ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি : মানবাধিকার

বেবী মওদুদ
Published : 27 Jan 2011, 02:59 PM
Updated : 27 Jan 2011, 02:59 PM

সরকার মহিলা চাকুরিজীবীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস নির্ধারণ করেছেন। এ সুবিধা শুধুমাত্র সরকারি মহিলা চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রে শিশু ও মায়ের স্বার্থ রক্ষার্থে করা হয়েছে। এর আগে এ ছুটির সুবিধা চার মাসের জন্য ছিল। বলা হয়েছে শুধুমাত্র দুটি সন্তানের জন্য এ ছুটি দেয়া হবে। আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের জন্য ধন্যবাদ জানাই। বর্তমান সরকারের গৃহীত উদ্যোগের ক্ষেত্রে এটা উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।

আমাদের সমাজে একটা ধারণা আছে যে, নারীর ধর্ম হচ্ছে সন্তান ধারণ, জন্মদান ও লালন-পালন। এটাকে একটা স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃত ক্ষেত্রে একটি মেয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ যে কতখানি থাকে সেটা কেউ চিন্তা-ভাবনা করে না। তার শরীর সন্তানের ধারণের উপযুক্ত কি না সেটা সে নিজে তো জানে না, স্বামী বা পরিবারের কেউ এ নিয়ে ভাবে না।

দেখা গেছে বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলির ন্যায় আমাদের দেশেও মাতৃমৃত্যু হার শতকরা ৩৫ ভাগ। এর প্রধান কারণ গর্ভধারণের পূর্বে তার শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি, রক্তের উপাদান থাকে না। সন্তান গর্ভে ধারণকালে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা সেবাও সে পায় না। ফলে জন্মদান কালে মা বা শিশু মৃত্যুর মতো দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। সন্তান জন্মের পরও মায়ের স্বাস্থ্যহানিতার কারণে চাহিদা মতো দুধ পানেও শিশুটি ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পরিবারে কন্যা সন্তানের প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা, বৈষম্য ইত্যাদি। সে যে ভবিষ্যতে মা হবে, সেজন্য তার পরিমিত শারীরিক মানসিক শক্তি থাকা জরুরী– এটা কেউ চিন্তা করে না। অনাদর অবহেলা নিয়ে সে বড় হয়ে ওঠে, মেধাবী হলে লেখাপড়া শেষ করে চাকুরিও পায়, তারপর যখন গর্ভবতী হয়, তখন দেখা যায় শরীরে পুষ্টি কম, রক্তে আয়রন কম, প্রেসার লো অথবা হাই এবং অন্যান্য জটিলতাও আছে। যারা এই ঘাটতিগুলো নিয়েও সুস্থ সন্তান জন্ম দিচ্ছে তারা যথেষ্ট ভাগ্যবতী।

তবে তাদের শরীরের অনেকখানি ক্ষতি হয়ে যায়। শারীরিক দুর্বলতা ও অসুস্থতা নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হয়। তারপর আবার সন্তানকে দুগ্ধপান, লালন-পালন করা ছাড়াও চাকুরিজীবী হয়ে থাকলে আরও দুশ্চিন্তা নিয়ে কাজ করতে হয়। বিশেষ করে নিয়মিত ও সময়মত অফিসে উপস্থিত হতে হয় এবং অফিসের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সন্তান, সংসার ও অফিসের কাজ –এসব সামলানো একজন তরুণী নারীর পক্ষে খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কোনও কোনও পরিবার ও স্বামীর সহযোগিতা থাকলেও সবার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। সবাই মনে করে এটাই তার কাজ, তার দায়িত্ব। সন্তানের মা হওয়া যেমন তার গর্ব, তেমনি ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠাও তার জন্য গৌরবজনক, এটা অনেকেই বুঝতে চান না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অফিসের সহকর্মীরাও তার প্রতি ঈর্ষাপরায়ন থাকে। তার সামান্য ক্রটিও বড় করে দেখা হয়। তাকে শুনিয়ে দেয়া হয়, "মা হয়েছ, এখন ঘরে বসে সন্তান পালন করো।" অনেক সময় মেয়েটি চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হয়। সংসারের ঘানিতে তার মেধা-মনন নষ্ট হয়ে যায়।

চিকিৎসক পরামর্শ দেন সন্তান গর্ভে আসার মুহূর্ত থেকে চিকিৎসকের অধীনে থাকা সবচেয়ে ভালো। তিনি প্রতি মাসে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন যাতে কোন জটিলতা দেখা না দেয় এবং সন্তান সুস্থভাবে জন্ম নেয়। কিন্তু দেখা যায় মা হয়তো ঠিকমতো খাচ্ছে না, বিশ্রাম নিচ্ছে না বা ঘুমাচ্ছে না, ওষুধ খাচ্ছে না, আবার এদিকে সংসারের ছোট বড় কাজও করতে হচ্ছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব স্বামীর, পরিবারের লোকজনের, বন্ধু-বান্ধবের। কিন্তু কতজন মেয়ের কপালে এসব জোটে ? সন্তান গর্ভে আসার সময় থেকে একজন গর্ভবতী মা'কে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। জীবনের ঝুঁকি তো থাকেই, তারপর মা হবার সম্ভাবনাও চিরতরে শেষ হয়ে যেতে পারে। দেখা গেছে গর্ভ নষ্ট হয়ে যাবার দোষারোপ অনেক সময় মেয়েটিকে দেয়া হয়। এর ফলে হতাশা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এসব থেকে মুক্ত হয়ে একটি মেয়ের পক্ষে জীবনযাপন করা অনেকখানি মানসিক শক্তির ব্যাপার। সেটা তো আমরা সবাই দিতে পারি না।

মাতৃত্বকালীন ছয় মাস করায় সরকারকে যতই সাধুবাদ দেই না কেন, পুরুষদের অনেকেই কিন্তু খুশি হতে পারেনি। তারা প্রশ্ন তুলেছেন এতে মেয়েটি অধিক সুবিধা ভোগ করবে এবং অফিসের কাজের ক্ষতি হবে। তারা কিন্তু দেখছেন না, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হওয়ায় একটি সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান শিশু আমরা পাবো। সেই সঙ্গে মায়ের জীবনের ঝুঁকিও কমবে। সন্তান জন্মের পূর্বে ও পরে মিলিয়ে এ ছুটি দেয়া হবে। জন্মের পর শিশুটি সান্নিধ্যে থাকায় মায়ের যত্ন ও মমত্ব নিয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে এবং মা তার স্বাস্থ্য উদ্ধারে সক্ষম হবে।

একজন চাকুরিজীবী মা সন্তান জন্ম দেবার পর সাত আট ঘন্টা অফিসে কাজের ব্যস্ততায় থাকার কারণে নিজের তো নয়ই, সন্তানের যত্ন বা বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন না, যা কিনা শিশুর শরীর গঠন বা জীবন রক্ষায় অত্যন্ত জরুরী। পুরুষরাও তো পিতা। বিধাতার সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে তারা যখন শিশুর জন্য কিছুই করতে পারেন না, তখন তার কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীর প্রতিও তো সহানুভূতিশীল হতে পারেন।

আমাদের দেশে ডেলিভারী রুমে স্বামীকে থাকতে দেয়া হয় না, বিদেশে দেয়া তো হয়ই, সেই সঙ্গে স্ত্রীকেও নবজাত সন্তানের সেবা করার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্বামীরা ডেলিবারি রুমে থাকলে স্ত্রীর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারতেন। সন্তান জন্মদান কোন সাধারণ ব্যাপার নয়, জীবনের ঝুঁকি থাকে, কষ্ট থাকে, তারপরও মাতৃত্বের ছবিটি আমাদের মানবিক প্রতিকৃতি তুলে ধরে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করায় অনেকের ধারণা এটা একটা অপব্যবহার। আমি মনে করি, কোন দায়িত্বশীল কর্মজীবী নারী তেমনটি করবেন না। আমি স্বীকার করি, এই ছুটি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য-সেবার জন্য জরুরী। তারপরও আমি মনে করি, যদি কোন মা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও শক্তিশালী থাকেন, তিনি নিশ্চয় এর অপব্যবহার করতে করবেন না। আমি আমার দু'সন্তানের জন্মদানের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি প্রথম সন্তানের জন্মের পূর্বে আমাকে অফিস ছুটি দেয়নি। তবে একমাস আমি ঘরে বসে লেখা তৈরি করে পাঠিয়েছি। জন্মের পর ৪৫ দিন আমি ছুটি পেয়েছি। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পাঁচ দিন আগে থেকে ছুটিতে ছিলাম। নির্দিষ্ট তারিখের ১৪ দিন পূর্বে তার জন্ম হয়। দশদিনের মাথায় অফিসে গিয়ে ছুটি প্রত্যাহার করে কাজে যোগদান করি। প্রথম সন্তানের সময় ৪৫ দিন ছুটি নেয়ায় আমার পত্রিকার সম্পাদক আমাকে ঠাট্টা করায় আমি এই জেদ ও সাহস দেখাতে সমর্থ হই। আমার শারীরিক সুস্থতা থাকায় কোন সমস্যা হয় নি। আমার নিজের কথাটা একারণে বললাম যে, সবার পক্ষে হয়তো সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, তবে কেউ কেউ সুস্থ থাকলে নিশ্চয় কাজে যোগদান করতে পারেন। ঘর, সংসার, সন্তান সামলে অফিসের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তাকে যদি সকলেই সহযোগিতা করেন তবেই সেটা সম্ভব।

ছয়মাসের ছুটি জরুরী তার স্বাস্থ্য উদ্ধার এবং সন্তানের প্রাথমিক লালন-পালনের জন্য। এটা তার মানবিক অধিকার বলে আমি মনে করি। এই সঙ্গে আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, ব্যাংক-বীমা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয়মাস করার জোর দাবি জানাচ্ছি। মেয়েদের সন্তান জন্মদানকে খাটো চোখে দেখবেন না। একে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

বেবী মওদুদ :সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।