নগর স্বাস্থ্যসেবার সাফল্য টেকসই হবে যেভাবে

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 2 Nov 2014, 05:17 AM
Updated : 2 Nov 2014, 05:17 AM

নগর স্বাস্থ্যসেবাদানে প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে, এমন গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে একটি সার্ভে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি ঢাকায়। ২০১৩ সালের মধ্যে শহর এলাকায় নারীপ্রতি গড় সন্তান সংখ্যা ২ (দুই) এ হ্রাস করার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে এ জরিপে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের সাফল্য পুনরায় প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলাদেশে নগরমুখী অভিবাসন এবং স্বাস্থ্যসেবার ফলাফল ও সক্ষমতা নিয়ে এ জরিপ পরিচালিত হয়েছে। 'বাংলাদেশ নগর স্বাস্থ্য সার্ভে, ২০১৩' নামক জরিপটি পরিচালনার সার্বিক সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করেছে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। আর্থিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে যুক্তরাজ্যের 'ডিএফআইডি' এবং যুক্তরাষ্ট্রের 'ইউএসএইড'। বাংলাদেশের 'আইসিডিডিআর' এবং 'মেজার ইভুলেশান' নামক আমেরিকান জরিপ সংস্থা সমীক্ষাটি বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে কৌশলগত সহযোগিতা ও মূল্যায়ন করে এক অনবদ্য তথ্যসমৃদ্ধ জরিপ দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে। অবশ্য তথ্যসংগ্রহে 'এসিপিআর' নামক একটি সংগঠন দক্ষতার সাক্ষর রেখেছে এবং 'ইমিনেন্স' নামক বেসরকারি সংগঠন চমৎকার ফটোগ্রাফি সংগ্রহ করে সমগ্র সমীক্ষাটি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০০৬ সালেও নিপোর্টের উদ্যোগে অপর একটি নগর স্বাস্থ্য সার্ভে সম্পাদন করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় যে, বিগত ৭ বছরে নগরকেন্দ্রিক অভিবাসন, আবাসনের পরিধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও ব্যাপ্তির বহুমুখী বিস্তার, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ও জনগণের সচেতনতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন নান্দনিক, অপরদিকে শহরমুখী অভিবাসনের ব্যাপকতা বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যৎ ভাবনার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে।

এ সমীক্ষা থেকে উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে, ২০২৮ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাত কোটি ৯৫ লাখ শহরে বসবাস করবে যা বর্তমানে হচ্ছে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ। জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বৃহত্তর ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা বর্তমানে হচ্ছে এক কোটি ৭০ লাখ এবং এ সংখ্যা ২০৩০ সালে হবে দুই কোটি ৭০ লাখ। ঢাকা হবে বিশ্বের ষষ্ঠ ঘনবসতিপূর্ণ শহর। জনগণের অভিবাসন বা শহরমুখী জনসংখ্যার অবিরাম বৃদ্ধি স্বাস্থ্যসেবার মান ও পরিধি ধরে রাখতে পারবে কিনা অথবা এর প্রসার কতটুকু ঘটাতে হবে এ হচ্ছে বর্তমানের ভাবনা।

সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ৭৫ শতাংশ বস্তিবাসী মাত্র একটি ঘরে একটি কক্ষে বসবাস করেন যেখানে একটি কক্ষে বসবাস করেন মাত্র ৩৫ শতাংশ অ-বস্তিবাসী। এছাড়া ব্যাপক মাত্রায় বস্তিবাসী পায়খানার স্থান ও শৌচাগার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবহার করেন এবং তাদের জল-নিস্কাশন ও ময়লা-আর্বজনা দূরীকরণের পরিস্থিতি অত্যন্ত অনভিপ্রেত, যেখানে দুর্গন্ধ হচ্ছে তাদের দুর্ভোগের নিত্য সহচর।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় সব বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিরাজ করছে এবং ৯০ শতাংশ গৃহে কমপক্ষে একটি মোবাইল ফোন আছে। বস্তিসমূহে মোবাইল ফোনের সংখ্যা ২০০৬ সালে ছিল ২০ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯২ শতাংশে উপনীত হয়েছে। এছাড়া ৮০ শতাংশ বস্তিবাসী নারী টেলিভিশন দেখেন এবং তাদের ৪৯ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণির উর্ধ্বে।

উল্লেখ্য, বস্তিতে বসবাসকারী দুই-তৃতীয়াংশ গ্রাম থেকে অভিবাসনের মাধ্যমে শহরে অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারীদের প্রতি পাঁচ জনের একজন এসেছেন বরিশাল বিভাগ থেকে। চট্রগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ঢাকার বস্তিতে আসা বসবাসকারীদের সংখ্যা নগণ্য।

নগরে মোট প্রজনন হার ২০১০-২০১৩ সালে নারীপ্রতি ২ (দুই)এ নেমে এসেছে এবং বস্তি এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার হার ৭০ শতাংশে উপনীত হয়েছে। এ হচ্ছে বিশাল সাফল্য এবং আশা করা যায় তা ২০১৬ সালের মধ্যে ৭২ শতাংশে উপনীত হবে যা হবে তৃতীয় বিশ্বে উদাহরণ। তবে খাবার বড়ি প্রায় ৩৩ শতাংশ, ইনজেকটেবলস ১৮ শতাংশ হিসেবে প্রাধান্য পেয়ে আসছে এবং সন্তান প্রসবকালে প্রায় ৪২ শতাংশ মা অস্ত্রোপচার করছেন এবং স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন না। দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি সক্ষম দম্পতিদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করছে না। তবে গর্ভপূর্ব ও গর্ভপরবর্তী সেবাগ্রহীতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে এবং কোনো কোনো বস্তিতে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই এমন সেবা গ্রহণ করছেন যা প্রমাণ করে স্বাস্থ্য-সচেতনতা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে শহরবাসীর মধ্যে।

কিন্তু কিশোরীদের মধ্যে সন্তান ধারণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বস্তি ও অন্যান্য শহর এলাকায় ২০ বছরের কমবয়সী প্রতি ৫ (পাঁচ) জনের মধ্যে একজন কিশোরী মা হয়েছেন এবং বস্তি ও অ-বস্তি এলাকায় বিগত বছরসমূহে কিশোরী মাতৃত্ব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ হচ্ছে উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো ভাবনা।

তবে সন্তান ধারণের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সিটি কর্পোরেশনের অ-বস্তি এলাকায় নারীপ্রতি গড় সন্তানের সংখ্যা বা টিএফআর সবচেয়ে কম, মাত্র ১.৭ এবং বস্তি এলাকায় বেশি, মাত্র ২ (দুই) এবং অন্যান্য শহর এলাকায় এ সংখ্যা ১.৯ মাত্র। এ হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ও আশানুরূপ জনমিতিক সাফল্য।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৬.৫ শতাংশ মানুষ বর্তমানে (২০১৪) গ্রামে বসবাস করেন। সমীক্ষা বলছে, ২০৩৯ সালের পূর্বেই গ্রামের তুলনায় শহরের জনসংখ্যার বসতির হার হবে অর্ধেকের বেশি। অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে শহরে বসবাসকারী সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, যা বর্তমানে হয়েছে ২৮ শতাংশ। গবেষণা বলছে, ২০৩৯ সালের আগেই ৫০ শতাংশের অধিক লোকজন শহরে বসবাস করবে। অর্থ হচ্ছে, বদলে যাবে বাংলাদেশের জনগণের জীবনধারা, মানুষের পরিচয় ও স্থায়ী ঠিকানা। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময়কালে গ্রাম বিরান হয়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ, তেমনি এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ আজ সমাগত।

জনসংখ্যার শহরমুখী অভিবাসন বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও সরকার নিজেই দিনের পর দিন শহরবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। সরকার হাটবাজারসমূহকে রাজনৈতিক স্বার্থে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছে। পৌরসভাকে মহানগর হিসেবে উন্নীত করছে এবং এ জন্যে কিছু গ্রাম বা কৃষিজমিকে শহর হিসেবে চিহ্নিত করেছে; যেমন হয়েছে গাজীপুর এবং রংপুর মহানগর ঘোষণার সময়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৭৪ সালে সারা বাংলাদেশে পৌরসভার সংখ্যা ছিল মাত্র ৮০ যা এখন হয়েছে ৩২১। অর্থাৎ প্রচুর সংখ্যক গ্রামীণ জনগণকে শহরবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সরকার নিজেই।

জনগণ শহরে আসেনি, শহর তাদের দুয়ারে গিয়ে ধর্ণা দিয়েছে। চমৎকার এ দৃশ্যপট। অথচ সরকার সেভাবে শহরের পয়ঃনিষ্কাশন, আবর্জনা দূরীকরণ এবং নগরপিতাদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে মোটেই ভাবেনি। সরকার ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন জারি করেছে (২০০৯ সালের ৬০ নং আইন)। জনস্বাস্থ্যসহ ২৮টি কাজ কর্পোরেশনের দায়িত্ব বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রায় সবই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হাতে। এমনকি সুপারসিড করার ক্ষমতাও রেখেছে সরকার নিজের হাতে। সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার ক্ষমতা একবারেই সীমিত, আয়ের উৎস আরও কম। নগরপিতাগণ স্থানীয় সরকারের মন্ত্রী ও সচিবের কাছে তদবির করছেন অহরহ, টিকে থাকার স্বার্থে।

সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভাসমূহ স্বশাসিত, কিন্তু বাজেট থেকে আরম্ভ করে করারোপসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড়া অন্যত্র হাত দিতে পারে না। কোনো কাজ করতে গেলে পূর্ত ও গৃহায়ন, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহণ, যোগাযোগসহ কত দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় তার হিসেব নেই। মেয়রগণ বারবার মিউনিসিপ্যাল সরকার গঠনের দাবি করছেন; কারণ প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তা আছেন প্রেষণে। কীভাবে নগর সরকার ব্যাপক খরচ বহন করবে?

তাই প্রশ্ন এসেছে, বিশাল স্বাস্থ্যসেবা– দাতা সংস্থার সাহায্যে যা সম্প্রসারিত হয়েছে– তা নগরপিতারা কীভাবে ধরে রাখবেন? এটি টেকসই হবে কীভাবে, অর্থের উৎসই-বা কোথায়?

খারাপ স্বাস্থ্য হচ্ছে দারিদ্র্যের লক্ষণ; তাই দারিদ্র্য নিরসনের মূলনীতির বাস্তবায়ন করতে হলে, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার অবশ্যই উন্নতি ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ নগর স্বাস্থ্য সার্ভে থেকে প্রাপ্ত উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করে এবং সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে এখানেই। এ কাজে সরকারের একা চলার নীতি গ্রহণ করা সঠিক হবে না। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসমূহকে ক্ষমতা দিতে হবে এবং ঢাকা মহানগরীর পাশে উপশহর গড়ে তোলা হবে সময়ের দাবি।

মোট কথা, শহরকে শহরের মতো চলতে দিতে হবে। পৃথিবীতে অনেক শহর বিলীন হয়েছে। বস্তির সমাবেশ শহরকে টেকসই হতে দেয় না।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সািচব ।