যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ২৩ ‘‘রাজাকারের সর্বনিম্ন শাস্তি ফাঁসি’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 26 Nov 2014, 06:05 PM
Updated : 26 Nov 2014, 06:05 PM

''ফুলবানুর বয়স তহন তিন। ম্যালেরিয়া ধরা পড়ে তার। এ রোগের তহন চিকিৎসা ছিল না। তাই দিন কয়ের মধ্যেই সে মারা যায়। তার জন্য আমরা কিসু করতে পারলাম না। বুকের ভিতরটা ফাঁকা হইয়া গেল। দুই ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন ছিল ফুলবানু। তারে আমি মায়া করতাম। কোলে কইরা বাজারে নিয়া যাইতাম। কিইন্না দিতাম রঙবেরঙের খেলনা। সব কিছুই একদিন থাইমা গেল।''

যুদ্ধদিনের গল্প শুনতে গিয়েছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ বশির উদ্দিনের কাছে। বয়স তাঁর সত্তরের মতো। গ্রামের বাড়ি সিলেটের গোয়াইন ঘাট উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। বাবার নাম ইলিম মিয়া ও মা নূরজাহান বেগম। ম্যালেরিয়ায় ছোট বোনের মৃত্যুর ঘটনাটি আলোড়িত করে তাঁকে। তার বর্ণনা দিয়েই শুরু আমাদের আলাপচারিতা।

শারীরিক অসুস্থতার জন্য কথা বলছিলেন থেমে থেমে। তাঁর গতিতেই আমার এগিয়ে যাই মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে। প্রশ্নের পিঠে আমাদের প্রশ্ন চলে।

লেখাপড়া তেমন করেননি। স্কুল-কলেজই তো ছিল না। বাপ-দাদার ছিল বিশাল জায়গা-জমি। সে আমলেই তাঁদের মহিষের হাল ছিল বিশটা। এক একটি মহিষ দুধ দিত এক বালতি করে। দুধ খাওয়ার লোক ছিল না। বাড়িতে দুধ জ্বাল দেওয়ার বড় একটা কড়াই এখনও আছে। দুধটায় মালাই উঠে যখন লাল হত, তখন ওরা খেতেন।

আগে ঘোড়া দিয়েই পথ চলতে হত। একটা সাদা ঘোড়া ছিল বশির উদ্দিনের। গ্রামে গ্রামে তখন ঘোড়দৌড় চলত। সাদা ঘোড়াটা নিয়ে তাতে উনি অংশ নিতেন। একবার ঘোড়দৌড়ে জিতে পান পঞ্চাশ টাকা। সেদিন খুব ভালো লেগেছিল তাঁর। বন্ধু শুক্কুর আলী, রমিজ উদ্দিন, কালা মিয়ার কথা ভুলতে পারবেন না। ওঁরা তখন হাডুডু আর বল খেলতেন। মাঝে মধ্যেই মাছ ধরতে যেতেন উনাই বিলে। বড় বড় কই ছিল ওই বিলে। ওই মাছ তো এখন চোখেই দেখা যায় না। বিলটাও ভরাট হয়ে গ্রাম হয়ে গেছে।

১৯৬৫ সাল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। বশির উদ্দিনের ইচ্ছে জাগল যুদ্ধে যাবার। তাই গোয়াইনঘাট থেকে চলে গেলেন সিলেটে, আখালুকি মুজাহিদ ক্যাম্পে। মুজাহিদ ট্রেনিং নেন এক মাস। ট্রেনিং শেষে ওদের নামিয়ে দেওয়া হয় তামাবিল বর্ডারে। ভারতের জৈন্তাপুরে ঢুকে সপ্তাহ খানেক যুদ্ধ করেন। এরপরই যুদ্ধ শেষ। সবাইকে ক্লোজ করে আনা হয় মুজাহিদ ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পেই ওরা থাকেন পাঞ্জাবিদের সঙ্গে।

তখনকার অভিজ্ঞতা শুনি বশির উদ্দিনের জবানিতে:

''পাঞ্জাবিরা আমাদের দেখতে পারত না। কথায় কথায় বলত, 'বেগারত আদমি', 'মাদারচোদ'। এই গালিটা সহ্য করতে পারতাম না। প্রতিবাদ করতে না পারলেও মন থেকে তাদের ঘৃণা করতাম। একবার ক্যাম্পে আসে এক পাঞ্জাবি অফিসার। সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হল। আমাকে ভালোভাবে দেখে বুকে একটা সিল মেরে দিল। কেন, আমি তার কিছুই জানি না। মুজিবর রহমান নামে ক্যাম্পে এক বাঙালি সুবেদার ছিলেন। গোপনে তিনি এসে বললেন, 'তোমার কাগজপত্র রেডি, তোমাকে পাঠাবে পাঞ্জাব রেজিমেন্টে।' শুনেই গা শিউরে উঠে। মরে যাব, তবুও পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যাব না! তহন পালানোর বুদ্ধি আঁটলাম।

মুজাহিদ ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিলেন এক মেজর। নাম পেন্দা খান। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমি সে সুযোগটিই নিলাম। একদিন বিকালে তিনি তার বাসার বারান্দায় বসা। আমাকে দেখেই বললেন, 'ক্যায়া বশির সাব, ক্যায়সা হালচাল?' বললাম, 'স্যার, ছয় ঘণ্টার আউট পাশ দরকার।' শুনেই বললেন, 'ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, কোই বাত নেহি।' তহন আমার পরনে ছিল শার্ট-প্যান্ট। এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়লাম।

আমাকে খুঁজতে থানা থেকে প্রায়ই পুলিশ আসত বাড়িতে। গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন আমার চাচা। তাঁর পরামর্শে আমি আত্মগোপন করি। কিছুদিন থাকি পশ্চিম জাফলংয়ে, বন্ধু আতাউর রহমানের বাড়িতে। পরে হাদারপাড়ের নদী পার হয়ে চলে যাই ভারতীয় সীমান্তের এক গ্রামে।

মাস দুয়েক পরেই সত্তরের নির্বাচন। দেশ তখন উত্তপ্ত। সে সময় ফিরে আসি ভোট দিতে। আমাদের ওখানে বিপুল ভোটে পাশ করেন আওয়ামী লীগের তোতা উকিল। এই তোতা উকিলই সিলেটে আইয়ুব খানের মিটিংয়ে একবার স্টেজে জুতা ছুঁড়ে মেরেছিলেন।''

সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভের পরও তো পাকিস্তানিরা ক্ষমতা দিল না, তখন আপনারা কী করলেন?

মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিনের উত্তর:

''অসহযোগ শুরু হইল। আমাদের সঙ্গে তীর-ধনুক নিয়া চা বাগানের আদিবাসীরাও অংশ নিল। বর্ডারে পাঞ্জাবিদের একবার গ্রামের লোকেরা ধরে মারল। তহন গোয়াইনঘাটের রাধানগর বাজারে আমরা জড়ো হইতাম।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনি রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু কইল, 'তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।' কথাডা মনে লাগছিল। তহন লাঠি দিয়া এলাকার ৩০-৪০ পোলারে ট্রেনিং করাই। ট্রেনিং হয় গোয়াইনঘাট বাজার এলাকার স্কুলে। গ্রামের সিরাজ মিয়া ছিল সংগ্রাম কমিটিতে। তার উদ্যোগে মুরুব্বিরা আমগো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।''

সিলেটে যখন আর্মি নামল, তখন আপনারা কী করলেন?

বশির উদ্দিন জানালেন, ২৫ মার্চের পরেই সিলেটে আর্মি নামে। সে সময় সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এসে জড়ো হতে থাকেন গোয়াইনঘাটে। সেখানে ওঁরা একটা দল গঠন করেন। গোয়াইনঘাট থানা থেকে কিছু অস্ত্র পান। আরও কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে আনেন ইপিআরের সুবেদার মুজিবর রহমান। এই নিয়েই ওঁরা সিলেটের দিকে অ্যাডভান্স হন। পজিশন নেন সিলেট জেলখানার পূর্বদিকে গিয়ে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তিনদিন চলে গোলাগুলি। পাকসেনাদের তোপের মুখে ওঁরা টিকতে পারেন না। তাই গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে পিছু হটে চলে যান তামাবিল বর্ডারে। পাঞ্জাবি সেনারা তখন তাদের পেছন পেছন এসে বর্ডার দখল করে নেয়।

বশির উদ্দিনরা চলে যান তামাবিলের ওপারে ভারতের ডাউকি বাজারে। সেখান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ওদের পাঠানো হয় মেঘালয়ে, ইকো ওয়ান ক্যাম্পে। সেখানে ট্রেনিং চলে বাইশ দিন। বশির উদ্দিনের এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল- ২২৮৫৫। ওদের শেখানো হয় এলএমজি, এসএলআর, মর্টার, ব্রিজ উড়ানোর কৌশল। ট্রেনিং করায় ভারতের শিখ রেজিমেন্ট। এপ্রিলের শেষে শপথ হয়। শপথ করতে হত কোরআন শরীফ ছুঁয়ে। পরে ওদের অস্ত্র দেওয়া হল শিলং ক্যান্টনমেন্ট থেকে। সব অস্ত্রই ছিল রাশিয়ান। বশির উদ্দিন চালাতেন এলএমজি।

কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?

খানিকটা নিরব থেকে মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিনের উত্তর:

''আমি চলে এলাম ৫ নং সেক্টরে। ওই সেক্টরের ডালডা কোম্পানির ৩০ জনের একটি প্লাটুনের কমান্ডার ছিলাম। কোম্পানি কামান্ডার ছিলেন আবদুল হান্নান। আমাদের প্রথম যুদ্ধ আরম্ভ হয় তেলিখাল থেকে। সেখান থেকে ক্যাপচার করে করে আমরা সামনে আগাই। পরে উমাইরগাঁও অপারেশনে আমরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। ওসমানী সাহেব তখন নির্দেশ দিলেন, 'আমি শুধু সিলেটের মাটি চাই'। ফলে আমরা আবারও উমাইরগাঁওয়ে অপারেশন করি। ওই অপারেশনেই আমি আহত হই।'"

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত সে দিনটিতে?

প্রশ্ন শুনেই বশির উদ্দিন আনমনা হয়ে যান। সেদিনকার স্মৃতি তাঁর মন সিক্ত করে। ভিজে যায় চোখ দুটো। অতঃপর তিনি বলতে থাকেন:

''পাকিস্তানি সেনাদের হেভি ডিফেন্স ছিল উমাইরগাঁওয়ে। ২১ নভেম্বর, ১৯৭১। গৌরনদী থেকে রাতেই অ্যাডভান্স হয়ে আমরা পজিশন নিই উমারইগাঁওয়ের উত্তর দিকে। পেছনে ইন্ডিয়ান ঘুরকা গ্রুপ। তাদের পেছনে ছিল ইপিআর, পুলিশ, আর্মিসহ আমাদের আরেকটি দল।

২২ নভেম্বরের সকাল, ফজরের আযান হচ্ছে। আমরা কাছাকাছি পৌঁছে সিগনাল পাঠাই পেছনের দলগুলোকে। তারা তখন ওয়ারলেস করে ভারতে। পরিকল্পনা মোতাবেক ভারতের তালাব বাজার থেকে মর্টার ছোঁড়া হয়। এর পরপরই আমরা ফায়ার ওপেন করি। সারাদিন চলে গোলাগুলি। পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে যাচ্ছিল।

বিকেল তখন ৪টা। হঠাৎ খেয়াল করলাম ওদের গুলি বন্ধ। খানিক অপেক্ষার পরই বুঝে গেলাম ওরা পালিয়েছে। আমরা তখন 'জয় বাংলা' বলে ওদের ডিফেন্সে ঢুকে বাঙ্কারগুলো চেক করতে থাকি। কোথাও মরা পাই, কোথাও গুঙ্গাচ্ছে। তবে বেশিরভাগই ছিল খালি। আমার পাশেই এলএমজির টোআইসি রমিজ উদ্দিন। দুজন মিলে বাম সাইডের শেষ বাঙ্কারটি চেক করছিলাম। ওরা তখন বাম পাশ থেকে কাউন্টার অ্যাটাক চালায়।

আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম রমিজ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। একটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে তার মাথায়। শরীরটা কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে তার দেহখানা নিথর হয়ে গেল। আমি তাকে ধরতে যাব, অমনি আরেকটি গুলি এসে লাগে আমার বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরে। আমি ছিটকে পড়ি। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি পিনপিনিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। আমাদের পেছনের গ্রুপটি পাল্টা অ্যাটাক করলে ওরা তখন পালিয়ে যায়। সে অপারেশনে শহীদ হয় রমিজ। আহত হই আমি, খাইরুল, নিজামসহ চারজন।''

চিকিৎসা নিলেন কোথায়?

''সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে পাঠিয়ে দেয় শিলং হাসপাতালে। ওখানেই গুলিটি বের করা হয়। সেখান থেকে প্রথমে গৌহাটি এবং পরে চিকিৎসা হয় লখনৌ হাসপাতালে। ওখানেই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দেখতে আসেন আমাদের। হাসিমুখে বললেন, 'আপকা দেশ আজাদ হো গ্যায়া'। দেশের খবর শুনতে তিনি আমাদের একটি করে রেডিও দিয়েছিলেন। লখনৌ থেকে আমাকে পাঠানো হয় ব্যারাকপুর সামরিক হাসপাতালে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস তখন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেখানেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কোরবান আলী। কিছু টাকার সঙ্গে সেদিন দিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের হাতে লেখা একটি পত্র। সে পত্রটি দেখলে আজও সবকিছু জীবন্ত হয়ে উঠে।''

তখন কি হাঁটতে পারতেন?

বশির উদ্দিনের উত্তর:

'না। তখনও পা প্লাস্টার করা ছিল। বাহাত্তরের শেষে চিকিৎসার জন্য আমাকে সরকারিভাবে পাঠানো হল মার্শাল টিটোর দেশে, যুগোশ্লাভিয়ায়। সেখানে ছয় মাস চিকিৎসার পর হাঁটতে পারলেও পা আর ভাঁজ করতে পারি না।''

হাসপাতালে ভারতীয়দের সেবা প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

''তাদের মনোভাব খারাপ হলে কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধাই দেশে ফিরতে পারত না। তারা আমাদের আপনজনের মতোই কাছে থেকে সেবা করেছে। উৎসাহিত করেছে। আমাদেরকে বীরের সম্মান দিয়েছে।''

[আহত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিন:

যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?

''স্বাধীন রাষ্ট্র পাইছি, কিন্তু স্বাধীনতা পাই নাই। চাইছিলাম তো স্বাধীনমতো চলব। পাঞ্জাবি চলে গেছে, 'মাদারচোদ' গালি আর শুনব না। সেটা পাইলাম কই? বঙ্গবন্ধুকেও বাঁচতে দিল না। কখনও তো কল্পনাও করি নাই রাজাকাররা স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াইব। তাও ঘটল। কী বলব! মা-বোনদের ইজ্জত নিল, মানুষ মারল আবার তারাই স্বাধীন দেশে মন্ত্রী হইল। এই দুঃখ কারে বলব?''

দেরিতে হলেও রাজাকারদের তো বিচার হচ্ছে…

''এটা ভাবলে ভালো লাগে। বাংলার মাটিতেই ওদের বিচার হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দাবি তো 'ফাঁসি'। ১৯৭১ সালে ওরা যা করছে তা হিসেব করলে রাজাকারের সর্বনিস্ন শাস্তি হয় 'ফাঁসি'। এত অপকর্ম ও অপরাধের পরও রাজাকারদের গুরু গোলাম আযমের নব্বই বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। এখনও তার পক্ষে কথা কয় পাকিস্তান! অথচ তার মৃত্যুর পর বায়তুল মোকাররমে জানাজা করতে দেওয়া হল। এটা তো আমাদের জন্য কষ্টের। গোলাম আযমের মতো রাজাকারের মাটি এদেশে হওয়া উচিত ছিল না। যে বাংলাদেশ সে চায় নাই, সেই বাংলাদেশই তাকে করুণা করেছে।

রাজাকারদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। জিয়া যদি তাদের রাজনীতিতে না আনতেন তাইলে তো মুজাহিদ ও নিজামীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ত না। পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিল শাহ আজিজ। ক্ষমতায় বসে জিয়া তাকেই বানাইলেন প্রধানমন্ত্রী!''

কেন এমনটা ঘটল…

বশির উদ্দিন বলেন:

''আসলে স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নীতি ধরে রাখতে পারেনি। অনেক বড় বড় মুক্তিযোদ্ধার নাম আপনারা জানেন, যারা রাজাকারদের সঙ্গে বইসা রাজনীতি করছে। যে দলেরই হোক, মুক্তিযোদ্ধারা যদি রাজাকারদের সাথে রাজনীতি না করত, তাইলে ওদের বিচার আরও আগেই হইত।''

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়::

'পাকিস্তানিরা তো তাঁর কিছু করতে পারেনি। যে বাঙালিদের জন্য, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি সারাজীবন জেল খাটলেন, সেই বাঙালিরাই তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এটা ছিল গোটা বাঙালি জাতির জন্যই কলঙ্কজনক। আমি মনে করি পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্টে বঙ্গবন্ধু নয়, হত্যা করা হয়েছে বাঙালির চেতনা।''

কথা উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিন বলেন:

''কোন সরকারের সময় তালিকা বিতর্কিত হয়েছে সেটা আপনাকে দেখতে হইব। তখন দেখেছি মন্ত্রীর সুপারিশের স্লিপ নিয়া মুক্তিযোদ্ধা হইছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা না হওয়ার জন্য পুরাপুরি দায়ী সেক্টর কমান্ডাররা। একজন সেক্টর কমান্ডার, তার অধীনে কতজন মুক্তিযুদ্ধ করছে সেই তালিকা কই? সেটা থাকলেই তো নতুন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারত না। আবার এই সেক্টর কমান্ডারাই বহু লোককে প্রত্যয়ন দিয়েছে যে, সে আমার সাথে যুদ্ধ করেছে। এখন আপনি এটা যাচাই করবেন কোন তালিকা দেখে?''

কী করলে দেশটা আরও এগিয়ে যাবে?

মুচকি হেসে বশির উদ্দিন বলেন:

''রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম থাকতে হইব। প্রধানমন্ত্রী কইছে না, 'আমি ছাড়া সবাইরে কেনা যায়', এইডা তো হাছা কথা। এরা তো দেশ নিয়া গাবরায় না, এরা গাবরাই এগো পেট নিয়া। পাকিস্তান পিরিয়ডে যারা ভিক্ষুক ছিল তারা এহন কোটি কোটি টাকার মালিক হইছে। কেমনে হয়?''

স্বাধীন দেশে ভালোলাগা আর খারাপ লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা…

''আগে মানিঅর্ডার করলে কতদিন পর পৌঁছাইত! এখন তো কথা শেষ হওয়ার আগেই টাকা পৌঁছায়া যায়। বিদেশে থাকে এমন আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলি ছবি দেখে। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সুবিধাগুলো দেখলে খুব ভালা লাগে।

আর খারাপ লাগা? একজন সরকারে বসলে অন্যরা কীভাবে তারে নামাবে এই তালে থাকে। সব জায়গায় চলছে হিংসার রাজনীতি। এইসব তো বাবা, ভালা না।''

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন দেশে কোনো চাওয়া আছেন কিনা, জানতে চাই আমরা। উত্তরে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

''সত্যিই, কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই। দেশটা আগাইয়া যাক এইটাই চাই মনেপ্রাণে।''

মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিনের বিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্ম দেশের জন্য বড় কিছু করবে।

[নতুন প্রজন্মের প্রতি মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিনের অনুরোধ

''এই যে আপনি যুদ্ধাহতদের সাক্ষাতকার নিচ্ছেন। আপনি যখন এটা ছাড়বেন, তখন তো আমার নাতিদের মতো ছেলেমেয়েরা মুক্তিযোদ্ধার এই ইতিহাস পড়বে, জানবে, বুঝবে। দেশের ইতিহাসে এটা থাকবে। এভাবে আমরা যেটা পারি নাই তারা ওইটা করে দেখাবে।''

তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

''তোমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ইতিহাস স্মরণে রেখ। একে অপরকে হিংসা কর না। তাহলেই দেখবে তোমাদের হাতেই এ দেশটা একদিন সোনার বাংলা হয়ে উঠবে।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ বশির উদ্দিন।

ট্রেনিং নেন: বাইশ দিনের ট্রেনিং নেন ভারতের মেঘালয়ে, ইকো ওয়ান ক্যাম্পে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল- ২২৮৫৫।

যুদ্ধ করেছেন যেখানে: ৫ নং সেক্টরের ডালডা কোম্পানির ৩০ জনের একটি প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধ করেন সিলেটের তেলিখাল, গৌরীনগর ও উমাইরগাঁওয়ে।

যুদ্ধাহত হলেন যেভাবে: ২২ নভেম্বর, ১৯৭১। বিকেল ৪টা। উমাইরগাঁও অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি এসে লাগে তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরে। চিকিৎসার পর হাঁটতে পারলেও পা ভাঁজ করতে পারেন না।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।