খালেদ মোশাররফ, ‘আঁতাতকারী’ প্রসঙ্গ ও যুক্তির প্রয়োজনীয়তা

নাদির জুনাইদ
Published : 15 Nov 2014, 10:04 AM
Updated : 15 Nov 2014, 10:04 AM

রাজনীতিতে সত্যাশ্রয়ী তথ্য উপস্থাপনের প্রসঙ্গটি জার্মান রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হানাহ আরেন্ড্টকে আকৃষ্ট করেছিল। রাজনীতিতে প্রকৃত, সঠিক তথ্য কখন কীভাবে অপ্রকাশিত রাখা বা বিকৃত করা হয়, আরেন্ড্ট সেই বিষয়টি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল 'ট্রুথ অ্যান্ড পলিটিকস'। ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ যদি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয় সে ক্ষেত্রে ইতিহাসের সেই ঘটনা ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে, এই প্রবন্ধে এই জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক তাই আলোচনা করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা কাজ সঠিক প্রমাণ করার জন্য কখনও ইতিহাসের কোনো ঘটনা ঠিকঠাক বর্ণনা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য অতীতের কোনো ঘটনার অশুদ্ধ উপস্থাপন ব্যবহার করা হয় একটি হাতিয়ার হিসেবে।

আরেন্ড্ট্ মনে করেন, এমন চেষ্টা বিপজ্জনক; কারণ রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যদি প্রকৃত ঘটনা অস্বীকার বা বিকৃত করা হয়, তাহলে যা তৈরি হয় তা হল একটি বিকল্প বর্ণনা যার সঙ্গে বাস্তব ঘটনা এবং সঠিক তথ্যের সংযোগ থাকে না। ইতিহাসের কোনো ঘটনা সঠিকভাবে বর্ণনার জন্য তাই জরুরি পক্ষপাতহীন, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি আর সত্যাশ্রয়িতা। অতীতের কোনো রাজনৈতিক ঘটনায় কোনো ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে যথেষ্ট জোরালো যুক্তির মাধ্যমেই মন্তব্য করা প্রয়োজন, যেন সেই মূল্যায়নটির যৌক্তিক ভিত্তি সহজেই সবার কাছে স্পষ্ট আর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

৮ নভেম্বর কর্নেল তাহের সংসদ আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের 'সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান' বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে 'জঘন্য আঁতাতকারী' হিসেবে অভিহিত করেছেন।

[সূত্র: ৯ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক 'প্রথম আলো', দৈনিক 'আমাদের সময়']

সেই সভায় হাসানুল হক ইনু বলেছেন, "খালেদ মোশাররফই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাই যাঁরা খালেদ মোশাররফকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সতর্ক হতে বলব।"

[সূত্র: ৯ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক 'প্রথম আলো']

১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ঘটনাবলীর আলোচনায় উঠে আসে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের নাম। দুজনই মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত দুটি সেক্টরের অধিনায়ক এবং বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। দুজনই যুদ্ধের ময়দানে গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন, যে আঘাতের কারণে তাদের মৃত্যুও হতে পারত। পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত গোলার একটি অংশ খালেদ মোশাররফের কপালে আঘাত হানে, এতে করে তার মাথার ঘিলু কিছুটা ছিটকে বেরিয়ে আসে।

[আখতার আহমেদ, ১৯৯৪: পৃ-১২০-২১]

আর যুদ্ধের সময় গোলা আঘাত হানে আবু তাহেরের বাম পায়ে। পরবর্তীতে হাসপাতালে তাহেরের সেই পায়ের হাঁটুর কিছুটা নিচ থেকে বাকি অংশ কেটে বাদ দিতে হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই দুই সেনা অধিনায়কের অবদান অনেক।

মুক্তিযুদ্ধের পর খালেদ মোশাররফ, আবু তাহেরের বিভিন্ন কাজের মূল্যায়ন করতে হলে যথেষ্ট নির্মোহ এবং বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার মাধ্যমে তা করা প্রয়োজন, যেন তাঁদের সম্পর্কে নতুন সময়ের মানুষরা পক্ষপাতমূলক বক্তব্য নয়, বরং জানতে পারেন সঠিক তথ্য। আর এই জন্য প্রয়োজন বাস্তবে যা ঘটেছিল সেই প্রতিটি ঘটনারই নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করে তারপর যৌক্তিক একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার সঙ্গে জড়িত সেনাবাহিনীর মেজরদের সঙ্গে খালেদ মোশাররফ আঁতাত করেছিলেন এমন দাবি গ্রহণযোগ্য নাকি ভ্রান্ত তা ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন ঘটনাবলী যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বিচার করতে হবে।

খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ প্রায়ই তোলা হয়। একটি হল, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মোশতাককে সমর্থনকারী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করার পর এবং সেই অভিযানে দ্রুত সফলতা পাওয়ার পরও কেন কারাগারে বন্দি জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ঠেকানো গেল না।

উল্লেখ্য, খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিম চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি নেওয়া হলেও এই সময়ে কারাগারে বন্দি জাতীয় নেতাদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে ঘাতক চক্র মোশতাক-বিরোধী এই চারজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে কোনো বাধা ছাড়াই হত্যা করে। আরও লক্ষণীয়, এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলদের কাছে পৌঁছায় ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিম চক্রের সদস্যরা দেশত্যাগ করার পর।

জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা এবং তাদের হত্যা করার সংবাদ যথাসময়ে জানতে না পারা খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলদের বড় একটি ব্যর্থতা নির্দেশ করে। শাফায়াত জামিল তাঁর বইতে এই জেল হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লিখেছেন:

"ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যখন বাকযুদ্ধ চলছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও আমরা জানতে পারিনি জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের কথা। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল ঐ বর্বর হত্যাকাণ্ড। ওসমানী ও খলিলুর রহমান ঐ ঘটনার কথা তখন জানতেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানাননি। জানালে এভাবে ১৫ আগস্টের খুনিদের নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হত না। আমাদের নেগোসিয়েশন টিমকেও এ বিষয়ে কেউ কিছু আভাস দেয়নি।"

[জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১৩৬]

পরদিন, ৪ নভেম্বর বঙ্গভবনে শাফায়াত জামিল সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে জেল হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার কথা জানার পরও তাদের এই তথ্য না জানানোর জন্য তিরস্কার করে বলেন:

"এই ডিসগ্রেসফুল আচরণের জন্য আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি।"

[জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১৩৮]

খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হল, তিনি কেন বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজরদের দেশত্যাগের সুযোগ দিলেন। এই বিষয়টি আলোচনার সময় কয়েকটি দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

১৫ আগস্ট ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিমসহ অন্যান্য মেজরদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর, সামরিক বাহিনী, রক্ষীবাহিনী বা দেশের কোনো রাজনৈতিক দল থেকে এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত মেজরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট– ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সার্স আর গোলন্দাজ ইউনিট দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট– ফারুক-রশিদদের অনুগত থাকে। ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের মাধ্যমে ফারুক-রশিদরা নিজেদের শক্তি টিকিয়ে রাখে। বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতি মোশতাকের পাশে অবস্থান নিয়ে এই ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিম চক্র হয়ে উঠে দেশের মূল ক্ষমতার অধিকারী। ট্যাংক আর গোলন্দাজ বাহিনী রয়ে যায় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের বাইরে। জেনারেল জিয়া, খলিল, ওসমানী– এই শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা কেউই এই ইউনিট দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। এই ইউনিট দুটো শুধু মোশতাক এবং ফারুক-রশিদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করত।

[জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১২৮]

সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এই মেজরদের এবং সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী ইউনিট দুটোকে চেইন অব কমান্ডে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। জেনারেল জিয়াকে ফারুক-রশিদ চক্র তাদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করত না। বরং সেই সময় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আর ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ও এই দুজনের অনুগত অন্য অফিসারদের মোশতাক এবং ফারুক-রশিদ চক্র চিহ্নিত করেছিল তাদের 'বিরোধী পক্ষ' হিসেবে। জানা যায়, ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের আগেই তারা সেনাবাহিনীতে নিজেদের জন্য ঝুঁকি হতে পারে এমন ৩৩ অফিসারকে বরখাস্তের একটি তালিকা তৈরি করে। এই তালিকার প্রথম নামটি ছিল খালেদ মোশাররফ।

[নাসির উদ্দিন: ১৯৯৭, ১১৬]

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের উৎখাত করার জন্য সরাসরি একটি সামরিক পদক্ষেপ প্রথম নেওয়া হয় ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে, খালেদ মোশাররফ আর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে। সেনা এবং বিমান বাহিনীর মূলত মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা এই অভিযানে খালেদ-শাফায়াতের পক্ষে থাকেন। এই অভিযান পরিচালনার শুরুতেই সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। ঢাকাস্থ তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন– রক্ষীবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকৃত কয়েকটি ব্যাটালিয়ন খালেদ-শাফায়াতের পক্ষে থাকে। ফারুক-রশিদের অনুগত ট্যাংক আর কামান প্রতিরোধ করার জন্য বিমানবাহিনীর অফিসাররা ব্যবহার করেন মিগ ২১ জঙ্গি বিমান এবং এম আই ৮ হেলিকপ্টার। বিমানবাহিনীর মহড়ায় ভীত হয়েই মূলত বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে অবস্থানরত ফারুক-রশিদ চক্র পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়।

খালেদ মোশাররফের সামরিক শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে না বুঝেই খুনি মেজররা দেশত্যাগের জন্য দেনদরবার শুরু করে। মোশতাকও তার অনুসারীদের দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়ার জন্য খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করেন। এই অবস্থায় খালেদ মোশাররফ খুনি মেজরদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালিয়ে তাদের পরাজিত করার চেষ্টা করতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে জঙ্গি বিমান ব্যবহার করতে হত। তাহলে একদিকে বিমান হামলা অন্যদিকে ফারুক-রশিদের অধীনে থাকা ৩০ টি ট্যাংক আর ১৮ টি কামানের গোলাবর্ষণে একটি ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি হত। হয়তো এই চিন্তা করেই খালেদ মোশাররফ আর তাঁর অনুসারীরা ফারুক-রশিদ চক্রকে আত্মসমর্পণ করানো থেকে বিরত থাকেন।

শাফায়াত জামিল লিখেছেন:

"সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের দেশত্যাগের সেফ প্যাসেজ দিতে রাজি হলাম আমরা। সে সময় এটা আমাদের মনে ছিল যে, বিদেশে চলে গেলেও প্রয়োজনে পরে ইন্টারপোলের সাহায্যে তাদের ধরে আনা যাবে।"

[জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১৩৬]

এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়ার জন্যই যদি খালেদ মোশাররফকে এই খুনিদের সঙ্গে 'জঘন্য আঁতাতকারী' হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাহলে তা যথার্থ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। সেই সময়ের ঘটনাবলীর দিকে তাকালে দেখা যায়, যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অবস্থানে ছিল তখন খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানই মোশতাক এবং ফারুক-রশিদ চক্রকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। এই গোষ্ঠী খালেদ মোশাররফকে তাদের 'শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিশালী পদক্ষেপটি খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের উদ্যোগেই গ্রহণ করা হয়। চার নেতার হত্যাকাণ্ডের খবরটি যথাসময়ে খালেদ-শাফায়াতদের কাছে পৌঁছালে হয়তো ফারুক-রশিদ চক্রকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হত না।

জিয়াকে বন্দি করার প্রেক্ষিতে খালেদ মোশাররফকে নতুন সেনাপ্রধান করা হলেও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, খালেদ মোশাররফ সেই সময় দেশের ক্ষমতা দখলের আগ্রহ দেখাননি। প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। খালেদের সহকর্মীরা তাঁকে বার বার রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করলেও খালেদ সেই কথায় রাজি হননি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই কেবল ভাষণ দেবেন, খালেদ তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন।

খালেদ মোশাররফকে খুনি মেজরদের সঙ্গে 'জঘন্য আঁতাতকারী' হিসেবে অভিযুক্ত করতে হলে, তাই এখনও অজানা এমন কোনো যৌক্তিক তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। সেই সময়ের যে ঘটনাগুলো আমরা জেনেছি তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খালেদ মোশাররফের উদ্যোগের কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজররা এবং মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। খুনি মেজরদের অনুগত ট্যাংক আর গোলন্দাজ ইউনিট দুটিকেও সেনানিবাসে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল।

খালেদের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকায় একটি মিছিলের আয়োজন করা হয়। ১৫ আগস্টের পর এটিই ছিল ঢাকার প্রথম মিছিল। মিছিলটি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফুল দেয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এই মিছিলে অনেকের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের মা এবং ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন:

"৩ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানটি না ঘটলে, মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া কি সম্ভব হত? মনে হয় না।"

[নির্মলেন্দু গুণ: ১৯৯৭, পৃ-১৭]

এমন বিভিন্ন কারণেই খালেদ মোশাররফকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে আঁতাতকারী হিসেবে বর্ণনা করা যৌক্তিক মনে হয় না। বরং জেনারেল জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাকে মুক্ত করা এবং সিপাহি-জনতার বিপ্লব সফল করার জন্য কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে যখন ৭ নভেম্বর জাসদের গণবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়, তখন মোশতাক এবং ফারুক-রশিদকে সমর্থন যোগানো ট্যাংক ও গোলন্দাজ ইউনিটের সৈনিকরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফারুক-রশিদরা দেশত্যাগ করার পর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ট্যাংক আর কামানগুলো সেনানিবাসে ফেরত এসেছিল।

৭ নভেম্বর কিন্তু ঢাকার রাজপথে আবার এই ট্যাংকগুলো দেখা যায়। এদিনের অভ্যুত্থানে ট্যাংক ইউনিটের সৈনিকদের যেমন সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যায়, তেমনি এই পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয় ফারুক-রশিদকে সমর্থন যোগানো অপর ইউনিট, দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিকেও। ঠিক করা হয় যে, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে বাধা প্রদানকারী অফিসারদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হবে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে।

[আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-৯৪]

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির এই সংযোগ তাই স্বাভাাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি করে। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার পর তাকেও নিয়ে আসা হয় এই রেজিমেন্টের দপ্তরেই। সেখানে জিয়ার অনুগত এবং খালেদ-বিরোধী অফিসার ও সৈনিকরা জিয়াকে সমর্থন যোগাতে থাকেন। ফলে দেখা যায়, মোশতাক এবং ফারুক-রশিদপন্থী সৈনিকরা সুযোগ পাওয়া মাত্রই খালেদ মোশাররফবিরোধী অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আঁতাত থাকলে খালেদ-বিরোধী অভ্যুত্থানে নিশ্চয়ই এই সেনাসদস্যরা অংশগ্রহণ করত না।

খুনি মেজরদের সহযোগী আর্টিলারি রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিন ফারুক-রশিদদের সঙ্গে দেশত্যাগ করেনি। ৭ নভেম্বর খালেদ-বিরোধী অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর এই মেজর মহিউদ্দিনই জেনারেল জিয়াকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসে।

[হামিদ: ১৯৯৬, পৃ-১২৬; মজুমদার: ১৯৯৭]

পরবর্তীতে কর্নেল তাহের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির দপ্তরে জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসে তাকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে, জিয়া সেই অনুরোধে সাড়া দেননি। এই দপ্তরে জিয়ার ওপর তাহের নিজের প্রভাব খাটাতেও ব্যর্থ হন, যা নির্দেশ করে সেই মুহূর্তে সেনানিবাসে জাসদের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যথেষ্ট শক্তি ছিল না। মোশতাকপন্থী অনেক সৈনিক জাসদের খালেদ মোশাররফবিরোধী অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় জড়িত হলেও বোঝা যায় তারা কর্নেল তাহেরকে সমর্থন দিয়েছিল কেবল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, জাসদের পরিকল্পনামতো সেনাবাহিনীর কাঠামো বদলের বিপ্লবের জন্য নয়।

সে সময় জাসদের গণবাহিনীর ঢাকা শহরের অধিনায়ক আনোয়ার হোসেন তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন:

"মোশতাক চক্র ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান সংগঠনের পর থেকেই তারা এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাতে শুরু করে।"

[আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-৯৯]

বোঝা যায়, মোশতাকপন্থী সৈনিকরা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সমর্থন করেছিল কেবল খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করে নিজেদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য।

১৯৭৫ সালে হাসানুল হক ইনু ছিলেন জাসদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের সমগ্র পরিকল্পনাটি কর্নেল তাহেরই করেন। এ সময় সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু।

[আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-৯০]

৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর কর্নেল তাহেরের সঙ্গে হাসানুল হক ইনুও সেনানিবাসে গিয়েছিলেন।

[প্রাগুক্ত, পৃ-৯৬]

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন বলে খালেদ মোশাররফকে হাসানুল হক ইনু সমালোচনা করেছেন। অথচ আমরা দেখতে পাই সেই সময় জাসদ নেতারা কিন্তু ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে মোশতাক এবং ফারুক-রশিদের অনুগত সৈনিকদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেননি। বরং জেনেশুনেই তাঁরা এই সৈনিকদের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে শামিল হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের এই দিকটি নিশ্চয়ই হাসানুল হক ইনুর অজানা নয়।

এই মোশতাকপন্থী সৈনিকদের প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেন লিখেছেন:

"৬ নভেম্বর রাতের যে সভায় অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং বিভিন্ন অপারেশনাল পরিকল্পনা নেওয়া হয় তাতে ট্যাংক রেজিমেন্টের সুবেদার সারোয়ারের নেতৃত্বে মুশতাক-ফারুক-রশিদ অনুগত কিছু সৈনিকও উপস্থিত ছিল। ৬ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে এদের একাত্মতা কর্নেল তাহেরের নজড় এড়ায়নি। তিনি জানতেন, এরা সৈনিক সংস্থার সদস্য নয় বরং মোশতাকের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী চক্রের প্রতিই তাদের আনুগত্য। কিন্তু একটি সাধারণ গণঅভ্যুত্থানে শামিল হওয়া থেকে তাদের নিবৃত্ত করার বাস্তবতা এবং যুক্তি কোনোটাই তখন খুব একটা ছিল না। তাছাড়া আমাদের আরেকটা ধারণা ছিল যে, ওই গোষ্ঠীটি অভ্যুত্থানে শামিল থাকলে অভ্যুত্থানের একটি বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় রাখা যাবে। এছাড়া ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর ট্যাংক রেজিমেন্টের ঘাতক চক্রের অধিকাংশ উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তাকেই খালেদ মোশাররফরা নির্বিঘ্নে দেশের বাইরে চলে যেতে দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, নেতৃত্বহীন এসব সৈন্য গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী অবস্থানে যেতে পারবে না।"

[আনোয়ার হোসেন: ২০১২, পৃ-৯৯-১০০]

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মোশতাকপন্থী এই সৈনিকরা যথেষ্ট সংগঠিতভাবে এবং যেন তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে নিজেদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য কাজে লাগায়। কর্নেল তাহের উপনিবেশী আমলের কাঠামো পাল্টে সেনাবাহিনীকে গরিব শ্রেণির স্বার্থরক্ষার গণমুখী বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই পরিকল্পনায় মোশতাক ও ফারুক-রশিদের সমর্থক এই সৈনিকদের আগ্রহ ছিল না। এরা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়েছিল খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর সঙ্গের অফিসারদের পরাজিত করে আবার ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য।

এই সৈনিকদের জাসদের ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে কর্নেল তাহেরের ভাই মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেছাত হোসেন বেলাল লিখেছেন:

"প্রকৃতপক্ষে নভেম্বর বিপ্লব নস্যাৎ করার লক্ষ্যে ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা এক ভয়াবহ চক্রান্তে মেতে উঠেছিল। সুবেদার সারোয়ারের নেতৃত্বে একটি কিলিং স্কোয়াড গঠন করে তারা। এই স্কোয়াডের টার্গেট ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দ। অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ের মধ্যে এরা রাজপথে মোশতাকের অসংখ্য ছবি সরবরাহ করে।"

[পারভেজ: ১৯৯৫, পৃ-১৪৬]

রাজপথে ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে পড়া এই সৈনিকরা ব্যবহার করে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী স্লোগান। ডানপন্থী এইসব স্লোগান, মোশতাকের ছবি প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব আবারও মজবুত করার চেষ্টা করে এই সৈনিকরা। কর্নেল তাহের মোশতাকবিরোধী হলেও মোশতাককে সমর্থনকারী এই সৈনিকদের নিজেদের অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারে তিনি এবং অন্যান্য জাসদ নেতারা আপত্তি তোলেননি। আর এই ভুল সিদ্ধান্ত জাসদ নেতৃবৃন্দের জন্য বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর পদাতিক ইউনিটগুলোর অর্থাৎ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো ব্যাটালিয়নের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। শাফায়াত জামিলের মতে, এই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সৈনিকদের বেশিরভাগই ছিল পাকিস্তান-প্রত্যাগত। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের "সিপাই সিপাই ভাই ভাই" স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের পক্ষে আর সক্রিয় অবস্থান নেয়নি। তবে শাফায়াত জামিলের কথা অনুযায়ী, তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে খালেদ মোশাররফের পক্ষের অফিসারদের বিরুদ্ধে কিছু করেওনি।

[জামিল: ১৯৯৮, পৃ-১৪৯]

সেই সময় ফারুক-রশিদকে সমর্থন দেওয়া ট্যাংক রেজিমেন্ট বেঙ্গল ল্যান্সারে পাকিস্তান-প্রত্যাগত সৈনিকদের সংখ্যা বেশি ছিল।

[নাসির উদ্দিন: ১৯৯৭, পৃ-৫২]

এই রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা অফিসার মেজর নাসির পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের সম্পর্কে লিখেছেন:

"বেঙ্গল ল্যান্সারে দায়িত্বে যোগদানের পর যে বিষয়টি আমাকে বেশি হতবিহ্বল করে তা হল বাকবিতণ্ডায় পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের ধৃষ্টতা। সংশ্লিষ্ট রেজিমেন্ট কিংবা মেসে তারা প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সরকারবিরোধী প্রচারণা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করত যেন মনে হত সেনাবাহিনীতে প্রচারণার এই বর্ধিত দায়িত্ব তাদের ওপর কেউ ন্যস্ত করেছে। কাজের ফাঁকে চা-বিরতির সময় তাদের এই অপপ্রচারণা চালানোর কাজটি প্রায় নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়।"

[প্রাগুক্ত, পৃ-৫৪]

খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সময় প্রায় পুরোপুরিভাবেই নির্ভর করেছিলেন সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের ওপর। তবে জাসদের গণবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা যে ১২ দফার ভিত্তিতে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশ নেয় তার একটি দফা ছিল পাকিস্তান-প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর লোকদের ১৮ মাসের বেতন দিতে হবে।

[পারভেজ: ১৯৯৫, পৃ-১৩৬]

বোঝা যায়, পাকিস্তান-প্রত্যাগত সেনাসদস্যদের সমর্থন লাভের জন্যই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা দাবিটি অন্তর্ভূক্ত করেছিল।

খালেদ মোশাররফ তাঁর অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে কোনো রক্তপাত ঘটাননি। অথচ ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরপরই খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর দুই সঙ্গী, বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমকে একটি কক্ষ থেকে জোরপূর্বক বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশাররফ একজন আঁতাতকারী হলে কি তাঁকে এমনভাবে হত্যা করা হত?

বোঝা যায়, খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন এবং এই কারণে মোশতাক এবং ফারুক-রশিদপন্থীরা খালেদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। জাসদ নেতৃবৃন্দ সেই অস্থির সময়ের সুযোগ নিয়ে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজেদের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করেছিলেন।

ফারুক-রশিদের অনুগত ট্যাংক আর গোলন্দাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফ ব্যবহার করেছিলেন সেনাবাহিনীর তিনটি পদাতিক ইউনিট আর বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। জাসদ নেতৃবৃন্দ তাঁদের অভ্যুত্থানে মোশতাকপন্থী সৈনিকদের যুক্ত করেছিলেন এই সৈনিকদের খালেদ-বিরোধী মনোভাবের জন্য।

বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করার পর খালেদ মোশাররফ একজন 'আঁতাতকারী' এমন একটি মন্তব্য যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য তা মনে হয় না।

তথ্যসূত্র:

১. আখতার আহমেদ, বার বার ফিরে যাই

(ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৪)

২. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব:), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর

(ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮)

৩. মেজর নাসির উদ্দিন, গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী

(ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭)

৪. নির্মলেন্দু গুণ, রক্তঝরা নভেম্বর, ১৯৭৫

(ঢাকা: সময় প্রকাশন, ১৯৯৭)

৫. আলতাফ পারভেজ (সম্পাদিত), অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্নেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি

(ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৫)

৬. ড. মো. আনোয়ার হোসেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের

(ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১২)

৭. হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, ৭ নভেম্বর: এক অভ্যুত্থানকারীর জবানবন্দি

(ভোরের কাগজ, ৬ নভেম্বর, ১৯৯৭)।