হাউএভার, থ্যাংক ইউ মাহফুজ আনাম

মোজাম্মেল বাবু
Published : 3 Nov 2014, 10:31 AM
Updated : 3 Nov 2014, 10:31 AM

দৈনিক 'ডেইলি স্টার' পত্রিকায় 'দ্য মিনিং অব নিজামীস ভারডিক্ট' শিরোনামে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক কমেন্ট্রিতে নিজামীর মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করায় শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম লিখেছেন:

''হাউএভার, … থ্যাংক ইউ শেখ হাসিনা।''

সে সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন:

''হোয়াইল উই ডু নট অ্যাগ্রি উইদ মেনি অব হার ক্লেইমস, ইয়েট হোয়েন সী সেইস দ্যাট ওয়ার ক্রাইমস ট্রায়াল কুডন্ট হ্যাভ বিন হেল্ড উইদাউট হার উই আনহেসিটেন্টলি অ্যাগ্রি, সিম্পলি বিকজ সী ইজ রাইট।''

মাহফুজ আনামের দেওয়া 'থ্যাংকস' এখানেই আর 'সৎ' থাকতে পারল না। এত বিশাল ঘটনায় শেখ হাসিনাকে খণ্ডিতভাবে সাধুবাদ জানিয়ে বস্তুত তিনি নিজেকেই মহিমাম্বিত করতে চেয়েছেন। শুধু তিনি যখন 'রাইট' মনে করবেন, কেবলমাত্র তখনই শেখ হাসিনা সঠিক, এ ধরনের মানসিকতাকে 'ম্যাগালোম্যানিয়া' ছাড়া আর কী বলা যায়? এক কথায় উড়িয়ে না দিয়ে শেখ হাসিনার কোন কোন 'ক্লেইম' সম্পাদক সাহেবের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তার একটা তালিকা প্রদানও এখানে বাঞ্ছনীয় ছিল, তাতে মাহফুজ আনামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা নমুনা পাওয়া যেত।

শেখ হাসিনার দেশ ও দল পরিচালনা নিয়ে নিশ্চয়ই অসংখ্য খুঁটিনাটি প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় তাঁকে ভাগ ভাগ করে 'পুরস্কার' কিংবা 'তিরস্কার' দেওয়ার কোনো উপায় আজ নেই। তাঁকে অভিনন্দিত করতে হলে সব হারিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে দল পুনর্গঠন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম, বিরাজনীতিকরণের মহাপরিকল্পনা পরাজিত করে ২০০৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিতকরণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বৈতরণী পার হওয়া, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সারা বিশ্বের সমর্থন অর্জন এবং শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের অসমাপ্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া– এ পুরো পথপরিক্রমাকেই এক সঙ্গে 'স্যালিউট' দিতে হবে।

কেননা '১৯৮১ থেকে ২০১৪'– এ পুরো সময়টা নিয়েই তিনি ধাপে ধাপে নিজেকে একজন 'স্টেটসম্যান' হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এ দীর্ঘ আন্দোলনে, একটা ধাপ ছেড়ে লাফ দিয়ে আরেকটা ধাপে চলে যাওয়ার কোনো সুযোগ কখনও ছিল না।

কিন্ত মাহফুজ আনাম যখন বলেন, ''ইয়েস, ইট ইজ ট্রু দ্যাট ডিউরিং দ্য ক্যাম্পেইন ফর কেয়ারটেকার গভারমেন্ট ইন মিড নাইনটিজ আওয়ামী লীগ ডিড টেক জামায়াত অ্যাজ অ্যান অ্যালাই'– তখন তার যুক্তির পক্ষপাতিত্বই ফুটে ওঠে। তাহলে তো অনেকেই বলবেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নস্যাতের ষড়যন্ত্রে মাহফুজ আনাম নিজেই জামায়াতের 'অ্যালাই' ছিলেন; কেননা তারা উভয়ে অভিন্ন লক্ষ্যেই কাজ করেছেন।

নির্বাচনের ঠিক আগে আগে 'ডেইলি স্টার' ও 'প্রথম আলো'তে একযোগে প্রকাশিত মাহফুজ আনামের চরম আকুতিতে ভরা কমেন্ট্রি ''প্লিজ, এ নির্বাচন করবেন না'' এবং লাগাতারভাবে টেলিভিশনান্তরে চালানো তার নির্বাচনবিরোধী ক্যাম্পেইন ও ২৯ ডিসেম্বরের গোলটেবিল আয়োজনের তো একটাই উদ্দেশ্য ছিল।

মাহফুজ আনামের দিক থেকে অনেক বেশি সততার কাজ হত যদি তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ না দিয়ে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে নেওয়া তার নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে আগে দুঃখ প্রকাশ করতেন। শুধু তাই নয়, ২০০৭ সালের 'মাইনাস টু ফর্মুলা' বাস্তবায়নে তার কী ভূমিকা ছিল সেটার কৈফিয়ৎও দেশবাসীকে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এবং সেনা-সমর্থনে ড. ইউনূসের 'নাগরিক শক্তি' নামে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি কতটুকু জড়িত ছিলেন? সে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দায়িত্ব নেওয়ার তথ্য কতখানি সঠিক?

মাহফুজ আনাম রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। শেখ হাসিনার বেশিরভাগ 'ক্লেইম' তার কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়া ও ২০০৭ সালে 'কিংস পার্টি' গঠনের পেছনে মুজিবতনয়ার বিরুদ্ধে তার কোনো পুরনো স্কোর সেটেলমেন্টের বিষয় আছে কিনা, সেটাও আজ পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।

বস্তুত ২০০৭ সালের 'মাইনাস টু কন্সপিরেসি' নস্যাৎ করা না গেলে এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষিত না হলে, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো দূরে থাক, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হত। 'হাউএভার'– সীমাবদ্ধ বিবেচনা থেকে শেখ হাসিনাকে অন্তত একটি খণ্ডিত 'থ্যাংকস' দেওয়ার জন্য মাহফুজ আনামকেও এক চিলতে 'ধন্যবাদ'।

মোজাম্মেল বাবু: সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।