আনুগত্যপরায়ণ জীবনের সমতূল্য করে দেখতে এবং দেখাতে চাইছেন তাঁকে। যে যতটুকু দেখতে পান তার চেয়েও দূর অব্দি দেখার তাকদ তারা পাবেন কোথায়! খুন কিংবা ধর্ষণের শিকার মানুষটির দোষগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে নামেন যে সমস্ত বিজ্ঞানী, তারা আসলে ইনিয়েবিনিয়ে মিনমিনিয়ে হত্যাকাণ্ডটিকে কিংবা ধর্ষণযজ্ঞটিকে জায়েজ প্রতিপন্ন করার গবেষণায় লিপ্ত হন।

আর, রাষ্ট্রকর্তা-কর্তৃপক্ষের আমলাতন্ত্র-দূষিত আমাদের অথর্ব সমাজের দিক থেকে আমি দেখতে থাকি, এই সেই চিন্তনপ্রণালী– যাতে করে হত্যাকাণ্ডটি অবৈধ বা অগ্রহণযোগ্য হতে গেলে খুন-হয়ে-যাওয়া মানুষটিকে হতে হয় 'নিখুঁত', 'নিষ্পাপ', 'নিরুপদ্রব', 'নিয়মিত' মানুষ। অন্যথায় 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়'। এই সেই তর্কের তরিকা– যাতে করে হত্যাকাণ্ড মাত্রেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, বৈধ হয়ে ওঠে। শুধু বিশেষ বিরল ব্যতিক্রমের জায়গাগুলোতে– যেখানে বছরের পর বছর ধরে চলা মামলায় সাক্ষ্য-উকিল, হাজিরা-তারিখ, ঝালমুড়ি-গসিপ-চানাচুর শেষে বিচারিক পদ্ধতি-প্রণালী নামক দুর্গম পাহাড়ের পাদদেশের গর্ত থেকে সর্বোচ্চ চূড়া পর্যন্ত আরোহনের পর– বাদিপক্ষ তথা ভিকটিমপক্ষ এই মর্মে একটি 'রায়' পান যে হত্যাকাণ্ডটি 'অবৈধ' বা 'অগ্রহণযোগ্য' ছিল বিধায় অমুকের-তমুকের ইহা-উহা শাস্তি হইল।

তর্কবিতর্ক, বাহাস-বাহাদুরি তবু চলতেই থাকে, কেননা খোদ বিচার বিভাগকেই অনেক ক্ষেত্রে লোকে 'নিখুঁত', 'নিষ্পাপ', 'নিরুপদ্রব' মনে করেন না। সুতরাং হত্যাকাণ্ডের 'অবৈধতা' বা 'অগ্রহণযোগ্যতা' নিয়ে– সাধারণ অর্থে বললে– কোনোভাবেই কোনো সর্বসম্মত মতৈক্যে পৌঁছুতে পারে না আমাদের অপদার্থ সমাজ। মাথার পেছন দিয়ে হাত ঘুরিয়ে কান ধরার মতো করে হলেও কানের ওপরে নিচে গেঁথে যাওয়া চাপাতির 'নিখুঁত', 'নিষ্পাপ', 'নিরুপদ্রব' কোপ বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায় এই যুক্তিতে যে: নিহত মানুষটার ভেতরেই তো ছিল ভেজাল। সুতরাং, ও কোপ খাবে না তো কে খাবে কোপ!

একই সঙ্গে সামাজিক ও ফৌজদারি উভয় পন্থায় 'বেআইনি' হয়ে ওঠে এই প্রশ্নটা যে: হত্যাকাণ্ড জিনিসটা কি সত্যিই অবৈধ? খুনখারাবির ব্যাপারগুলো কি আসলেই অগ্রহণযোগ্য? এভাবেই ঘোরালো-প্যাঁচালো হত্যাকাণ্ডের অধিকতর আবর্তে ক্রমবর্ধমান হারে ঘুরপাক খেতে থাকি আমরা। আর পায়ে-ঘাড়ে-মাথায় চাপাতির কোপ নিয়ে সোজা হয়ে বসে মরার জন্য হাসপাতালে যেতে যেতে লিলন ভাই বলতে থাকেন: 'কী হয়েছে আমার? আমাকে একটু আরাম করে বসতে দাও।'

লিলন ভাই চির-আরামের বিশ্রামে শায়িত হয়েছেন। আমরা কিন্তু অত আরাম পাব না এখনই। 'প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই/শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না, পাবে না'।

সেই শান্তি, সেই আরামের আগে আমাদের সৃজনে-মননে ভাবতে শুরু করতে হবে হত্যাকাণ্ড জিনিসটাকে আসলেই আমরা অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করব, নাকি করব না। এই প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করছে আমাদের এবং পুরো মানবজাতির ভবিষ্যৎ।

তার আগে নিজের সম্ভাব্য-ভবিষ্যৎ প্রাণহীন মুখটা একবার আমি দেখে এসেছি কাল রাতে। খুবই ঘনিষ্ঠভাবে। খাটিয়ায় শোয়ানো লিলন ভাইয়ের মুখে।

পশ্চিমপাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: ১৬ নভেম্বর ২০১৪, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা

সেলিম রেজা নিউটন: কবি-প্রাবন্ধিক-শিক্ষক।