বীরাঙ্গনা মায়েদের জন্য দিতে হবে আরও পথ পাড়ি

শাহমিকা আগুন
Published : 13 Nov 2014, 09:32 PM
Updated : 13 Nov 2014, 09:32 PM

আমরা বারবার লিখি ধর্ষণের বিরুদ্ধে। বারবার লিখি বীরাঙ্গনাদের জন্যেও। যদিও তাতে কোথাও কৃষ্ণপক্ষ বদলে শুক্লপক্ষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, বরং বাংলাদেশে ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের কোনো পুরুষ নিজের ক্ষমতার দাম্ভিকতায় কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করছে ভাবতেই ঘৃণায় আমি কুঁচকে যাই।

যে দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা অত্যন্ত নির্মম ও বর্বরভাবে চার লাখের বেশি নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করেছে, সেই দেশের পুরুষ কী করে এই দেশের নারীদের ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের পর সেই ভিডিও চিত্র প্রচার করে! সেই দেশের শিক্ষিত পুরুষ কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসে বসে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করতে পারে! একাত্তরের নির্যাতিত আমাদের মা-বোনদের প্রতি সম্মান দেখিয়েই তো এই জাতির পুরুষদের উচিত ছিল ধর্ষণকে 'না' বলা, ধর্ষণ রুখে দেওয়া। আমাদের সকল নৈতিকতা কি সরকারকে গড়ে দিতে হবে?

এই বাংলাদেশেই গারো সমাজে ধর্ষণ বলে কোনো শব্দ নেই। গারো পুরুষ বাংলাদেশেরই জলে-ঝড়ে বেড়ে ওঠা পুরুষ। তারা ধর্ষণের কথাও দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

শান্তির সময়ে ধর্ষণ ও যুদ্ধে ধর্ষণের মাঝে ফারাক অনেক। যুদ্ধে ধর্ষণ জৈবিক কারণে হয় না। এখানে চলে 'এথনিক ক্লিনজিং'। একটি স্বাধীনতাকামী জাতিকে চরমভাবে অপমানিত করার জন্য এবং তাদের পরিবারে ও সমাজে ধ্বংসের দগদগে ক্ষত রেখে দিতেই যুদ্ধে ধর্ষণ করা হয়। আর তাই যুদ্ধে গণধর্ষণের সংখ্যাই বেশি। এর বীভৎসতাও অকল্পনীয়।

একাত্তরের যুদ্ধেও আমরা দেখেছি বীরাঙ্গনা নারীদের ওপর চালানো নৃশংসতার নানা ঘটনা। ডা. বিকাশ চক্রবর্তী বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মমতার উদাহরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, "যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে কয়েকটি কাঁচের জার উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। অংশগুলো কাটা হয়েছিল খুব নিখুঁতভাবে।''

তবু যুদ্ধের পর আমাদের বীরাঙ্গনাদের আমরা শুধু তথাকথিত 'সতীত্ব-হারানো' কিছু শরীরজীবীয় প্রাণি হিসেবে গণ্য করেছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম ধর্ষণ ছাড়াও আরও অনেক নির্মম অত্যাচার তাদের সইতে হয়েছে। নিজেরই মাথার চুলের সঙ্গে ঊর্ধফাঁসে সিলিংএ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করা হয়েছে তাদের দেহ, বাবাকে দিয়ে মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা বা ছেলেকে দিয়ে মাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে ওরা। বীরাঙ্গনাদের মাথা কামিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন তাদের বিবস্ত্র রাখা, অভুক্ত রাখার মতো ঘটনার বিষয়ে আমরা কী করে শুধু 'ধর্ষণ' বলে চোখ বন্ধ করে ছিলাম তা আমার বোধগম্য হয় না।

যুদ্ধের পর পুনর্বাসন ক্যাম্পে বীরাঙ্গনাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত কর্মী মালেকা খানের ভাষ্যে:

''আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিতাদের প্রায় সবার ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়নেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন, ঊরু এবং পশ্চাতদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন ক্যাম্পে আসত।''

পাকবাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে আট বছরের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ নারীকেও নিপীড়ন করেছে। মা ও কন্যাকে একই সঙ্গে ধর্ষণ করেছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনেই, এমন ঘটনাও ঘটেছে। বার থেকে চৌদ্দ বছরের হাজার হাজার সদ্যকিশোরী (বর্তমানের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় তারা শিশু) সংঘবদ্ধ নিপীড়নের ফলে যুদ্ধের সময় বা পরে হয়ে পড়েছিল সন্তানসম্ভবা। বীরাঙ্গনাদের সামনে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের প্রিয় সন্তান, স্বামী, বাবা-মা এবং ভাইবোনকে। তারপর তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।

যুদ্ধে নারী নির্যাতনের সাক্ষী মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম এর বিবরণে:

"মার্চে মিরপুরের একটি বাড়ি থেকে পরিবারের সবাইকে ধরে আনা হয় এবং কাপড় খুলতে বলা হয়। এতে তারা রাজি না হলে বাবা ও ছেলেকে আদেশ করা হয় যথাক্রমে মেয়ে ও মাকে ধর্ষণ করতে। এতেও রাজি না হলে বাবা ও ছেলেকে টুকরো টুকরো করা হয় এবং মা ও মেয়েকে চুলের সঙ্গে বেঁধে উলঙ্গ অবস্থায় টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।''

সুসান ব্রাউনমিলার ও ড. জিওফ্রে ডেভিসের গবেষণা এবং বাংলাদেশ অবজারভার (১৯৭২)এর তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে প্রায় চার লাখের বেশি বাংলাদেশি নারী পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে বাংলাদেশ এবং বিশ্ব মিডিয়াতে নারীনির্যাতনের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, নির্যাতনের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে তেমন কোনো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে নারীনির্যাতনের বিষয়টি খুব প্রকট হয়ে পড়ে এবং তার চেয়েও প্রবল হয়েছিল নির্যাতনের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। যদিও নারীনির্যাতন ছিল পাকিস্তানিদের যুদ্ধের অন্যতম কৌশল।

নারীনির্যাতনের নৃশংসতা দেখে ড. জিওফ্রে ডেভিস কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটক এক পাকিস্তানি অফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তারা কীভাবে কোনো নারীর ওপর এত জঘন্য অত্যাচার চালিয়েছে! অষ্ট্রেলীয় এই চিকিৎসক ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্ম থেকে এসেও বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু অন্তরে 'পাক্কা' মুসলমান, ইসলামের ঝাণ্ডা উত্তোলনকারী সেই অফিসারের নির্লিপ্ত জবাব ছিল: "আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিল যে, একজন ভালো মুসলমান কখনওই তার বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের উচিত যত বেশ সম্ভব বাঙালি মেয়েকে গর্ভবতী করে যাওয়া। আমরা তাই করেছি। চেষ্টা করেছি তারা যেন ভালো মুসলিম ও ভালো জাতি হয়ে ওঠে এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয় ভালো মুসলিম ও ভালো পাকিস্তানি।''

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্যসূত্র বলছে, ধর্ষণের ফলে প্রায় দুই লাখ নারী ও কন্যাশিশু গর্ভধারণ করেছিলেন। এছাড়া প্রায় এক লাখ পঁচাত্তর হাজার ধর্ষিতা নারী ও কন্যাশিশুর গর্ভপাত ঘটানো হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত এক লাখ বাষট্টি হাজার নারী-কন্যাশিশু অদৃশ্য হয়ে যান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে। ব্রিগ্রেডিয়ার আবদুর রহমান সিদ্দিকী তাঁর বই 'ইস্ট পাকিস্তান: দ্য অ্যান্ড গেম'এ লিখেছেন:

"জেনারেল নিয়াজি তার সৈনিকদের অসৈনিকসুলভ, অনৈতিক ও কামশক্তিমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, 'গতকাল রাতে তোমাদের অর্জন কী আমার বাঘেরা?' অর্জন বলতে তিনি ধর্ষণকেই বোঝাতেন।''

তাকে মিডিয়া প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ''আপনারা কীভাবে মনে করেন যে একজন সৈনিক যুদ্ধ করে মারা যাবে পূর্ব পাকিস্তানে আর যৌনক্ষুধা মেটাতে আসবে ঝিলমে (পশ্চিম পাকিস্তান)?''

না, তারা ঝিলমে যায়নি। বাংলাদেশের নারীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন ঘটানোর সময় তারা ভুলে গিয়েছিল যে তারা সাচ্চা মুসলমান! ঠিক এখন ধর্মের নামে আইএসআইএস যা করে যাচ্ছে ইরাকে ও সিরিয়ায় অসহায় নারীদের ওপর।

দুঃখ হয় তাই ভেবে যে, এদেশে একটি সড়কের নামও কোনো বীরাঙ্গনার নামে হয়নি। তাদের নামে স্মৃতিসৌধ তো অনেক দূরের ব্যাপার!

বীরাঙ্গনা মমতাজকে নিয়ে লিখেছিলাম এর আগের একটি লেখায়। তিনি গত তেতাল্লিশ বছর ধরে তাঁর ছেঁড়াফাড়া ধর্ষিত কোলন নিয়ে বেঁচে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। জেনে কষ্ট হল যে, মসজিদের ইমাম মসজিদের মাইকে তাঁর নাম ঘোষণা করতে দেননি। কারণ ইমামের ব্যাখ্যায়, বীরাঙ্গনা মমতাজ অসতী ছিলেন! তাঁর জানাজা পড়তে সমাজের মানুষজনের দ্বিধা ছিল। বেশিরভাগ মানুষই যাননি শেষবারের মতো তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে।

এর মাঝেও ছোট্ট একটু প্রাপ্তির বিষয়, সরকারের কাছ থেকে আমরা আমাদের দাবিগুলোর কিছু আদায় করে ফেলেছি। আর তাই বীরাঙ্গনা মমতাজ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে মারা গেছেন। মাননীয় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী নিজে টেলিফোন করে তাঁর পরিবারকে সান্তনা দিয়েছেন। আমাদের আসল লড়াইটা এখানেই। এদেশের কত শত মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গির্জা অসংখ্য রাজাকার-আলবদর দ্বারা বারবার কলঙ্কিত হয়। বীরাঙ্গনা মমতাজের জানাজা যখন রুখে দেওয়া হয় তখন রাজাকার গোলাম আযমের জানাজায় হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ!

এই আমরাই রাজাকার কাদের মোল্লা, নিজামি, কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় ঘোষণা হলে বাসে আগুন দিই, বোমা ফাটাই, ককটেল ছুঁড়ে মারি। যারা ত্রিশ লাখ বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে হত্যা করতে সাহায্য করেছিল, তারা আজ আমাদের ধর্মগুরু! যারা নিজ দেশের মা-বোনদের ছুঁড়ে দিয়েছে পাক হানাদারদের বিছানায়, যে রাজাকাররা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল, তারা গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সরকারি প্রহরায় সংসদে যায়। অথচ রাজাকারদের কৃতকর্মের দণ্ড ভোগ করছে বাংলাদেশের বীরাঙ্গনারা। এ কেমন জাতি আমরা!

এত লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেও এরা পার পেয়ে যায়। বীরাঙ্গনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে তাদের মুখে ঘটনার ভয়াবহতা শুনেছি। এমন একজন বীরাঙ্গনা পাইনি যাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিতে বাংলার রাজাকারদের ভূমিকা ছিল না। কুড়িগ্রামে কয়েক জন বীরাঙ্গনা বলেছেন, রাজাকারেরা মিলিটারির সঙ্গে গণধর্ষণে অংশ নিয়েছে। অনেক সময় এই রাজাকারেরা বাংলার নারীদের মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের স্বামীদের বেঁধে রেখে পিটিয়েছে কিংবা তাদের কোলের সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, মেরে ফেলেছে।

বীরাঙ্গনা হাজেরা তাঁর পরিবারসহ লুকিয়েছিলেন শন ক্ষেতে। চোখের সামনে দেখেছেন মিলিটারিরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে রাজাকারদের সহায়তায়। তাঁকে গণধর্ষণ করেই থেমে থাকেনি তারা, তাঁর তিন মাসের শিশু সন্তানটিকেও আছড়ে ফেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছে। অবুঝ শিশুর যন্ত্রণাময় চিৎকার শুনে হো হো করে হেসেছে ওরা। সেই অবস্থাতেই শিশুটির কচি শরীর হয়েছে পিঁপড়ার খাবার। আহত শিশুটির নাক চোখ আর শরীরের নানান অংশ কুটকুট করে খেয়ে গর্ত করে ফেলেছিল পিঁপড়ার দল। সেদিন সেই শিশু, তার বাবা আর বীরাঙ্গনার রক্তে স্যাতস্যাতে হয়ে যাওয়া বাংলার মাটিও হয়তো শপথ নিয়েছিল এই অন্যায়ের শোধ নেবার।

বেয়নেটের আঘাত আর পিঁপড়ার খেয়ে নেওয়া ঘা হয়ে যাওয়া অসহ্য যন্ত্রণাকাতর শরীর নিয়ে শিশুটির মৃত্যু আমাদের কতটা ভাবায় আমি জানি না। তবে এই আমরাই ফিলিস্তিনের শিশুহত্যার বিচার চাই। আমি নিশ্চিত যে, যদি ইসরাইলের কোনো সৈন্য হাজেরার শিশুটির মতো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ফিলিস্তিনের কোনো শিশুকে মেরে ফেলত কিংবা সন্তানদের সামনে তাদের মাকে ধর্ষণ করত এবং তাদের বাবাকে গুলি করে মেরে দিত, তাহলে বাংলাদেশ থেকেই কত কত জিহাদি তলোয়ার উঁচিয়ে সেই শিশুহত্যার বিচার চাইতে ছুটত ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্য। কিন্তু দুঃখ যে, নিজের দেশের শিশুটির জন্য তাদের বুকের ভেতর তৈরি হয় না জমজমের রহমতের পানির ফোয়ারা। নিজের দেশের মেয়েটির ওপর অকথ্য অত্যাচারের বিচার চেয়ে তাদের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয় না।

বীরাঙ্গনা আসিয়াকে দুজন রাজাকার এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পে। দীর্ঘ দিন ক্যাম্পে অত্যাচারিত হয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছেন তিনি। এরপর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি বাড়ি ফেরেন। ভেবেছিলেন, তাঁর দুর্ভোগ বুঝি শেষ হল। কত বড় ভুল ধারণা ছিল! মিলিটারিরা এবার তাঁর বাড়িতে হানা দিতে লাগল। রোজ একদল তাঁর শরীর ছিঁড়ে খুবলে খেত। এমনি এক ঠা ঠা দুপুরে তারা আবার এল। এবার তাঁর স্বামীকে বেঁধে স্বামীর সামনে তাঁকে ধর্ষণ করল। মিলিটারি আর রাজাকাররা চলে যাবার পর তাঁর স্বামী কিছুক্ষণ বসে ছিলেন স্তব্ধ হয়ে। তারপর এক সময় বের হয়ে গেলেন। সেই যে গেলেন আর কখনও ফিরেননি।

এই বীরাঙ্গনার শারীরিক অবস্থার কথা জেনেও বুকে চিন চিন ব্যথা তৈরি হল। দিনের পর দিন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পরিণতিতে দীর্ঘ পঁচিশ বছর তাঁর যোনিপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ হত। অথচ তিনি না পেয়েছেন মানবিক সহায়তা, না পেয়েছেন সমাজের একটুখানি ভালোবাসা। এমনকি নিদেনপক্ষে সামান্য করুণাও নয়!

বীরাঙ্গনাদের মতো তাদের সন্তানরাও অসহায়। জুন মাসে বাংলাদেশে গিয়ে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ, আমেনা বেগম, আলাউদ্দিন খোকন, আবদুল হাইএর সাহায্যে ফোনে ও স্কাইপিতে তাঁদের সঙ্গে আমার কথা হত। বীরাঙ্গনাদের মুখে শুনতে পেতাম তাঁদের সন্তানরা তাঁদের দেখাশুনা করে না। ভাবতাম কী করে কোনো সন্তান মাকে অবহেলা করতে পারে।

আমার চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে কিছু বীরাঙ্গনার বাড়িতে যাবার পর। তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিজে দেখেছি আমাদের দেওয়া টাকা কীভাবে অসুস্থ মায়ের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে গেছে তাঁর নিজের সন্তান। অনেক কষ্ট করে দুদিন ছোটাছুটি করে একজন বীরাঙ্গনাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম, নিজে তাঁর চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডে ফিরে শুনি, মাত্র দুদিন পর তাঁর পরিবার তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কারণ মায়ের চিকিৎসায় তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। খবরটা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম।।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে তাঁদের সন্তান বা পরিবার বুঝি খুব নিষ্ঠুর। তা কিন্তু নয়। আমাদের বুঝতে হবে মায়ের পাশাপাশি এই সন্তানরাও কী এক অত্যাচারিত ভয়াবহ জীবন যাপন করেছে এবং করছে। এদের অনেকেই তাই মানসিক রোগী। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অসুস্থতা ব্যাঙ্গাচির মতো কিলবিল করছে তাদের জীবনে। তাদেরকে এই পরিস্থিতি থেকে আমাদেরই মুক্ত করতে হবে। তাই বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের ব্যাপারেও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

সরকারের কাছে আমাদের যে দাবিগুলো ছিল তার মধ্যে অন্যতম হল পাঠ্যপুস্তকে বীরাঙ্গনাদের কথা এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীনির্যাতন ও এর প্রচণ্ডতা নিয়ে বিস্তারিত লেখা থাকতে হবে। আমরা বলছি না যে, প্রাথমিক স্কুলে তা প্রয়োগ করতে হবে। তবে হাই স্কুলে এই বিষয়টি গুরুত্বসহ অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি। তা না হলে বীরাঙ্গনারা 'ছায়ামানবী' হয়েই রয়ে যাবেন।

সরকার শিগগির বীরাঙ্গনাদের নামের তালিকা সংগ্রহ শুরু করবে। গ্রামে গ্রামে এই কাজের জন্য কিছু লোকও নিয়োগ করা হবে। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলে যা জনতে পেরেছি তা এখানে একটু না বললেই নয়।

একটি এলাকার বীরাঙ্গনারা জানালেন যে, তাঁরা মোট পঁয়তাল্লিশ জন এলাকায় 'বীরাঙ্গনা' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এখন তাঁদের মধ্যে বেঁচে আছেন চব্বিশ জন। তাঁদের নামের তালিকা এলাকার নেতাদের কাছে থাকলেও কখনও জমা দেওয়া হয়নি, বরং মৃত বীরাঙ্গনাদের নামের জায়গায় বসানো হচ্ছে নেতাদের আত্নীয়-স্বজনদের নাম! নৈতিকতা, মূল্যবোধ বলে যে কিছু বিষয় রয়েছে তা আমাদের চরিত্র থেকে একেবারেই বিদায় নিয়েছে কি?

তবু বীরমাতাদের মুক্তির জন্য আমাদেরকেই লড়তে হবে, এগিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বীরাঙ্গনাদের বুকে টেনে নিলেও তাঁকে সপরিবারে হত্যার পর বীরাঙ্গনাদের উচ্ছেদ শুরু হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো। তাঁদের বিরুদ্ধে সমাজে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঘৃণার বীজ। বড় অবহেলা আর অসম্মানের এ জীবন তাঁদের। যে দেশে সাড়ে চার লাখ নারীকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছে সে দেশের মানুষের উচিত ছিল ধর্ষিতাদের ঘৃণা না করে, ধর্ষণকাণ্ডটি ঘৃণা করা। সেই মূল্যবোধ আমাদের প্রজন্মের ভেতর আমরা তৈরি করতে পারিনি, এটাও আমাদের ব্যর্থতা।

জাতিগত ঘৃণা আর রাজনৈতিক অরাজকতা ছড়ানোর জন্যে ধর্ষণ এখনও বাংলাদেশে অপ্রতিরোধ্য অস্ত্র। তাই আমার আবেদন থাকবে, বীরাঙ্গনাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আসুন ধর্ষণকে 'না' বলি। ২০১৫ সালের নারী দিবস আমরা আমাদের বীরাঙ্গনাদের জন্য উৎসর্গ করি। আর এগিয়ে যাই বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে।